পিয়ানোর সুর পর্ব-২০+২১

0
358

পিয়ানোর সুর
#২০পর্ব

— আরে অই খাতুন কই গেলি, এইহানে আয়।

— দাদী এই রাতে কী ছুরু করলেন ঘুমাইতে দিতেন না? ছক্কালে উইঠ্যাই তো চিল্লাইবেন খাতুন খাওন দে খাওন দে। আর তিন চাইর ঘন্টায় ছক্কাল হইয়া যাইব দাদী ঘুমান তো। হেরা মৃদা বাইত্থন আইলে কমুনে।

— আরে হুন ছেড়ি বেশি কথা কছ। তর দাদায় ঘুমাইছে আস্তে আওয়াজ কর। এই বয়ছে মান ইজ্জত ধুলায় লুটায়া দিল রে মিথি। আইচ্ছা ক ছেন দেহি বাসায় পোকা মারনে বিছ কী আচে? এরোচল আচেনি দেখ ত? ইন্দুর মারার বিছ হইলেই হইব।

— কী কন দাদী বিছ দিয়া কী করবেন এই রাইতে? মছা তো নাইক্কা। ইন্দুর আইব কইত্থে। মাছে মাছে (মাসে মাসে) বেডারা আইয়া মিশিন দিয়া বেবাক ছাপ কইরা দিয়া যায় গা। আফনে কী ভুইলা গেলেন। অবইশ্য বয়স হইছে ভুলোনের। দাঁত গেছে গা এলা মগজ তো যাইবই গা, আইজ হউক কাইল হউক।

— চুপ কর ছেড়ি তর বদনজর দিয়াই খাইছস আমার সইন্দর্য। কী খাইলে আরামচে ঘুমায়া ঘুমায়া কব্বরে যামুগা হেইডা ক।

— আল্লাহ গো দাদী ইডি কী কন!!

— কমু কী দেহছ না। কানানি তুই। ওরে খাতুন রে মান ইজ্জত গেলে গা বাঁইচা থাইকা কী করুম। রান্না ঘরে দেখ গিয়া কিছু পাছনি। রেডি কইরা রাহি। ছময় মতন হাতের কাচে কিছু পাইনা। পোলার বউগুলান বেবাক দখল কইরা লইচে রে। ছময় অহন কলিকাল ছাগলে চাটে বাগের (বাঘ) গাল বুঝলি রে খাতুন।

— হ এইডা কইচেন এক্কেরে কারেক কথা। দাদী গো পোলা বিয়া দিলে আর পোলা থাকে না গো। পেডের পোলা হইয়া যায় তালই ছাব। চিন্নাও চিনে না। একবার হারপিক খায়া মরবার চাইছিলাম। হারপিকের যা দাম। পরে বাদ দিছি। আইজকাইল মরতেও টেকা লাগে। মইরা ফকির হমুনি কন? ধার কইরা মরণ যায় অবইশ্য। মাগার ঋণ শোধ করব কেলা! হেই দুক্কুতে মরতে পারতাচি না।

— হ ঠিকই কইছস রে খাতুন মইরাও ছান্তি নাইক্কা। খোদার ঘরে ছব মাপ আচে ঋণের কুনো মাফ নাই।

— দাদী ডেট উবার হওয়া ডিটল আছে। নীল রঙের কেরাছিনও আছে। মাগনা। বড় মামী ফেলাইতে কইচিল। ফেলাই নাইক্কা। দেক্লেন ফেলনা চিজ কামে লাগে কেমতে। আমি বুয়া অইলে কী অইব বড়ই লক্কি। দাদী টেরাই করবেন? লইয়ামু?

— হাতের কাছে রাখিছ। করুম নে। দেহি ছাদের(সাদমান) বাড়ীত মিথি রে পাইলে তো বাঁইচা যামু। না পাইলে টেরাই করুম। বারান্দায় গিয়া দেখ ওই বাড়ীথন কিছু হুনা যায়নি। মিথির গলা হুনলে আমারে ডাক দিছ। আমার বহুত আদরের মাইয়ার ঝি মিথি। ওর কিছু হইলে জামাই বাবাজিরে মুখ দেহাইতে পারুম না। মরতেই হইব। বাঁচনের পথ নাই রে খাতুন। কী যুগ আইলো পুলাপাইন বংছের ইজ্জত নিয়া ভাবে না।

— আইচ্ছা দেখতাছি আফনে কুনো চিন্তা কইরেন না মিথি বুবুর গলা হুনলেই চিক্কুর দিমু।

— আস্তে চিক্কুর দিছ তর দাদায় চিক্কুরে ডরায়। ঘুমের ভিত্রে মইরা যাইব ডরে। তর যেই খাডাশ গলা।

— আইচ্ছা আস্তে চিক্কুর দিমু এমনে হুনেন… ও দাদী দাদীইইই.. এইটুক আওয়াজ দিলে হইব?

— মা শা আল্লাহ হইব হইব যা যা জলদি বারান্দায় যা। দুয়া কর আমারে যেন অকালে অল্প বয়সে মরবার না হয়।

— আল্লাহ গো দাদীরে আমার চুলের সমান হায়াত দেও।

— আমীন আমীন। খাতুন তুই কত ভাল রে।

মিথিকে খাইয়ে শাওয়ারে পাঠিয়েছি। এই ফাঁকে দু’জন ল’ইয়ার বন্ধুকে কল করে মিথি এবং আমার পুরো ব্যাপার নিয়ে কথা বললাম। দুজনেই ঘুম বাদ দিয়ে এই রাতে জয়েন কলে পুরো ব্যাপারটির সবদিক ভাবলো। শেষে আমি কী চাই জানতে চাইলে ডিসিশন জানিয়েছি। ওরা ঘন্টা খানেকের মধ্যে সব গুছিয়ে আসছে জানালো। এমুহূর্তে আইনের সাহায্য ছাড়া এই সিচুয়েশন কন্ট্রোল করা যাবে না। আমার পক্ষে গুণ্ডামি করা সম্ভব নয়। নোমান মামা নেতা গোছের মানুষ। আমাকে মিথির পারিবারিক সম্মানের দিক বিবেচনায় রাখতে হবে। কোন্দলে জড়ানো ঠিক হবে না। যদিও ড্যাড এনাফ বাট সবকিছুতে লড়াই আমার পছন্দ না। যা করার আইনের আওতায় করলে হয়ত একটা শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসবে সবাই।

মিথি শাওয়ার সেরে বের হলো। কুরবানির ঈদে আমাকে ড্যাডির দেয়া উপহার পার্পল কালার পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা সেট পরা মিথিকে দেখে আমি অবাক বিস্ময় চোখে পলক ফেলতে ভুলে গেছি।
অনিমেষ চেয়ে দেখছি সাইজের চেয়ে দ্বিগুণ ঢিলেঢালা পাঞ্জাবীর ভেতরে মিথিকে একটা পার্পল কালার টিউলিপ ফ্লাওয়ারের মত নড়বড়ে লাগছে। হাতের মোবাইল সোফায় ছুঁড়ে ফেলে মিথিকে কাছে টেনে নিলাম। ওর ভেজা চুলের পানিতে আমি ভিজে যাচ্ছি।

— মিথি?

— উমম..

— ভয় লাগছে? দরজা খুলে দেবো?

— না। বুকের ভেতর থাকি? শান্তি লাগছে এখানটায়। এই জায়গটা আমার তো সৌর? কেউ নেবে না বলুন?

কথা বলছে আর আঙুলের নখ দিয়ে আমার বুকে আঁচড় কাটছে মিথি। চোখ ভরা টলটলে জল। বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল ওর ভয়ার্ত চেহারা দেখে।

— শুধুই কী এইটুকু চাই? আর চাই না? সৌরের ভেতর বাহির সবটা শুধুই মিথির। নইলে দেখো না কোথা থেকে কোথা এসেছি। নিয়তি টেনে নিয়ে এসেছে তোমার কাছে।

— আমায় রেখে দিন সৌর। নইলে হারিয়ে যাব চিরতরে। ওরা নিয়ে যাবে আমাকে। সুপ্তি আপু আমার সৌর নিয়ে যাবে।

— উঁহু কেউ নেবে না। ভয় পেওনা, তোমার সৌর তোমারই মিথি। এঘর থেকে তুমি আর কোনোদিন বের হতে পারবে না। তুমি চাইলেও না।

— আমি চাইলেও না?

— না।

— এটা আমার ঘর?

— হ্যাঁ তোমার। শুধুই তোমার। আমিও তোমার।

— ঘুম পাড়িয়ে দিন সৌর। এভাবে ঘুমোবো। শরীর ভাল লাগছে না। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে।

দুর্বল দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে বুকে মুখগুঁজে শরীর ছেড়ে দিল মিথি। হাত পা কাঁপছে মেয়েটার। ভয়, দুর্বলতা দুটোই গ্রাস করে নিয়েছে ওকে। আমাকে হারানোর ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। পাগল মেয়েটা জানেই না সে এমুহূর্তে
পৃথিবীতে সবচাইতে সুরক্ষিত অবস্থায় আছে।
গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিয়ে মিথিকে অনেকটা কোলের ওপর নিয়ে ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে দিলাম। বাহিরে শোরগোল। দরজায় ক্রমাগত টক টক টোকা পড়ছে।

ড্যাডি ডাকছে,
— সৌরভ ওপেন দ্যা ডোর! পাগলামি করিস না বেটা। ওরা মিথিকে নিতে এসেছে।

এসব শুনে মিথি আমাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্ত করে পিঠ খামচে ধরলো।

— ভয় নেই মিথি। কেউ নেবে না তোমাকে। গান শুনবে? পিয়ানোর সুরহীন কন্ঠে?

— হুউউউ শুনব।
সৌরের কন্ঠই আমার পিয়ানোর সুর। আই লাভড ইওর ভয়েস টোন সৌর।

— লাভ ইউ বেইবি!

— উইল ইউ ম্যারি মী সৌর? আমাকে বউ বানিয়ে নিন না। নইলে আব্বু এসে আমাকে নিয়ে যাবে।

আমার সমগ্র শরীর
কেঁপে উঠলো মিথির আদুরে আবদারে। এই মেয়ে তো জানেই না ও বলার আগেই মিথির সৌরের বিয়ের সানাই বেজে উঠেছে।
আলতো করে ওর কান্নারত কম্পমান ভেজা ঠোঁটে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললাম,

— দিস ইজ লাস্ট কিস ফ্রম ইওর বয়ফ্রেন্ড সুইটহার্ট!

মিথিও ভেজা চোখে মিষ্টি করে হেসে আমার ঠোঁটে টুপ করে চুমু খেয়ে বলল,
— মী টু মাই বিলাভড!

পরম সুখে নিমগ্ন চিত্তে
মিথিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছি। পোষা বেড়ালের মত গুটিসুটি মেরে পড়ে রইলো সৌরভের স্বপ্নকন্যা।
মন কখন জানি এমনিতেই কন্ঠে সুরের ধ্বনি তুলে গাইতে আরম্ভ করলো,

“জড়োয়ার ঘোমটা পরে

ফুলের বাসরে

সেজেছে সুন্দরী রাত

জোছনা শিশিরে

এই মিষ্টি রাতেই আমি চাই

তোমার ছোঁয়া

মহুয়ার গন্ধ ধরে

রাতের আঁচলে

বসেছে মনের ময়ূর

চোখের কাজলে

ঐ দৃষ্টি থেকেই আমি চাই

প্রেমের ছোঁয়া

নীল চাঁদোয়া….

আকাশটাকে আজ লাগছে যেন

মাঝে মাঝে কিছু কিছু তারা বোনা… বৃষ্টি ধোয়া”

চলবে…….

পিয়ানোর সুর
#২১পর্ব

ঘরের মেইন ডোর খোলা তারপরও ডোরবেল বাজাচ্ছে। এদিকে সৌরভ মিথিকে নিয়ে ওর রুমের দরজা আটকে বসে আছে। নাওয়াজ ভাই, নীলিমা ভাবী মুরুব্বী মানুষ। এদের সামনে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। নানান দুশ্চিন্তায় ডোরবেল কে বাজায় দেখার জন্য এগোবো আমার আগেই সুপ্তি দৌড়ে গেল। কী দেখলো কে জানে ভয়ে উল্টো দৌড়ে ফিরে এসে ওর বাবার পাশে মানে আমার বন্ধু নোমান হায়দারের পাশে গা ঘেঁষে বসল। বলল,

— বাবা পুলিশ সাদা পোশাকে এসেছে।

সবাই থ বনে গেছে। দেরি না করে দরজার কাছে এলাম। সত্যি সত্যি সাদা পোশাকে দু’জন পুলিশ অফিসার সাথে নিয়ে সৌরভে দুই ব্যারিস্টার বন্ধু জুনায়েদ ও মারুফ এসেছে। চোখ ইশারায় কথা বলে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না এ কার কাজ হতে পারে। অবাক হতে ভুলে গেলাম ওদের ঠিক পাশেই পেছনে সারি হয়ে দাঁড়ানো দুজন মৌলভী গোছের মানুষ।

আমার বিজনেস রিলেটেড ওয়েতে পরিচিত হয়েছিল সৌরভ জুনায়েদের সাথে দেশে আসার মাস কয়েক পরেই। মারুফ হলো জুনায়েদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অফিসে টু অফিস বার কয়েক যাতায়াতে সৌরভের সাথে ওদের দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য তা জুনায়েদের চেষ্টায়। সৌরভ হুট করে মিশতে পারে না বুঝে নিজেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল। এই মাঝ রাতে ওরা বন্ধুর সাহায্যে এগিয়ে এসে প্রমাণ করে দিয়েছে, আমার অনুমানের চাইতে অনেক বেশি গভীর এদের বন্ধুত্ব।
সালাম বিনিময় শেষে জুনায়েদ আগে কথা বলল খুব নীচু স্বরে,

— চাচা সৌরভ কোথায় ওকে ডেকে দিন প্লীজ। আর ভেতরে যারা আছেন তাদেরকে বলুন পুলিশ এবং সৌরভের ল’ইয়ার এসেছে।

স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললাম,
— আমার বলা লাগবে না অলরেডি প্রচার কার্য সম্পাদন হয়ে গিয়েছে। যাও নিজেরাই ডেকে নাও বন্ধুকে। দরজা আটকিয়ে বসে আছে।

হাসি চেপে মারুফ দরজায় দাঁড়িয়েই কল দিল সৌরভকে।
এরপরের ঘটনাগুলো
মনে হলো স্বপ্নে দেখছি। এ বাস্তব হতেই পারে না।
সৌরভ ওর রুমের দরজা খুলে বের হয়ে এল। বাইরে থেকে রুম লক করে বসল ওদের নিয়ে লিভিং রুমেই।
এক্ষুণি বিয়ে।
নাসিম বাদে হায়দার ফ্যামিলির সবার মাথায় বাজ পড়লো। কারো কোনো তোয়াক্কা বা অনুমতি নেয়ার ধার ধারছে না সৌরভ। শুধু নাসিমকে অনুরোধ করলো মিথির বাবাকে কল দিয়ে বিয়ের ব্যাপারে অনুমতি নিতে।
নাসিম আধঘন্টা চেষ্টা করে মিথির বাবা নওশাদ চৌধুরীকে রাজি করাতে পারলেও মিথির মা মিতা রাজির হয়নি। দাদা দাদী কেউ না। মিথিকে ভিডিও কলে ওর বাবার সাথে একলা কথা বলতে দেয়া হলো।
তারও ঠিক আধঘন্টা পর সৌরের রুম থেকে ওয়াটার কালার ট্রান্সপারেন্ট জামদানী শাড়ীর ওপর মিল্ক হোয়াইট ও গোল্ডেন সুতোর বুননের আউটফিটে মিথি বের হয়ে এল সৌরভের রুম থেকে।
গা ভর্তি এন্টিক কালারের লালচে সোনার গহনায় জ্বলজ্বল করছে আমার সৌরভের ভাবিবধূ। মাথায় মুক্তোর টায়রায় ছেয়ে গেছে ছোট্ট কপাল। চুলের সিঁথির দুই ধারে সৌরভের দাদীর বিয়ের সোনার ঝাপটা। উত্তরাধিকার সূত্রে লিয়ানার পরে মিথির পাবার কথা। আমি মিথিকেই দিয়েছি। মেয়েটিকে দেখলেই যে আমার মায়ের চেহারা চোখে ভাসে।

লিয়ানা ফিরবে যেদিন সেইদিনই আমাদের বিয়ে মিথির এই প্ল্যান শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার সৌরভের বউয়ের জন্য মণিহার জুয়েলার্সে নিজে গিয়ে সবার আগে মনের মত যা যা পছন্দ হয়েছে সবগুলো অলংকার কিনেছি। তারপর লিয়ানার জন্য।
আজই বিকেলে গিয়ে একফাঁকে কিনে নিয়ে এসেছিলাম। আমার দুই বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রীরা এব্যাপারে টুকটাক হেল্প করেছিল। লিয়ানার জন্য ট্রাডিশনাল লাল বেনারশী কেনার পাশাপাশি মিথির জন্য নিয়েছি ট্রাডিশনাল ওয়াটার কালার ট্রান্সপারেন্ট জামদানী কাতান। সৌরভের প্রিয় রঙ।
আমাদের বিয়ের
পর পরই সৌরভ, মিথির বিয়ের প্রস্তাব দেবো মিথির বাবাকে, এমনই প্ল্যান ছিল। ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি বাবা মায়ের আগে ছেলের বিয়ে হয়ে যাবে।
আপাতত, আকদ।
আগামীকাল মিথির বাবা এলে দিনক্ষণ ঠিক করে জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠান হবে।
কী অদ্ভুত,
নিজের ভাবিবধূকে ভাবিবর নিজেই সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। হায়দার পরিবারের ওর মামীরা, কাজিনরা কেউ এগিয়ে আসেনি। অবশ্য মিথিকে সাজাতে ওর মেঝোমামা আর ছোটমামা নাসিম দুজনে সাহায্য করেছে সৌরভের পাশে দাঁড়িয়ে। ভাগ্যিস আড়ংয়ের শো রুমে তাগা সেকশনে মেনিকুইনকে পরানো সাদা জরির কাতানের টপস আর লংস্কার্ট মিথিকে দারুণ ফিট করে গেছে। নইলে বিয়ের শাড়ীর সাথে হুট করে কী পরতো মেয়েটা। এরবেশি কোনোকিছুই যে কেনাকাটার সুযোগ পাইনি। আমার ভাবনার মাঝখানে
হন্তদন্ত হয়ে শেফ থালাভরা বাতাসা, এরাবিয়ান খুরমা খেজুর আর সফট ড্রিংকসের ট্রলি নিয়ে হাজির। আল্লাহ বাঁচিয়েছে যে দুইদিন পরের বিয়ের চিন্তা করে অল্পস্বল্প বাজার করে রেখেছিলাম।

বাবা সাদমান আশরাফি মৃধার চোখ জুড়িয়ে দিতে শীতল হাওয়ার বোরাকে চড়ে বুঝি আমার প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র সালমান আশরাফি মৃধা সৌরভ শ্বেতশুভ্র কাবুলি আউটফিটে শোয়েবের সাথে আমার বেডরুম থেকে খানিকটা হতভম্ব চেহারা নিয়ে বেরোলো। বেচারা বুঝতেই পারেনি বাবা তাকে আর মিথিকে নিয়ে কতটা এডভান্স চিন্তা করে রেখেছিলাম। ছেলের দিকে তাকিয়ে বা’চোখ টিপে দিলাম। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে মুচকি হাসলো মিথির সৌর।
বদনজর না লেগে যায় তাই সবার আগে আমিই জোরসে বলে উঠলাম,
— মা শা আল্লাহ আমার ছেলেমেয়ে দুটোকে রাজপুত্র রাজকন্যা লাগছে!

অমনি ঘরভর্তি সবাই ইচ্ছে এবং অনিচ্ছে সুর তুলে বলল,
— মা শা আল্লাহ!

রাত্রির তৃতীয় ভাগের প্রথম প্রহরে লিভিং রুমে সবুজ গালিচা পেতে মিথি সৌরভকে মুখোমুখি বসানো হলো। ওদের দু’জনকে ঘিরে কাজী, ইমাম ও সৌরভের দুই বন্ধু বসলো। মিথির তিন মামা মেয়ে পক্ষের গার্ডিয়ান ও সাক্ষ্যদাতা হিসেবে গালিচায় কাজির পাশে আসন নিয়ে বসলে শোয়েব ওর মায়ের অগ্নি দৃষ্টি উপেক্ষা করে সৌরভের পাশে বসে পড়লো। সুপ্তি উঠে বের হয়ে যেতে নিলে নোমানের ধমকে থেমেছে। মামীদের মুখ ছাইবর্ণ।
বিয়ে পড়ানো শুরু হলো।

ফাঁপড়ে পড়লাম সবাই
কাজী কবুল বলতে বললে মিথির সর্বাঙ্গে কাঁপুনি শুরু হলো। ওর মামারা, আমি আমরা সবাই ওকে সাহস দিচ্ছি।
কাজের কাজ কিছুই হয়নি। না পেরে লাজলজ্জা ভুলে মিথির মাথা ঢেকে দেয়া লাল টুকটুক জামদানী ওড়নার ভেতরে টুক করে ঢুকে পড়লো সৌরভ।
এদিকে আমরা মুরুব্বীরাও কম যাই কীসে! সবাই হো হো করে হেসে ফেললাম। আমার মনে হলো, এই হাসির গুঞ্জনই আমার সৌরভের বিয়ের সানাইয়ের সুর।

কমবেশি সবাই চোখ সরিয়ে নিয়েছি ওদের দু’জন থেকে। একটু পরেই শুনি মিথি কথা বলছে। বিস্ময় চোখে চেয়ে দেখি ওড়নার ভেতরে সৌরভ নিজের মোবাইল ফোন থেকে মিথির বাবাকে ভিডিও কল করেছে।
বাবা, মেয়ের কী দারুণ বন্ধুত্ব। মিথির কাঁপন থেমে গেছে কখন খেয়াল করিনি। এটা-সেটা নিয়ে মেয়েকে নানান কথা বলে স্বাভাবিক করতে মিথির বাবার একমিনিটও লাগলো না। খেলাচ্ছলে কবুল বলে নওশাদ সাহেব কীভাবে মিথির মাকে বিয়ে করেছিলেন সেই গল্পটাও বলে দিলেন।

বাবার কথা শেষ হতেই মিথি বলল,
— বাবা কবুল কী বলব?

— হ্যাঁ মা বল।

— বাবা তোমার হাত ধরতে ইচ্ছে করছে। পাশে থাকো বাবা।

— আমি তোর পাশেই আছি। ভয় লাগছে মামণি?

— হুউউউউ। তুমি এলে কবুল বলি?

— তোর পাশে কে আছে যাকে তুই আমার মতন ভালোবাসিস। ভয় লাগে না এমন কে আছে?

— দু’জন আছে।

— দু’জনের হাত ধরে বোস তো
আমি দেখি কে সে, যে আমার জায়গা নিয়ে নিল, তার এত বড় দুঃসাহস!!

ঘরভর্তি মানুষ, কাজী, ইমাম সম্মুখের বসে। এদের মাঝে সাতরঙা জৌলুশ ছড়িয়ে মাঝে যে মুক্তোটি আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে, সে সবার হার্টবিট মিস করিয়ে হঠাৎ আড়াই হাত ঘোমটার আড়াল থেকে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

এবং পরক্ষণেই
সে তার চারদিক ইকো করে সশব্দে বলল,

— কবুল কবুল কবুল।
বাবা দেখো,
কবুল বলে দিয়েছি একটুও ভয় লাগেনি।

নওশাদ সাহেব সহ সবাই মিলে সমস্বরে ধ্বনি তুলে বলছি,
— আলহামদুলিল্লাহ!

সৌরভ আর বের হয়নি
মিথিকে ঢেকে রাখা ঘোমটার ভেতর থেকে। সে ওভাবেই কবুল বলে এজিন দিয়েই মিথির ঠোঁটে চুমু খেলো। ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিকভাবেই করেছে সে। যেন মিথিকে চুমু খাওয়ার জন্য তাকে কিছু ভাববার বা দেখবার প্রয়োজন নেই। আসলেই কী নেই?
লজ্জায় সবার মাথা হেট!
ছেলে আমার হইয়াও হইলো না। আধেক তার মায়ের মতই বৃটিশ রইয়া গেল।

বিয়ে পড়ানো শেষ হলে সবাইকে মিষ্টিমুখ করতে বাধ্য করে ছাড়লো সৌরভের ল’ইয়ার দুই বন্ধু। পুলিশ অফিসার দু’জনের মেকি গাম্ভীর্য বেশ ভালোই কাজে দিয়েছে। ভয়ে ভয়ে সুপ্তি এক টুকরো বাতাসায় কামড় দিয়ে কেঁদে ফেললে আরেক ধাপ লজ্জায় পড়লো হায়দার ফ্যামিলি। ও বাড়ীর সদস্যদের মধ্যে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসছে শুধুই মিথির সুদর্শন ব্যাচেলর মামু নাসিম হায়দার। মনে হচ্ছে, বিয়েটা বুঝি ওরই।

একে একে সবাই বিদায় নিতে উঠলো। মিথিকে নিয়ে যেতে চাইলো মিথির বড় মামা। কাল ওর মা বাবা এলে আনুষ্ঠানিক ভাবে মেয়ে তুলে দেবে বলল।
বন্ধু নোমানের বড়ভাই। আজীবন আপন বড়ভাই তুল্য সম্মান করেছি। এমন কথা বললে তার বিপরীতে কথা বলার ধৃষ্টতা কীভাবে দেখাই বুঝতে পারছি না।
কারণ, যেই মিথিকে যেতে দেবে না বলে এতকিছু করা সৌরভের। সে’ই মিথিকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব শুনে আরো একবার নির্লজ্জের মত অঘটন ঘটিয়ে বসলো সৌরভ। এবার মারাত্মক লেভেলের লজ্জায় পড়েছি আমি। বাপ হই। ছেলে আমার বাপের বাপ মনে হচ্ছে।
গালিচায় বসা থেকে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে, বসে থাকা মিথিকে দু’হাতে কোলে তুলে বুকের সাথে চেপে ধরলো সৌরভ।
পুত্র তো রসাতলে আগেই গেছে, এবার পুত্রবধূ মিথিও গেল। সোনার চুড়ি পরা ভরা দু’হাতে সৌরভের গলা পেঁচিয়ে ধরলো মিথি। ধরেই সে কী কান্না। যাবে না সে।

সৌরভ অস্বাভাবিক কঠোর গলায় বলল,
— ড্যাড অনেক রাত হয়েছে, আমরা ঘুমোবো। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো, সুইট ড্রিমস। বাই এভ্রিওয়ান।

এরপর কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মিথিকে ওভাবে নিয়েই সৌরভ ওর রুমে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
ঘরভর্তি মানুষ চোখ বড় বড় করে আমার দিকে চেয়ে। আমি কী রিএকশন দেবো বুঝেই পেলাম না।

তার আগেই
মিথির মিষ্টি মধুর কন্ঠস্বর সৌরভের শোবার ঘর থেকে ভেসে এসে আমাদের সবাইকে কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।
চোখ ভিজে ওঠেনি এমন একটি মানুষ নেই এখানে। নাসিমকে জড়িয়ে ধরে শোয়েব অকারণ ফুঁপিয়ে উঠলো। উপস্থিত প্রত্যেকেই উপলব্ধি করছি সৌরভের প্রতি সর্বদা আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকা মিষ্টি আদুরে মেয়ে মিথি
কী অপরিসীম ভালোবাসা গোপনে লালন করে এসেছে। সে তার সৌরভকে পাবার আনন্দেই বুঝি লোকলজ্জা ভুলে কান্নাভেজা ধরা গলায় গাইছে,

“তুমি ছাড়া প্রহরগুলো

বছর মনে হয়

সাথী হারা আমার সাথে

সময় থেমে রয়

ওগো তুমি ছাড়া আর কাটে না সময়….

স্মৃতির সাথে কথা বলা

সে আর কতক্ষণ

একা থাকার দারুণ জ্বালা

সহে না তো মন

শুধু অচেনা অবুঝ ব্যথা

মন ছুয়ে রয়…. সেকি জ্বালাময়

তোমার কাছে চেয়ে থাকার

উদাস দুটি ক্ষণ

লোনা জলের সোহাগ মাখি

ফেলে না পলক

সে যে তোমাকে হারাই যদি

সেই ভয় হয়…. শুধু সেই ভয়

তুমি ছাড়া প্রহরগুলো বছর মনে হয়….”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে