প্রাপ্তির শহরে পর্ব-০১ সিজন ০২

0
1019

#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব-০১
#তাহরীমা

‘স্বপ্ন দেখার আগে এভাবে শেষ হয়ে যাবে কখনো ই ভাবে নি তাহু।’
হঠাৎ করে মেজাব্বু এভাবে তাদের ছেড়ে চলে যাবে কল্পণা করেনি।জীবনটা তার থমকে যাবে।সব যে এলোমেলো হয়ে যাবে কখনো মাথায় আনেনি।মেজাব্বু সেদিন তার স্বপ্নের পথের সঙ্গী হয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়।তাহু ডাক্তার হবে।এত এত না পাওয়ার ভীড়ে এই একটায় পাওয়া যেন সব না পাওয়াকে হারিয়ে দিয়েছিলো।

মেজাব্বু শহরে চলে যায়।তারপরে ই হার্ট এট্যাক করে তাদের ছেড়ে পরপারে চলে যায়।থমকে গেলো তাহুর পড়ালেখা থমকে গেলো স্বপ্ন।এসএসসি টা কোনোমতে দেয়।
.
তাহুর চাচি বদলে যান।আগের মতো বকাঝকা করেনা।তবে তিনি চান বেচে থাকতে ই তাহুকে বিয়ে দিয়ে দিবেন।যদি ও তাহুর ১৬ বছর বয়স।তাতে কি দেখতে দেখতে ১৮ হয়ে যাবে।
চাচির মুখের দিকে তাকিয়ে তার নিজের ভাগ্যেকে মেনে নেয়।বিসর্জন দেয় নিজের স্বপ্নকে।কোনোদিন সুযোগ হলে তার কখনো মেয়ে হলে তাকে না হয় ডাক্তার বানিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করবে।
___________

আজ পাত্রপক্ষ তাহুকে দেখতে আসবে।সকাল থেকেই নাস্তার বানানোর তাড়াহুড়া চলছে।রিয়াদ এসে তাহুকে জড়িয়ে ধরে–“আপু তুই কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবি?”

তাহু হাসার চেষ্টা করে।
–“একেবারে যাব না।মাঝেমাঝে তোদের দেখতে আসবো।”
–“সত্যি ই আসবি তো?”
–“হ্যা রে ভাই।আর আমি আসতে না পারলে তোরা আমায় দেখতে যাবি।কি যাবি তো?”
–“হ্যা আমি ভাই না?আমি দেখতে যাব না তো কে যাবে?”

দূরে দাঁড়িয়ে রিপা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে।তার খুব কান্না পাচ্ছে।আপুর এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়ার কি প্রয়োজন?
.
তাহুর চাচি এখন সেলাইয়ের কাজ করে।কাথা সেলাই করে সেগুলো বিক্রি করে।সংসার চলবে কিভাবে?বসে থাকলে তো আর পেটে ভাত জুটবে না।যদি ও তাদের জমিজমার অভাব নেই।সেগুলো বিক্রি করেও কয়দিন বসে খাবে।কাজ তো করতে হবে।অতীতের কথা ভেবে তার চোখের জল পড়ে।তখন একটু কাজ করে হাপিয়ে যেতেন আর এখন পুরা সংসারের দায়িত্ব তার।কতটা বদলে গেলেন।
.
.
তাহু কাজ সব শেষ করে।তারপর চাচির একটা শাড়ি পড়ে নেয়।
পাত্রপক্ষ আসলে তাদের আপ্যায়ন করে তাহু চাচি।আর রিপা হাতে হাতে সাহায্য করে।
.
খাওয়াদাওয়া শেষে তাহুকে নিয়ে আসা হয়।তাহু সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর পাত্রের মা বসতে বলে,
তাহুকে নাম বলতে বললে সে নিজের নাম বলে।

তারপর তাহুর চাচি পাত্রকে জিজ্ঞেস করে তার নাম কি?পাত্র তখন বলে–“মেঘাদ্র আহমেদ।”

তাহু চোখ উপরে তুলে একবার তাকায়।ছেলে ফর্সা।কালো শার্ট পরেছে।এটুকুই খেয়াল করেছে।আবার চোখ নামিয়ে রাখে।
ছেলে আর তার মা ই শুধু দেখতে এসেছে।

তারপর তাহুর চাচির সাথে আরো কিছুক্ষণ তারা কথা বললো।ছেলের দুইভাই একবোন।বোন বিবাহিত।ভাই অবিবাহিত।ছোট সংসার ই।তাহুকে তারা অনেক ভালো রাখবে।অহ হ্যা ছেলে প্রবাসী।

তাহুকে কিছুক্ষণ দেখে তারা মা ছেলে কথা বলে।তারপর তাহু নিজের রুমে চলে আসে।

আদ্রর মা আর আদ্র একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলে–“মেয়ে কেমন লেগেছে?”

আদ্র চুপ।
–“বল?”
–“আমার আরো ফর্সা মেয়ে চাই।”
–“একে তোর পছন্দ হয়নি?”
–“বললাম তো।”

তারপর আদ্রর মা হাসিমুখে তাহুর চাচি ডাকে আর বলে–“আমরা বাসায় গিয়ে আলোচনা করে তারপর ই বলবো।”


তারা চলে গেলে তাহুর চাচি তাহুকে বলে–“আমার মনে হয়না তোকে পছন্দ হয়েছে,পছন্দ হলে তো সাথে সাথেই বলে যেতে।”

তাহু তখন মাথা নিচু করে বলে–“মেজাম্মু ছেলেটা ফর্সা আর আমি কালো।আমাদের এমনিতেই মানাবে না।তাছাড়া যার কপালে যে আছে তার সাথে তার বিয়ে হবে।”
তাহুর চাচি রাগ নিয়েই বলে–“আল্লাহ জানে তোকে বিয়ে দিতে কত কষ্ট হয়।”

তাহু চুপ করে থাকে।ফর্সা হওয়া জরুরী ছিল কি?

______

বাসায় গিয়ে আদ্র মায়ের সাথে রেগে বলে–“তুমি মেয়ে কালো তো বলোনি?”
–“মেয়েটা কালো নয় শ্যামবর্ণের।”
–“অই হলো।আমার সব ফ্রেন্ডরা ফর্সা মেয়ে বিয়ে করেছে।সে জায়গায় আমি এত সুন্দর হয়ে ও কিভাবে অই মেয়েকে বিয়ে করবো?ভাবলে কি করে?”

আদ্রর মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে–“মেয়েটা নাকি সংসারিক।সব কাজ পারে।একটা কাজের মানুষের দরকার বল?তাছাড়া মেয়ের চাচি আমাদের টাকা ও দিবে বলেছে।এতসব হাতছাড়া করবো?আজকাল মানুষ মেয়ে ও দিতে চায়না সেখানে আমরা মেয়ে পাচ্ছি।টাকা পাচ্ছি কম কি?”

আদ্র চুপ থাকে।তারপর বলে,
–“বেশি লোভ ভালো না”
–“লোভ কই করছি?মেয়ের চাচি এসব নিজ থেকে দিবে বলেছে।”

আদ্রর মা অনেক বুঝিয়ে আদ্রকে রাজি করায়।আদ্রর মা তাহুর চাচিকে কল করে জানায় মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে।
তাহুর চাচি খবরটা তাহুকে দেয়।তাহু হাল্কা হাসে।তবে ভয় হতে লাগে নতুন পরিবেশে যাবে।মানুষ গুলো ভালো হবে নাকি খারাপ?কিভাবে কি মানিয়ে নিবে।

__________

অবশেষে তাহুর সাথে আদ্রর বিয়ে হয়ে যায়।তাহুকে যেহেতু টাকা দিয়েই বিয়ে দিচ্ছে সেহেতু তাহুর চাচি বিয়ের তেমন আয়োজন করেনি।শুধু কাজি এসে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে ব্যাচ এটুকুই।তাহু এসবের কিছুই জানেনা।তাহুর চাচির নিজের বিয়ের গহনা বিক্রি করেই টাকাগুলা জোগাড় করেছে।

তাহুকে বিদায়ের সময় রিয়াদ রিপা জোরে জোরে কান্না করে।কিন্তু তাহু কাঁদেনা।ছোট থেকেই কাদতে কাদতে চোখের জল একদম শুকিয়ে গেছে।

আদ্রর পাশাপাশি তাহুকে গাড়িতে বসায়।আদ্র কোনো কথা বলেনা।সারা রাস্তায় সে চুপ ছিলো।
.
তাহুকে গাড়ি থেকে নামানো হয়।আদ্র আগেই চলে গেছিলো।আদ্রর বোন আলো দূর থেকে তাহুকে প্রথম দেখে।দেখে মুখ কালো করে ফেলে।আলো সুন্দরী,তার স্বামী সহ এ বাড়িতেই থাকে।আলোর স্বামী কোনো আয় করেনা।আলো গার্মেন্টস এ সেলাইয়ের কাজ করে কোনোমতে থাকে।

আলো মায়ের কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
–“কি বউ আনতেছো?এতো কালো।”
–“চুপ থাক।কালো হলেও সমস্যা নেই।পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবো মেয়েটা যে শান্ত বলে।ওদের পাড়ার লোকেরায় বলেছে।কখনো কাউকে কষ্ট দেয়না নাকি।”

আলো মুখ ভেংচি কেটে চলে যায়।তাহুকে রুমে আনানো হয়।আদ্রর মা হেসে হেসে কথা বলেন।এটা দেখেই তাহু মনে সস্থি পায় মানুষ গুলো অনেক ভালো।নিশ্চয় তার বর ও অনেক ভালো হবে।

আদ্রর মা তাহুর সব গহনা শাড়ি চেঞ্জ করে একটা হাল্কা শাড়ি পড়তে দেয়।আর শাড়ি গহনা গুলো নিয়ে চলে যায়।তাহুকে একদম বাড়ির বউ নয় যেন লাগছে কাজের মেয়ে।তাহু তারপর ও খুশি।এসব গহনা শাড়ির তার প্রয়োজন নেই,তার জীবনে ধর্য্য ধরা আর শুকরিয়া করার মন মানসিকতা থাকুক।আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকুক সেটাই চায়।

তাহু এশারের নামাজ পড়ে নেয়।তাহুকে খাবার খাওয়ার জন্য ননদে ডাকতে আসে।
আলো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে–“এই যে মেয়ে খেতে আসো?”

তাহু অবাক হয়।
–“এ কেমন কথাবার্তা?”
তাহু হেসে বলে–“আপনাকে তো আপু চিনলাম না?”

আলো মুখ বাকা করে বলে–“আমি তোমার ননদ হই।”

সাধারণত ননদরা ভাবি বলে ডাকে।নয়ত নাম ধরে।অথচ তাকে ‘এই মেয়ে’ বলে সম্বোধন করলো?

তাহুকে ভাবতে দেখে আলো বলে–“খেতে আসলে আসো নইলে নেই।যতসব ভাবার দুনিয়ায় চলে গেছে।”

তাহু ছোট করে ‘আসছি’ বলে।

মনে মনে খুব আঘাত পায়।এর চেয়ে চাচি মারতো যে এত আঘাত লাগতো না।মানুষের ব্যবহারের আঘাত এত তিক্ত।তার জীবনে সুখ নেই।এটাই সে মেনে নেয়………

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহু রুম থেকে বের হয়।
.
.
তাহুর শশুড়বাড়ি টাও অনেক বড় পাকা বাড়ি।একটা আদ্রর রুম।একটা আলোর রুম।একটা দেবরের রুম একটা তাহুর শশুড় শাশুড়ির রুম।একটা মেহমান আসলে থাকার জন্য রুম আছে।

তাহু একা একা গিয়ে খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়ায়।আদ্রর বাবা সেখানে বসে ছিলো।উনাকে গিয়েই তাহু সালাম করে।
আদ্রর বাবা শান্ত মনের মানুষ মনে হলো তাহুর কাছে।আদ্রর বাবা বলে,
–“আজ থেকে আমার আরেকটা মেয়ে আসলো এ ঘরে।সুখী হ।”

তাহু যেন আরেক বাবা ফিরে পেয়েছে জীবনে তার চোখ ছলছল করে উঠলো।

তাহু তারপর টেবিলের একপাশে দাঁড়িয়ে রইলো।কেউ তার সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না।আদ্রর বোন,বোনের জামাই সবাই যে যার মতো খাবার খেয়ে চলে গেলো।বাকি রইলো আদ্র,আদ্রর ভাই আদ্রর মা আর বাবা।

আদ্রর ভাইকে তাহু এখনো দেখেনি।আর আদ্র সেই যে উধাও আর ফেরার নাম নেই।

আদ্রর বাবা বলে–“তাহু তুই বসে যা?”
তাহু একপলক চেয়ে থাকলে আদ্রর বাবা বলে,
–“তোকে আমি নাম ধরেই বলবো আপত্তি আছে?”

তাহু মাথা নাড়ায় মানে ‘নাহ’

তাহু বলে–“আপনারা সবাই খাওয়ার পর আমি খাব।আগে খাওয়ার অভ্যাস আমার নেই।তাছাড়া দেখতে ভাল ও দেখায় না।”

তাহুর কথায় শাশুড়ি খুশি হয়।তারপর আদ্রর মা বাবা খেয়ে নেয়।

কিছুক্ষণ পর একটা ছেলে এসে টেবিলে বসে–“উহ খুব ক্ষুধা পেয়েছে খাবার দাও?”

ছেলেটি তাহুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়–“এই তাহলে ভাবি?দেখতে তো কাজের বুয়ার মতো লাগছে।”

ছেলেটি অট্টহাসি হাসে।আর হাসে আদ্রর মা ও।

তাহু চুপ করে থাকে।বললে ই হলো পোশাক আশাকে মানুষের আসল পরিচয় না।ব্যবহার আসল পরিচয় এটাই একদিন তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে।তাহু নতুন বউ চুপ থাকায় মানায়।

আদ্রর মা তাহুকে বলে–“তোর দেবর আকাশকে খেতে দে?”

তাহু চুপচাপ আকাশকে ভাত বেড়ে দেয়।তারপর আদ্র এসে চুপচাপ খেয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

সবার শেষে তাহু বসতে নিলে শাশুড়ি বলে-“এত খাবার জীবনে একসাথে খেয়েছিস?মনে তো হয়না।”
তাহু জবাব দেয়–“খায়নি।”

–“তাহলে তো ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নিতে পারবি।”

তাহু অবাক হয়।আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–“আলহামদুলিল্লাহ”

চলবে….?

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে