পিয়ানোর সুর পর্ব-০৯

0
360

পিয়ানোর সুর
#৯মপর্ব

— মিথি দেখতো মা কে এসেছে।

বড় মামা সৈয়দ নওয়াজ হায়দারের কথায় দৌড়ে বাসার মেইন ডোর খুলতে এসেছিলাম। বিকেল থেকে খেয়াল করেছি মামী নীলিমা হক অতিথি আপ্যায়নে বিশেষ তোড়জোড় শুরু করেছেন। জানি না কারা আসবে। আমাকে বলা হয়নি কিছু। নিজে থেকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হয়নি। আমাদের বাড়ী হলে বাড়ীর সবাইকে ডেকে বলে দেয়া হত কে আসবে আর আমাদের কার কী করণীয় বলে কাজ ভাগ ভাগ করে দিতেন মুরুব্বীরা। রান্নাঘর আলাদা হয়ে গেলেও মেহমান আপ্যায়নের বেলায় সবার সমান কন্ট্রিবিউশান থাকতে বাধ্য।
নানুবাড়ীতে অবশ্য একই নিয়ম। সবাই জানে কার ঘরে কে আসছে। কেবল আমাকে বলা হয় না। এই যেমন এখন জানি না দরজার বাইরে এক্সাক্টলি কে দাঁড়িয়ে আছে, মেহমান নাকি অন্য মামাদের বাসার কেউ।
দোদুল্যমান মন নিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে ভুলে গেলাম মনিটরে দেখে নিতে কে এসেছে। বলাইবাহুল্য,
এই বিল্ডিং যতই পুরানো হোক এর আভ্যন্তরীণ সিস্টেম সবই অত্যাধুনিক। মেজো মামার ছেলে সৈয়দ শোয়েব হায়দার উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে প্রায় বারো বছর কাটিয়ে এসেছেন।
দেশে ফিরেই সবার আগে এবাড়ীর সিকিউরিটি সিস্টেম থেকে শুরু করে বড়সড় হোক বা খুঁটিনাটি, সবকিছু নিজ দায়িত্বে বদলে দিয়ে বাড়ীর গ্যারেজ থেকে ছাদ তক পুরো ভোল পাল্টে দিয়েছেন। শোয়েব ভাইয়ার স্থানীয় একটা কলেজের লেকচারার হিসেবে জয়েন করার পর থেকে মেজো মামা মামীরা ওনার জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেছেন মাস কয়েক হলো (নানুর মুখে শোনা)।
হতে পারে,
সম্ভবত পাত্রী পক্ষের কেউ আসবে।
এবাড়ীর ছেলেমেয়ে বিয়ে যারই হোক, সমস্ত কথাবার্তা বড়মামার বাসায় হয়।
এখানে নানা নানু আছেন এ কারণে। ওনারা মেডিকেল ইমার্জেন্সি ছাড়া সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামেন না।

দরজা খুলে আহত বাজপাখির মত স্থির হয়ে গিয়েছি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে অসম্ভব সুদর্শন একজন পৌঢ় ব্যক্তিত্ব।
বয়সটা এক আধটু কম হলে নির্ঘাত ক্রাশ খেতাম। অবশ্য এখনও ক্রাশ খাওয়ার মতই উনি। কাকু হ্যান্ডসাম হলে ভাতিজী গর্বিত হতেই পারে। ইশশ আল্লাহ সাদমান কাকুকে আমার আপন রক্তের কাকু বানিয়ে দিতে যদি।

কাকুর পেছনে কেউ নড়ে উঠলো। ভয়ে ওখানেই শেষ আমি। নিশ্চয়ই সৌরভ!

— কেমন আছো মিথি মামনি? আসসালামু আলাইকুম! ভেতরে আসবো?

গম্ভীর অথচ আদুরে টোনে সাদমান কাকুর কথায় আমার শেকড় গজানো পা দুটো প্রাণ ফিরে পেল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে উল্টো ঘুরে সোজা দৌড়। গন্তব্য নানুর ঘরের বারান্দা। চার পাঁচটা শাড়ী দড়ির ভাজে ভাজে মেলে দেয়া।
একদম শেষের শাড়ীটার আড়াল নিয়ে দম ছাড়লাম।
বুক ধড়ফড় করছে, কন্ঠ শুকিয়ে কাঠ। একটু পানি না পেলে মরেই যাবো।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।
হাতের তালুতে বৃষ্টির পানি নিয়ে চুমুক দিলাম। ভয় আর ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিল। ব্যালকনিতে পেতে রাখা চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লাম।

হায়, সৌরভ আপনি আমার পরাণের শান্তি কেন কেড়ে নিলেন!
|
|
মিথি চমকে উঠে ইউটার্ণ নিল। আবারো মিস করে ফেললাম। বাবার পেছন থেকে উঁকি দিয়েও মিথির ফেইস দেখা গেল না।
রুমের ভেতর ঝলমলে আলোয় কেবল ঘুরে দাঁড়ানো মেয়েটির বা’কানের ঠিক নীচে, গ্রীবায় একটি রক্ততিলের দেখা মিললো।
মনেমনে এক ভয়ানক প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম, আজ ঐ তিলে কিস না করে এ বাড়ী ছেড়ে এক পা’ও নড়বো না আমি।

একজন মুরুব্বী বয়সে আমার বাবার বেশ সিনিয়র হবেন। তিনি এসে আমাদের ওয়েলকাম জানালেন। লিভিং রুমে বসেছি আমরা।
মুরুব্বী ভদ্রলোকের নাম মিস্টার হায়দার। বাবা হায়দার ভাই বলে সম্মোধন করলেন।
আলাপের মাঝখানে স্ন্যাকস পরিবেশন করা হলে অপূর্ব সুন্দর একটি মেয়ে এল হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে।
চোখ ফেরানো যায় না এমন সৌন্দর্যে। কেমন একটা পুতুল পুতুল ভাব আছে চেহারার অভিব্যক্তিতে।
একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। মন জানান দিল, উঁহু ও আমার মিথি নয়।

এই মেয়েটি মিথির চেয়েও সুন্দরী হবে হয়তো। গায়ের রঙ, শারীরিক গঠন, ফেইস এক্সপ্রেশন এক কথায় নিঁখুত।
একবার শাঁখারী বাজারে ঘুরতে গিয়ে এক মন্দির ভিজিট করেছিলাম।
দূর্গা নামের একটা অনন্য সুন্দর মূর্তি ছিল সেখানে। যতগুলো মূর্তি দেখেছি তার ভেতর দূর্গা মূর্তিটিকেই আমার কাছে সবচাইতে সুন্দর লেগেছিল।

চায়ের ট্রে নিয়ে আসা এই মেয়েটি হুবহু দূর্গারই জীবন্ত রূপ যেন। এতটাই মোহনীয় রূপ।
তবু কেন যেন মন বারেবার বলছে,
না ও আমার মিথি না।
মিথির গায়ের রঙ রূপালী চাঁদের আভা ছড়ায়।
এই মেয়ের গায়ের রঙ দুধের সরের মত ক্রিমি একটা ভাব আছে কিন্তু গ্লিটারের স্পার্কিং সেই আভাটুকু নেই। যেমনটা মিথির আছে।

আচ্ছা,
আমার ঐ এক দেখাই কী যথেষ্ট মিথিকে চেনার জন্য?
শুধুই তো শাড়ী পরা ব্যাক সাইডের উন্মুক্ত ছোট্ট সরু কোমড় আর ঘাড়ের পেছনের অর্ধ চাঁদ আকৃতির অনাবৃত পিঠটুকু দেখেছিলাম। তাও একঝলক।
এরবেশি দূর থেকে সহ্য করা যায়নি। গরম কফি পড়ে পা পুড়ে গেল হুহ!

— সাদমান এসো পরিচয় করিয়ে দিই, এ হলো সুপ্তি আমার সেঝো ভাই মানে তোমার বাল্যবন্ধু সৈয়দ নোমান হায়দারের মেয়ে। ওরই বিয়ের কথা বলছিলাম তোমাকে।

হায়দার আঙ্কেলের কথায় কিছুটা থমকে গেলাম। সুপ্তির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল। প্রাথমিক কুশল বিনিময় শেষে কথা খুঁজে পাইনি। পাশেই ম্যাগাজিন হোল্ডার থেকে অনেকগুলো ম্যাগাজিন থেকে ভোগ ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিলাম।
বেশ পুরাণো ম্যাগাজিন। সময় কাটাতে পাতা ওল্টাচ্ছি।
সবাই কথা বলছে। মিথির মেজোমামা, সেঝো মামা ও মামী এসে যোগ দিলেন আড্ডায়। কয়েকজন কাজিন ব্রাদার, সিস্টার্স এসেছে।
এরই মাঝে বেশ ক্যাজুয়াল টোনে মিথির বড় মামী সুপ্তিকে বললেন আমাকে ওদের বাসা দেখিয়ে নিয়ে আসতে।
বাবা বাঁচালেন এই বলে,

— আজ নয় ভাবী অন্য একদিন। আমার ছেলেটা সিক। আজই সন্ধ্যায় হসপিটাল থেকে এসেছে। বাসায় একা থাকবে ভেবে সঙ্গে নিয়ে এলাম।

— আচ্ছা ভাই বুঝেছি। সুপ্তি তুই তাহলে যা সৌরভকে তোর দাদা দাদীর সাথে পরিচয় করিয়ে নিয়ে আয়।

সুপ্তি উৎফুল্ল চিত্তে রাজি হয়ে গেল। সঙ্গে আমিও। ঐ রুমে মিথি আছে।
একটি লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে দাদা-দাদীর রুমে এলাম।
মন ভেঙে চুরচুর। মিথি নেই এ রুমে।
দাদা মিথির মতই বেশ চুপচাপ।
দাদীর সাথে টুকটাক গল্প করায় বুঝলাম, এরা সবাই আমাকে একটু বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছে যা প্রথম পরিচয়ে বড্ড বেমানান।
খুব হালকা রজনীগন্ধার স্মেল বাতাসে ভাসছে। তারমানে মিথি এখানেই কোথাও।

হার্টবিটে হাজার মাইল স্পীডের প্রেশার নিয়ে দাদা দাদীর কাছে ওনাদের বারান্দা দেখার অনুমতি চাইলাম।
শুনে সুপ্তিকে বেশ খুশী মনে হলো কেন? মেয়েটি কী বয়সের তুলনায় একটু বেশিই লাফাচ্ছে না? কিন্তু কেন?
হোয়াটএভার!
আমি মিথির জন্য এসেছি।

ব্যালকণিতে পা রাখতেই মিথি মিথি সৌরভ আমায় পাগল করে তুলল।
মনেমনে আল্লাহকে ডাকছি, মিথি যেন এখানেই থাকে।
কী ভাগ্য আমার..
ব্যালকণির লাইটের সুইচ অন করতে গেল সুপ্তি। লাইট জ্বলেই নিভলো। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছে।
ঐ এক পলকেই দেখে নিয়েছি,
কর্ণারের চেয়ারে বসা রূপালী চাঁদ রঙা দুটি পায়ের পাতার ঝলক। সাথে নূপুরের ক্ষীণ ঝংকার। উঠেই মিলিয়ে গেল।

— সৌরভ আপনি দাঁড়ান আমি চার্জার নিয়ে আসছি। বড় মামাদের আইপিএস সারতে দিয়েছে। এখনো আসেনি। আপনি একটু অপেক্ষা করবেন প্লীজ?

— শিওর সুপ্তি, টেক ইয়োর টাইম!

সুপ্তি চলে গেলে খুব ধীরে ব্যালকণির রশিতে মেলে দেয়া শাড়ীর আড়াল সরিয়ে কর্ণারের চেয়ারটার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম।
চেয়ারের ওপর পা তুলে হাটুতে মুখগুঁজে বসে আছে পিংক কালারের ফ্রক পরা সেই মেয়েটি। যাকে দরজার সম্মুখে দেখেছিলাম।
চাইলেই মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দেখে নিতে পারি ঐ মুখখানি।
উঁহু তাড়া নেই।
মিথির ইচ্ছের বিরুদ্ধে মিথিকে দেখতে চাই না।
আধো আলো আধো অন্ধকারে বসে থাকা মিথিকে হুট করে দেখলে মনে হতে পারে একেবারেই বাচ্চা একটি মেয়ে।

বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। শ্বাস আটকে আসছে। নিজেকে বাঁচাতে অস্ফুটস্বরে ডাক দিলাম,

— মিথি!

ভয়ে চমকে উঠে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল ভীতু মেয়েটি।
ও বোঝেনি আমি ওর এতটা কাছে দাঁড়িয়ে আছি যে, দাঁড়াতে গিয়ে আমারই পায়ের পাতার ওপর নিজের পা রেখে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে সে।
গায়ের সাথে গা লেগে গিয়ে উল্টে পড়ে যেতে নিল মিথি।
ওর পিঠে আলতো হাত রেখে ওকেই আবার আমার দিকে থ্রো করেছি।
ঘটনার আকস্মিকতায় দু’হাতের ডানা মেলে মিথি এসে লুটিয়ে পড়লো ঠিক আমার বুকের মাঝখানটায়। নখের আঁচড়ে খামচে ধরলো দু’বাহু।

ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠার আগেই অন্ধকারে ওর ছোট্ট ঠোঁট দুটো ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরতেই গুঙিয়ে উঠলো মিথি।
আমার এই কয়দিনে ওকে দেখতে না পাওয়ার আকণ্ঠ তৃষ্ণার সবটুকু ঠোঁটে এসে ভর করলো।
পরম মমতায় দু’জোড়া ঠোঁট মিলিত হতেই
হৃদয়ের অনুভূতিরা অসংখ্য ময়ূর পেখম মেলে বাতাসে ফিসফিস গুঞ্জন তুলে বলল,

‘পারলে এ তুলতুলে ছোট্ট ঠোঁট দুটি সত্যি সত্যি টুপ করে গিলে ফেলো সৌরভ!’

ফার্স্ট কিস। মিথি প্রচন্ড ভয়ে সারা শরীর ঝাঁকিয়ে থরথর করে কেঁপে উঠলো।
এই মেয়ে যে এজন্মে কাউকে কিস করেনি তা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়লো।
নইলে কেউ দাঁত দিয়ে ঠোঁটে মৌমাছির মত হুল ফোটায়!
ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি ঝরছে আমার তবু ছাড়ছি না। কেন ছাড়বো? হুহ..
জিভে রক্তের স্বাদ পেলাম।
মিথি ফুঁপিয়ে উঠে দাঁত সরিয়ে নিলে চুমুর সময়টুকু আরেকটু দীর্ঘ করে দিলাম দু’জনার।
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে অস্থির আকুতি ঝরে পড়লো কন্ঠ হতে,

— তুমি মিথি? বলো না তুমি কী আমার মিথি?

ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল মিথি।
মিহি কণ্ঠে আদুরে সুর তুললো,

— হুউউউউউউউউ…

এ যেন আমার পিয়ানোর মধুরতম সুর বাজলো কানে। কোমড় পেঁচিয়ে মিথিকে ফ্লোর থেকে শূন্যে তুললাম।
কানের বা’পাশে রক্ততিলে গভীর চুমুর দাগ এঁকে দেবার সময়, আবেগের চূড়ান্ত বাঁধ ভেঙে পড়লো আমার।
আনমনে ফিসফিস করছি,
— বেইবি.. বেইবি আই লাভ য়্যু সো মাচ..!

কান্না থেমে গেল মিথির। ভয়ে কম্পমান নরম কোমল অথচ অপরিপক্ক দু’হাতে শক্তভাবে আমার গলা জড়িয়ে নিল। নিঃশব্দে হাসছি।

— আনাড়ী মেয়ে! এই চেয়ে দেখো তো কী হাল করেছো উমম.. ইঁদুরের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কেটে কুটিকুটি করে দিয়েছো আমার। জুড়ে দাও। জানো না আমার ভীষণ অসুখ..

এক পৃথিবী লজ্জা নিয়ে অদেখা মেয়েটি আমার কাঁধে মুখগুঁজে দিল। কোনো কথার বিনিময় হলো না আমাদের মাঝে।

ভেতর ঘর থেকে সুপ্তির ডাক,
— সৌরভ বাতি নিয়ে এসেছি। ভেতরে আসুন। বাহিরে ঝড় উঠেছে।


চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে