এক টুকরো আলো পর্ব-৪৩ এবং শেষ পর্ব

0
335

#এক_টুকরো_আলো
#অন্তিম_পর্ব
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

আয়েশাকে গোসল করাচ্ছেন সাজেদা। নাতনি আসায় গল্প করার একটা সঙ্গী পেলেন তিনি। আয়েশা মুখ দিয়ে অর্থহীন কিছু শব্দ করে। নাতনি কথা বলতে না পারলেও সাজেদা অনর্গল কথা বলেন তার সাথে।
হুরাইন রান্না শেষ করে নিজে গোসল করতে গেল। বাড়ির সবার প্রাণ আয়েশা। আগে তার চাচ্চুর বাড়িতে আসা-যাওয়া কম ছিল। এখন সুযোগ পেলেই বাড়ি চলে আসে। দাদা যতক্ষণ বাড়ি থাকে, ততক্ষণ নাতনিকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। নানা কিছুদিন পরপরই দেখতে আসেন। তাসিন অবশ্য এটা নিয়ে হুরাইনের সাথে ঝগড়া করার চেষ্টা করে। হুরাইন চুপ করে থাকে। পাত্তা দেয় না বলে ঝগড়াটা ঠিক জমে ওঠে না। সবার চুলদাড়ি আয়েশার প্রিয় জিনিস। কোলে নিলেই খাবলা মে*রে ধরে।

গোসল করিয়ে সাজেদা তাকে নিয়ে দিল হুরাইনের কাছে। মেয়েকে জামা পরাতে দোয়া পড়ল সে। আয়েশা মায়ের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ পিটপিট করে সেও ঠোঁট নাড়ে। হুরাইন মুগ্ধ হয়ে মেয়েকে দেখে। কপালে চুমু খায়। আয়েশা ঠোঁট দুটো বাড়িয়ে মায়ের গাল চু*ষে দেয়।
আয়েশাকে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বউ-শাশুড়ি খেতে বসলো।

তাসিন এসেই মেয়েকে ঘাড়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো। হাতের তালুতে দাঁড় করিয়ে দিল। আয়েশা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাজেদা সাবধান করছেন।
“তাসিন নামা ওকে। কখন আবার বি*প*দ ঘটে।”

তাসিন হাসতে হাসতে বলল,“মাশাআল্লাহ আমার আয়েশা হাতের উপর দাঁড়াতে পারে। কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।”

“কিছু হলে তোকে বাড়ি ছাড়া করব আমি।”

আয়েশাকে হাত থেকে নামিয়ে কোলে নিতেই সে বাবার দাড়ি খামছে ধরল।
তাসিন হাত চেপে ধরে আদুরে স্বরে বলল,“দাড়ি ধরে না মা।”

আয়েশা বাবার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বুঝল কিনা বুঝা গেল না। কিন্তু দাড়ি ছেড়ে দিল।

★★★

ফাবিহা বাথরুমে। বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে শাবাব। তাকে চিন্তত দেখাচ্ছে। ফাবিহা বের হচ্ছে না। এত সময় কেন লাগছে?
তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফাবিহা দরজা ঠে*লে বের হল। শাবাবকে ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে রইল। ফাবিহার চোখমুখ স্বাভাবিক। শাবাব নিভে এলো। ফাবিহাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,“মাত্র তো এক বছর হলো বিয়ের। এখনো সারাজীবন পড়ে আছে। তুমি মন খা*রা*প কোরো না তো।”

অথচ ফাবিহা লক্ষ করল তাকে সান্ত্বনা দেওয়া মানুষটিরই বেশি মন খা*রা*প হয়ে গিয়েছে। গতবার ভেবেছিল সে প্রেগন্যান্ট। তারপরই পিরিয়ড হয়ে গেল তার। এবার আবারও সবাই ধারণা করেছে ফাবিহা প্রেগন্যান্ট।
সে এসে শাবাবের পাশে বসল। শাবাবের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুহাতে ওর গাল চেপে স্থির চোখে চেয়ে বলল,“সন্তান না হলে কি তোমার ভালোবাসা ফুরিয়ে যাবে শাবাব? যেমন তেল শেষ হয়ে গেলে কুপি নিভে যায়?”

শাবাব মন খা*রা*পে*র মাঝেও কেমন করে হেসে দিল। বলল,“আমি তোমাকে তোমার জন্য ভালোবাসি। বাচ্চার জন্য নয়।”

“ওহ্, তাহলে বাচ্চার জন্য নিশ্চয়ই অন্য কাউকে ভালোবাসবে? আরেকটা বিয়ে করবে!”

ফাবিহার মাথায় টো*কা দিয়ে শাবাব বলল,“বোকা মেয়ে। এসব ভেবে মাথায় চাপ নিও না। আমি বিয়ে করতে চাইলে তুমি মানবেই বা কেন? সন্তান না হলে কী হবে? কত সন্তান বাবা-মায়ের অভাবে ডাস্টবিনে, অনাথ আশ্রমে পড়ে থাকে। আমরা তাদের দায়িত্ব নেব।”

ফাবিহার চোখজোড়া বিচরণ করছে শাবাবের মুখে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শাবাবের হাতে চুমু খেয়ে নিজের পেটে রাখল। চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করল তারা কেউ একজনকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবে। শাবাব হতভম্ব। তার মুখে কথা নেই। ফাবিহা মুুচকি হাসল। শাবাবের ঘোর কেটে গেল নিমিষেই।
“এ্যাই তুমি সত্যি বলছ?”

“সত্য-মিথ্যা জানার জন্য দশমাস অপেক্ষা করো।”

শাবাব কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না। সে একেবারে শান্ত হয়ে গেল। তারপরই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফাবিহা অবাক হলো। শাবাবকে দেখে মনে হচ্ছে না সে অখুশি। তাছাড়া বাচ্চার জন্য আগ্রহ তারই বেশি ছিল। তবে এভাবে উঠে গেল কেন?

ফাবিহার সামনে শাববা ঠিকঠাক অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। খুশিতে সে কী করবে বুঝতে পারছে না। মনে মনে বলল,“আমি যে লুকিয়ে এখনো দু-একটা সিগারেট খাই, আমার সন্তান যদি সুস্থ স্বাভাবিক পৃথিবীতে আসে, আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেব আল্লাহ।”

শাবাব দ্বীনের পথে ফেরেনি। তার মাঝে আগ্রহ দেখা যায় না। ফাবিহা পর্দা মেনেই চলে। হুরাইনের মত এত এত আমল করার ক্ষমতা তার না থাকলেও নামাজ-রোজা, পর্দা ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। সাথে শাবাবকে জোর করে নামাজে পাঠায়। পাঁচ ওয়াক্ত সে কোনোদিনই পড়ে না।
হুরাইনের সাথে এই ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়ায় সে বলেছিল, “নরম গলায় ভালোবাসা দিয়ে বোঝাও। না বুঝলে রাগ করে বোঝাও।”

ফাবিহা বলল,“ওর উপর রাগ করে থাকা যায় না। এখন রেগেমেগে বেরিয়ে যাবে। ঘন্টাখানেক পর ঘরে এসে স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে। যেন কিছুই হয়নি। আমি কথা না বললে যেকোনো উপায়ে রাগ ভাঙিয়ে নেয়।”

“আরো ধৈর্য ধরো। তোমার স্বামীর মাঝে আগ্রহ নেই। আগ্রহ জন্মাতে পারলেই তোমার অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যেত।”

ফাবিহা তাই ধৈর্য ধারণ করে আছে। শাবাবকে এখন আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। সে জীবনের শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে।

শাবাব ঘরে আসল একেবারে রাতের খাবার খেয়ে। ফাবিহা বসে আছে। শাবাব জিজ্ঞেস করল,“ঘুমাবে না? শরীর খা*রা*প করবে তোমার।”

“শরীর খা*রা*প করলে কিছু হবে না।”
ফাবিহার গলা ভার ভার।

শাবাব হয়তো বুঝল ফাবিহার এমন আচরণের কারণ। সে নিচু হাঁটু গেড়ে বসে ফাবিহার হাত মুঠোয় নিয়ে নরম স্বরে বলল,“আমি জানি না কীভাবে এত আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করতে হয়। আমার কেবল মনে হচ্ছিল আমি প্রজাপতির মত উড়ছি। থামতে পারছি না। আরো কিছু অনুভূতি হল। কিন্তু আমি তাদের নাম জানি না। ঘর থেকে আমি রাগ করে বের হইনি। আমি নিজেকে নিজের কাছে প্রকাশ করতে বেরিয়ে গিয়েছি। আমার বাচ্চা। তার ছোটো, ছোটো হাত-পা হবে। সে আয়েশার মত আমার, আমার কোলে চড়বে। আমি তোমায় বোঝাতে পারছি না ফাবিহা।”

ফাবিহার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়ালো। শাবাবের হাতের মুঠোয় এখনো তার হাত বন্দী হয়ে আছে।
“তুমি যে নামাজ পড়ো না। তোমার বাচ্চা তোমায় দেখে দেখে শিখবে না?”

“পড়বো।”

সুরাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,“পরীক্ষা করিয়েছ?”

ফাবিহার গালদুটো লাল হয়ে গেল। লজ্জা পেয়ে হাসল সে। সুরাইয়া যা বোঝার বুঝে গেলেন। বিড়বিড় করে পড়লেন,“আলহামদুলিল্লাহ।”

ফিরোজ আলমের নাস্তা নিয়ে ঘরে গিয়ে খবরটা দিলেন ওনাকে। তিনিও একগাল হেসে গদগদ কণ্ঠে বললেন,“আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! শাবাবকে বলো মিষ্টি আনতে।”

বাবার ব্যবসাটা আগের মত নেই। বাবার মত শক্ত হাতে সবটা ধরতে পারেনি সে। মাঝখানে বাবা-ছেলে দুজনই অসুস্থ দেখে অনেকদিন কিছুই দেখাশোনা করতে পারেনি। এখন কোনোভাবে চলছে ব্যাবসা। শাবাবের চোখ পড়ে খেলনার উপর। বাচ্চাদের জামাকাপড়ের উপর। ছেলে না কি মেয়ে আসবে সেটা জানে না। তাই ছেলে-মেয়ে উভয়ের কাপড়ই কিনে নিচ্ছে। সবাই তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসে। শাবাব কারো চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মত করে বাচ্চাদের জিনিসপত্র দিয়ে ঘর ভরিয়ে ফেলার বন্দবস্ত করছে।

দুই পরিবারের কেউই এখন একে-অপরের উপর রেগে নেই। সবাই স্বাভাবিক। তুলি খুশিতে উড়ে উড়ে কাজ করছে। আগে সুযোগ পেলেই কাজ চু*রি করে ঘুমিয়ে পড়ত। এখন কাজ শেষ করে ফাবিহার আশেপাশে থাকে। বারবার জিজ্ঞেস করে,“ভাবি কী খাইবেন?”

আজ পেটের দিকে তাকিয়ে থেকে উৎসুক হয়ে বলল,“ভাবি, বাবু কি লা*থি দেয়?”

ফাবিহা হেসে ফেলে বলল,“এত তাড়াতাড়ি? যখন লা*থি দেবে, তখন তোকে বলবো।”

★★★

আয়েশা কথা বলা শিখেছে। হুরাইন তাকে মা-বাবা বলা না শিখিয়ে তার সাথে বসে কালিমা পাঠ করত, জিকির করত। প্রতিটি কাজে দোয়া পাঠ করত। আয়েশার এখন এসব অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সাজেদা তাকে খেতে বসিয়েছেন। দোয়া পাঠ না করেই খাবার মুখে দিতে নিচ্ছিলেন। আয়েশা আদোও আদোও স্বরে বলল,“ডু’আ, তাতু ডু’আ।”

সাজেদা মুগ্ধ হয়ে মনে মনে কয়েকবার মাশাআল্লাহ পড়লেন। নাতনির ওপর নিজের না নজর লেগে যায়। তারপর দু’আ পড়ে খাবার মুখে দিলেন।

তাসিন তাকে ঘুম পাড়াতে নিল। গান শুনে নয়, ঘুমের দু’আ শুনে নিজে নিজে বলার চেষ্টা করে, তবেই ঘুমায়। তাসিন ঘুমের দু’আ পড়িয়ে ঘুম পাড়ালো আয়েশাকে।
ছোটো ছোটো দুটো হিজাব এনেছে সে। ছোট্ট আয়েশা হিজাব পরে যখন ছোটো ছোটো পায়ে হেঁটে বেড়ায়, তখন তাসিনের মনে হয় তার ঘরে জান্নাত নেমে এসেছে।

আসর নামাজ পড়ে আয়েশার দাদা এসে বসলেন। আয়েশা দাদুর চুল থেকে চিরুনি সরিয়ে এবার দাদার চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। সাজেদার চুলে চিরুনি চালিয়ে সব পেঁচিয়ে দিয়েছেন। সবার আদরের বলে কেউ একটু জোর করেও কথা বলে না। হুরাইন মাঝেমাঝে ধমক দিলে প্রথমে চুপচাপ তাকিয়ে থাকবে। ধীরে ধীরে চোখে পানি টলমল করবে, তারপর গাল ফুলিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। না বলতেই বৃষ্টির মত চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। অভিমান না যাওয়া পর্যন্ত আর মায়ের কাছে যায় না। ঘন্টাখানেক গেলেই আবার মাকে খুঁজে বেড়ায়।
ধমক দেওয়ার কারণে হুরাইনকে চারদিক থেকেই বকা শুনতে হয়। আয়েশার দল ভারী। তার বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ফুফু, মামা-মামি সবাই হুরাইনকে ধমকায়। একটা ধমকের পরিবর্তে তাকে দশটা ধমক শুনতে হয়।

তাসিন যতক্ষণ বাসায় থাকে, সে চোখের আড়াল হতে পারে না আয়েশার। বাথরুম গেলেও বেচারা শান্তি পায় না। আয়েশা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান্না করছে।

“আব্বু দাবো।”

হুরাইন মেয়েকে কোলে নিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,“আব্বু আসছে মা। এইতো এখনই বেরিয়ে যাবে।”

তাসিন যত দ্রুত সম্ভব বের হলো। মেয়েকে কোলে নিতেই আয়েশা বাবার সাথে মিশে গিয়ে বাবার ঘাড়ে মাথা রাখলো। হুরাইনের মাঝেমাঝে বেচারার প্রতি মায়া হয়, আবার পেট ফেটে হাসিও পায়। এমন বাপ ভক্ত মেয়ে বানিয়েছে যে ঠিকমতো প্রকৃতির ডাকেও সাড়া দিতে পারে না। হুরাইনকে ঠোঁট টিপে হাসতে দেখে তাসিন বলল,“আমার মেয়ে যা ইচ্ছে করবে। তাতে তোমার কী?”

“আমার আবার কী? আমি যাচ্ছি বেরিয়ে।”

“যাও।”

হুরাইন বের হতে নিতেই চট করে মাথা উঠিয়ে ফেলল আয়েশা। মায়ের দিকে তাকিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে বলল,“আম্মু দাবো।”

তাসিনের দিকে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে হাসলো হুরাইন। সে গেলে তার মেয়েও সাথে যাবে। হুরাইন আয়েশাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিতেই আয়েশা বলল,“আব্বু দাবো।”

এবার হুরাইনের দিকে তাকিয়ে হাসলো তাসিন। ইশারায় বুঝিয়ে দিল তার মেয়ে তার কাছেই থাকবে। তাসিন কোলে নিতেই আয়েশা আবার মায়ের কোলে যেতে চাইলো। আবার হুরাইন কোলে নিলো। এভাবে সে বেশ মজা পাচ্ছে। একবার বাবার কোলে একবার মায়ের কোলে চড়ে খিলখিল করে হাসছে। ভীষণ সুখী দেখাচ্ছে তিনজনকে। সুখ চিরস্থায়ী নয়। জীবনে উত্থানপতন আসবেই। তবুও বর্তমান সময়টা তাদের সুখেই যাচ্ছে।

★★★

নার্স একটি কন্যা সন্তান এনে শাবাবের কোলে দিল। আশ্চর্য! বে*য়া*দ*প, ব*খা*টে, লা*ফা*ঙ্গা শাবাব কাঁদছে। মেয়েকে দেখে তার কান্না পাচ্ছে। সাজেদা ছেলের কোল থেকে নিয়ে নিলেন নাতনিকে। এই প্রথম বোধহয় ছেলেকে মন থেকেই ধমক দিলেন।
“এদিকে দে। তুই যেভাবে হাত কাঁপা-কাঁপি করছিস।”

শাবাব মায়ের কোলে মেয়েকে দিয়ে অপলক তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে তার জান বের করে দিয়েছে। দুদিন পেটের ভেতর কোনো নড়চড় নেই। ডাক্তার জানালেন দ্রুত সি সেকশন লাগবে।
কলিজার পানি শুকিয়ে গেল তার।

★★★

আদরের কন্যা শূহরাহর কান্নায় বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে শাবাবের। সাথে হিং*স্রতা ছড়িয়ে পড়েছে চোখেমুখে। ১৩ বছরের শূহরাহ মাদ্রাসা থেকে আসার পথে রোজ একটা ছেলে তাকে উ*ত্য*ক্ত করে। সেই ছেলেকে ক*ঠি*ন শা*স্তি দেওয়ার কথা মাথায় এলো শাবাবের। আগামীকাল মেয়ের সাথে বের হবে। কোন ছেলের এতবড় সাহস তার মেয়েকে উ*ত্য*ক্ত করে! মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে দিল।
সে এখনো পুরোপুরি দ্বীনের পথে আসেনি। যতটুকু দ্বীন পালন করার চেষ্টা করে, তা বাধ্য হয়ে ফাবিহার জোরাজোরিতে। ঘুমাতে গিয়ে কাল ছেলেটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল নিজের কথা। সেও কি এভাবে অন্যায় করেনি একটি মেয়ের সঙ্গে? সেই মেয়ে এখন নাহয় তার স্ত্রী। কিন্তু তখন তো স্ত্রী ছিল না। তার মেয়ের মতই একজন বাবার রাজকন্যা ছিল। তাহলে তার নিজের কৃ*ত*ক*র্মে*র শা*স্তিই কি তার মেয়ে পাচ্ছে? পা*প বাপকেও ছাড়ে না। নিজের কৃতকর্মের শা*স্তি একদিন পেতেই হবে। সেটা হোক দুনিয়া কিংবা আখিরাতে। ঘুমন্ত ফাবিহার দিকে তাকালো। দ্বীনের প্রতি মেয়েটির আগ্রহ যেন বেড়েই চলেছে। মেয়ের কথা মনে করল। মেয়েকে হাফেজা বানানোর ইচ্ছে, মাদ্রাসায় পড়াচ্ছে। অথচ সেই মেয়ের বাবা হয়ে ঠিকমতো নামাজ পড়ে না। পরনারী মানে না, চোখের পর্দা করে না। সবকিছু ভেবেই নিজেকে একটা নীচু স্তরের কিট মনে হলো। মনে মনে নিজের হেদায়েত প্রার্থনা করল।

রাতে গভীর ঘুম হলো না। বারবার সজাগ হচ্ছে। ফজরে নিজ থেকেই উঠে গেল। ফাবিহাকে ডেকে দিয়ে মেয়েকে ডাকতে গিয়ে দেখল মেয়ে জায়নামাজে বসে আছে। আফসোস হলো! তার মেয়ে হয়ে তার আগেই নামাজের জন্য প্রস্তুত। অথচ সে? জীবন তো পেরিয়ে যাচ্ছে। কবে হবে হেদায়েত? এই যে সে হেদায়েত প্রাপ্ত হচ্ছে না, এটা কি তার জন্য শা*স্তি নয়? আল্লাহ তাকে নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করে কি নিজের কৃতকর্মের শা*স্তি দিচ্ছেন না? বান্দা তো লাঠির আ*ঘা*ত বা পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারলেই ভাবে এটাই তার সবচেয়ে বড়ো শা*স্তি। অথচ মানুষ বুঝতেও পারে না আল্লাহ কীভাবে বান্দাকে শা*স্তি দেন। বান্দার উপর থেকে রহমত-বরকত উঠিয়ে ফেলেন। আল্লাহর এই নিরব শা*স্তি কতটা ভয়*ঙ্কর!

আজ থেকে এই মুহূর্ত থেকে দ্বীনের পথে চলার প্রতিজ্ঞা করল। আজ মোনাজাতে যে জিনিসটা চাইলো, তা হচ্ছে নিজের হেদায়াত।

★★★

দুটো বাড়িতেই আলো জ্বলছে। খুশির আমেজ দু-বাড়িতেই। মিষ্টি বিতরণ নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে সবাই। দুজন হাফিজার বাড়ির দৃশ্য। দুটি দ্বীনি পরিবার।
শাবাবের গর্ব হচ্ছে। সে একজন হাফিজার বাবা। এখন সে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে। যেখানে দ্বীনি আলোচনা হয়, সেখানে চলে যায়। তার সুপথে ফিরে আসার পেছনে তার স্ত্রী এবং মেয়ের অবদান বেশ।
ফাবিহা আজ এই খুশির দিনে কল দিল একটি নম্বরে। কল তুললো সে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি। সালাম বিনিময়ের পর ফাবিহা বলল,“তোমার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। আমার জীবন যখন অন্ধকারে মোড়ানো, তখন এক টুকরো আলোর সন্ধান নিয়ে এসেছো তুমি।”

হুরাইন মুচকি হেসে বলল,“কখনো আমার প্রশংসা কোরো না। প্রশংসা শুনলে মনে হয় আমার মনে অহংকার জন্ম নিচ্ছে। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই তোমরা আলোর সন্ধান পেয়েছো।”

তাসিন নিজের হাফিজা কন্যাকে জিজ্ঞেস করছে,“আপনি আমার কাছে কী চান মা? যদি পুরো পৃথিবী এনে দেওয়া সম্ভব হতো, আমি তাই করতাম।”

আয়েশা বাবার পাগলামি দেখে হাসছে। তার একটুখানি লজ্জাও হচ্ছে আজ।

#সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে