প্রাপ্তির শহরে পর্ব-১৫(শেষ পর্ব) সিজন ০২

0
1174

#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব-১৫(শেষপর্ব)
#তাহরীমা
.
তাহু যে মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছিল সেটা বদলি হয়ে আদ্রদের শহরে এসেছিলো।এখানের মেডিকেলে জয়েন হয়েছিল।
আজ হয়ত ভালবাসার টান আছে বলেই এখানে এসেছিল।না হলে তাদের দেখা ই যে হতো না।
.
তাহুর কিছু মনে পড়ার বিষয় নিয়ে আর মাথা ঘামায় না।তাহু এখন পরিপূর্ণ ডাক্তার।একটা জব ও নিয়েছে।মানুষের চিকিৎসা করছে। সেবা করছে। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি তার জীবনে কিছুই নেই।সবকিছুর জন্য শুকরিয়া।
তাহু আর মেঘা জবে চলে গেলে আদ্রর মা দুই নাতি নাত্নিকে চোখেচোখে রাখেন।একটু ও আড়ালে যেতে দেন না।আদ্র ও আগের মতে আবারও দুইদিনের জন্য বিদেশ যাবে আবার দেশে চলে আসবে।কারণ মানুষ হাজার বিশ্বস্ত হলেও নিজের কাজ নিজেকেই দেখে রাখতে হয়।

তাহু বাসায় থাকলে রান্নাবান্না তাহু করে।আবার মেঘা বাসা থাকলে মেঘা করে।দুজনে মিলেই এখন সংসারের কাজ করে।আর কাজের মহিলারা তো আছেন ই।ঘর ঝাড়ু কাপড়চোপড় ধুয়ার জন্য।

আদ্রর মা নাতি নাত্নিদের সাথে বেশিরভাগ থাকেন।এদের সাথে মাঝেমাঝে খেলা করে।এটাসেটা শেখায় নাত্নিদের সাথে গল্প করে।মাহি ও এখন আয়াতের সাথে খেলা করে।তেমন আর কান্নাকাটি করেনা।আলো আবারো আলাদা হয়ে গেলো।তবে মাঝেমাঝে বেড়াতে আসে।

প্রিয়ার বাবা মা ও দুইদিন পর পর তাহুকে এসে দেখে যান।এতেই তারা শান্তি খুঁজে পান।মেয়ে হারানোর ব্যথা একটু হলেও ভুলতে পারেন।
_______

আজকে সবার অফডে তাই সবাই একত্রিত হবে।তাহুর চাচি রিয়াদ রিপা,প্রিয়ার বাবা মা,মেঘার বাবা মা,আলো তার হাসবেন্ড ছেলেমেয়ে সবাইকে দাওয়াত।
.
তাহু ভোরে উঠে নামাজ পড়েই সব কাজ সামলে নেই।
তাহু আজকে ত্রিপিস পড়েছে।উড়না গায়ে পেঁচিয়ে কাজে নেমে পড়ে।আদ্র ও সেই আগের মতো তাহুর সাথে উঠে গেলো।নামাজ পড়ে ল্যাপটপ এ কি যেন কাজ করছিলো।

তাহু রান্নাঘরে কাজ করছে আর মেঘা টেবিল গুছাচ্ছে।হঠাৎ তাহুর উড়না খুলে একদিকের আচল পড়ে যায় চুলায়।
সাথে সাথে উড়নায় আগুন লেগে যায়।

মেঘার হঠাৎ চোখ যাওয়ায় সে চিল্লিয়ে উঠে,
–“আগুন লেগেছে আগুন লেগেছে।”

তাহু পিছনে দেখে আগুন লেগেছে।সে উড়নাটা শরীর থেকে ফেলে দেয়।তারপর তার যেন কি হলো সে বেহুঁশ হয়ে পরে গেলো।
আদ্র মেঘার চিৎকারে দৌড়ে আসে আর তাড়াতাড়ি উড়নার আগুন নিভায়।
আদ্র তাহু কে কোলে নিয়ে রুমে নিয়ে যায়।ডাক্তার কে কল করে।


ডাক্তার আসলে জানায়।ভয়ে অথবা আতংকে এমন হয়েছে।সমস্যার কিছুই নেই। তারপর ডাক্তার চলে যায়।

আদ্র মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“কতবার বলেছিলাম উড়না সাবধানে রাখতে।আজ একটা অঘটন ঘটতো।’
আদ্রর মা বলে,
–“তুই শান্ত হ।আমি নেক্সট তাহুকে বুঝিয়ে বলবো।যারা উড়না পড়ে তারা যেন রান্নাঘরে সাবধানে থাকে।’
.
মেহমান রা সবাই চলে এসে।এসে সবাই জানতে পারে এমন ঘটনা।তাহুকে দেখতে সবাই রুমে ছুটে আসে।তখনো তাহুর হুশ ফিরে নি।সবাই যে যার মতো তাহুর পাশে দাঁড়িয়ে আর বসে ছিলো।
.
কিছুক্ষণ পর তাহুর হুশ ফিরে।হুশ ফিরেই সে প্রথমে আদ্রকে দেখতে পাই।তারপর আতংকিত হয়ে দুইহাত বাড়িয়ে দেয়।

তারপর আদ্র জড়িয়ে ধরার পর তাহু হু হু করে কেঁদে উঠে।
–“কেদো না সব ঠিক হয়ে গেছে।”
তাহু অবাক করে জিজ্ঞেস করে,
–“আমার ছেলে আয়াত কোথায়?”

আদ্র আয়াতকে নিয়ে আসে।তাহু বলে,
–“আমার ছেলে এতবড় হয়ে গেছে?”
আদ্র খুশিমুখে বলে,
–“তোমার আগের সবকিছু মনে পড়েছে?”
তাহু মাথা নাড়ায়,
–“হ্যা।”

তাহু একে একে সবাইকে চিনতে পারে
শুধু প্রিয়ার বাবা মাকে ছাড়া।তারা অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকলে আদ্র তাহুকে সব বুঝায়।তারপর সবকিছু মনে করার জন্য তাহুলে সময় দেয়।তাহু অনেক্ষন মাথা চেপে বসে থাকে।আস্তে আস্তে তাহুর সব মনে পড়ে যায়।

তারপর আদ্র জিজ্ঞেস করে সেদিন কি এমন হয়েছিলো?

তাহু বলে,
–“ভাইয়া যখন আমাকে উনার অফিসে যেতে বলেছিল আমি গেলাম।ফোনটা ও নিয়ে যাইনি।এক কলিগ থেকে জানতে পারি যে ভাইয়া একটু বাইরে গেছে কিছুক্ষণ পর ফিরবে।আমি কিছুক্ষণ বসে থেকে ভাবলাম বের হয়ে দেখি কোথাও দেখতে পাই কিনা।বের ও হলাম কিন্তু ভাইয়াকে দেখছিলাম না।আবার যখন ভিতরে ডুকবো তখন দূর থেকে দেখলাম অফিসের ভীতর এক মহিলার হাতে একটা চেইন,প্রায় দেখতে আমার চেইনটার মতো।মহিলাটি অফিসের ভিতর দাঁড়িয়ে ছিলো।মনে পড়লো আমার চেইনের কথা।আমি আমার গলায় হাত দিলাম দেখি চেইন নেই।আমি বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর ও গলা চেক করেছিলাম।
তখন অই মহিলার কাছে যেতে চাইলাম।যেই না জানতে যাচ্ছি মানে চেইনটা কার? অমনি একটা শব্দ কানে ভেসে আসলো,
‘আগুন লেগেছে,আগুন লেগেছে।’

শব্দটায় আমি এতই আতংকিত ছিলাম ফাইলটা হাত থেকে পড়ে গেলো।আমি কি মনে করে রাস্তার ধারে দৌড়াচ্ছিলাম।কিন্তু হঠাৎ কি হলো ধুম করে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেলাম আর কিছুই মনে নেই।”

আদ্র বলে,
–“তারপর তুমি একটা বাবা একটা মা পেয়ে গেলে,ইউ আর আ লাকি গার্ল।”

আলো বলে,
–“কিন্তু অই মহিলা যাকে তুমি ভেবেছিলাম এতদিন?”
তাহু বলে,
–“হয়ত কোম্পানির কর্মচারী হবে।নয়ত আমার মত কারোর বউ,বোন হয়ত দরকারে গেছিলো।কি জানি তারা ডেডবডি খুঁজে না পেয়ে কেমন করেছে।”
তখন আকাশ বলে,
–“ওখানে অনেক লাশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছিলো।খুবই দুঃখের বিষয়।”

সবাই আফসোস করে উঠে।তারপর তাহু সুস্থ হয়ে গেছে সেটা ভেবে উপস্থিত সকলে খুব খুশি হয়।তাহু ও হাসে।

আজ তাহুর কিছুর ই অভাব নেই।ধর্য্য ভরসা আল্লাহর উপর বিশ্বাস আর অল্পতে সন্তুষ্ট, শুকরিয়া আদায় করার কারণে আজ তার পরিপূর্ণ সংসার।আদ্রর বাবা আজকের দিনে থাকলে কতই না খুশি হতো।আরো খুশি হতো তাহুর চাচা বেচে থাকলে।

রিপা রিয়াদ ও মায়ের সাথে এসেছিলো আজ।তাহু উঠে ভাইবোনদের জড়িয়ে ধরে,
–“কত বড় হয়ে গেছিস তোরা?”
রিপা বলে,
–“এইবার চিনতে পেরেছিস তাহলে,অইদিন ত চিনিস নাই?”

তাহু হেসে ফেলে।

সবাই খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার মতো দলে দলে গল্প করতে বসে।
.
.
রাতের খাবার ও দুই জা আর আলো মিলে রেডি করে ফেলে।
খাবার টেবিলে সবার জায়গা হয়না তাই বড়রা আগে খাবে।তাহু আর মেঘা সব এনে সাজিয়ে দেয়।
সাথে রিপা ও কাজে হেল্প করে।পুরা বাড়ি যেন হাসিতে ভরে উঠে।মেঘার মা অনেক অবাক হয় মেয়ের এমন পরিবর্তন দেখে।তবে একসাথে থাকার মজা যে আলাদা সেটা ভাল করেই বুঝেছেন।

বড়দের খাওয়া হলে এবার বাড়ির ছেলেরা বসে।তাহু মেঘা আর আলো বাচ্চাদের আগে খাইয়ে দেয়।
তারপর তারা বসে।খেতে খেতে অনেক গল্প সল্প হয়।

সবাই যার যার রুমে চলে যায়।আদ্রর মা,তাহুর চাচি, মেঘার মা,প্রিয়ার মা এক জায়গায় থাকে।তারা আজ সারারাত সুখ আর দুঃখের গল্প করবে।প্রিয়ার বাবা মেঘার বাবা এক জায়গায়।আর বাকিরা যার যার রুমে।

আলো রুমে ডুকতেই দেখে আহানকে তার হাসবেন্ড কোলে করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে।আলো হাসে,
–“তোমাকে ছেলে জ্বালাচ্ছে বুঝি?”
–“কই না তো?তুমি মা হয়ে ছেলের এতসব দায়িত্ব নিতে পারলে আমি বাবা হয়ে এটুকু পারবো না?”

আলো তখন ছেলেকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দেয়।আলোর হাসবেন্ড ও পাশে শুই আর ফিসফিস করে বলে,
–“ভালবাসি।”
–“বউ ভাল হলে ভালবাসি তাইনা?”
–“কেন বউ যখন রাগারাগি করত তখন বাসতাম না?”
–“বাসতে। মজা করছিলাম’

তারপর দুজনেই হেসে উঠে।
.
আকাশ আর মেঘ ও একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।মেঘা তখন বলে,
–“আজকে আমি খুব খুশি।আমি আলাদা থাকতে চেয়ে একটু ও শান্তি পাইনি।অথচ একসাথে থেকে সবাইকে ভালবাসলে জীবন কতই না সুন্দর।”
আকাশ হাসে।অবশেষে মেঘাকে হারাতে হয়নি।
.
তাহু আয়াতকে ঘুম পাড়িয়ে রুমের জানালা বরাবর দাঁড়ায়।আজকের চাঁদ টা গোলগাল।কতই না সুন্দর।
আদ্র রুমে এসে দেখে তাহু চাঁদ দেখে আছে।আদ্র ও হেসে বলে,
–“ডাক্তার প্রিয়া।আমার ভালবাসার প্রিয়া চাঁদ এর মতো সুন্দর।”

তাহু হাসে,
–“আমি তাহু ই।”
–“না তুমি আমার ভালবাসার প্রিয়া।”
–“আমি আপনার তাহু হয়েই আজীবন থাকতে চাই।তবে প্রিয়ার স্মরণে আমি ডাক্তার প্রিয়া হয়েই থাকবো।”

আদ্র কিছু বলেনা হাসে।
তারপর দুহাত দিয়ে তাহুর চোখ ধরে নেয়।
–“হঠাৎ চোখ কেন ধরছেন?’

আদ্র তাহুকে হাটিয়ে ব্যালকনির দিকে নিয়ে যায়।তারপর চোখ খুলে দেয়।চাঁদ এর আলোর ব্যালকনিতে সব স্পষ্ট।

তাহু খুশি হয়ে বলে,
–“মেহেদি গাছ?আমার খুব প্রিয়।”
–“জানি।”
–“কিভাবে?”
–“অই যে রিপা বলেছিলো’

তাহু অনেক খুশি হয়।আদ্র অবাক হয়ে বলে,
–“মানুষ কে এত এত টাকার গিফট দিয়ে খুশি করানো যায়না।আর আমার বউকে দুইটাকার গাছ এনে দিলেও হাসে।কি অবস্থা!”

তাহু তখন আদ্রকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–“ভালবেসে দুইটাকার জিনিস দেন সেই জিনিসের মূল্য ও অনেক।ভালবেসে যায় আনবেন তাতেই আমি সন্তুষ্ট।সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।”

আদ্র ও তাহুর সাথে বলে উঠে,
‘সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ’

আয়াত হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ঘুম ঘুম চোখে দেখে পাশে বাবা মা নেই।সে হাল্কা চিল্লিয়ে বলে,
–“মাম্মাম বাবাই কই তোমরা আসো ঘুমাবে।”

আদ্র তাহু আতংকিত হয়ে একজন আরেকজন কে ছেড়ে দেয়।
তারপর চোখাচোখি হয়।তারপর হেসে উঠে।আয়াত আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।দুজনে দুইপাশে শুয়ে পড়ে।আয়াতকে দুজনেই জড়িয়ে ধরে হাসে।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে