পিয়ানোর সুর পর্ব-১২

0
349

পিয়ানোর সুর
#১২পর্ব

একটা অতি সাধারণ স্ট্রিটফুড ক্যাফেটেরিয়ার বাইরের লনে বসেছি আমরা। ইন্সট্যান্ট তৈরি বিফ চাপের সাথে লুচি নিয়ে ছিলাম সবাই। সাথে রায়তা ও দইবড়া। বিফ চাপের ঝালে মুখ পুড়ে গেল সৌরভের। মিথিকে ইমপ্রেস করার পাল্লায় পড়ে ছেলে আমার পুরোই নাজেহাল অবস্থা। মিথিটা যে কী না। সৌরভের সামনে কেমন মুখ লুকিয়ে আছে। না নিজে ঠিক করে খেতে পারছে আর না সৌরভ নিজে খাচ্ছে।
আমরা চারজন মুখোমুখি চারদিকে চারটা চেয়ার মাঝে ছোট্ট প্লাস্টিকের টেবিল নিয়ে বসেছি। মিথি আমি পাশাপাশি তারপর নাসিম ও সৌরভ। খেতে খেতে গল্প করছি আমি, নাসিম। টুকটাক জয়েন করছে সৌরভ। মিথি চুপ।
মিথির কন্ঠায় সৌরভের নামের স্বর্ণের লকেট লাইটের আলো পড়ে স্পার্ক করছে। দেখেই শান্তি আঃ! ভারি মিষ্টি এই পুতুলটা আমার সৌরভের বউ হবে ভাবছি আর মন ভরে দেখছি দুটোকে।
নাসিমের সাথে রিক্সায় এ নিয়ে প্রাথমিক আলাপ সেরে ফেলেছি।
নাসিম সৌরভকে আগে থেকে খুব পছন্দ করতো। মিথিকে সৌরভ চায় শুনে নাসিমের দু’চোখে গর্বের ঝলক দেখেছি। তবে নাসিম চাইছে তার বোকা ভাগ্নি প্রেমের অনুরাগ বুঝুক। একটু প্রেম হোক দুজনের।
এদের প্রেমে ভিলেন সাজবে নাসিম নিজে। আমাকে দলে ভেড়াতে চাইছে। শুনে মাফ চেয়েছি। আমার ছেলে হার্টফেল করবে। বাবার নাটক বুঝবে না। অগত্যা নাসিম নিজেই ভিলেন ভিলেন খেলবে প্ল্যান করেছে। আমার কাছথেকে কথা নিয়েছে ফাঁস করা যাবে না। কিছুটা এক্সাইটেড ফিলিংস থেকে কথা দিলাম।
কেমন জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। বন্ধুদের কত কত প্রেমের যে ব্রেকআপের কারণ হয়েছি…আহা সেই দিনগুলো!
মোবাইলে কল এল। সৌরভের মায়ের ফোন। মনেমনে ভীষণ মিস করছিলাম লিয়ানাকে। হোয়াটসঅ্যাপের প্রোফাইলে নিজের মিষ্টি একটা ফটো দিয়েছে লিয়ু।
সৌরভ বলে ওর মায়ের বয়স নাকি বায়ান্ন। অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি সেই একুশের তন্বী তরুণী।
আপাদমস্তক হিজাব পরিহিতা এক পরী হাসছে প্রোফাইলে। মন্ত্রমুগ্ধের সম্মোহনে চেয়ে আছি।

— ড্যাড পিক আপ দ্যা কল! আর কতক্ষণ ওয়েটিংয়ে রাখবে। নিশ্চয়ই মম কল করেছে। ধরো, নইলে এখুনি আমার নাম্বারে কল দেবে।

সৌরভের কথায় সম্বিৎ ফিরলো। কল রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই মিথি হাত থেকে ফোন নিয়ে স্পিকার অন করে নিজেই লিয়ানাকে বললো,

— ও হাই!

— হাই! হু?

— মিথি।

— সাদমানের সেলফোন তোমার কাছে কেন?

একটা লম্বা দম নিয়ে ঝটপট রিপ্লাই দিল মিথি,
— রিলেশনশিপে আছি আমরা। এই যে পাশাপাশি বসে আছি। আপনি কল দিলেন।

— কী বললে! রিলেশনশীপ!
— ইয়াপ!

— সৌরভ জানে ওর বাবা এক্সট্রা ম্যারিটিয়াল এ্যাফেয়ারে জড়িয়েছে?

— যতদূর জানি আপনাদের ডিভোর্স হয়েছে ত্রিশ বছর হয়। বলুন, এক্সট্রা ম্যারিটিয়াল কীভাবে?
তিনদিন পর বাবার বিয়ে। ছেলে জানবে না বলছেন! আগামীকাল বাবার বিয়ের শপিং করবে সৌরভ।

— ও স্টপ ননসেন্স! মোবাইল দাও সাদমানকে।

— সরি, আমি চাই না আমার ফিয়ান্সে তাঁর এক্স ওয়াইফের সাথে কথা বলুক। এমনিতেই বহু কষ্টে সৌরকে একসেপ্ট করেছি। এরবেশি টলারেট করা সম্ভব না।

— সৌর কে? তুমি সাদমানকে ফোন দাও। ও বলুক।

মিথির কথা শুনে আমরা তিনজন অলরেডি শকড! মিথিকে বাঁধা দেয়ার চিন্তা মাথায় আসেনি কারোরি। সৌরভের চোখ ছলছল করছে। এসময়ে মিথি সবাইকে আড়াল করে আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপে প্রশ্ন করছে,

— সাদমান তুমি চাও সৌরের মায়ের সাথে কথা বলতে? দেখো আমি চাই না আমাদের মাঝে চতুর্থ কেউ আসুক। তুমি ভাল করেই জানো সৌরকে মেনে নিতে স্ট্রাগল করছি আমি।

ওড়নার আড়ালে মিটিমিটি হাসতে হাসতে কথাগুলো বললো মিথি। এই মেয়ের মাথায় কী চলছে ওপরওয়ালাই জানে। তবু দুষ্টু মেয়েটার ফাঁদে পা দিতে মন চাইলো।

মিথির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে লিয়ানাকে বললাম,

— ডোন্ট কল মী এগেইন লিয়ু। তিনদিন পর বিয়ে করছি আমি।

বলেই লিয়ানাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিয়েছি। লিয়ানা কথা বলতে শুরু করলে দুই মিনিটে বুঝে ফেলবে আমি ডাহামিথ্যে বলছি। আমার মাথায় মিথির চিন্তা।
সৌরভ খাওয়া ফেলে টেবিল থেকে উঠে পড়লো। লনের একপাশে পানির ফোয়ারা। সেখানে গিয়ে ভেজা ঘাসের মাটিতেই বসলো আমার অভিমানী ছেলেটা।

মিথিকে নাসিম জিজ্ঞেস করলো,
— এই কী ছিল এটা।

— মামা সাদমান কাকাকে বিয়ে করবো।

— তোকে আমি জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো অসভ্য মেয়ে কোথাকার! যাকে বিয়ে করবি তাকে কাকা বলছিস।

— সরি! অনলি সাদমান।

নাসিম মিথিকে চড় মারতে হাত তুললে ওকে থামিয়ে দিয়ে মিথিকে নিয়ে একটু দূরে রাস্তার আইল্যান্ডের উপর এসে দাঁড়িয়েছি। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বলবো তার আগেই মিথি আমাকে হাগ করলো।
আমিতো আমি রাস্তায় চলাফেরা করা মানুষ সুদ্ধ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। দূরে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে নাসিম। সৌরভ যেন কিছুই দেখছে না। ওর দৃষ্টিতে শূন্যতা। আমার বুক মুচড়ে উঠলো সৌরভের চাহনিতে।

মিথি ফিসফিসালো,
— লাভয়্যু সাদমান কাকা। সত্যি ভালোবাসি।

— এবার আমিই তোকে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেবো পাজি মেয়ে। তাকিয়ে দেখ কী হাল করেছিস তোর সৌরের। আমার ছেলেটা কাঁদছে মিথি।

— কাঁদুক। আগামী তিনদিন সৌর কাঁদুক। সারাজীবন আজকের দিন মনে করে খিলখিলিয়ে হাসবে সৌর।

— সত্যি?
— একদম সত্যি।
— বল কী করতে চাইছিস!

আমাকে চমকে দিয়ে মিথি বলল,
— ইয়্যু স্টিল লাভ লিয়ানা কাকী, এম আই রাইট কাকা?

— দেখ মিথি তোকে জড়িয়ে থাকা অস্বস্তিকর কিছু না। আমার মেয়ে তুই। কিন্তু তোকে বুঝতে হবে সৌর কষ্ট পাচ্ছে। কদিন আগে টিনা বিট্রে করেছে। এখন তুই। ত্রিশ বছর পর ছেলেকে পেয়েছি আমি। তুই বুঝবি না এ বাবার কাটানো সন্তানহীনে ত্রিশটা বছরের হাহাকার কেমন ছিল। একটু ছাড়বি মা? দূরে দাঁড়া প্লীজ। তাকিয়ে দেখ সৌরভ কাঁদছে।

মিথি আমায় ছেড়ে অশ্রুসিক্ত চোখে সরে দাঁড়ালো। ওর ঠোঁট অস্বাভাবিক ফুলে আছে। লালচে ঠোঁটে রক্ত জমাট বেঁধে গাঢ় লাল দেখে মায়া হোলো। হাতের আঁজলায় মিথির মুখখানি উঁচু করে তুলে হাসতে হাসতে বললাম,

— পাজি মেয়ে আমার ছেলের চুমুতে নিজের ঠোঁট রাঙিয়ে বলছিস সাদমান কাকাকে বিয়ে করবি! এই নে মুখে মাস্ক পরে নে। নাসিম দেখলে রক্ষে নেই। তোকে তো চিড়িয়াখানায় রেখে আসা উচিৎ রে মিথি। নইলে দেখা যাবে আমার বাপকে কখন বলে বসবি, দাদাভাই তোমাকে বিয়ে কর‍তে চাই।

মিথিকে নিজেই ফেইস মাস্ক পরিয়ে দিচ্ছি সেই ফাঁকে এই মেয়ে আমাকে জব্দ করতে বললো,

— বলবোই তো। তোমার বাপকেই বিয়ে করবো। এই দেখো তার নাম গলায় ঝুলিয়েছি।

মিথি ওর গলার চেইনে সৌরভের নামের ওপর আঙুল বুলিয়ে লাজুক হাসছে। এবার আমি নিজেই ওকে আদরে বুকে জড়িয়ে নিলাম।

সস্নেহে জানতে জিজ্ঞেস করছি,
— কী চাইছিস মা তুই বলে ফেল। তোর সব আবদার শিরোধার্য।

— সৌর লিয়ানা কাকীকে খুব মিস করে কাকু। তুমিও গুমরে মরছো ত্রিশটা বছর। আমার শ্বাশুমা চাই কাকু। এনে দাও।

— এইজন্যে এই কাণ্ড!
— হুউউউ
— এই মেয়ে সত্যি করে বল, তিনদিন পর কার বিয়ে?

— সাদমান কাকা আর লিয়ানা কাকীর বিয়ে।

বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইলাম মিথির দিকে। দুষ্ট মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল,

— রিক্সায় আসতে আসতে সৌরের কাছে শুনেছি সাদমান লিয়ানার লাভ স্টোরি। সেইসাথে বাবা মাকে একসাথে দেখতে না পাওয়ার আফসোসের সুর শুনেছি সৌরের দীর্ঘশ্বাসে। কাকির কলটা জাস্ট মিরাকল হয়ে এসেছে আমার জন্যে। তুমি দেখো কাকু, আগামী বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে লিয়ানা কাকী উড়ে উড়ে ঢাকা বিমানবন্দরে পাখা ঝাপটিয়ে নামলো বলে। সৌর নিশ্চিত করেছে লিয়ানা কাকীর বর্তমান এই পরিবর্তন শুধুই ব্যক্তি সাদমান আশরাফি মৃধার জন্য।

মিথির কথা শুনে আমার মৃত হৃদয়ের গহীনে পুরানো অনুভূতির বান ডাকছে। দ্রিমদ্রিম আওয়াজে হৃৎপিণ্ড ফেটে পড়ার উপক্রম। খুব খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে ছোট্ট মিথির শেষের বাক্য।
লিয়ানা আমার জন্য নিজেকে বদলে নিয়েছে। ওর এই রূপ শুধুই আমার জন্য! আর চিন্তা করতে পারছি না। মিথির দিকে অসহায় চোখে চেয়ে আছি।
মিথি অসম্ভব সুন্দর এক হাসি দিয়ে জানালো,

— কাকু এই তিনদিন তুখোড় অভিনয় করতে হবে আমাদের। সৌর যেন কিছুতেই টের না পায় কী হচ্ছে। মন বলছে সৌরের কান্নাই লিয়ানা কাকীকে তোমার কাছে আগামী তিনদিনের মধ্যে টেনে আনবে। মনের উপর ভরসা করে আন্দাজে বিয়ের কথা বলেছি। কথা দাও কাকু ধরা পড়বে না।

— কথা দিচ্ছি মিথি মা।

মিথি হাসছে ওয়াদা করিয়ে। ওদিকে সৌরভ এগিয়ে আসছে। আমাদের ডিনার অসমাপ্ত রেখেই ফিরতে হচ্ছে। কারণ সৌরভ খাবে না জানিয়েছে। ও বাসায় ফিরতে চাইছে।
রিক্সায় বসে মিথি ওরপাশে সৌরভের ওঠার অপেক্ষা করছে। সৌরভ মিথিকে উপেক্ষা করে আমার রিক্সায় উঠে বসলো। নাসিম রাগান্বিত মেজাজে মিথিকে নিয়ে রওনা হলে আমাদের রিক্সা চলতে শুরু করেছে। এরমধ্যেই সৌরভের ফোনে রিং এল। লিয়ানার কল।
এক মনে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থেকে হটাতই মোবাইল সুইচ অফ দিয়েছে সৌরভ। অসম্ভব মনমরা হয়ে জিজ্ঞেস করছে,

— ড্যাড তুমি সত্যিই মিথিকে বিয়ে করবে?

— তিনদিন পরে বিয়ের ডেট সৌরভ। মিথি মিথ্যে বলে না।

— হোয়াটএভার! ডু ইয়্যু লাভ মিথি ড্যাড?

— ইয়েস বেটা, নো ডাউট। মিথিকে ভাল না বেসে উপায় আছে!

— মিথি চেইন পরাতে বাঁধা দেয়নি ড্যাড। ভেবেছি, শী লাভস মী। আসলে সে তোমাকে ভালোবাসে বলে তোমাকে হ্যাপি করতে ওটা পরেছে। তাইনা?

— হয়তো। টেইক ইট ইজি মাই সান! লাইফ অলওয়েজ সারপ্রাইজ আস, ইয়্যু নো!

— আই হেইট সারপ্রাইজ! মিথি কিস মী ভেরি ডিপলি ড্যাড.. কী করে মেনে নিই সে আমার নয়…

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো সৌরভ। আমার মিথি পাগল ছেলেটা মিথিকে হারানোর ভয়ে দিশেহারা। ওর এই হাল দেখে আমি নিজেই ভেঙে গুড়িয়ে শেষ।
সৌরভকে দুই হাতে পাঁজরের সাথে চেপে ধরে ভাবছি, এই বাবা আগামী বাহাত্তর ঘন্টা কেমনে তুখোড় অভিনয় করবে। ছেলের অদম্য কান্নায় এই বাপ যে শুরুতেই নিঃশেষ! ওহ মিথি! দুষ্টু মেয়ে আমার নিষ্পাপ ছেলেটাকে কাঁদাচ্ছিস।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে