প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০২

0
332

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২
জাওয়াদ জামী জামী

মুখের সামনে ভাতের প্লেট নিয়ে বসে আছে সৃজন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্লেটের দিকে। ভাতের সাথে পুঁইশাকের চচ্চড়ি আর বেগুন ভাজা দেখে ওর খেতে ইচ্ছে করছেনা। কতদিন ধরে মাছ-মাংস খায়না। বাবা সেই তিন বছর আগে অসুস্থ হল, তারপর থেকেই শুরু হয়েছে ওদের দুর্দশা। বাবার চিকিৎসা করাতে একে একে সব শেষ হয়েছে। আর কতদিন এভাবে চলবে! কতদিন ওদের শুধু শাক-লতাপাতা খেয়ে বাঁচতে হবে? কতদিন লড়াই করবে নিয়তির সাথে?

কুহু সৃজনের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল, ছেলেটা খেতে পারছেনা। ছোট ভাইয়ের চুপসানো মুখ দেখে কুহুর বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। এগারো বছর বয়সেই ছেলেটা জীবনের কঠিনতম দিকের সাথে পরিচিত হয়েছে। পরিচিত হয়েছে নিত্যনতুন অভাবের সাথে।

” সৃজু, এবেলা এসব দিয়ে খেয়ে নে। রাতে মাংস রান্না করে দিব। ”

” মাংস কোথায় পাবে, আপু? আমাদের তো আর কোন হাঁস-মুরগীও নেই। ”

” তোর এত কিছু ভাবতে হবেনা। তুই খেয়ে নিয়ে মা’য়ের কাছে যা। ”

শাকিলা সুলতানা কুহুর দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। কুহু তাদের কত আদরের ভাতিজী। বাবার রাজকন্যা ছিল মেয়েটা। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল! মেয়েটা তার বাবাকেও হারালো, সেই সাথে হারালো তার বর্তমান, ভবিষ্যৎ। ভাই সুস্থ থাকতে ছেলে-মেয়েকে রাজার হালে রাখত। কোন অভাব-অনটন ছুঁতে পারেনি ওদের। তিনবেলা মাছ, মাংস ছাড়া ভাত খেতনা। কিন্তু ভাই অসুস্থ হবার পর থেকেই মাসে একবার পাতে মাছ জোটে কিনা সন্দেহ। সৃজনের মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। যে ছেলে মাংস ছাড়া ভাত খেতে পারতনা, সেই ছেলেই এখন দিনের পর দিন সবজি দিয়েই খায়। একটাবারও অভিযোগ করেনা। শাকিলা সুলতানা সব বুঝেও নিশ্চুপ থাকেন। তাছাড়া তার করারই বা কি আছে! আব্বা মা’রা যাবার পর, যেখানে বড় ভাই তার পরিবারের দ্বায়িত্ব নিয়েছিল। তার সুখে-দুঃখে বড় ভাই ছায়া হয়ে পাশে থেকেছে। সেই ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানদের দূর্দিনে, সব কিছু চোখে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। নিজের সন্তানদের জন্য দুশ্চিন্তার পাশাপাশি এখন আবার যুক্ত হয়েছে ভাতিজা-ভাতিজীর জন্য চিন্তা। তিনি বুঝতে পারছেন, ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে দুইটা পরিবারে দুঃখের কালো ছায়া নেমে এসেছে।

আইরিন পারভিন খেতে না চাইলেও কুহু জোর করে তাকে কয়েক লোকমা ভাত খাইয়ে দেয়। এরপর নিজে খেয়ে, ব্যাগ হাতড়ে কিছু টাকা বের করে, বাড়ির বাহিরে যায়।

তাহমিদ গোসল সেড়ে রুমে এসে দেখল, ওর খালু রায়হান আহমেদ বিছানায় বসে আছে। আজ সকাল থেকেই তাকে কেমন মনমরা লাগছে। তাহমিদ ঝটপট টি-শার্ট গায়ে দিয়ে চেয়ার টেনে খালুর মুখোমুখি বসল।

” তোমার রুমে সিগারেট খেলে কি তুমি কিছু মনে করবে, তাহমিদ? ” কথাটা বলেই রায়হান আহমেদ তাহমিদের উত্তরের অপেক্ষা না করে সিগারেট ধরায়।

” আমার জানামতে, আপনি অনেক আগেই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎ করেই তাকে আবার আপ্যায়ন করার কোন বিশেষ কারন আছে নাকি! ” তাহমিদ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে রায়হান আহমেদের দিকে।

এদিকে রায়হান নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত। তাহমিদের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। লম্বা টান দেয় সিগারেটে।

” আমি চিরদিনের জন্য কালপ্রিট হয়ে গেছি, তাহমিদ। যারা আমাকে ছোট থেকে বড় করেছে, আমার পড়াশোনার রসদ জুগিয়েছে, আমার ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করেছে, তাদের দুঃসময়ে আমি নিস্পৃহ থেকেছি। তাদের যখন আমাকে প্রয়োজন ছিল, তখন আমি নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। আম দোষী হয়ে গেলাম। অথচ আমি তাদের কাছে সময়ে-অসময়ে ছুটে যেতে চেয়েছি। ” হু হু করে কেঁদে উঠল রায়হান আহমেদ।

হুট করে খালুর কেঁদে উঠায় তাহমিদ বেশ ভড়কে গেছে। ওর সামনে বসা ভদ্রলোকটিকে খারাপ বলা চলেনা মোটেও। একটু নরম স্বভাব তার। সেই সাথে ভীতুও বলা যায়। সে তার স্ত্রী’কে বেশ ভয় পায় এবং সমীহ করে। স্ত্রী’র মন জুগিয়ে চলতে ভদ্রলোক সদা তৎপর থাকে। তাহমিদ এখানে আসলেই ভদ্রলোক তার সুখ-দুঃখের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয় কাছে। আজও নিশ্চয়ই কোন দুঃখের আলাপ করতেই এসেছে ভদ্রলোক।
তাহমিদ আলতোভাবে হাত রাখল রায়হান আহমেদের হাতে।

” এভাবে কাঁদছেন কেন! জানেননা পুরুষদের কান্না মানায়না। পুরুষ হলো সিংহের জাতি। শত কষ্টেও তাদের কঠোর হতে হয়। শত অপমানেও অন্যদের ভালো রাখতে, নিজের ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়। চোখ মুছে আমাকে বলুন আপনার কি হয়েছে। সকাল থেকেই আপনাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আমার কেমন যেন লাগছে। ”

চোখ মুছে সোজা হয়ে বসল রায়হান আহমেদ। কথা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করল।

” আমার বড় ভাই মা’রা গেছে, তাহমিদ। তিন বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে, দুই দিন আগে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এই তিন বছর তাকে শুধু তিনবার দেখতে গেছি। তা-ও অতিথির ন্যায় মেডিকেলে গেছি, আধাঘন্টা পর ফিরে এসেছি। অথচ আমার ভাবি দিনের পর দিন মেডিকেলে পরে থেকেছে ভাইকে নিয়ে। এক বেলা খেলে দুইবেলা খালি পেটে থেকেছে। আমার ছোট ভাতিজা-ভাতিজীও মেডিকেলে থেকেছে। ওরাও না খেয়ে থেকেছে দিনের পর দিন। কিন্তু আমি তাদের সাহায্য করিনি। এক বেলার খাবারও দিইনি। অথচ আমি চাইলে তার চিকিৎসার পুরো টাকা দিতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করিনি। ফলশ্রুতিতে, আমার ভাইয়ের সব টাকা, জমিজমা সব শেষ। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে তাহমিদ বেশ অবাকই হয়।

” আপনার বড় ভাই মানে যিনি স্কুলের টিচার ছিলেন তিনি মা’রা গেছেন! আমি শুনেছিলাম তিনি অসুস্থ। ”

” হুম, আমার স্কুল টিচার বড় ভাই। যে আমাকে পড়াশোনা শিখিয়েছে, মানুষ করেছে। আমার সেই ভাই মা’রা গেছে। আর আমি একটিবারও ভাইকে সাহায্য করার কোন চেষ্টাই করিনি। অথচ তাদের আমাকে ভিষণ প্রয়োজন ছিল। ” দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রায়হান আহমেদ।

” প্রয়োজনে যখন তার পাশে থাকেননি, তবে এখন অশ্রু ঝরিয়ে কোন লাভ হবে বলে আমি মনে করিনা। না কেঁদে বরং তার পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টা করুন। ”

” আমি চাইলেই কি সব হবে? আমার বিপরীতে কেউ একজন আছে, সেটা তুমি ভালো করেই জানো। আমি সংসার টিকিয়ে রাখতে গিয়ে, আমার মাথার ছাতাকে অযত্নে রেখেছি। অবহেলা করেছি আমার পিতার ন্যায় বড় ভাইকে। সে রাজশাহী মেডিকেলেই মা’রা গেছে, অথচ আমি সেটা জানতে পারিনি। হয়তো ভাবি অভিমান করেই আমাকে জানায়নি। এত অপরাধবোধ নিয়ে আমি কেমন করে বেঁচে থাকব, তাহমিদ? ”

” আপনার বিপরীতে কেউ আছে সেটা জেনেও কেন আপনি প্রতিবাদী হলেননা! সংসার টিকিয়ে রাখার দায় শুধুই আপনার? বিপরীতজনের কি একটুও দায় নেই? আপনি তো অযোগ্য নন। তবে কেন দায় আপনাকেই নিতে হলো? আমার চোখে দোষী আপনি। আপনি পারেননি আপনার স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে। অথচ দ্বায়িত্ববোধ কিন্তু আপনারই বেশি ছিল, আছে। আপনার যেমন স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব আছে, তেমনি পরিবারের লোকজনের ওপরও কিছু দ্বায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে হবে। সেজন্য স্ত্রীকেও আপনাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হত। কিন্তু আপনি সেটা করেননি। আপনি একজন সরকারি কমকর্তা হয়ে কেন স্ত্রী’র সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকছেন? তাদেরকে কি আলাদা বাসায় ক্ষমতা আপনার নেই? অবশ্যই আছে। আপনি প্রথমেই যদি আপনার শ্বাশুড়ি কিংবা স্ত্রী’র কথা না শুনে আলাদা থাকতেন, স্বামী হিসেবে একটু কঠোর হতেন, সংসারের ভালোমন্দ, করনীয়গুলো স্ত্রী’কে শিখিয়ে দিতেন, তাকে সেসব মানতে বাধ্য করতেন, তবে ঘটনা এতদূর পর্যন্ত গড়াতোনা। আপনার ভাইও সুচিকিৎসা পেত, আপনার ভাবিও অভিমান, অভিযোগ করার কোন সুযোগ পেতনা। আমার কথা শুনে আপনার খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। ”

রায়হান আহমেদ তাহমিদের কথা শুনে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। সে ভাবছে, ছেলেটা কত সহজেই তার ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

” তোমার সব কথাই সত্যি। আমি জানি সব দোষ আমার। আর এজন্যই বোধহয় নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারছিনা। জানো তাহমিদ, ভাইয়ের দা’ফ’ন করার পর আর গ্রামে থাকতে পারলামনা। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল অন্তত একটা রাত ঐ এতিম ছেলেমেয়ে দুটোর কাছে থেকে আসি। কিন্তু তোমার খালা সেটা হতে দিলনা। মানুষজনের সামনেই রাগারাগী শুরু করল। অজ্ঞান ভাবি, ভাতিজীকে রেখেই চলে আসতে হলো। ”

” আপনি কেন খালামনির রা’গ’কে পাত্তা দিলেন? তাকে কেন গ্রামে থাকতে বাধ্য করলেননা? তাকে আড়ালে ডেকে কেন শাসন করলেননা? একটু ভয় তাকেও দেখাতেন। তাকে বুঝতে দিতেন আপনার ভাই আপনার জন্য কি। প্রয়োজনে কঠোর হতে পারতেন। আর কতকাল মেরুদণ্ডহীন হয়ে থাকবেন? এবার একটু সোজা হয়ে চলাফেরা করুন। আজ আপনার স্ত্রী আপনাকে মানছেনা, সেসব দেখে ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েরাও আপনাকে মানবেনা। তখন কি করবেন? তাই ভবিষ্যতে ভালো কিছুর জন্য বর্তমানকে কাজে লাগান। মিছেই তেঁতুল গাছে আম আশা করবেননা। এখনও সময় আছে। ”

রায়হান আহমেদ আরও একবার অবাক হয়ে তাকায় তাহমিদের দিকে। ছেলেটার বয়স আটাশ কি উনত্রিশ। কিন্তু তুখোড় বুদ্ধি তার। কঠিন সমস্যাও খুব সহজেই সমাধানে ওর জুড়ি নেই। তাই সে প্রয়োজনে, অপ্রোয়জনে তাহমিদের কাছে ছুটে আসে। এবং আশানুরূপ সমাধানও পায়। আজকে যেমন কত সহজ গলায় সমাধান দিল! রায়হান আহমেদ মনে মনেই তাহমিদের বলা কথাগুলো ভাবল। সে সিদ্ধান্ত নিল, আর তাকে এরকম থাকলে চলবেনা। এবার বোধহয় সময় এসেছে নিজেকে বদলানোর।

রাতে খাবার প্লেটে মাংস দেখে খুশি হয় সৃজন। আনন্দে ওর চোখে পানি এসেছে। সত্যিই আপু ওর জন্য মাংস রান্না করেছে! খুশিতে প্লেটের খাবার চেটেপুটে খাচ্ছে ছেলেটা। কিন্তু ওর ছোট মাথায় একবারও প্রশ্ন জাগলোনা, বাবার মৃ’ত্যু’র তিনদিনও হয়নি, কিন্তু বাড়িতে মাংস রান্না হয়েছে। এ নিয়ে কেউ কথা শোনাতে পারে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে