এক টুকরো আলো পর্ব-০৭

0
225

#এক_টুকরো_আলো
#পর্ব_০৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

শান্তিপ্রিয় মানুষ হওয়ায় কখনো স্ত্রীর সাথে তর্কে যান না তাসিনের বাবা। কিন্তু আজ আর কোন অন্যায় মেনে নিলেন না৷ কড়া গলায় বলে দিলেন।
“তোমার এসব বাহানা চলবে না। আমার কথাই শেষ কথা। আর কিছু শুনতে চাই না আমি।”

সাজেদা রাগে ফেটে পড়লেন। তাসিন দেখলো যে মা খালাকে কিছুই জানায়নি। সে সরাসরি ফাবিহাকে কল দিল। ফোন তুললো না ফাবিহা। পরপর কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল।

ফাবিহা বাড়ি পৌঁছাতেই তার মা আঁতকে উঠলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন মেয়েকে। ফাবিহাকে ধরে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,“এই অবস্থা কেন তোর? কী হয়েছে?”

ফাবিহা ঝিমিয়ে ঘরে ঢুকলো। মৃদু স্বরে বলল,“আগে আমায় ভেতরে যেতে দাও৷ ক্লান্ত আমি। মা ফাবিহাকে ধরে নিয়ে বসিয়ে দিলেন৷ মায়ের মন। দ্রুত পানি দিয়ে অস্থির স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“এবার বল, কী হয়েছে?”

ফাবিহা ধীর গলায় শাবাবের কথা বলল মাকে। তীব্র আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
“ওই হারামজাদার এত বড়ো সাহস! কার মেয়ের সাথে বাজে ব্যবহার করেছে ও জানে না। তোর বাবা আসুক একবার। এর একটা বিহিত করেই ছাড়বো। তুই এতদিন কেন বললি না? খুব বড়ো হয়ে গিয়েছিস, না?”

ফাবিহা চুপ করে রইলো। ভেতরে ভেতরে সেও তীব্র রাগ পুষে রেখেছে। ফোন হাতে নিয়ে তাসিনের কল দেখে মন ভালো হয়ে গেল। শাবাবের চিন্তা একপাশে রেখে ফোন হাতে ঘরের দিকে উঠে গেল। মা জিজ্ঞেস করলেন,“কোথায় যাচ্ছিস?”

“ঘুমাবো৷ আমাকে ডেকো না।”

“যা, বিশ্রাম নে।”

ফাবিহা নিজের ঘরে এসে কল ব্যাক করলো তাসিনকে। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করিয়েই তাসিন ফোন তুললো।
“কেমন আছিস?”

“খুব ভালো।” ফাবিহার নরম স্বর।

তাসিন গম্ভীর স্বরে বলল,“তোর সাথে আমার কথা আছে। ফ্রি আছিস?”

“হ্যাঁ, বল।”

তাসিন কোন প্রকার ভনিতা না করেই বলে ফেললো,“আমি একজনকে পছন্দ করি। আর তাকেই বিয়ে করতে চাই। আমাদের ঘরে বিয়ের আলোচনাও চলছে। তোকে আমি সবসময় নিশির মতোই ছোটো বোনের নজরে দেখে এসেছি।”

ফাবিহা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তার শব্দ স্বল্পতা দেখা দিল। বুক কাঁপছে তার। তাসিন নিশ্চিয়ই তার সাথে মজা করছে। ফাবিহা হাসার চেষ্টা করে তোতলানো স্বরে বলল,“ত তুমি মজা করছো, তাইনা?”

তাসিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“না। আমি সত্যি বলছি। আমি যাকে পছন্দ করি, তার নাম হুরাইন। মা কিছুতেই খালাকে ব্যাপারটা জানাতে পারছিলেন না। জানাতে চাচ্ছেন না। তিনি চান আমি যেন তোকে বিয়ে করি৷ কিন্তু মনের টান যেখানে শূন্য, সেখানে সারাজীবন সংসারের সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি। আমার কথা কি বুঝতে পারছিস? তুই খালাকে একটু বুঝিয়ে নিস। আর আ’ম সরি। আমার দো*ষে*ই ব্যাপারটা এতদূর গড়ালো।”

“আমাকে কে বোঝাবে?” ফাবিহার ব্যথাতুর চোখজোড়া এই কথা বললেও মুখে বলতে পারলো না। তার গলা ধরে আসছে। দ্রুত কথা শেষ করতে চাইল সে। তাই তড়িঘড়ি করে জবাব দিল,“আমি বোঝাবো মাকে। তুমি চিন্তা কোরো না।”

তাসিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,“থ্যংকিউ।”
কল কেটে দিতেই ফাবিহার আটকে রাখা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো। কত সহজেই সবটা বলে দিল। একটা সরি তে কি আর মনের ক্ষ*ত সারিয়ে তোলা যায়? কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেললো সে৷ গোপন চিৎকারে কাঁদলো তার মন। যার আওয়াজ কারো কান পর্যন্ত গেল না৷ যাকে মন দিয়ে এসেছে, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, সেই মানুষটাই আজ তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ফাবিহা ক্রন্দনরত গলায় চাপা আর্তনাদ করে বলল,“আপনার মনে আমায় একটুখানি জায়গা দিলে কী হতো তাসিন ভাই?”

তাসিন – হুরাইনের বিয়ের কথা দ্রুত এগোচ্ছে। যেহেতু বিয়ের কথা পাকা, তাই শুধু শুধু ছেলেমেয়ের মনে আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে লাভ কী? সাজেদা জেদ করে কারো সাথেই কথা বলছেন না। নিশিও মনোক্ষুণ্ণ। তাসিনের বাবা মেহমানের লিস্ট করার সময় সাজেদা সাফসাফ বলে দিলেন উনার বাবার দিকের কোন লোক বিয়েতে আসবে না। তাঁদের যেন গোনায় না ধরা হয়। তাসিনের বাবা চুপচাপ লিস্ট তৈরি করে গেলেন। তিনি নিজে গিয়ে বিয়েতে দাওয়াত দিয়ে আসবেন। উনার দায়িত্ব উনি পালন করবেন। তাঁরা আসুক, না আসুক সম্পূর্ণ তাঁদের ইচ্ছে।

ফাবিহা নিজেকে ধাতস্থ করে সন্ধ্যায় ঘর থেকে বের হলো। চোখমুখের ফোলা ভাব এখনো স্পষ্ট। মুখে পানি দিয়ে মায়ের কাছে গেল। তিনি চিন্তিত স্বরে বললেন,“তোর চোখমুখ এমন ফুলে আছে কেন?”

“মাথাব্যথা করছে মা।”

“সে কি। আমাকে ডাকিসনি কেন? আমি মলম লাগিয়ে দিতাম।”

“এখন আর লাগবে না। শোন না।” বলেই ফাবিহা ইতস্তত করে উঠলো।

“কিছু বলবি? বল না।”

“তুমি আগে বল কোন রিয়েক্ট করবে না৷ আগে ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করবে।”

“ঠিক আছে।”

ফাবিহা ভয়ে ভয়ে তাসিনের কথা মাকে জানালো। শান্ত থাকবেন বলেও ফাবিহার মা শান্ত থাকতে পারলেন না। স্বাভাবিক, কোন মা-ই নিজের মেয়ের অপমান, মন ভাঙার আর্তনাদ মেনে নেবেন না। ঝড়ের পূর্বের পরিবেশ বেশ থমথমে। তিনি বললেন,“এসব আ*জে*বা*জে কথা কে বলেছে তোকে?”

“এসব আ*জে*বা*জে কথা নয়।” রুদ্ধশ্বাসে কথা খানা বলতে গিয়ে এক ফোঁটা অবাধ্য আোখের জল গড়িয়ে পড়লো ফাবিহার।
মায়ের মাথায় যেন বর্জ্রপাত হলো। চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
“কী পেয়েছে আমার মেয়েকে? আমার মেয়ে খেলার পুতুল? আমার ফোন কই?”

ফাবিহা ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল,“মা ঝামেলা কোরো না।”

“এই জন্যই তোর চোখমুখ ফোলা? কেঁদেছিস তুই।”

ফাবিহা ক্রমাগত মাথা নেড়ে অস্বীকার করলো সে কাঁদেনি। তার মা ফোন হাতে নিয়ে কল দিলেন সাজেদার নম্বরে। থামাতে পারলো না ফাবিহা। সাজেদার সাথে তর্কাতর্কি শুরু হলো। সাজেদা ওপাশ থেকে হয়তো বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মিথ্যা, বানোয়াট মনে হলো ফাবিহার মায়ের কাছে। রাগে শরীর থরথর করে কাঁপছে।
সাজেদা বোনকে বোঝাতে অক্ষম। তিনি তো মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন ফাবিহাকে বউ করে নিতে। ছেলে যদি না শোনে তাহলে উনারই বা কী করার আছে? সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়েও নিলেন তিনি। ছেলের মুখের দিকেও তাকাচ্ছেন না। আর কী করতে পারেন?

গেটের দিকে মুখ করে বাইকের উপর বসে রইলো শাবাব। ফাবিহা গেট দিয়ে প্রবেশ করেছে।মনে হচ্ছে প্রাণহীন দেহটা হেঁটে আসছে। চোখেমুখে অন্যদিনের মতো উজ্জ্বলতা নেই আজ। নেই কোন তেজ। ভ্রু কুঁচকে গেল শাবাবের। বিড়বিড় করে বলল,“এর আবার কী হলো? একটা চ*ড় খেয়ে এই অবস্থা?”

তার সামনে দিয়ে ফাবিহা হেঁটে চলে গেল। ফরহাদ বলল,“ভাই, মাইয়া দেখি চুপসে গেছে। যে চ*ড়*টা দিছেন ভাই, আমি নিজেই ভয় পাই গেছি।”

শাবাব ফরহাদের কথায় প্রত্যুত্তর না করে তীক্ষ্ণ চোখে ফাবিহার ক্লাসের দিকে তাকিয়ে রইলো। ক্লাস শেষে বের হয়ে গেল ফাবিহা। ক্যাম্পাসের বিপরীতে তার বাসা। সামনে এগিয়ে যেতেই গতকালের মতো পথ রোধ করে দাঁড়ালো শাবাব। সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করে বিদ্রুপ করে বলল,“প্রেমিক ছ্যাকা দিয়েছে পরমা সুন্দরী? কেঁদেছ কেন? আমার কাছে এসে দেখ, আমি ছ্যাকা দেব না। সত্যি বলছি।”

ফাবিহা শক্ত মুখে বলল,“আপনার সাথে আমি কোন কথা বলতে চাই না। পথ থেকে সরে দাঁড়ান।”

“সত্যি বলছি। তোমার প্রেমিকের চেয়েও বেশি ভালোবাসবো তোমায়৷ ছ্যাকাটাও তারচেয়ে বড়ো দেব।”
শেষ কথাটা ফিসফিসিয়ে বলেই শব্দ করে হেসে ফেললো শাবাব। অপমানে শরীর রিরি করে উঠছে। দাঁতে দাঁত চেপে একটা কথাই উচ্ছারণ করলো ফাবিহা।
“ল*ম্প*ট কোথাকার।”

পাশ কাটিয়ে যেতে যেতেই শুনতে পেল শাবাবের স্বর। “গালে মলম লাগিয়ে নিও পরমা সুন্দরী। দেখতে ভালোলাগছে না।”

ফাবিহা দাঁড়িয়ে পড়লো। পিছু ঘুরে করুণ গলায় বলল,“আমার পিছু ছাড়বেন কবে?”

শাবাবের চাহনি পরিবর্তন হলো। কোমল হলো চেহারার আদল। এবার বুঝি রহম করবে মেয়েটার উপর! পরক্ষণে মুখ ফুটে বলল,
“আমার সাথে প্রেম করো। তখন আর পিছু করবো না। ছ্যাকা দেব।”

শাবাবের ঠোঁটে ফিচেল হাসি।
ফাবিহা নিজের কাজে নিজেকে দোষারোপ করলো। সে কেন এই বেয়া*দব ছেলেটার সাথে কথা বলতে গেল? এ সোজা হওয়ার মতো ছেলে নয়৷ রাস্তা পার হওয়ার আগে সামনে দিয়ে একটা ট্রাক গেল। যদি লম্প*টটাকে পি*ষে মা*র*তে পারতো, তবে ক্ষো*ভ মিটে যেত।

তাসিন -হুরাইনের বিয়েতে তাসিনের মায়ের পক্ষের কোন লোকজন এলো না। বরপক্ষ থেকে খুবই কম লোকজন গেল হুরাইনের বাড়ি। মসজিদে অবস্থানরত সকলে অপেক্ষায় আছে। স্বল্প পরিমাণ দেনমোহর ধার্য করে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল। জনাব আজাদ জামাতা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। হুরাইনের এক অজানা অনুভূতি হচ্ছে। সে নিজেকেই বুঝে উঠতে পারছে না। বুক ধুকপুক করছে তার। তাসিন মুখিয়ে আছে তার প্রিয় বিবি সাহেবাকে এক নজর দেখার জন্য। আজ তারা একে অপরের জন্য হালাল। আর লুকোচুরি করে দেখতে হবে না। খুব কাছ থেকে দেখতে পারবে, চাইলেই একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারবে।

পুরো পর্দার সহিত বিদায় দেওয়া হলো হুরাইনকে। প্রিয় বাবা-মা, প্রিয় পরিবার ছেড়ে যেতে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। নিকাবের ভেতর তার গাল ভিজে একাকার। চোখজোড়া এখনো জলে টইটম্বুর। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। হুরাইনের কান্নার মাঝেই একটি শক্তপোক্ত হাত তার হাত ছুঁয়ে দিল। কেঁপে উঠলো হুরাইন। কান্না থেমে গেল তার। তাসিন কেমন বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল। ছোটো স্বরে শুধালো, “পানি খাবে?”

হুরাইন জমে বসে রইলো। নড়াচড়া করতে পারলো না। তাসিন তার জড়তা দেখে বলল,“বিবি তুমি আমার। ভয় নেই। পানি দেব?”

হুরাইন মাথা নেড়ে না জানালো। আড় চোখে একবার সামনে ড্রাইভারের দিকে তাকাতে গিয়েও মাথানিচু করে ফেললো। তাসিন বলল,“উনাকে নামতে বলি। তুমি পানি খাও।”

এবারেও না সূচক মাথা নাড়লো হুরাইন।
নতুন বউ নিয়ে গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। সাজেদা বের হয়ে এলেন না। হুরাইনের ফুফু শাশুড়ীরা আগ বাড়িয়ে সব করছেন। মান রক্ষা করতে হবে যে। যিনি হুরাইনকে দেখছেন, তিনিই মাশাআল্লাহ বলে থামছেন। এভাবে এতগুলো দৃষ্টির কবলে পড়ে অস্বস্তি বাড়লো হুরাইনের। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। চুপচাপ সবটা মেনে নিতে হলো।

নিশি ফোন করলো ফাবিহাকে। জানালো তাসিন বউ নিয়ে এসেছে। সাথে রাগ, বিরক্তি দুটোই প্রকাশ করলো৷
“বড়ো ভাইয়ের বিয়ে, অথচ আমি একমাত্র বোন হয়ে বিয়েতে যেতে পারলাম না। বিয়ে নাকি কোন শোকের মাঝে আছি বুঝতে পারছি না। কোন হৈ-হুল্লোড় নেই৷ তুমি আমার ভাবি হলে কত ভালো হতো।”

ফাবিহা নিজের কান্না চেপে বলল,“আল্লাহ যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন৷ মা ডাকছে আমায়। পরে কথা বলবো।”

“শোন না। তুমি আসবে কাল?”

“চেষ্টা করবো।”
বলে কল কেটে দিল ফাবিহা। তার কিচ্ছু ভালোলাগছে না। হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে নিজেকে আঘাত করার চেষ্টা করলো। টেনে সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। রাগ গিয়ে এবার চুলের উপর পড়লো। পরক্ষণে হাঁটু গুটিয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদলো। দেখতে ইচ্ছে করলো সেই সৌভাগ্যবতীকে। যে দেখা না দিয়েও তাকে পরাজিত করে তাসিনকে জিতে নিয়েছে। এক সময় কাঁদতে কাঁদতে শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠলো। থম ধরে পড়ে রইলো ফাবিহা। এখন আর চোখের পাতা মেলে ধরতে ইচ্ছে করছে না।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে