এক টুকরো আলো পর্ব-০৮

0
227

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

এখন পর্যন্ত শাশুড়ির দেখা পেল না হুরাইন। চারদিক থেকে তাকে ঘিরে রেখেছে প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন। মেয়েদের ভীড় ঠেলে একজন পুরুষ স্ত্রীকে ডাকতে চলে এলেন এ ঘরে। এসেই যেহেতু পড়েছেন, কৌশলে একবার তাসিনের বউ দেখে নিলে মন্দ হয় না। আফসোস উঁকিঝুঁকি দিয়েও তিনি দেখতে পেলেন না নববধূর মুখশ্রী। পুরুষ কন্ঠ কর্ণগোচর হওয়া মাত্র তড়িৎ মুখ আড়াল করে ঘুরে বসে হুরাইন। তার বুকে তীব্র কম্পন হচ্ছে। নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। হুরাইনের অন্তরে ভয়। ওই অজ্ঞাত ব্যক্তি কি তাকে দেখে নিয়েছে? দেখলেও বা কতটুকু? ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই পুরুষ কন্ঠ। পূর্বের মত ঘুরে বসতেই কেউ কেউ বুঝে নিলেন হুরাইনের ভয়। কেউ সরু গলায় বললেন,“কী গো মেয়ে? আমাদের দেখে এমন মুখ ঘুরিয়ে বসেছো কেন? শুনলাম পর্দাশীল মেয়েদের মন স্বচ্ছ। অথচ তোমার মন দেখি অহংকারে ভরা। আমরা কি বিধর্মী নাকি? আমাদের দিকে তাকালে কি তোমার ইজ্জত যাবে?”

বৃদ্ধার কথা শুনে হুরাইন নিজের অন্তর পরিষ্কার প্রমাণ করতেই তড়িঘড়ি সাফাই দিল।
ক্ষীণ স্বরে বলল,“আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না। একজন পুরুষ মানুষ এই ঘরে প্রবেশ করেছিলেন। ওনার সাথে দেখা দেওয়া আমাদের সবার জন্য জায়েয নয়।”

বৃদ্ধার চোখমুখের আকার বড়ো হয়ে গেল। হাহুতাশ করে বললেন,
“তাসিনের মা তাসিনের জন্য কী ধরে এনেছে! এখনো বিয়ের গন্ধ যায়নি। অথচ শশুর বাড়ি পা রেখেই মুখে মুখে জবাব দেয়। এই মেয়ে সংসারে অশান্তি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না।”

পাশেই বৃদ্ধার মেয়ে ছিলেন।
“তুমি থামবে মা?”
অতঃপর হুরাইনের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,“বয়স হয়েছে। সেকেলে মানুষ। তাই না বুঝে ধর্ম টেনেও কথা বলে ফেলেছে। কিছু মনে কোরো না।”

হুরাইন বলল,“আমি কিছু মনে করিনি।”

বৃদ্ধা খেঁকিয়ে উঠলেন। মেয়েকে বললেন,
“ওঠ এখান থেকে।”

রাত বাড়তেই ভিড়ভাট্টা কমে গেল। মাগরিবের নামাজ আদায় করলেও এশা এখনো আদায় করতে পারেনি হুরাইন। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজতেই ফুফু শাশুড়ি এসে মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন,“কী খোঁজা হচ্ছে?”

“আপনাকেই। ওজু করবো।”

হুরাইন ফুফু শাশুড়ির সাথে গিয়ে ওজু করে নামাজ আদায় করে নিল। সকলের রাতের খাবার শেষ হওয়ার পর তিনজন বাকি রইলো। তাসিন, হুরাইন আর তাসিনের ফুফু। হুরাইনকে নিয়ে খেতে বসিয়ে দিলেন ফুফু। জড়োসড়ো হয়ে একবার চারপাশে নজর বুলানোর চেষ্টা করলো হুরাইন। ফুফু শাশুড়ি ছাড়া পরিবারের আর কেউ তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি। তার না-কি একটা ননদ আছে! কই তাকেও যে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। হুরাইন যখন আপন ভাবনায় মত্ত, তখন পাশে চেয়ার টানার শব্দ হলো।
আরো অনেকগুলো চেয়ার থাকতেও তাসিন এসে হুরাইনের পাশের চোয়ার টেনে বসলো। নড়াচড়া করলো না হুরাইন। শক্ত হয়ে বসে রইলো। তার বুক কাঁপছে দুরুদুরু। একটা সম্পর্কে জড়িয়ে তো পড়েছে। কিন্তু মানুষটা কেমন হবে সেই ভয় তাকে কাবু করে নিয়েছে। ফুফু নিজেও খেতে বসলেন। হুরাইন খাচ্ছে কম,খাবার নড়াচড়া করছে বেশি। তেমন কিছুই নিলো না পাতে। তাসিন বেশ খানিকক্ষণ যাবত লক্ষ করে বলল,“খাচ্ছো না কেন? আমরা মুরগীর বাচ্চা পালি না।”

কথাগুলো বলার সময় তাসিনের ঠোঁটে হাসি ছিল না। ওর চেহারা ছিল স্বাভাবিক। ফুফু মৃদু হেসে বললেন,“জায়গা বদলেছে, বাবা-মা ছেড়ে এসেছে। তাই এমন হচ্ছে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”

হুরাইন উশখুশ করছে। তার দৃষ্টি এলোমেলো। কিছু বলতে চাইছে সে। তাসিন তার দিকে তাকাতেই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। তাসিন ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,“কিছু বলবে?”

দুদিকে মাথা দুলিয়ে না জানালো। ফুফু জিজ্ঞেস করলেন,“কোনো সমস্যা?”

“আমি আর খাব না।” অস্ফুট স্বরে কথাখানা বলতেই তাসিনের কপালে ভাঁজ পড়ে চোখ দুটো ছোটো হয়ে এলো। তীক্ষ্ণ চাপ দিল মস্তিষ্ক। ফুফুকে বলছে অথচ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে! তাসিন বাঁধা দিল না। হুরাইন উঠে পড়লো। পেটে খিদে থাকলেও গলা দিয়ে নামছে না। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে।

★★
হালকা-পাতলা ফুল দিয়ে তাসিনের ঘর সাজানো হয়েছে। বিছানার মাঝখানে মাথায় কাপড় টেনে দৃষ্টি নিচু করে বসে আছে হুরাইন। তাসিন ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল। শরীরে একখানা নীল সুতি শাড়ি। মুখে কোনো কৃত্রিম সাজ নেই। ছোট্ট নাকফুলটা ঝিলিক দিয়ে উঠছে। নীল শাড়িতে একটুকরো সাদামেঘ যেন উঁকি দিচ্ছে। তাসিনের হুঁশ উবে গেল। তার ঘরে উঠে এসেছে নীলপদ্ম। এ তো চোখের তৃষ্ণা। মনের তৃষ্ণা মেটাতে হলে যে অন্তর ছুঁয়ে দিতে হবে। তাসিন মৃদু স্বরে শুধালো, “তুমি কি আমাকে ভয় পাও?”

হুরাইনের নিরব রইল। সব সময় নিশ্চুপ থাকা মানে সম্মতির লক্ষণ নয়। কখনো কখনো জড়তা মুখ চেপে ধরে। তাসিনের দৃষ্টি এক মুহুর্তের জন্য সরলো না। বলল,“ভয় পাও?”

“নতুন জীবনটা নিয়েই আমার ভয়।”
হুরাইনের কম্পিত স্বর। তাসিন প্রত্যুত্তর করলো না। আল্লাহ তায়ালার নিকট শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো তাসিন। আহবান করলো হুরাইনকে। নরম স্বরে বলল,
“আমি পা*পী। পেছন দিকে ঘুরে তাকাতে চাই না। তোমার সাথে আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তোমার৷ তার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আমি।”

হুরাইন অবাক চোখে তাকালো। তাসিন ফের বলল,“আমার জন্য তোমার চোখে ভয় দেখতে চাই না। তোমার জীবন নিয়ে আশঙ্কা দেখতে চাই না। মৃত্যুর পর অব্দি তোমার সাথে থাকতে চাই।”

হুরাইনের ভয় অনেকটাই কেটে গেল। তাদের বাড়ির পরিবেশ আর এই বাড়ির পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাড়িতে কখনো তেমনভাবে তাদের মাথা থেকে কাপড় সরে না। অথচ এখানে এমন অনেক নারীকে নজরে পড়েছে। যাঁরা খোলা চুলে হেঁটে বেড়িয়েছে। হুরাইন ধীর পায়ে তাসিনের পাশের জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওজু সে পূর্বেই করে নিয়েছে। বুকের ভেতর দিয়ে একটা শীতল ঢেউ অনুভব করলো তাসিন। একই সাথে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নিলো। বিছানায় পা টানটান করে শুলো তাসিন। পাশ ফিরে হুরাইনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,“পাশে এসো।”

জড়োসড়ো হয়ে এগিয়ে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল হুরাইন। তার ভীষণ লজ্জা করছে। একজন অপরিচিত মানুষ এক মুহূর্তের মাঝে তার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আচ্ছা সে-কি এই মানুষটাকে মহব্বত করবে? পবিত্র বন্ধনে নাকি আল্লাহর রহমত,বরকত, ভালোবাসা থাকে অঢেল! চোখ বুজে অনুভব করলো একটি উষ্ণ হাত এসে তার শরীর ছুঁয়েছে। আলিঙ্গনে নিজের দিকে টে*নে নিয়ে যাচ্ছে। হুরাইন ঝট করে খুলে ফেললো চোখের পাতা। ভড়কে গেল ভীষণ। তাসিনকে তার দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখল। তাসিনের চোখে ঘোর। বিপরীত মানবীর প্রতি আকর্ষণ। ক্রমশ তাদের মাঝের দূরত্ব কমলো। ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো হুরাইনের ঘাড়ের কাছে।

★★★

গতদিনের মত আজও অনেকে এসে হুরাইনকে দেখে যাচ্ছে। কাল তার মাঝে ভীতি থাকলেও আজ চোখমুখ উজ্জ্বল। সকালেই ফুফু শাশুড়ি পরিচয় করিয়ে দিলেন হুরাইনের একমাত্র ননদ নিশির সাথে। মেয়েটি খুব একটা কথা বললো না। ভাবি নিয়ে তেমন উল্লাস নেই তার। হুরাইনের মনে হলো বেশ মেপেঝেপে কথা বলে। দুপুর হওয়ার পূর্বে একটি মেয়ে নিয়ে হুরাইনের কাছে ছুটে এলো নিশি। সালাম দিল হুরাইন। মেয়ে মানুষটি বয়সে তার তুলনায় বড়ো হবেন৷ এক কথায় রূপবতী নারী। হুরাইন তাঁর দৃষ্টিতে থতমত খেল। কেমন গভীর দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। নিশি বলল,“উনি আপনার ননদ হয়। আমার কাজিন, ফাবিহা আপু।”

মিষ্টি করে হাসলো হুরাইন৷ ফাবিহা আরো ঘোরের মাঝে ডুবে গেল। এবার বুঝলো এই নারীর সাথে প্রতিযোগিতা করা, যুদ্ধে নামার যোগ্যতা তার নেই। গুণের কথা পূর্বেই শোনা হয়েছে। আজ তার লাবণ্যময়ী রূপও দেখা হয়ে গেল। ফাবিহা নিজেকে স্বাভাবিক করে জোরপূর্বক মৃদু হাসলো। বলল,“আপনাকে দেখার আগে ভেবেছিলাম আপনি সৌভাগ্যবতী বলেই তাসিন ভাইকে জীবনসঙ্গী রূপে পেয়েছেন৷ এখানে এসে আপনার সম্পর্কে জেনে আপনাকে দেখে আমার ধারণা পরিবর্তন হলো। আপনি নন, তাসিন ভাই সৌভাগ্যবান পুরুষ। আপনার মত স্ত্রী কতজন পুরুষের ভাগ্যে জোটে?”

সামনের আপুটিকে ভালোলাগছে হুরাইনের। বলল,“আমাকে তুমি সম্বোধন করবেন আপু। আমার ভালোলাগবে।”

ফাবিহা বুকের কষ্ট চেপে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। বলল,“তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে। তোমার সংসার জীবনে শান্তির বৃষ্টি হোক। আবারও আমাদের দেখা হবে। আজ তাড়া আছে। আসছি।”

হুরাইন বলল, “এখনই চলে যাচ্ছেন আপু? আপনাকে কাল থেকেও দেখলাম না। আর এখনই বিদায় নিচ্ছেন?”

“ওই যে বললাম, তাড়া আছে। আসছি।”

ফাবিহা চলে যেতেই হুরাইনের মন খারাপ হয়ে গেল।
ফাবিহা বাড়ি পথে রওনা দিয়েছে। তাসিনকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে গেল। তার সুখের জীবনে কাঁটা হয়ে থাকতে চায় না ফাবিহা। ওই মেয়েটাও নিশ্চয়ই তার মত রঙিন স্বপ্ন নিয়ে এসেছে। তার সংসারের অশান্তির কারণ কী করে হয় ফাবিহা?

সকালে বাবার সাথে কাজে হাত লাগিয়ে আর বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেনি তাসিন। হুরাইনের আশেপাশে সারাক্ষণ কেউ না কেউ বসা রইল। এখন বসে আছে তাসিনের ফুফাতো বোনের মেয়ে। সে অপলক হুরাইনের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইলো। হুরাইন যতবার তার দিকে তাকিয়েছে, ততবারই তাকে একইভাবে দেখতে পেল। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,“তাকিয়ে আছো কেন বুড়ী?”

“আপনার ঠোঁট আমার ভালোলাগে।”

তাসিন ভেতরে ঢুকে মেয়েটিকে বলল,“একটু বাইরে যাও তো আম্মু।”

বাচ্চা মেয়েটি চলে গেল এক ছুটে। তাসিন গলা ঝেড়ে গভীর স্বরে বলল,“আমারও ভালোলাগে।”

হুরাইনের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি পড়ে দুষ্টুমি ফুটিয়ে তুললো চোখেমুখে। ধীর স্বর বলল,“ঠোঁট।”

লজ্জা পেয়ে পিছু ঘুরে গেল হুরাইন। বিড়বিড় করে বলল,“খুব বাজে।”

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে