পিয়ানোর সুর পর্ব-২২

0
430

পিয়ানোর সুর
#২২শেষপর্ব

— চাঁদ কপালি আমার মিথুমণি চাঁদ কপালি বুঝলা সাফিয়া তুমার সুপ্তির লাহান না। কী কমু, নিজেরই বেটার বেটি হয়। মন খুইল্যা দুইখান গাইল পাড়তে পারলে সিনায় আরাম পাইতাম। কী করলি সুপ্তি বুড়িরে তুই। তরা মা ঝি মিইল্যা কী পিডানডি দিছোছ আমার মাইয়ার ঝিয়েরে। এলা আইব, বুঝিস, দেহিছ কী করে তোগোরে মিতায়, নওশাদে। আমি ছব কমু, ছব কইয়া দিমু। অই খাতুন?

— জ্বি দাদী, কন হুনতাছি।

— হিছাব রাহিছ। মিতারে ছব কইতে হইব। ভুইল্যা গেলে মনে করায়া দিছ।

— আইচ্ছ্যা দিমুনে, অহন লন ঘুমাইবেন।

— আরে রাখ তর ঘুম! নওশাদ রে কমু অর মাইয়ারে অর সমুন্ধির বউরা মিইল্যা কেমতে মারছে, অত্যাচার করছে। মুবাইলের ভিডিওডি ঠিকঠাক করছিলি তো? অই খাতুন কছ না ক্যালা, ঠিকঠাক রেকর্ড করছিলি?

— হ দাদী ছব করছি। দাদার মুবাইলে আছে। আরেক বার চেক কইরা লন।

খাতুন আর আম্মার কথা শুনে তিন ভাবীর চেহারা শুকিয়ে গেল। ভাইয়াদের একই অবস্থা। সৌরভদের বাসায় মিথিকে রেখে এসেছি, মিথির বিয়ে সৌরভের সাথে হয়েছে, মিথিকে এবাড়ীতে আসতে দেবে না সৌরভ, নওশাদ ভাই আর মিতাও আসবে না এবাড়ী, তারা ঢাকায় এসে সরাসরি মিথির শ্বশুরবাড়িতে উঠবে, ইত্যাদি সবিস্তারে শুনে আম্মার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনিও থাকবেন না এবাড়ী। যে বাড়ীতে তাঁর মেয়ে, মেয়ের জামাই উঠবে না সেই বাড়ীতে আম্মা থাকবে না। সাদমান’দাকে একটু আগেই জানিয়ে দিয়েছেন ওনার থাকার ব্যবস্থা করতে। উনি নাকি নাত্নীর বিয়ের যৌতুক হিসেবে নাত্নী জামাই সৌরভের কাছেই থাকবেন। সাদমান’দা হাসতে হাসতে এই যৌতুক সানন্দে গ্রহণ করেছেন তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন আব্বাকে সহ যৌতুক চায়। আম্মা কথা দিয়েছেন আব্বা ঘুম থেকে উঠলেই উনি সাদমান’দাকে ফোন করে বলে দেবেন এসে নিয়ে যেতে। পালকি আর ঘোড়ার গাড়ী পাঠাতে বললেন। সাদমান’দা রাজি। সকাল হলেই উনি নিজে এসব নিয়ে হাজির হবেন।

আমার মাথায় ঢুকছে না, এবাড়ী আর ওবাড়ী এক কদম দূর না, সেখানে ঘোড়ার গাড়ী এনে কী হবে? পালকি হলেই তো হয়। নানী যাবে নাত জামাইয়ের বাড়ী। পালকিই যথেষ্ট বলতেই আম্মার সেকি ঝাড়ি। ব্যাখ্যা দিলেন,
ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ে ব্যাণ্ড বাদক নিয়ে পুরো ওয়ারি এলাকা থেকে শুরু করে আহসান মঞ্জিল, বুড়িগঙ্গার পাড়, নাজিরা বাজার সহ পুরান ঢাকার সবদিক রাউন্ড দিয়ে তবেই পৌঁছবেন নাত জামাইয়ের বাড়ী।
আম্মার ফিরিস্তি শুনে খাতুন মাটিতে গড়াগড়ি করে হেসেই শেষ।
আমারও পেট ফেটে যাচ্ছে হাসিতে কিন্তু হাসতে পারছি না। বড়’দা, মেঝ’দা, সেঝ’দা রাগে চক্ষু লাল করে বসে আছেন যার যার বউদের ওপর। বড়’দা নীলিমা ভাবীকে বলে দিয়েছেন,
তাঁর আব্বা, আম্মা এবাড়ী থেকে এক পা চৌকাঠের বাইরে ফেললে ভাবীও যেন তার বাবার বাড়ী চিরতরে চলে যায়।
বড়’দার সাথে হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলালেন মেঝ’দা সেঝ’দা।
স্বামীদের জেদি কন্ঠস্বর শুনে সেই তখন থেকেই তিন ভাবী মিলে আম্মার হাত পা ধরে বোঝাচ্ছেন একাজ যেন না করেন, তাঁদের সংসার ভেঙে যাবে। আম্মা যা বলবেন তাই শুনবেন।

এদিকে,
আমার আম্মা তো আমার আম্মা। এতদিন মুখ বুঁজে মিথির কষ্ট সবচাইতে কাছথেকে দেখেছেন তিনি। আমি ছাড়া অন্য কাউকে মিথির পাশে পাননি। আব্বা, আম্মা যা যা ঘটতো সবকিছু আমাকে গোপনে বলে দিতেন। যার কারণে আমি শুরু থেকেই মিথিকে আগলে নিতে পেরেছিলাম। এমুহূর্তে আমি বাদে বাসার সবাই বিপদগ্রস্ত। আম্মার চোখের মণি হয়ে বসে আছি মুখে কুলুপ এঁটে। কারো পক্ষে নেই আমি। আম্মা যা বলবেন তা’ই হবে।

সবাইকে যার যার ঘরে যেতে বলে আম্মা খাতুনকে নিয়ে বসলেন তাঁর বিয়ের গহনা ভাগ করতে। তিন ভাবীকে তিন জোড়া হাতের চুড়ি দিয়ে বাকি সব জড়োয়া সেট মিথির বিয়ের জন্য দেবেন বলে প্যাক করছেন। তা দেখে অন্যান্য নাতী নাত্নীরা এই ভোর রাতে চিল্লাফাল্লা শুরু করল তাদের ভাগ কোথায় বলে।
এইসব শোরগোলের মধ্যে শোয়েবটা জোর গলায় বলল,
— আমার বউয়ের ভাগ মিথিকে দিয়ে দাও দাদী। আমার ভাগে এবাড়ীর সহায় সম্পত্তির যা কিছু হয় সব মিথি, সৌরভকে দিয়ে দাও। এটাই আমার তরফ থেকে ওদের ওয়েডিং গিফট।

কথাটা বলে আর দাঁড়ায়নি শোয়েব। দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। ওর চোখের পানি আম্মার নজর এড়ায়নি। অস্ফুটস্বরে বললেন,
–সোনার খনি বানের জলে ভেসে গেলে তহন হুঁশ হয় কী গেল, কই গেল। আমার শবুটার চক্ষের পানিতে হায়দার বাড়ী ভাইস্যা যাওনের আগে ও নাসিম যা তো বাপ, শবুর কাছে যা, অর কান্দন থামা। অরে ক অর এই দাদী, মিথুমণির লাহান বউ আইন্যা দিব অর লেইগ্যা। অর মা বাপের পছন্দে বিয়া দিম না আমি আমার নাতী রে।

আম্মা কাঁদছে। শোয়েব, মিথির জন্য। ওঁনার আর আব্বার সুপ্ত ইচ্ছে ছিল মিথিকে শোয়েবের বউ করে এবাড়ীতে রাখার। শুনে, তিন ভাবী চরম অপমান করেছিলেন আব্বা, আম্মাকে। ভাইয়ারা সে কথা জানতেন না। জানলে ভাবীদের খবর করে ছেড়ে দিতেন আব্বা, আম্মাকে অপমান করার জন্য। আম্মা যা আমাকে গোপন করতে বলেছেন তা নিজেই ফাঁস করে দিলেন এখন। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে খাতুন সেই অপমানের ভিডিও রেকর্ড, আব্বার মোবাইল থেকে প্লে করে দেখাল। সেটা দেখেই মূলত ভাইয়ারা রেগেমেগে আগুন। মেঝ’দাকে জীবনের প্রথম আফসোসের বিলাপ করে কাঁদতে দেখছি তাঁর একমাত্র ছেলে শোয়েবের কষ্ট অনুভব করে।
সুপ্তি আর ভাবীরা বাদে বড়’দার বসার ঘরে চোখে পানি নেই এমন কেউ নেই।
সুক্ষ্ম আফসোসের ডঙ্কা আমার মনেও বাজল। আহা, আমার মিথিটা এ বাড়ীর বউ হয়ে থাকলে কতইনা ভালো হত।
পরক্ষণেই ভাবছি,
সৌরভ আজ যেভাবে সবার বিপক্ষে গিয়ে মিথিকে নিজের সাথে বেঁধে নিয়েছে, শোয়েব কী পারত অমন সাহসী হতে? হয়তো পারত। কিন্তু আমার ‘হয়তো’ নিজের মনে শুনতে জোরালো লাগছে না। সৌরভের পৌরুষ দীপ্ত চেহারাটা ভাবনায় এলে ওর ঐ চেহারার পাশে
মিথির নরম আদুরে মুখখানি উদ্ভাসিত হল। যেখানে শোয়েব বড় বেমানান, অস্তিত্বহীন একেবারেই।

মেঝ’দার ক্ষীণ ভঙ্গুর কন্ঠস্বর শুনে চকিতে ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরেছি।
মেঝ’দা বললেন,
— নাসিম, শোয়েবের পাশে যা। কলেজ শিক্ষক হলেও ছেলেটা আমার শিশুর মতন,ভীষণ আবেগী।

— কিন্তু শোয়েব ওর ঘরে মেঝ’দা। কীভাবে যাই!

— না রে। দেখ গিয়ে তোর চিলেকোঠার আশপাশেই আছে। দুদিন আগে ওখানেই মিথিকে দেখে ছেলেটা আমার….

আর বলতে পারলেন না মেঝ’দা। কন্ঠ রোধ হয়ে এল দলা পাকানো যন্ত্রণায়। বুকটা হু হু করে উঠল। দ্রুত পায়ে ছাদে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

মেঝ’দার অনুমান সত্যি।
শোয়েব ছাদের দোলনায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কেমন নিথর দেহে।
পাশে বসে মাথায় হাত দিতে না দিতে আমার কোলে মাথা রেখে শোয়েব ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল,

— বড্ড দেরি হয়ে গেল ছোট’কা, বড্ড দেরি করে ফেললাম। মা, কাকীদের কথা বিশ্বাস করে মিথিটাকে ভীষণ অবহেলা করেছি। কতবার যে মেয়েটা আমার আশপাশ দিয়ে পায়ে পায়ে ঘুরেছে। কুরবানির ঈদের দিন সব ভাইবোনকে নিজহাতে ঈদি দিয়েছি। হাত পেতেছিল মিথিও। মা টেনে সরিয়ে দিয়েছিল মিথিকে। পরে খাতুনের হাতে ঈদি পাঠিয়েছিলাম ওরজন্য।
ছোট’কা
ঈদিটা যদি নিজহাতে দিতাম, বল না মিথিটা আজ আমার হত, তাই না? বল না ছোট’কা, মিথি আমার হত?

গভীর নিঃশ্বাস বুকে চেপে ভাতিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
— হ্যাঁ, হয়তো তোরই হত। কারণ, তখনও সৌরভ মিথিকে দেখেনি, চেনেনি, জানেনি। স্রেফ বারান্দায় রাতের অন্ধকারে এক ঝলক দেখা। অনুভূতি তৈরি হয়েছে তারও অনেক পরে, সৌরভ যেদিন সন্ধ্যায় ওর বাবার সাথে বড়’দার ঘরে এসেছিল। আম্মার ঘরের বারান্দায় মিথিকে কাঁদতে দেখে সৌরভ এগ্রেসিভ হয়ে উঠেছিল মিথির জন্য। ছেলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, সাদমান’দা আমাকে ওদের দু’জনের সম্পর্কের কথা সেদিনই জানায়।
হ্যাঁ রে শোয়েব,
ঈদি নিজহাতে দিতি যদি, হয়তো আমার মিথিটা সবার দ্বারা এমন করুণভাবে উপেক্ষিত হত না। তুই ঠিকই বাঁচিয়ে নিতি। দোষ আমার ভাইদেরও। যাক, বাদ দে।
এখন ওঠ। ফ্রেশ হ। আমাদের এখন কত কাজ বাকি। মিথির বিয়ের সব দায়িত্ব তোকেই নিতে হবে। মিথিকে ওর মনের মত শপিং করিয়ে দিতে তুই নিবি হায়দার বাড়ীর পক্ষ হতে। তুই ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাস নেই।

আমার কোনো কথাই শোয়েবের কানে ঢুকল না। আরও ছটফট করে উঠল ছেলেটা। ডানাভাঙা পাখির মত ব্যথায় ককিয়ে উঠে বলল,

— ছোট’কা আমার বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে জানো। অসহ্য যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। দুদিন আগেও এই যে দেখ, ঠিক ওখানটায় কলের পাশে দাঁড়িয়ে মিথিকে
মনেমনে নিজের ভবিষ্যৎ বউ ভেবে অনেক অধিকার নিয়ে, ওর ওড়নার আঁচলে আমার ভেজা হাতমুখ মুছেছি।
হাত ধরে নিয়ে গিয়েছি আমাদের ঘরে। একসাথে ব্রেকফাস্ট করেছি। খেতে বসে আম্মুর অবহেলায় কাঁদছিল মিথি ডাইনিংয়ে।
এই যে দেখ
আমার এই দু’হাতের করতলে ওর কোমল মুখখানি রেখে, চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিয়েছিলাম। এত অল্পতে কাঁদে মেয়েটা।

এইটুকু বলে আচমকা জোরে কেঁদে উঠল শোয়েব। রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— ছোট’কা,
মিথিকে এনে দাও ছোট’কা… মরে যাচ্ছি আমি।

শোয়েবের হু হু কান্নার জলে আমার কোল ভিজে যেতে লাগল। কখন যে নিজের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াতে শুরু করেছে নিজেও বুঝিনি। আমি এ বেদনার ভার কেমন করে বইব বিধি, বলে দাও।

নিজের রুমের দরজার কপাটে পিঠ ঠেকিয়ে সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। আমার এলোমেলো অগোছালো ঘর আলোকিত করে বসে আছে মিথি। দরজা থেকে খাটের দূরত্ব ঘোচাতে হিম শীতল রুমে রীতিমতো সোয়েটিং হচ্ছে আমার।

এইতো একদিন আগেই পুরো একটা রাত কাটিয়েছি আমরা একসঙ্গে। কিছুই মনে হয়নি। কী সাহসী ছিলাম।
আর এখন, এইমুহূর্তে পা নড়ছে না। আমার স্বপ্ন বসে আছে ডানা মেলে আমারই ব্যক্তিগত রুমে। যেখানে আজকের আগে অন্য কোনো মেয়ের প্রবেশাধিকার ছিল না। বিগত দুই বছরে কেউ আসেনি।
যে এল, একেবারে চিরদিনের জন্য এল।

— মিথি!

ভীষণ মিষ্টি করে উত্তর এল,
— হুউউ..

— কাছে আসি?

লাল টুকটুক ঘোমটার ভেতর থেকে দু’হাত ভরা সোনার চুড়িতে ঝঙ্কার তুলে তার চাঁদ রঙা হাত দুটো, আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিথি বলল,
— আসুন।

প্রচণ্ড মেঘের গর্জনে ঘরের আলো নিভে গেল। অন্ধকারে মিথি আমার চোখে আনন্দাশ্রু দেখতে পেল না।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।
ঘরের জানালা, ব্যালকণির দরজা খুলে দিয়ে মিথির পাশে এসে বসলাম। ওর বাড়িয়ে দেয়া হাতদুটো অন্ধকারে গুটিয়ে নিয়েছে। সেই হাতদুটো ধরে টেনে আমার কোলের ওপর বসিয়ে মাথার ওড়না সরিয়ে দিয়েছি মিথির।
বলল কাছে আসুন।
আসার পর কেমন কাঁপছে দেখ।
আইপিএস এর কল্যাণে সিলিং ফ্যান চলছে।
গুমোট গরম তবু কাটছে না। ইলেক্ট্রিসিটি কখন আসবে কে জানে।

— মিথি
পাঞ্জাবী খুলে দাও, গরম লাগছে।

কোলের ওপর বসে থাকা মিথি লজ্জায় গুটিসুটি মেরে, হাতে চুড়ির রিনিঝিনি ঝঙ্কার তুলে আমার পাঞ্জাবীর বোতাম খুলছে।
আধো আলো,
আধো অন্ধকারে মিথি যেন চন্দ্রিমা।
রাতের আকাশে মেঘে মেঘে ঘর্ষণে সৃষ্ট বিদ্যুৎ চমকানোর আলোর আভায়, স্পার্ক করছে মিথির সর্বাঙ্গ।
পাঞ্জাবী খুলে মিথি যত্ন সহকারে ভাঁজ করে, ওটা রাখার জন্য কোল ছেড়ে উঠতে নিলে জড়িয়ে কাছে টেনে নিলাম।
ফিসফিস করে বললাম,

— এবার
আমার পালা। অনুমতি দাও মিথি।

মিথি লজ্জায় মিইয়ে পারে তো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমি চুমুর কোমল স্পর্শে মিথির গা থেকে একটি একটি করে অলংকার গুলো খুলে নিচ্ছি। আমার কোনোকিছুতে সে বাঁধা দিচ্ছে না। বরং নীরব সম্মতিতে কেমন তিরতির করে প্রতিটি উষ্ণ স্পর্শে কাঁপছে।
এত নরম, এত স্নিগ্ধ কোনো মেয়ে হয়!
নিজেকে দূরে না সরিয়ে
আরো গুটিয়ে আমার কাছে এল মিথি। লাজুক মেয়েটিকে গায়ের ওপর তুলে নিয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে নিলাম নিজেদের।
উঁহু, না, কিছু করছি না আমি। নিজেকে তৃষ্ণার্ত, কামার্ত একদম অনুভব করছি না।
কেবল, স্নিগ্ধ আদরের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছি মিথির সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে।
আস্তে আস্তে ভয়ের কাঁপুনি থেমে গেল লাজুক মেয়েটির। একটু একটু করে আদর ফেরত দিতে লাগল। এ এক অভূতপূর্ব বিনিময়!
যা এর আগে অন্য কোনো রমণীয় স্পর্শে পাইনি।
মিথির প্রতিটি স্পর্শে আমি, ধীরে ধীরে হয়ে উঠছি শুচি, শুভ্রতায় পরিপূর্ণ, পবিত্র।

— মিথি।

— উমম..

— এমনি এক বৃষ্টির রাতে আমাদের দেখা হয় মিথি তোমার মনে আছে?

চাদরের আড়ালে টুপ করে নিজেকে লুকিয়ে আমার উন্মুক্ত বুকের গহীনে মুখ ডুবিয়ে মিথির নরম ঠোঁটে কথার খই ফুটলো।
— হুউউ… মনে আছে আমার স্বপ্ন পুরুষ!

— আমি তোমার স্বপ্ন পুরুষ!! সত্যি?

— সত্যি।

— কবে থেকে?

— প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকে।

— তুমি দেখতে পাওনি আমায়, মিথ্যুক মেয়ে!

— শুনতে পেয়েছি। কথা বলেছি। অন্ধকারের আলোয় দেখেছি আপনাকে।

সারা গায়ে শিরশিরে হিমেল বাতাস বয়ে গেল মিথির কথার নিগুঢ় অর্থ বুঝে। ওর হরিণী গ্রীবায় মুখ ডুবিয়ে ফিসফিস করে বললাম,

— তুমি করে ডাকো মিথি, প্লীজ! তোমাকে স্বপ্ন লাগছে। চোখ মেললে মিলিয়ে যাবে নাতো?

মিথি এবার নিজে থেকেই ওর নরম হাতের দু’পাতায় আমার মুখ তুলে আলতো ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,

— কামড়ে দিই তোমাকে?
স্বপ্ন ভেঙে যেতে এর জুড়ি নেই। দেব?

— তবে রে দুষ্টু মেয়ে,
তুমি করে ডেকে কোথায় ভালোবাসি বলবে। তা না, সোজা কামড়ে দেয়ার হুমকি!

মিথি লাজুক হাসিতে গড়িয়ে গেল আমার সারা শরীর জুড়ে। কাছে টেনে নরম স্পর্শে ফের ছুঁয়ে দিতেই সব চুপ।
আমার স্বপ্ন
আমারই মাঝে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে একটু একটু করে। আজ আর কোনো ভয় নেই, কেউ দেখে ফেলার।
বাঁধা নেই কোনো
অবাধ্য ছুঁয়ে দেয়ার। বাহিরে ঝড়োবৃষ্টি।
চারদিকের ঘন অন্ধকারে আমার ঘরে, আমারই আদরের স্পর্শে সিক্ত মিথি, চাঁদের পিদিম হয়ে জ্বলছে তার সৌর ভূবনে।
ঝড় উঠলো
ভেতর, বাহির সবখানে।
সৌরভের বুনো ঘ্রাণে সুরভিত মিথি। বৃষ্টি থামলো।
পরম সুখানুভূতি
শরীর, মন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রক্তের শিরা-উপশিরায় বইয়ে দিল প্রশান্তির আমেজ।

অল্প অল্প করে ভোরের আলো ফুটছে। একটি দুটি পাখি ডাকছে। কাছেই কোথাও হতে ভেসে এল মোরগের ডাক।
আদরের ঝড় শেষে
থেমে যাওয়া বলে কিছু থাকে না। বরং বাড়ে। দ্বিগুণ, সহস্রগুণ হারে কেবল বাড়তেই থাকে।
আমার শূন্য বুকের
সারাটা পূর্ণ করে তারওপর নেতিয়ে পড়ে থাকা মিথির শরীরে, বুলিয়ে যাওয়া আঙুলের স্নেহের পরশ মেখে দিচ্ছি।
ভীষণ দুর্বল, ক্লান্ত মেয়েটি ঘুম বাদ দিয়ে আনমনে তার আঙুলের নখ দিয়ে, বিরামহীন আঁকিবুঁকি করে চলছে আমার গলায়, পিঠে, চোখেমুখে, গাল জুড়ে।

— মিথি?

— উম..

— ঘুমোবে? ঘুম পাচ্ছে?

— উমম না। ভাল লাগছে।

— কী ভাল লাগছে, স্পর্শ নাকি চুমু?

— সবকিছু।

‘সবকিছু’ বলেই বুঝলো বেফাঁস বলে ফেলেছে। জিভে কামড় দিয়ে চাদর টেনে মুখ ঢাকলো মিথি। আমি হাসতে হাসতে ওকে নিয়ে গড়িয়ে পড়েছি। আবারও… আবারও.. বারে বার
বেহিসেবী আদরের ঝড় বইয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ মেতে রইলাম সিলভার গ্লিটারের চিকচিক করা মসৃণ, আদুরে, কোমল ত্বকের অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারিণী, আমার মিথিকে নিয়ে।
তারপর,
একরাশ ভালোবাসাময় স্নিগ্ধতা নিয়ে শান্ত, সুস্থির হয়ে মিথির বুকে মাথা রেখে চোখ বুঁজেছি। আমার মাথার চুলে নরম আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে মিথি।

— মিথিবউ!

— উমম..

— ঘুমোবে?

— না। আমার ঘুম আসবেই না।

— আরে আরে কেন!! কত ক্লান্ত তুমি। ঘুম এমনিতে চলে আসবে। এস ঘুম পাড়িয়ে দিই।

— এই না না সৌর, ঘুম আসবে না। ঘুমোতে চাই না।

— কেন?

— তোমাকে পাওয়ার খুশীতে। মনে হচ্ছে, স্বপ্ন দেখছি।

— হায় আল্লাহ! আমারও সেইম ফিলিংস! কেমন মাতাল মাতাল লাগছে। ড্রিংক না করেও যে পুরোপুরি মাতাল হওয়া যায়,
এই প্রথম ফিল করছি জানো!
কিছুতে তুমি নামক ঘোর কাটছে না মিথি। কত কষ্ট দিয়েছ মেয়ে। কী পরিমাণ জ্বালিয়েছ
মুখ লুকিয়ে।

— মুখ দেখে কষ্ট কমেছে?

— না, আরো বেড়েছে। এত্ত সুন্দর তুমি ড্রিমগার্ল!!

— উঁহু, আমার সৌর বেশি সুন্দর। সূর্যের চেয়েও প্রখর তেজ তোমার সৌন্দর্যে, ব্যক্তিত্বে। আমাকে কখনো ছেড়ে যেওনা সৌর।

— নেভার, এভার বেইবি! কখনো যাবো না। আমি তোমাকে চিনি মিথি কিন্তু
জানি না।
তোমাকে জানতে চাই। আমাকে তোমার গল্প বলো মিথি। যেমন আমি বলেছি আমার বত্রিশটি বসন্ত কেমন কেটেছে তুমিহীন। তেমন।
তোমার গ্রাম কেমন
যেখানে তুমি চঞ্চল উচ্ছলতায় বেড়ে উঠেছ?

— আমার গ্রাম কবিতার মত সুন্দর, ছন্দময়।

মিথির কন্ঠায় ঠোঁট ডুবিয়ে বললাম,
— তবে এই আদুরে কন্ঠে,
আবৃত্তি করে শোনাও তোমার সে-ই গ্রামের গল্প। কেমন কেটেছে তোমার শৈশব, বল মিথি।

হঠাতই নীরবতা নেমে এল ঘরজুড়ে। দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ যেন হাওয়ার ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ানো কোনো মিষ্টি পিয়ানোর সুর। চষে ফিরছে সারা ঘরময়।
তখুনি,
হ্যাঁ, ঠিক তখুনি, আমার চুলে বিলি কেটে কেটে মিথির কন্ঠে আদুরে পঙক্তি হয়ে ঝরে পড়তে শুরু করেছে ওর গ্রামের সৌন্দর্য।
আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি সেই অপরূপ ছন্দময় কবিতা…..চোখের ভাসছে, মিথিদের অদেখা গ্রাম।

” ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,

ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।

এলোমেলো হাওয়া বয়,

সারা বেলা কথা কয়,

কাশফুলে দুলে ওঠে নদীর দু’পার,

রূপসীর শাড়ি যেন তৈরি রূপার।

কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,

নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।

পরনে খড়কে-ডুরে,

বেণী নাচে ঘুরে ঘুরে,

পায়ে পায়ে- ‘রুনু ঝুনু’ হালকা খাড়ুর,

কেন নাচি নাই তার খেয়াল কারুর।

আকাশে গড়িয়া ওঠে মেঘের মিনার,

তারি ফাঁকে দেখা যায় চাঁদের কিনার।

গাছের পাতার ফাঁকে,

আকাশ যে চেয়ে থাকে,

গুনগুন গান গাই, চোখে নাই ঘুম।

চাঁদ যেন আমাদের নিকট কুটুম।…

নৌকারা আসে যায় পাটেতে বোঝাই,

দেখে কী যে খুশি লাগে কী করে বোঝাই।

কত দূর দেশ থেকে,

আসিয়াছে এঁকে বেঁকে,

বাদলে ‘বদর’ বলে তুলিয়া বাদাম,

হাল দিয়ে ধরে রাখে মেঘের লাগাম।…

দু কদম হেঁটে এস মোদের কুটির,

পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।

চাল আছে ঢেঁকি ছাঁটা,

রয়েছে পানের বাটা,

কলাপাতা ভরে দেব ঘরে-পাতা দই,

এই দেখ আছে মোর আয়না কাঁকই।

যদি আস একবার, বলি –মিছা না,

মোদের উঠোনটুকু ঠিক বিছানা।

পিয়াল, পেয়ারা গাছে–

ছায়া করে রহিয়াছে,

ধুঁধুলের ঝাঁকা বেয়ে উঠিতেছে পুঁই,

খড়কুটো খুঁজে ফেরে দুষ্টু চড়ুই।

এস এস আমাদের সোনার কুটির,–

ঝিকিমিকি করে জল নিটোল নদীর।

ঝিঙের শাখার পরে

ফিঙে বসে খেলা করে,

বেলা যে পড়িয়া এল, গায়ে লাগে হিম,
আকাশে সাঁঝের তারা, উঠানে পিদিম।”

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে