পিয়ানোর সুর পর্ব-১০+১১

0
351

পিয়ানোর সুর
#১০মপর্ব

ইচ্ছে করছে এক্ষুণি বাসায় ফিরে যাই। ব্যালকণিতে দাঁড়াই। তাতে যদি কিছুটা দূরত্ব ঘোচে। লিভিং রুমে মিথির নানাবাড়ীর ফ্যামিলির সবার মাঝে মধ্যমণি হয়ে বসে আছি। আর মিথি ঐ দূর কোণের ব্যালকণির কর্ণারে।
আশ্চর্য হয়ে যাই এরা কেউ এখনপর্যন্ত মিথির নাম মুখে উচ্চারণ করেনি।
কেউ খোঁজ করছে না মেয়েটাকে। কেন?
সবাই মিলে কত মজার মজার খাবার খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে, কত ধরণের সাত সতেরোর গল্প করছে।
একটা মানুষও মিথিকে স্মরণ করছে না।
বাবা কয়েকবার চেষ্টা করেছে আমায় কিছু খাওয়াতে। মুখে তুলিনি।

আমার মন পড়ে আছে মিথির বাহুডোরে। তাকে ওভাবে ফেলে আসতে চাইনি।
মিথিই এল না।
একটি কথার বাক্য তো দূর, একটি শব্দ উচ্চারণ করেনি ঐ একটুখানি “হুউউউউ” বলা ছাড়া।
সুপ্তির ডাকে ফিরে আসার সময় আরও শক্ত হয়ে চেপে বসেছিল ওর দু’হাত আমার গলায়।
ভয়ে কিংবা সংশয়ে।

যেই বলেছি,
— “সৌরভ কেবলই রূপালী চাঁদের মত মেয়ে মিথির।”

দু’হাত সরিয়ে নিয়েছিল। দু’জনার মাঝে বাক্য বিনিময় হয়নি। কোল থেকে নামিয়ে চেয়ারে বসিয়ে রেখে মিথিকে ছেড়ে আসতে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল।
বুকে জ্বলুনি অনুভব করছি।

— কী ব্যাপার সৌরভ আপনি কী সত্যিই কিছু খাবেন না? কেমন দেখায় বলুন তো!

সুপ্তির কথায় রাগ হলো খুব। বিরক্তি প্রকাশ অভদ্রতা বলে কিছু বলছি না। এরমাঝে নোমান আঙ্কেল সুপ্তির বাবা আমার বাবাকে বললেন,

— ও সাদমান ছেলে তো বড় কম হলো না। এবার বিয়ে থা কিছু করা। নাকি কনে খুঁজে পাচ্ছিস না? বলিস তো নিজ ঘরের মেয়ে তোর ছেলের বউ বানিয়ে দিয়ে দিই।

নোমান আঙ্কেল ঠিক কী বললেন বুঝতে পারছি না। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি আমারই পানে চেয়ে হাসছেন। বললেন,

— বন্ধু দাও দেখি মেয়ে কাকে দিতে চাও। ছেলের পছন্দ হলে আমার আপত্তি নেই।

— সুপ্তিকে কেমন লাগে তোর ছেলেকে জিজ্ঞেস কর।

বাবার মুখে মেঘের ছায়া নামলো। আমি এখনো বুঝিনি এরা এক্সাক্টলি কী নিয়ে কথা বলছেন। বাবাকে বললাম,

— ড্যাড আর য়্যু ওকে?
চলো ফিরি রেস্ট নেবে। আই ফিল এক্সাস্টেড (Exhausted).. নিড সাম ফ্রেশ এয়ার।

আমার এই এক কথায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো লিভিং রুমে বসে থাকা সবাই। ইলেক্ট্রিসিটি এখনো আসেনি। চার্জার ফ্যান, লাইটের চার্জ কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়েছে।
সারা ঘরে মোমবাতি জ্বালানো। গরমে হাসফাস করছে প্রত্যেকে।
কেউ একজন হাতপাখা নিয়ে এলে সুপ্তি আমাকে বাতাস করা শুরু করলো। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর আমার জন্য। না করা সত্ত্বেও শুনছে না সুপ্তি।

— বড়’দা আমি মিথিকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি কিছু সময়ের জন্য।

কথাটা কে বললেন দেখার জন্য ঝট করে লিভিং রুমের দরজার দিকে তাকালাম। হায়দার আঙ্কেলের ছোট ভাই।
তারমানে মিথির ছোট মামা হন তিনি।
ওনার শরীরের আড়াল নিয়ে দাঁড়ানো গোলাপি ফ্রক পরা মেয়েটির পরনের ওড়না আর ফ্রকের আংশিক অংশ ছাড়া কিছুই দেখা গেল না।

হৃৎপিণ্ডে তোলপাড় শুরু হলো আমার… এত কাছে তুমি
তবু কেন ছুঁতে পারি না!
ঐ চাঁদমুখের আলো আমার চোখ ভাসিয়ে নিক না মিথি… একটু তাকাও!

চলবে…….

পিয়ানোর সুর
#১১পর্ব

হায়দার আঙ্কেল বললেন,
— রাত হয়ে গেল। এখন কোথায় যাবি সেয়ানা মেয়ে নিয়ে! বাসায় থাক। কাল দিনে নিয়ে যাস।

— না এখনি যাবে।
— নাসিম কী হলো তোর! জেদ করছিস মনে হয়।

— তো কী করবো বলো তো বড়’দা! একটা মেয়ে সেই সন্ধ্যা থেকে বারান্দার কোণায় বসে আছে আর তোমরা কেউ একবার তার খোঁজ নাওনি। সবাই মিলে কত মজার মজার খাবার খাচ্ছো। কেউ কী মিথিকে এক কাপ চা সেধেছো?
এনি স্ন্যাকস অর আদার মিলস! খেতে দিয়েছো ওকে?

— বাসায় গেস্ট নাসিম, বিহেইভ ইয়োর সেলফ!

নোমান আঙ্কেল ধমকে উঠলেন। নাসিম আঙ্কেল প্রতিত্তর দিতে সময় নিল না। বললেন,

— সাদমান ভাই আবার গেস্ট হলো কবে সেঝ’দা?

— ও না হোক। সাদমানের ছেলে সৌরভ প্রথম এসেছে খেয়াল করেছিস?

— সেটা আমার দেখার বিষয় না সেঝ’দা। মিথি ইজ মাই ফার্স্ট প্রায়োরিটি।
এক্সট্রিমলি সরি সৌরভ, তুমি কিছু মনে কোরো না। মিথি আমার বড় আদরের ভাগ্নী।

— না না নাসিম আঙ্কেল ঠিক আছে। হাই মিথি! কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?

মিথি নিরুত্তর! নাসিম আঙ্কেল পেছনে দাঁড়ানো মিথির এক হাত ধরে বললেন,

— আমরা দুই মামা ভাগ্নী রিক্সা ভ্রমণে বের হচ্ছি। মিথি স্ট্রিট ফুড খেতে পছন্দ করে খুব। ওর সাথে রাতের ডিনার ফুটপাতে বসে করার প্ল্যান করেছি। তোমরা বোসো গল্প করো।
আমরা আসছি.. বাই এভ্রিওয়ান।

আমি আর বাবা বাদ দিয়ে সবার চেহারা দেখার মত হলো। মনে হলো মোমবাতি সব এক ফুঁ’তে নিভে গেল।
মিথির পক্ষ নেয়ার মত এ বাড়ীতে একজন শক্তিশালী মানুষ আছে জেনে হৃষ্ট হলো মন।
বাবা আমায় ওইনকিং (Winking) করে উঠে দাঁড়ালেন। চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছি।
বাবা কী চাইছে মাথায় এল না।
লিভিং রুমের দরজা থেকে চলে যেতে উদ্যত হওয়া নাসিম আঙ্কলকে ডাকলেন বাবা,

— ওয়েট নাসিম!

থেমে দাঁড়ালেন মামা ভাগ্নী দুজনেই। মন হরিণী চঞ্চল মিথিটা এবারও ইচ্ছে করে আড়াল নিল।

— জ্বি সাদমান ভাই বলেন।

— তোর আর মিথির সমস্যা না’হলে আমাদের বাপ বেটাকে সঙ্গে নে। বহুদিন হয় স্ট্রিট ফুড খাই না।

— না না কোনো সমস্যা নেই। সৌরভ খেতে পারবে তো নাকি? আইল্যান্ডে বসবো কিন্তু.. বৃষ্টির দিন। কাদামাটিতে মেখে যাবে সৌরভ।

বাবা আমার দিকে তাকালেন,
— কী বেটা ফুটপাতে বসে খেতে পারবে? তুমি অসুস্থ। ভেবে দেখ, বাসায় যাবে?

— নাসিম আঙ্কেলের সাথে যাই ড্যাড?

— আরে কীসের ড্যাড! কল হিম বাবা।

— ও বাবা বলতে পারে না নাসিম বাববা হয়ে যায়.. বলেই বাবা হেসে টিপ্পনী কাটলেন আমায়।

সবাই হো হো করে হাসলেন। আমার অস্বস্তি লাগছে। নাসিম আঙ্কেল তাড়া দিলেন বের হতে। নোমান আঙ্কেলের ওয়াইফ সাফিয়া আন্টি মানে সুপ্তির মা বললেন,

— সুপ্তিকে সঙ্গে নে নাসিম।

— নো! অনলি ট্রিট ফর মিথি। যারা একই ছাদের নীচে বাস করে এ বাড়ীর মেয়ে মিথিকে ভুলে যায় তাদেরকে সৈয়দ নাসিম হায়দার মনে রাখে না।

মিথির হাত ধরে নাসিম আঙ্কেল বের হয়ে গেলেন। সাফিয়া আন্টি অপমানে চুপ।
বাবা আমি সবার কাছথেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম।
দরজার বাইরে এসে দেখি মামা ভাগ্নী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
মোবাইলের টর্চ জ্বেলে আগে নাসিম আঙ্কেল নামলেন বাবাও মোবাইলে টর্চ জ্বেলে নিলেন। দুই মুরুব্বী গল্প করতে করতে নামছেন।
আমি আমার মোবাইলের টর্চ জ্বেলে নিয়ে সিঁড়িতে আলো ফেললাম।
হাত ইশারায় মিথিকে বললাম আগে যেতে। গেল না। টর্চ নিভিয়ে দিতেই এগোলো।
সিঁড়ি বেয়ে পাশাপাশি নামছি। অদ্ভুত এক অনুভূতি গ্রাস করলো।
মিথির ওড়নার ছোট্ট আঁচল ধরলাম। বুঝতে পেরে মাথার ঘোমটা ফেলে দিল সে।
আঁচল বড় করে দিয়ে নিজেই বাড়িয়ে দিল ওড়না একাংশ। আঙুল ছুঁলো আঙুলে।
মুঠোতে ওড়না পেঁচিয়ে নিলাম অনেকখানি। আঁচলে জড়ানো মিথির তুলতুলে হাত কী করে ফেরাই! গোলাপ অনুভূত হলো আমার শক্ত মুঠোয়। ভয়ে থরথর কাঁপতে থাকা মেয়েটির সিঁড়ি দিয়ে নামা থেমে গেল।
গা ঘেঁষে এসে এবার মিথির পুরো হাতখানি বুকে চেপে আগলে নিলাম। চুমু খেতে ইচ্ছে হলো।
ভয় হলো,
হাত ধরাতেই যে মেয়ে কেঁপে উল্টে পড়ার দশা হয় তাকে চুমু খাই যদি, এ অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। রক্ষে পাবো তো!
লোভ সামলে নিলাম।
পাশাপাশি হেঁটে নামছি।
একে অন্যের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি।
রজনীগন্ধার মিষ্টি সুবাসে আমি আলোড়িত।
মিথির কী ইচ্ছে হয় না একটু ছুঁয়ে দিতে, কথা বলতে? এত চাপা কেন মেয়েটা!
কথা হলো না আমাদের।

গন্তব্য কোথায় নাসিম আঙ্কেল আর মিথি জানে। আমি আর বাবা জানি না। এটাই কারণ নাকি অন্যকিছু জানি না, নাসিম আঙ্কেল আমাকে আর মিথিকে এক রিক্সায় তুলে দিলেন।
বাবা আর আঙ্কেল অন্য রিক্সায় সামনে এগোলে আমাদের রিক্সা পিছু নিল। মিথিদের দোতলার ব্যালকণিতে ছায়ার মত কেউ দাঁড়িয়ে। কে? অন্ধকারে চেনা গেল না।
পুরো এলাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত।
মিথি গুটিসুটি মেরে একপাশে দূরত্ব নিয়ে বসেছে। নিজেকে নিজেই বিশ্বাস করাতে পারছি না এর সাথেই কী ব্যালকণিতে কিছু উষ্ণ সময় কেটেছিল!

— মিথি ভয় লাগছে? হাত ধরো।

আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতে মিথি দোদুল্যমান হাত রাখলো।
তুলোর মত তুলতুলে হাতটি আঙুলে পেঁচিয়ে নিয়ে তার উল্টো পিঠে চুমু খেলাম।
শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে মিথি ফের কাঁপছে। এ কাঁপন আমার জন্য।
বুক ভরে প্রশান্তির শ্বাস নিচ্ছি আর ভাবছি,
আমার প্রাপ্তি আমারই পাশে বসে স্পর্শের শিহরণে কেঁপে কেঁপে জানান দিচ্ছে, আমি তোমারই জন্য।

ইংল্যান্ডের দিনগুলোয় এমন সুখ কী কখনো এসেছিল?
গভীর আবেগে আমার সিক্ত কন্ঠ আনমনে আওড়ালো,

— কেমন পাগল পাগল লাগছে মিথি। বোঝাতে পারবো না। আমার গলায় পরা এই চেইনটি আমার বাবার দেয়া।
ত্রিশতম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল। সেইদিনই বাবাকে প্রথম দেখি। বাবা মায়ের বিচ্ছেদের পর বাবা দেশে ফিরে এটি বানিয়ে নিজেই পরেছিলেন সুদীর্ঘ আটাশ বছর।
চেইনের লকেট আমার নাম দিয়ে স্বর্ণাক্ষরে লিখা “Sawraav”।
পরবে মিথি?
তোমাকে পরিয়ে দিই?

মিথি শান্ত ভীষণ। কাঁপুনি থেমে গেছে। মাথানত করে বসে আছে একদম চুপটি মেরে।
কী মনে করে চেইন পরিয়ে দিতে ওর গ্রীবায় হাত বাড়ালাম। মিথি বাঁধা দিল না।
আমার দিকে ফিরিয়ে ওর চিবুক উঁচু করে ধরতেই এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি চলে এল।
ভয়, লজ্জার লালিমায় আঁকিবুঁকি ওর ঐ চেহারার এক ঝলক.. সৌরভের হার্টবিট থামিয়ে দিতে যথেষ্ট।
মিথি মুখ লুকালো এসে সোজা আমার বুকে…

রাস্তার নিয়ন আলোয় ওভাবেই মিথিকে নিজহাতে চেইন পরানো শেষ হলে ওর এলোমেলো চুলগুলোয় ঠোঁট ছুঁয়ে কানে কানে বললাম,

— মিথি আমার হলো।
আমি মিথির.. তাইনা?

এবারও আমার বুকের মধ্যিখানে কম্পমান তার সেই একই আদুরে গুঞ্জন..

— হুউউউউউউউ…

|
|
#চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে