প্রাপ্তির শহরে পর্ব -০২

0
1005

#প্রাপ্তির শহরে
#পর্ব-০২(শেষপর্ব)
#তাহরীমা
.
বিকেলের দিকে তাহু হাতে প্লাসিক বেধে মেহেদি পাতাগুলা যত্ন করে বেটে রাখে।রাত্রে এসব দিবে।দিনের বেলায় কাজ থাকে যে এসব দিতে পারবেনা।
কিছু মেহেদি মেজাম্মুকে দিয়ে আসে।মেজাম্মু এসব দেখে বলে–“কোত্থেকে এনেছিস?”
–“আমার বান্ধবীদের গাছ থেকে।”

মেজাম্মু তখন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে–“মাথায় লাগিয়ে দে।”

তাহু হাতে প্লাস্টিক নিয়েই চাচির মাথায় দেয়।তারপর রিপাকে ডেকে ওর হাতে লাগিয়ে দেয়।
রিপার হাতে মেহেদি দেখে রিয়াদ ও বায়না করে সে ও দিবে।দুজনকে দিয়ে দেয়।

রিপা বলে–“আপু দিবি না?”
–“হ্যা রাতে দিবো।এখন যে কাজ আছে মেহেদি দিলে কাজ করতে পারব না।

রিপা দুইঘন্টা মেহেদি হাতে নিয়ে বসে থাকে।ভাল কালার আসার জন্য।তারপর ধুয়ে দেখে হাতগুলো কত সুন্দর লাগছে।

রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে সব গুছিয়ে তাহু হাতে মেহেদি লাগায়।যত্ন করে অনেক্ষন বসে থাকে।হাল্কা শুকিয়ে আসলে আস্তে করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
.
ভোরের আযানে তাহুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।তাহু নামায শিখেছে স্কুলের হুজুরের কাছ থেকে।মেজাম্মু ও নামাজ পড়েন।তবে হুজুর নিয়মকানুন ভাল জানবেন বলে তাহু উনার থেকেই জেনে নিয়েছে।

নামায পড়তে উঠে দেখে মেহেদি একদম শুকিয়ে গেছে।সেগুলো ধুয়ে দেখে হাত গুলো কি সুন্দর লাল লাল হয়ে আছে। পাতা মেহেদি এজন্য তার এত প্রিয়।
____________

সকালবেলা তাহু সবার কাপড়চোপড় ধুয়ে শুকাতে দেয়।তারপর এসে রান্নাবান্না করার কাজে হাত দেয়।

রিয়াদ এসে বলে–“আপু আজকে আমি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছি।”
তাহু হেসে বলে–“কেন আপুকে আর দরকার নেই বুঝি?”
–“নাহ তা না।আমি বড় হচ্ছি না এখন তাই?”
–‘আচ্ছা তাই?”

রিয়াদকে শিশুশ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়েছে।সকালেই সে স্কুলে চলে যায়।স্কুলে ওর অনেক বন্ধু।তাদের সাথে খেলা করতে সে বেশি পছন্দ করে তাই আগেভাগে কিভাবে স্কুলে চলে যাবে সেটাই সে ভাবে।
.
তাহু নিজে নিজে কাজ করছে।রিপা রান্নাঘরে উকিঁ দেয়ার সময়, তাহু সেটা খেয়াল করে–“কিছু লাগবে তোর?”
–“নাহ।”
–“তবে?”
–“কাল স্কুল থেকে ফেরার পথে ড্রেস টা একটু করে বড়ই গাছের কাটাতে লেগে ছিঁড়ে গেছে।”
–“বড়ই গাছের কাটা কোথেকে আসলো?”

কাজ করতে করতে তাহু প্রশ্ন করে।কিন্তু রিপা চুপ।রিপাকে চুপ থাকতে দেখে তাহু আবারো বলে–“চুরি করা অন্যায় যে কতবার শিখিয়েছি,তাও চুরি করে বড়ই খাওয়া হচ্ছে?”
–“আপু বান্ধবীরা জোর করে ধরে নিয়ে গেছে।ঢিল ছুড়ে কয়েকটা নিছি বাকিগুলা গাছে উঠে……”

তাহু অবাক।
–“আর এমন করব না আপু।প্লিজ আমার ড্রেস টা সেলাই করে দে?নানুর মেয়ে দেখলে আস্ত রাখবে না।”

রিপার কথায় তাহু হাসে।
–“কিন্তু আর চুরি করা যাবেনা ঠিক আছে?”
–“আচ্ছা।”
–“বড়ই খাওয়ার ইচ্ছে হলে মেজাব্বুকে বলবি।নয়ত বড়ই গাছের মালিকের অনুমতি নিয়েই খাবি।”
–“চুরি করতে বেশ মজা লাগে।”

এটা বলে রিপা দৌড়।তাহু হাসে।বড় হলে মেয়েটা ঠিক হয়ে যাবে।যখন তার মতো বড় হবে তখন।আচ্ছা সে কি অনেক বড় হয়ে গেছে?
.
রান্নাবান্না শেষে তাহু রিপার স্কুল ড্রেস সেলাই করে।সেলাই গুলা স্কুলের গাহস্থ্য বিজ্ঞান বই থেকেই শিখেছে।মেডাম শিখিয়ে দিয়েছে।শেখার জন্য হলেও পড়ালেখা করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

রিপা স্কুলে যায়।কিছুক্ষণ পর তাহু ও যায়।


স্কুল শেষ তানি বলে–“তোর জন্য একটা মেহেদি গাছের ডাল রেখেছি।নিয়ে যা?”

তাহু বলে–“ঠিক আছে কিন্তু ঘরে যাবো না।”

তানি আচ্ছা বলে একদৌড়ে ঘর থেকে ডালটা নিয়ে আসলো।তারপর তাহুকে দিয়ে কিভাবে কি করবে বুঝিয়ে দিলো।তানি এসব তার মায়ের কাছ থেকেই জেনেছে।

তাহু বাসায় গিয়ে ব্যাগ রাখলো।তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো।সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়লো রিপাকে নিয়ে তাহু উঠানে গেলো।

তাহুদের পাকাবাড়ি।সামনে বিশাল উঠান।উঠানে তবে কোনো গাছ নেই।দু একটা ফলে গাছ রোপন করলে মন্দ হতো না।কিন্তু তাহুর চাচির এসবের শখ নেই।শুধু শুধু গাছ কতগুলা রোপন করা অযতা কাজ মনে করেন।

তাহু রিপার সাহায্য ডাল টা পুতে দেয়।রিপা তখন বলে–“আপু এটা বাঁচবে? ”
তাহু হেসে বলে–“আমার বিশ্বাস যত্ন করলে ঠিকই বাঁচবে।তুই শুধু দেখবি মেজাম্মু যেন এটা ফেলে না দেয় সেটার দায়িত্ব নিবি।”

রিপা অভয় দেয়–“সে মা কে দেখে রাখবে।”
____

আজকে শহর থেকে তাহুর চাচা বাড়ি আসবে।তাই মেজাম্মু বলে কিছু নাস্তাপানি বানিয়ে রাখতে।তাহু ও তাই করলো।প্রতিবার মেজাব্বু শহর থেকে আসলে তাহুদের জন্য বিভিন্ন পছন্দের জিনিস নিয়ে আসে।তারা তিনজনি এসব পেয়ে খুব খুশি হয়।

তাহু রিয়াদ আর রিপাকে পড়াচ্ছিলো।মেজাব্বু এসেই দেখে তাহুরা সবাই টেবিলে।চাচাকে দেখে তাহু খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে।সবাই একে একে জড়িয়ে ধরে।

তাহু চাচার জন্য শরবত নিয়ে আসে।চাচা ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে।তারপর তাহুকে জিজ্ঞেস করে–“তোর চাচি কই?”
–“মনে হয় ছাদে।”
–“ওখানে কি করে?”
–“অন্য মহিলাদের সাথে গল্প করছে।”

চাচা হাল্কা নিঃশ্বাস ফেলে বলে–“এই মহিলার চরিত্র আর বদলানো গেলো না।”
.
তারপর তাহুর চাচা ব্যাগ থেকে তাহুদের জন্য শহর থেকে কাপড় নিয়ে আসেন যে সেগুলো বের করেন।রিপা আর তাহুর টা একদম মিল।রিয়াদের টা আলাদা।

চাচি ছাদ থেকে নামতেই এসব দেখে তেড়ে এসে বলে–“অযতা টাকা উড়াও কেন?তাহুর ত এসবের প্রয়োজন নেই।”

তাহুর হাসিমুখ টা নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়।তারপর হাসার চেষ্টা করে চাচাকে বলে–“মেজাম্মু ঠিকই বলেছে,আমার অনেক কাপড় আছে।আমার লাগবে না।”

এটা বলে তাহু কাপড় রেখে দিয়ে চলে আসে।
–“ঢং যত্তসব।”

রিপার এসব দেখে খুব কষ্ট লাগে।সে ও কাপড় টা আস্তে করে রেখে তাহুর রুমে চলে আসে।রিয়াদ চুপচাপ বসে কাপড়গুলা দেখছিলো।

তাহুর চাচা এসব দেখে বলে–“আমি টাকা আয় করছি।আমার টাকায় আমি কাকে কি দিবো সে কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে?”

তাহুর চাচি মেকি রাগ দেখিয়ে রুমে যায়।তারপর সেখানে চাচা ও যায়।তারপর বলে–“তুমি দুইটা মাসুম বাচ্চাদের সামনে মেয়েটাকে এমন রাগারাগি করো।বাচ্চাগুলার মন ভেঙ্গে যায় সেটা খেয়াল রাখো?আর তাহু আমার মেয়ের মতো তুমি ওকে এত অবহেলা কেন করো?”

তাহুর চাচি বলে,
–“তোমার মেয়ের মতো।তবে মেয়ে ত নয়।আর শুনো আমি ওর জন্য পাত্র দেখছি খুব শীঘ্রই ঘর থেকে তাড়াবো।”
–“মানে ও তো এখনো ছোট।তাছাড়া ওর স্বপ্ন পড়ালেখা করা।”
–“হুহ স্বপ্ন।এসব আমি শুনতে চাইনা।”
–“না চাইলে ও শুনতে হবে।ভুলে যেওনা এ সম্পত্তি গুলোর একমাত্র মালিক তাহু।ভাইজান তাহুর নামে ই করে দিয়ে গেছেন।”

এ কথা শুনে তাহুর চাচি কিছুক্ষণ এর জন্য চুপ হয়ে যায়।হাজারহোক সম্পত্তির প্রতি তার খুব লোভ।তাহু নরম মনের মেয়ে।১৮ বয়স হলেই একদিন কৌশলে সম্পত্তি নিয়ে নিতে হবে।ততদিন অপেক্ষা করতে হবে।কিন্তু তাহুর চাচা অন্যরকম মানুষ।

–“ঠিক আছে।এখন বিয়ে দিবো না।কিন্তু ১৮ বছর হয়ে গেলে দিয়ে দিবো।”
–“তখনকার কথা তখন দেখা যাবে।মেয়েটা এত ভাল মনের সে অল্পতে সন্তুষ্ট হয়,একদম ই লোভ নেই।তারপর ও অপ্রাপ্তি বেশি তার জিবনে।তাছাড়া মেয়েটা তোমাকে কত ভালবাসে।ভালবাসার দাম দিতে শেখো।”

তাহুর চাচি চুপ হয়ে যান।সত্যি ই এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি।

তাহুর চাচা আবারো বলে–“মা বাবা মরা মেয়েটাকে একটু আদর ভালবাসা দাও।নাহলে ওর বদদোয়ায় শেষ হয়ে যাবে।যদিও আমার তাহু এমন মেয়ে নয়।তারপর ও আল্লাহ তো সব দেখছেন।তোমার পাপের প্রভাব আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবনে ও তো আসতে পারে।সময় আছে শুধরে নাও।”

তাহুর চাচি কিছু বলতে নিলে তাহুর চাচা আবারো বলে–“মেয়েটা পড়তে চাই পড়ুক।তারপর ওর জীবনের সিদ্ধান্ত অই নিতে পারবে।তাছাড়া তুমি যদি ওর ক্ষতি করতে চাও মনে রেখো,আল্লাহ শাস্তি ঠিকই দিবেন।”

এই বলে তাহুর চাচা রুম থেকে বের হয়ে যায়।
.
.
তাহু আবারো রুম থেকে এসে রিয়াদ আর রিপাকে পড়াতে বসায়।পড়া দিয়ে এসে নিজের রুমে বসে।আর আনমনে কি যেন ভাবে।

তাহুর চাচা তাহুর রুমে আসে।আর তাহুর মাথায় হাত রাখে।
–“কিছু বলবে মেজাব্বু?”
–“হ্যা।তোর বিয়ে ঠিক করেছি।”

তাহু আতংকিত কন্ঠে বলে–“বিয়ে?”

তাহুর চাচা দেখে তাহু কি বলে–“কেন?বড় হচ্ছিস বিয়ে দিতেই হবে।”
তাহু চুপ।
–“তোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারিস।”

তাহু মাথা উঠিয়ে বলে–“আমি অনেক পড়তে চাই।”
–“কতটুকু?”
–“যতটুকু পড়লে মানুষের সেবা করতে পারব।আমি ডাক্তার হবো মেজাব্বু।”

তাহুর চাচা হাসে।
–“অবশ্যই তোর স্বপ্ন পূরণে আমি তোর সাথে আছি।বিয়ের কথাটা মজা করে বলেছি।তুই এগিয়ে যা।”

চাচার কথার খুশিতে তাহু খুব খুশি হয়।সব অপ্রাপ্তির মাঝে এটা যে বড় প্রাপ্তি।সে একদিন বড় হবে।বড় ডাক্তার হবে।মানুষ দের সেবা করবে।আর অসহায়দের সাহায্য করবে।তার চাচা তার প্রাপ্তির শহরের বন্ধু।তাহু খুশিতে কেঁদে ফেলে।

–“কাঁদছিস কেন রে?”
–“খুশিতে কাঁদছি।আমার জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই।আমি এতেই সুখী।”
–“পাগলি একটা।”
–“আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”
–“তোকে দেখে আমি অবাক না হয়ে পারিনা।জানিস তোর আম্মু ও এমন ছিলেন।ভাবি ও অল্পতে খুশি হয়ে যেতেন।আসলে জীবনে সে মানুষ ই সুখী হয়েছে যে,যা ই পেয়েছে সন্তুষ্ট থেকেছে।”

তাহু হেসে ফেলে।

তাহুকে চাচা পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে