পিয়ানোর সুর পর্ব-০৮

0
325

পিয়ানোর সুর
#৮মপর্ব

দুটো দিন ধরে সৌরভ সত্যিই বারান্দায় এল না। খুব ভোরে এম্বুলেন্সের আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল। দৌড়ে বারান্দায় এলাম। নীচে রাস্তায় তাকিয়ে দেখি সৌরভদের বাসার সামনে এম্বুলেন্স। স্টেচার নিয়ে ওদের বাড়ীর ভেতর ঢুকলো এম্বুলেন্স কর্মীরা। একছুটে নেমে এলাম নীচে। ঠিক করে ভোরের আলো ফোটেনি। সবাই ঘুমিয়ে। কেউ দেখেনি।

দেখলে দেখতে পেত এ বাড়ীর সবচাইতে অনুগত বাধ্য মেয়েটি উন্মাদের মত ছুটছে এক অচেনা যুবকের জন্য।
হ্যাঁ আমার মন বলছে, এম্বুলেন্স সৌরভের জন্য এসেছে। সৌরভ ভালো নেই।
বাড়ীর মেইন গেইট তখনও লকড। দাড়োয়ান চাচা ঘুমাচ্ছে। কটা বাজে দেখার জন্য গ্যারাজের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। ভোর ৫:৩৩ মিনিট।

যা ঘটে ঘটুক দাড়োয়ান চাচাকে ডেকে তুলে মিথ্যে বললাম, ‘রাস্তায় হাঁটতে যাবো’। উনি অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে গেট খুলে দিলেন। কোনোদিকে না দেখে সৌরভদের বাসায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দে ছুট।

এম্বুলেন্সের সামনে আসতেই স্টেচারে অচেতন সৌরভকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। সাদমান কাকা অসহায় চোখে তাকিয়ে বললেন,

— একটু মিথিকে দেখার জন্য সারাটা রাত জ্বরের ঘোরে ছটফট করেছে আমার অবুঝ ছেলেটা। ওরজন্য দু’আ কোরো মিথি মা।

কান্নার শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ বেরুলো না মুখ দিয়ে আমার। চোখের সামনে দিয়ে সাদমান কাকা আর সৌরভকে নিয়ে এম্বুলেন্স দ্রুতবেগে চলে গেল।

রুমে ফিরে বালিশে মুখগুঁজে অঝোরে কাঁদলাম। কী জন্য জানি না। জানতে চাই না। সুপ্তি আপু আমার মামাতো বোন। মেঝো মামার ছোট মেয়ে। বয়সে আমার বড়। এবার মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। বাড়ীতে ওনার বিয়ের আলাপ চলছে বেশ কিছুদিন ধরে।
হটাৎ করে কুরবানির ঈদের পরদিন সুপ্তি আপু ডিক্লেয়ার করলেন, উনি ওনাদের পাশের বাড়ীর বিদেশী ছেলেটার প্রেমে পড়েছেন। প্রথমে বুঝিনি। পরে ছোটমামার মুখে সবটা শুনে থ বনে গেলাম। প্রায় বছরখানেক ধরে সুপ্তি আপু সৌরভকে গোপনে ভালোবাসে। বিয়ের কথা ওঠায় বলতে বাধ্য হয়েছেন – “শী লাভ’স সৌরভ”!

অনুভূতি তৈরি হবার আগেই অনুভূতির গলাটিপে মারতে ওস্তাদ বলে যদি কেউ থেকে থাকে – সে আমি। সৌরভ থেকে সরে আসার এরচেয়ে যুক্তিসঙ্গত কারণ আর কীইবা আছে।
মেঝো মামা কথা দিলেন মাস্টার্সে রেজাল্ট ভালো করলে সৌরভদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।
সুপ্তি আপু পারে তো খুশীতে মাদল বাজায়। অবশ্য নানাবাড়ীর ভেতর মহলে ততক্ষণে আন অফিশিয়াল ডঙ্কা বাজলো, “সুপ্তি ওয়েডস সৌরভ”।

সেই আমার আমিটার এতগুলো দিন পর এসে ঠিক দুদিন আগে সৌরভকে একনজর দেখার যে অস্থিরতা পেয়ে বসলো তা শুধু অস্বাভাবিক না ভীষণ ভয়ংকরও।
কখনো ভাবিনি বারান্দায় ভেজা চুল ঝাড়তে গিয়ে সৌরভকে দেখে ফেলবো।

এত সুদর্শনও মানুষ হয়?
সৌরভের দেবদূতের মত সৌন্দর্য অবলোকন করতে গিয়ে আমার সমগ্র শরীরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠেছিল যেন। লিকুইড মিল্কের মধ্যে জাফরান ছিটিয়ে দিলে যে রঙ হয় সৌরভের স্কিন একদম ঐরকম! ওর ক্রিস্টালের মতন পার্পল কালার আইবল হতে ঠিকরে বেরোনো জ্বলজ্বলে আভাটুকু আকুল হয়ে শুধু মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিলো।

কাঁচ ভাঙার শব্দে চমকে উঠে পেছন ফিরে প্রথমে এমনই লেগেছিল সৌরভকে। পরক্ষণেই দেখি গরম চায়ে পা পুড়ে যাচ্ছে ওর আর আমার কলিজায় অব্যক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল।

একেই কী বলে লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট! জানিনে!
তবে হ্যাঁ, এক ওপরওয়ালা জানেন, কতটা কষ্ট হয়েছিল ঐমুহূর্তে নিজেকে আড়াল করতে। সৌরভের ছেলেমানুষী অভিমানে আকুল হয়ে কেঁদেছিল আমার মত এক গেঁয়ো ভূত।

অসুস্থ সৌরভকে দেখে মনে হলো স্টেচারে সৌরভ না, আমি শুয়ে আছি। এমন কেন লাগছে আল্লাহ!
এ ঠিক নয় জেনে মন মানছে না কেন?

জীবনে প্রথম অচেনা কারো জন্য জায়নামাযে বসেছি। বহু বহুদিন পর সৃষ্টিকর্তার নিকট হাত তুলে সৌরভের সুস্থতার জন্য দু’আ করার সময় নিয়ত করলাম সৌরভ ঘরে না ফেরাপর্যন্ত শক্ত কারণ ছাড়া জায়নামায ছাড়বো না।

পাক্কা পাঁচদিন পর সৌরভকে নিয়ে সাদমান কাকা বাড়ী ফিরলেন। ছোটমামা কথায় কথায় জানালেন সুপ্তি আপুকে।
নানুর ঘরে সন্ধ্যায় ক্বুরআন তিলাওয়াত করছিলাম। নানা নানু, মামা মামীদের সহ কাজিনরা সবাই মিলে ডাইনিংয়ে নাশতা করতে বসেছিলেন। ওদের আলাপের গুঞ্জন নানুর ঘর পর্যন্ত আসছিল। তখনই জেনেছি সৌরভ বাড়ী ফিরেছে। মুনাজাত ও শুকরিয়া আদায়ের নামাজ শেষ করে একপ্রকার দৌড়ে বারান্দায় এলাম।
সৌরভ বারান্দাতেই ছিল। অন্ধকারে আবছায়া হয়ে। আমি এসেছি বুঝতে পেরে চলে গেল। ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারিনি।

সৌরভের উপেক্ষা গলায় ফাঁস হয়ে ঝুলছিল তখন।

— ড্যাড কোথাও যাচ্ছো?

বাইরে বেরুবার সময় পেছন থেকে সৌরভের ডাক শুনে ফিরে বললাম,

— হ্যাঁ রে পাশের বিল্ডিংয়ের বাড়ীওয়ালার বাসায় যাচ্ছি। উনি ডাকলেন, তার মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আলোচনার জন্য ডেকেছে।

— ও! আচ্ছা যাও।
— কিছু বলবি সৌরভ? তোকে এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন? মাত্রই হসপিটাল থেকে এলি। খারাপ লাগছে? চোখ এত লাল! কী হয়েছে বেটা?

— নিড শ্যাম্পেইন! দমবন্ধ হয়ে আসছে এখানে। বাসায় তো রাখো না। কোথায় গেলে পাবো এড্রেস দাও? বারে যেতে চাই ড্যাড।

— সৌরভ!

বিগত দুইটা বছরে ভুল করেও বারে যাওয়ার নাম নেয়নি যে ছেলে, সেই ছেলের এরকম বিধ্বস্ত রূপ আমাকে হেলিয়ে ছাড়লো। ধমকে দিতেই সে খেপে বলল,

— ড্যাড প্লীজ আন্ডারস্ট্যান্ড, একসাথে পর পর দুটো আঘাত সহ্যের বাইরে। টিনার বিট্রে ভুলে গিয়েছিলাম মিথির ইনোসেন্সে। সেই মেয়েটা জ্বালা দিচ্ছে ড্যাড। এত নিঠুর মেয়ে হোল লাইফে দেখিনি।

— তাইবলে ড্রিংক করবে!

— আমাকে বাঁচতে হবে তাইনা? মিথিকে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা পাগল করে দিচ্ছে। ম্যানারলেস মেয়েটাকে ভুলতে চাই ব্র‍্যাণ্ডির গ্লাসে।

— মিথি জানতে পারলে চিরতরে হারাবে। বাঙালী রক্ষণশীল মেয়েরা মদকে ঘৃণা করে। মিথির দুই সেকেন্ড লাগবে না তোমার থেকে মুখ ফেরাতে।

— মুখ ফেরানো প্রশ্ন তখন আসে যখন তাকায়! ও তাকায় না ড্যাড টু মাচ রুড ইউ নো.. মিথি লাইক করে না আমাকে..

বলতে বলতে আমার ভাবুক ছেলেটা সোফায় বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে বাচ্চাদের মত হু হু করে কেঁদে দিল। এমুহূর্তে ওকে প্রশ্রয় দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বেশ গম্ভীরতা নিয়ে বললাম,

— চলো।
— কোথায়?
— মিথিদের বাসায়। ওবাড়ীতেই যাচ্ছিলাম। তুমি বাঁধা দিলে।

— না তুমি যাও। কিছুটা সময় একলা থাকতে চাই।

মিথি পাগল বাবুটা আমার প্রথমে বুঝলোই না বাবা কী বললাম। পরক্ষণেই সোফা ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো।

— কী বললে ড্যাড! কোথায় যাচ্ছিলে?

আমায় মিটিমিটি হাসতে দেখে লাফিয়ে পড়ে দুই হাতে শক্ত করে হাগ করলো ছেলেটা। ফার্স্ট টাইম বাবার গালে টাপুসটুপুস শব্দ করে চুমু খেল সেই দুই বছরের শিশু সৌরভের মত। চোখে জল এসে গেল। এখন মনেহচ্ছে মিথিটা ছাড়া আমারও চলছে না। এই ছেলের আদর পেতে হলে আমার মিথি মাকে চাই’ই চাই।

ঠিক তার দশ মিনিটের মাথায় মিস্টার নওয়াজ হায়দারের বাসায় কলিংবেলের সুইচ প্রেস করতেই বুকে সাদা সুতোর কারুকাজ করা সিম্পল ডিজাইনের একটি সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত আমার রাজপুত্র ছেলেটা আমারই পিঠের পেছনে আড়াল নিল। আমি হাসছি ওর ছেলেমানুষী এক্সাইটমেন্ট ফিল করে। মিথি জ্বরে রীতিমতো ছটফট করছে সে।

স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হয়ে ভাবছি,
একটা সময় আমিও লিয়ানার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এভাবে লাজুক হতাম.. আচ্ছা আমি কী লিয়ানাকে মিস করছি!
অনুভব করার সময় পেলাম না ক্লিকড একটা শব্দে সৌরভ পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রেখে পিঠে কপাল ঠেকালো। অনুভূতিরা ওকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না।
আমি পড়লাম টেনশনে, এই ছেলেকে নিয়ে আসা কী ঠিক হলো!
মিথিকে সামনা-সামনি দেখে কোনো পাগলামি করে বসে যদি? হাগ কিংবা কিস! রক্তে আছে তো!

ভুলিনি। স্মৃতির ক্যানভাসে দিনক্ষণ সুস্পষ্ট,
লিয়ানার প্রপোজে আমি ‘ইয়েস মাই লাভ’ বলতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে হাগ এন্ড কিস সমানতালে ঘন্টা ধরে চলছিল ক্রেজি মেয়েটার। ভাবতেই ঘাম ছুটলো। ও গড, পাগলী মায়ের ছেলেটা আজ না ফাঁসায় এই বাপকে। কথায় আছে,
‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়’..

দরজা খুললো মিথি।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে