প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৫

0
311

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫
জাওয়াদ জামী জামী

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই কুহু ওর চাচাকে বাইক থামাতে বলল। ও এইখানেই নেমে যেতে চায়। সাইদ আহমেদ অনেকবার বলেও কুহুকে মানাতে পারলনা। বাধ্য হয়ে সে কুহুর কথায় রাজি হয়। আসলে কুহু চায়না ওর চাচি যেনে যাক বিষয়টা। তাহলে সে অশান্তি করবে। কুহু বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেই সাইদ আহমেদ ওকে ডাক দেয়। কুহু পেছনে ঘুরে তাকালে দেখতে পায় সাইদ আহমেদ টাকা বের করেছে।

” কুহু মা, এই টাকাগুলো নে। মাছ-মাংস কিনবি। সৃজনের স্কুলের জুতা জোড়াও দেখলাম নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে জুতা কিনে দিস। ”

কুহু চাচার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। ও বুঝতে পারছে ছোট চাচা খুব আশা নিয়ে টাকাগুলো ওকে দিতে চাইছে। কিন্তু কুহু নিরুপায়। ছোট চাচি যদি এই কথা শোনে, তবে নির্ঘাত ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর গায়ে হাত তুলবে। আরেকবার সংসারে অশান্তি বাঁধবে। তাছাড়া ওর মা’ও হয়তো কিছুতেই টাকাগুলো নিতে চাইবেনা। কুহু কিছুতেই অশান্তি চায়না।

” টাকা লাগবেনা, চাচা। তুমি আমাদের জন্য দোয়া কর। ”

” আমাকে পর করে দিচ্ছিস, মা? এভাবে আমাকে দূরে ঠেলে দিসনা। এই টাকাগুলোর ব্যাপারে শিরিন কিছুই জানতে পারবেনা। ”

” চাচিকে লুকিয়ে আমাদের কিছু দেয়া তোমার ঠিক হবেনা, চাচা। আমি সামনের মাসে বেতন পেলেই সৃজনকে জুতা কিনে দেব। এই মাসে আরও কয়েকজন ছাত্র পেয়েছি। আশা করছি আমাদের সংসারে আর কোন সমস্যা থাকবেনা। ”

” আমি আসলেই তোদের চাচা হবার যোগ্য নই। হয়তোবা কখনো তোদের সেভাবে ভালোবাসতেই পারিনি। তাই তোরা আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস। আর ভাবিও আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। ” সাইদ আহমেদের চোখে ছলছল করছে পানি। যা দেখে কুহুর কান্না পায়। কিন্তু ও নিজেকে শক্ত করে।

” তুমি এভাবে বলোনা, চাচা। আমরা কেউই তোমার থেকে দূরে যাইনি। আমরা যেমন ছিলাম তেমনই আছি। শুধু আমাদের মাঝখানে একটা অদৃশ্য পর্দা এসে আমাদের একটু আড়াল করে দিয়েছে। কিন্তু দেখ এই অদৃশ্য পর্দা আমাদের ভালোবাসা, স্নেহ একটুও কমাতে পারেনি। আমি যাই, চাচা। মা’য়ের শরীর খুব একটা ভালো নয়। আমাকে গিয়ে রান্না করতে হবে। ”

কুহুর কথা শুনে ধক্ করে উঠল সাইদ আহমেদের বুক। সে চিন্তিত মুখে বলল,

” কি হয়েছে, ভাবির? আমাকে আগে কিছু বলিসনি কেন? ”

চাচার অস্থিরতা বুঝতে পেরে কুহু ম্লান হাসল।

” কয়েকদিন থেকেই মা কিছু খেতে পারছেনা। দিনরাত কান্নাকাটি করে। রাতে ঠিকমত ঘুমাতেও পারেনা। ঘুমের ঔষধেও কাজ করছেনা। ”

” কি বলছিস এসব! বাইকে ওঠ, আমি ভাবিকে দেখতে যাব। ” সাইদ আহমেদ অস্থরচিত্তে বলল।

” চাচা, তুমি বাড়ি যাও। তোমার হুটহাট নেয়া কোন সিদ্ধান্তে আবার সমস্যা সৃষ্টি হবে। এরপর কোন সমস্যা হলে, আমি মা’কে সামাল দিতে পারবনা। ”

কুহুর কথার মানে বুঝতে পেরে সাইদ আহমেদও চুপসে যায়। সে বুঝতে পারছে কুহুর ভয়ের কারন। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় আজকে নয় বরং কালকে ভাবিকে দেখতে যাবে। এবং শিরিনকে জানিয়েই সে ঐ বাড়িতে যাবে।

শাকিলা সুলতানা সকাল সকাল ভাইয়ের বাড়িতে এসেছেন। গতরাতে তিনি আইরিনের শারিরীক অবস্থা জানতে পেরে ফজরের নামাজের পরই রওনা দেন।

আইরিন পারভিন বারান্দার এককোণে বসে কাঁদছেন। তিনি কিছুতেই স্বামীর স্মৃতি ভুলতে পারছেননা। তাছাড়া সংসারের অভাব অনটনের কথা চিন্তা করলেও তিনি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এই দূর্মুল্যের বাজারে কিভাবে টিকে থাকবেন সেই চিন্তা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

ভাবিকে উদাসভাবে বসে থাকতে দেখে শাকিলা সুলতানার চোখে পানি জমা হয়। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন ভাবির এমনভাবে বসে থাকার কারণ। তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে আইরিন পারভিনের কাছে বসলেন।

” ভাবি, তুমি এত মন খারাপ করোনা। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চোখের পানি, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, কুহুর ত্যাগ বৃথা যাবেনা। ”

” জানিনা কবে সেই দিন আসবে। আমার ছেলে-মেয়ে অল্প বয়সেই কত বড় হয়ে গেছে, বুঝদার হয়েছে। নিজেদের চাওয়া-পাওয়াকে মাটি চাপা দিয়ে, ভালো থাকার, হাসার অভিনয় করছে অহরহ। আমাকে বোঝাতে চাইছে ওরা ভালো আছে, ওদের কোন কষ্ট কিংবা সমস্যা নেই। মা হয়ে আজ ছেলে-মেয়েদের মিথ্যা অভিনয় দেখতে হচ্ছে আমাকে। আজ নিজেকে বড্ড অযোগ্য মনে হচ্ছে, শাকিলা। এখন বারবার মনে হয়, কেন লেখাপড়া করিনি। তোমার বড় ভাই বিয়ের পর অনেকবার আমাকে বলেছে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে। কিন্তু তার কথা না শুনে সংসারে মনযোগী হয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারি তার কথার মুল্য। ” ডুকরে কেঁদে উঠলেন আইরিন পারভিন।

শাকিলা তার ভাবিকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আইরিন পারভিন কেঁদেই চলেছেন।

” ভাবি, এভাবে কেদোঁনা। তুমি পড়াশোনা না করে সংসার করেছ, সেটাও খারাপ করোনি। তোমার দিক থেকে তুমি সঠিক ছিলে। তুমি দেবর-ননদের মানুষ করেছ, তারা আজ সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, তার কারন একমাত্র তুমি। কিন্তু আজ যখন তোমার বিপদ, তাদের উচিত ছিল তোমার পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু তারা সেটা করেনি। তোমার বিপদে তুমি পরিবারের সদস্যদের সাথে বেইমানী করোনি। কিন্তু তোমার নিজ হাতে গড়ে তোলা আপনজনেরাই তোমার সাথে বেইমানী করেছে। এর জন্য দায়ী তারা। তারা নিজেদের দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ”

” আমি তাদের কোন দোষ দিইনা, শাকিলা। তাদের ভালো আমি সব সময়ই চেয়ে এসেছি, এবং আজও চাই। ওরা সুখী হয়েছে এটা দেখলেও আমার শান্তি লাগে। দোষ আমার ভাগ্যের। নইলে কি বাপের বাড়ি থেকে চিরতরে বিতাড়িত হই। আমার বাপের বাড়ি থেকেও নেই। আব্বা-আম্মার মৃ’ত্যু’র সাথে সাথে ঐ বাড়ির সম্পর্কও চুকেছে। তিন ভাই কোনদিন তাদের একটামাত্র বোনের খবর নেয়না। এর থেকে বড় দূর্ভাগ্য কোনও মেয়ের কি হতে পারে! আমার স্বামী তিনটা বছর ধরে মৃ’ত্যু’র সাথে যুদ্ধ করে গেছে, কিন্তু আমার ভাইয়েরা একবারও তার খবর নেয়নি। এমনকি তার মৃ’ত্যু’র পরও কেউ একটিবারের জন্যও খবর নেয়নি। ” আবারও হু হু করে কেঁদে উঠলেন আইরিন পারভিন।

শাকিলা সুলতানা কিভাবে ভাবিকে শান্তনা দেবেন সেটা ভেবে পাচ্ছেননা। তিনি অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রইলেন ভাবির দিকে।

তাহমিদ কলিং বেল বাজিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করছে। অধৈর্য হয়ে বারবার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে ও। প্রায় দশ মিনিট যাবৎ ও দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদ বেশ বুঝতে পারছে এই রাত দেড়টায় ওকে দরজা খুলে দেয়ার জন্য কেউ জেগে নেই। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারছে, কে বাসার মেইডদের জেগে থাকতে বারণ করেছে। চিন্তাটা মাথায় খেলে যেতেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। কিন্তু ওকে বাসায় যেতেই হবে। কি করবে ও। কিছুটা সময় চিন্তা করার পর ও সামনের দিকে তাকায়।

ওর ব্যালকনির সামনে সগৌরবে মাথা তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে কাঁঠালচাঁপার গাছ। হাতে থাকা ব্যাগ দরজার সামনে রেখে, জুতা খুলে এগিয়ে যায় কাঁঠালচাঁপা গাছের দিকে। গাচের গোড়ায় এসে তাহমিদ হাত বুলিয়ে দেয় গাছটায়। ওর মনে পরে যায় সেদিনের কথা। যেদিন মা’য়ের হাত ধরে স্কুল থেকে আসবার সময় বায়না ধরেছিল নার্সারিতে যাওয়ার । অনেকদিন থেকেই ওর নজর ছিল নার্সারির দিকে। নার্সারির গাছগুলোয় ফুটে থাকা নানান ধরনের ফুল ওকে আকর্ষিত করত। ওর মা মিথিলা আরজুমান্দও ছেলের বায়না মেটাতে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিল নার্সারিতে। সেই নার্সারিতে ছিল একটা বড় কাঁঠালচাঁপা গাছ। সেখানে থোকায় থোকায় ফুঁটে ছিল কাঁঠালচাঁপা। ছোট ছোট পায়ে তাহমিদ এগিয়ে যায় সেদিকে। ততক্ষণে ওর পুরো নাসারন্ধ্র কাঁঠালচাঁপার সুবাসে আটকে গেছে। এই ফুলের সৌন্দর্যে, সুবাসে এতটাই মোহিত হয়ে যায় তাহমিদ, মা’কে বলে একটা চারাগাছ কিনে নেয়।

বাসায় এসে মালী চাচাকে নিয়ে এখানে লাগিয়ে দেয় সেই চারাগাছ। কারন সেই ছোটবেলায় একদিন ওর মা বলেছিল, দোতলার দক্ষিণের ঝুল বারান্দাওয়ালা রুমটা ওর হবে। ছোট্ট তাহমিদ তখনই বুঝেছিল এই চারাগাছ একদিন নার্সারির গাছটার মত অনেক বড় হবে। আর ও একদিন বড় হয়ে ঝুল বারান্দায় এসে বসে কাঁঠালচাঁপার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হবে।

এত বছর পর আবার সেইদিনের কথা মনে পরে যায় তাহমিদের। চোখের কোনে চিকচিক করতে থাকে অবাধ্য অশ্রুকনা। সেই চারাগাছ আজ অনেক বড় হয়েছে। এর ডালগুলো তাহমিদের ঝুল বারান্দায় এসে থোকা থোকা ফুলে ভরিয়ে দেয়। তাহমিদ রুমে থেকেও সেই সুবাস পায়। কিন্তু সে এখন আর কাঁঠালচাঁপার সুবাসে মোহিত হতে পারেনা। ওর ভেতরে অনেক আগেই জায়গা করে নিয়েছে সম্পর্কহীনতার দুষিত গন্ধ। গাছটা সদর্পে দাঁড়িয়ে থাকলে কি হবে, তাহমিদ এখন আগের সেই তাহমিদ আর নেই। সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুই বদলে গেছে। সেই ছোট্ট তাহমিদ ভুগেছে নিরাপত্তাহীনতায়, দগ্ধ হয়েছে অপমান আর অবহেলার বিষাক্ত বাণে। সর্বোপরি ও পেয়েছে এক ঘৃণিত জীবন।
চোখের পানি মুছে তাহমিদ গাছে উঠতে শুরু করল। একটা মোটা ডাল ওর বারান্দায় চলে গেছে। তাহমিদ অতি সন্তপর্ণে সেই ডালে পা রাখল। বেশ কয়েক বছর পর ওকে এই কাজ করতে হচ্ছে।

ঘুম থেকে উঠতে নয়টা বেজে যায়। এদিকে তাহমিদের ক্লাস নিতে হবে সাড়ে দশটায়। ও ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছাড়ল। এখনই যদি না বের হতে পারে তবে ক্লাসে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।

পরিপাটি হয়ে দোতলা থেকে নামতেই তাহমিদ মুখোমুখি হয় ওর বাবা রাশেদ কুরাইশির। ভদ্রলোক অফিসের উদ্দেশ্য বাসা থেকে বের হচ্ছিল।

” তাহমিদ, তুমি গতরাতে বাসায় এসেছিলে! কখন এসেছিলে? ”

” দেড়টার দিকে। ” তাহমিদ হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে আবার পিছু ডাকে রাশেদ কুরাইশি।

” খেয়ে যাও। এভাবে বেরিয়ে যাচ্ছ কেন? ”

” জাষ্ট আ মিনিট। তুমি তোমার ছেলেকে আগে জিজ্ঞেস কর, ও বাসায় ঢুকেছে কিভাবে। আমি সকালে মেইডদের জিজ্ঞেস করেছি, তারা বলেছে তোমার ছেলে রাতে বাসায় ফেরেনি। ইনফ্যাক্ট ওরা কেউ দরজা খুলে দেয়নি। ”

স্ত্রী’র কথা শুনে ভ্রু সংকুচিত হয় রাশেদ কুরাইশির। সে উত্তরের আশায় তাকায় তাহমিদের দিকে।

তাহমিদ রাশেদ কুরাইশির মনোভাব বুঝতে পেরে ব্যাঙ্গের হাসি হাসল।

” আমি গাছ বেয়ে ভেতরে ঢুকেছি। রাত দেড়টায় আমাকে অভ্যর্থনার জন্য কেউই জেগে ছিলনা। তবে জেগে ছিলনা নাকি ঘুমাতে বাধ্য করা হয়েছে সেটা এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। আশা করছি আপনাদের উত্তর পেয়ে গেছেন? এবার আমাকে যেতে হবে। ” তাহমিদ কারও কোন উত্তরের আশা না করেই বেরিয়ে যায়।

” তোমার ছেলে কতবড় বেয়াদব সেটা তো নিজের চোখেই দেখলে, রাশেদ? ও চোর-ডাকাতদের বাসার ভেতরে ঢোকার রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে! তোমার আস্কারা পেয়েই ও এতটা বেড়েছে। সব কিছুর জন্য তুমিই দায়ী। আমি জাস্ট অসহ্য হয়ে গেছি তোমার ছেলের এরূপ আচরনে। ”

রাশেদ কুরাইশি স্ত্রী’র কথার প্রত্যুত্তর না করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সে ভালো করেই জানে তার অনিহার কারণেই আজ তাহমিদ ছন্নছাড়ার ন্যায় এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। সে যদি প্রথম থেকেই ছেলেটার প্রতি সদয় হত তবে আজ তার ছেলে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারত।

স্বামীর বেরিয়ে যাওয়া দেখে ডেইজি কুরাইশি বাকহারা হয়ে তাকিয়ে থাকে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে