অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -১০

0
1567

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১০

বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করতে গিয়ে আরেক ঝক্কি সামলাতে হয়েছে।অনেক তর্কবিতর্ক শেষে ঠিক হলো সামনের শুক্রবারে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে আর সমস্ত অনুষ্ঠান আরাফাত সুস্থ হওয়ার পর করা হবে।সবাই এতে রাজি তবে রাহাত এত জলদি বিয়ের জন্য রাজি ছিলো না।তার ইচ্ছে ছিল আরাফাত সুস্থ হওয়ার পর বিয়ে দিবে,কিন্তু তাদের সবার জোরাজুরিতে তার যুক্তি ঠিকলো না বেশিক্ষণ।মিসেস মুমতাহিনা চান দ্রুত বিয়ের কাজ সম্পন্ন হোক।

সব ঠিকঠাক শেষে মিসেস মুমতাহিনা মাহাকে ডেকে এনে সবার সামনে তাকে সোনার বালা,আংটি ও চেইন পরিয়ে দিয়ে বললেন;

-‘মাশা-আল্লাহ!আমার মা টাকে সোনার মতো লাগছে দেখতে।অনেক অনেক সুখী হ আম্মা।এই দোয়াই করি।’

মাহার কপালে চুমু খেয়ে কথাগুলো আদুরে কন্ঠে বললেন তিনি।মাহা সলজ্জ হাসলো।মি.এরশাদ মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন;

-‘বিয়ে হয়ে যাবে মানে এটা নয় যে নিজেকে আগের থেকে পরিবর্তন করে ফেলতে হবে,আমার মা আগে তুই যেমন দুষ্টু ছিলি বাকি জীবনও তেমন দুষ্টুই থাকিস!আমার ছেলের বউ কম আমাদের মেয়ে হয়ে থাকবি মামণি।আজ থেকে আমি তোর আরেক বাবা।আতিকের মেয়ে আজ থেকে আমাদেরও মেয়ে।’

সাইফ কিছু নিয়ে আসে নি তাই মাহার হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো;
-‘ভাইয়ের তরফ থেকে এই সামান্য কিছু টাকা।তোমার পছন্দ মতো কিছু কিনে নিও বোন।’

মাহা তো খুশিতে বাকবাকুম।এই টাকা দিয়ে সে আরও কয়টা মুরগি কিনে আনবে।সাথে অনলাইন থেকে দুটো শাড়ির অর্ডার দিবে।নিজের টাকা উড়ানোর চাইতে অন্য কারও দেয়া টাকা খরচ করতে তার মজা লাগে ভীষণ।

মিসেস মুমতাহিনারা দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।এতক্ষণ অবধি রাহাত একদম স্বাভাবিক ছিলো।কিন্তু ওনারা যাওয়ার পর মাহাকে ক্যাঁক করে ধরলো সে।ধমক দিয়ে মাহাকে বললো;

-‘বোকার হদ্দ তুই না করতে পারলি না তাদের?আমার কথা তাদের সামনে বলার কী দরকার ছিলো?কী বাধ্য মেয়ে ওনি,আমার পারমিশন ছাড়া নাকি বিয়ে করবেন না!সোজাসাপটা না করে দিতে কী মুখে ঠাডা পড়ছিলো তখন?’

-‘আহ,কী শুরু করেছো রাহাত?ওকে কেন ধমকাচ্ছ তুমি?এখানে আমার মেয়ের কী দোষ?সে তো ভালো কথাই বলেছে!আর আরাফাত ছেলে হিসেবে কোন দিক দিয়ে খারাপ বলে মনে হয় তোমার?’

মি.আতিক পাল্টা ধমক দিয়ে বললেন রাহাতকে।মাহা চুপচাপ মায়ের কাছে বসে ওনার শাড়ির আঁচল নিয়ে খুটছে।আনিশা মাহার রুমে বসে বসে ফোন টিপছে।ওদের পারিবারিক বিষয়ে থাকাটা তার কাছে বেমানান তাই এখান থেকে চলে গেছে।

মি.আতিকের কথার বিপরীতে রাহাত আবারও চড়া কন্ঠে জবাব দিলো;

-‘আরাফাত খারাপ নয়,খারাপ আমার কপাল।তোমরা জানো না এই ছেলে বেশি ইমোশনাল!ছেলেরা হবে বাস্তবভিত্তিক,এত ইমোশন হলে তাদের মানায় না।সামান্য একটা মেয়ে ধোঁকা দেয়ায় আজ তার এই অবস্থা পরে হালকা কোনো বিপদ আসলেই তো সে সহজে ভেঙে পড়বে।জেনেশুনে এমন কারও সাথে বিয়ে দিতে চাইনি আমি তোমার মেয়েকে!বেশি ওকালতি করতে যাওয়ার ফল ভোগ করো এখন।আমি কিচ্ছু জানি না।’

-‘রাগ করিস না বাবা,ওখানে বিয়ে হলে মাহা অনেক সুখী হবে!আরাফাত অনেক ভালো একটা ছেলে।আমরা সব জেনেশুনেই তো রাজি হয়েছি।তোদের জন্মের আগের থেকে তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক।ওরা সবাই অনেক ভালো মানুষ,দেখিস মাহাও খুব ভালো থাকবে।তুই রাগ করিস না বাবা।যা হয়েছে মেনে নে!’

মিসেস মিনারা নরম স্বরে বললেন কথাগুলো রাহাতের দিকে তাকিয়ে।বাবাকে এত রাগতে দেখে জাওয়াদ ড্রয়িং রুমের সোফার চিপায় লুকিয়ে বসে আছে চুপচাপ।টু শব্দও করছে না ভয়ে।রাহাত আর কোনো কথা বললো না।”তোমাদের যা ভালো লাগে তাই করো আমাকে কিছু বলো না” এই কথা বলেই ড্রয়িং রুম ছেড়ে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল সে।তার পিছন পিছন ইরাও গেল।মিসেস মিনারা জিমিকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে আছেন,অসহায় দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে।মি.আতিক ইশারায় মিসেস মিনাকে আশ্বস্ত করে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলেন।মাহাও কোনো কথা ছাড়া নিজের রুমে চলে গেছে।

-‘কী রে!কী কথা হলো?সব ঠিকঠাক আছে তো?’

মাহার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো আনিশা।মাহা রুমের দরজা লক করে চিল মুডে এসে আনিশার পাশে বসে বললো;

-‘ভাইয়া সাময়িক চিল্লাচিল্লি করছে ঠিকই তবে ব্যাপার না,বিয়েটা তো হবেই!আটকানোর সাধ্য কার?’

আনিশা ফিক করে হেসে দিয়ে বললো;
-‘তুই এক চিজ রে বোন?তোর ভাইয়ের এত রাগারাগিতে মনে হচ্ছে তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস না,যুদ্ধের ময়দানে যাচ্ছিস!হায়…টুরু লাভ স্টোরি বোধহয় একেই বলে তাই না?কত বাঁধা বিপত্তি আসছে তাও বিয়ে না করে ছাড়বি না।’

-‘ইউ আর রাইট দোস্ত!হাজারও বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে আমি অবশেষে আরাফাতকে নিজের করে পাচ্ছি।সহজভাবে চাইতে গেলে জীবনেও পেতাম না তাকে,জাস্ট একটু বুদ্ধি খাটিয়েছি।ব্যস নাউ আই এম সাকসেস!তবে আরাফাত সুস্থ থাকলে এটা জীবনেও হওয়ার ছিলো না।কারণ সে আমায় পছন্দ করে এজ এ সিস্টার হিসেবে,প্রেমিকা বা বউ হিসেবে নয়!এক্সিডেন্ট করেছে বলেই তাকে আমি পাচ্ছি।নয়তো ওর আর আমার বিয়ে কোনোদিনও সম্ভব ছিলো না!’

-‘আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব!
চিন্তা করিস না।তোর বিয়ের সব ঠিকঠাক মতোই সম্পন্ন হবে।এবং বিয়ের পর আরাফাত ভাইয়ার সাথে তুই অনেক সুখী হবি দেখিস।এমন একটা সময় আসবে যখন আরাফাত ভাইয়া তোকে চোখে হারাবে!এবং তা খুব শীঘ্রই হবে!’

মাহাকে জড়িয়ে ধরে কথাটা বললো আনিশা।মাহা মুচকি হেসে বললো;
-‘তাই যেন হয়!’

⛓️

লিসা নিসা ভীষণ খুশি হয়েছে মাহা তাদের ভাবী হয়ে আসবে কথাটি শুনে।ওরা এখনই প্ল্যানিং শুরু করছে বিয়েতে কী পড়বে কী কেনাকাটা করবে না করবে এসব!মি.এরশাদ একদম কাছের কয়েকজনকে দাওয়াত দিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে।বিয়েটা একদমই ছোট্ট আয়োজনের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে তাই যাদেরকে দাওয়াত না দিলেই নয় তাদেরকে ফোন করে বলে দিলেন বিয়ের কথা।সাইফ আজকে আর অফিসে যায় নি।সে বসে বসে লিস্ট করছে কী কী লাগবে না লাগবে সব!মিসেস মুমতাহিনা কালকে ইশানীকে নিয়ে শপিংয়ে যাবেন।আর এর পরদিন লিসা নিসা যাবে মাহা,নওশিন আর ইরার সাথে।ধাপে ধাপে সকল কাজ শেষ করতে হবে।নয়তো পরে ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

মিসেস মুমতাহিনা লিসাকে সাথে নিয়ে আরাফাতকে ধরে ধরে বিছানার ওপর আধশোয়া করে বালিশে হেলান দিয়ে বসালেন।আরাফাত চুপচাপ অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।মিসেস মুমতাহিনা ছেলের গালে মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললেন;

-‘জানিস বাবা,আজকে মাহার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করে এলাম।এতদিন পর বুঝতে পারলাম যে তোর সাথে একমাত্র মাহাকেই ভালো মানায়।জানিস মাহা তোকে খুব ভালোবাসে,আমি শিওর মাহা তোকে খুব ভালো রাখবে।’

কথাগুলো আরাফাতের মনে কোনো প্রভাব ফেললো বলে মনে হয় না।কারণ সে আগের মতো একই ভাবে একধ্যানে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।মিসেস মুমতাহিনা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে লিসাকে বললেন;

-‘যা তো মা,তোর ভাবীকে বলে আরাফাতের জন্য খিচুড়ি নিয়ে আয়।ওর খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।’

-‘হ্যা আম্মু যাচ্ছি।’

আরাফাতের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মিসেস মুমতাহিনা করুন কন্ঠে বললেন;

-‘এবার তো একটু স্বাভাবিক হো বাপ!আর কতকাল তুই এভাবে চুপচাপ হয়ে থাকবি।তোর এই নিরবতা যে আমায় শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।কেন আগের মতো হাসছিস না,কথা বলছিস না?এত কীসের কষ্ট তোর বাপ?একটু কথা বল না আমার সাথে!মনটা যে খা খা করে তোর কথা শোনার জন্য!’

চোখ জোড়া থেকে দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে মিসেস মুমতাহিনার।ছেলের এই নিরবতা মানতে খুব কষ্ট হয় যে তাঁর।ছেলেটা কেন স্বাভাবিক হয় না?

লিসা খাবার নিয়ে আসায় চোখের জল মুছলেন তিনি।তারপর খুবই সন্তর্পণে ছেলেকে খাওয়াতে লাগলেন নরম খিচুড়ি।আরাফাতকে এখন বাচ্চাদের মতো ট্রিট করতে হয় খাবার খাওয়াতে গেলে।সহজে খেতে চায় না।একপ্রকার জোর করেই মুখে ঢুকিয়ে দিতে হয় নয়তো হা করে নিজে থেকে মুখে নেয় না।

কোমায় না গেলেও কোমার মতো পরিস্থিতিতে আছে বর্তমানে আরাফাত।রাহাত বলেছে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে তার সময়ের প্রয়োজন।তাকে সবসময় উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করতে হবে।তবে ওনারা কেন জানি সেটা করতে পারেন না।নিজের রুমেই সারাদিন থাকতে হয় আরাফাতকে।মি.এরশাদও নিজের ব্যবসা এবং আরাফাতের ব্যবসা নিয়ে বিজি,সাইফ তার অফিস নিয়ে,ইশানী ছেলে ও সংসার নিয়ে,লিসা নিসা স্কুল নিয়ে সবাই প্রচুর ব্যস্তসময় পার করছে।শুধু মিসেস মুমতাহিনা আর ওই ছেলেটাই একমাত্র যে আরাফাতের খেয়াল রাখে।নয়তো কারও সময় নেই।এজন্যই রাহাত তাকে বিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলো।

আরাফাতকে সামান্য খিচুড়ি খাইয়ে দিয়ে তার মুখ মুছে দিলেন মিসেস মুমতাহিনা।আরাফাতকে ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল ওই ছেলেটি।মিসেস মুমতাহিনা মলিন মুখে নিজের রুমে চলে গেলেন।কিছু কাজ বাকি আছে তা সারতে।

তিনি তার রুমের আলমারি খুলে সেখান থেকে কিছু স্বর্ণের গহনাঘাটি ও ওনার শ্বাশুড়ির রেখে যাওয়া শাড়ি গুলো বের করলেন।সেখান থেকে কিছু শাড়ি ও গহনা মাহার জন্য আলাদা করে রাখছেন তিনি।মাহার জন্য শুধু আকদের আংটি আর নাকফুল কিনতে হবে,বাকিসব ওনার কাছে আছে আলহামদুলিল্লাহ।

⛓️

নওশিন রিয়াজকে নিয়ে আজকেই চলে আসছে।সে তো মারাত্মক অবাক হয়েছে আরাফাতের সাথে মাহার বিয়ে ঠিক করায়।সে ভাবেও নি কখনো এমনটাও হতে পারে বলে।মাহা তো নিজের রুমে বসে আছে জিমিকে কোলে নিয়ে।পাশেই জাওয়াদ রং পেন্সিল দিয়ে একমনে আঁকিবুঁকি করছে।মাহার শয়নে স্বপনে শুধুই আরাফাত।ও ব্যতিত আর কিছু মাথায়ই আসে না তার।

মি.আতিকের একদম নিকটাত্মীয় বলতে একমাত্র আরাফাতের পরিবার।আর কেউ এই দেশে নেই।ওনার এক আপন ছোট ভাই আছে,সে সপরিবারে সৌদি আরবে থাকে।আর কাছাকাছি কোনো আত্মীয় নেই।তাই কাউকে দাওয়াত দেয়ারও প্যারা নেই।তবে ইরার পরিবার ও রিয়াজের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত করা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।আত্মীয় বলতে শুধু এরাই।

নওশিন মাহার রুমে এসে মাহার মাথায় আলতো ভাবে চাটি দিয়ে বললো;

-‘একারণেই বুঝি আরাফাতের ওই সো কলড গার্লফ্রেন্ডের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করা হয়েছিলো তাই না?’

কাশি ওঠে গেল মাহার নওশিনের কথা শুনে।ধরা পড়া চোরের মতো চেহারা হয়েছে তার।আমতা আমতা করে জবাব দিলো;

-‘আসলে তুমি যা ভাবছো তা নয় আপু!আমি ওসব কিছুতে নেই বিশ্বাস করো।’

-‘হয়েছে বুঝতে পেরেছি আমি।এতোটাও বোকা নই যে তোর মতিগতি বুঝতে পারবো না।তোর বড়বোন হই আমি,বোন হয়ে বোনের মনের কথা বুঝবো না তা কী করে হয়!’

মাহা জিমিকে একহাতে ধরে অন্যহাতে নওশিনকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বললো;

-‘কাউকে বলো না আপু প্লিজ।আমি অনেক আগে থেকেই আরাফাত ভাইয়াকে পছন্দ করতাম,কিন্তু কখনো কাউকে কিছু বুঝতে দেই নি।এমনকি যাকে ভালোবাসি সে নিজেও এ ব্যাপারে জানে না কিছু।নিজের অনুভূতি নিজের কাছেই লুকিয়ে রেখেছিলাম।’

নওশিন মাহার কপালে চুমু খেয়ে জবাব দিলো;
-‘আমাকে আগে বললে তোকে নিশ্চয়ই বকতাম না আমি।এই চাপা স্বভাবটা বাদ দে বোন।আর কাউকে কিছু না জানাস,আমাকে তো বলতে পারিস?হাজার গোপনীয় হোক তবুও আমাকে বলিস।একা একা নিজে থেকে কোনো মাতব্বরি করতে যাস না যেন!যাকগে,নতুন জীবনের জন্য কনগ্রেটস সোনা!তোর জীবনে সুখের বন্যা নেমে আসুক এই দোয়াই করি।’

-‘থ্যাংকিউ আপুনি!এজন্যই তোমাকে এত ভালোবাসি আমি।আই লাভ ইউ সো মাচ।’

-‘হয়েছে এখন আয় তোকে কিছু রূপচর্চা শিখিয়ে দিই।বিয়ের দিন যাতে মেকআপ অনেক ভালো হয়।আয়’

নওশিনের কাজে বাঁধা দেয় না মাহা।কারণ সে জানে এটা সৌন্দর্য বৃদ্ধির রূপচর্চা নয়,এটা হলো মুখের অয়েলি ভাব এবং নাকের হোয়াইট হেডস দূর করার টেকনিক।গরম কালে মাহার মুখ প্রচুর অয়েলি হয়ে যায়,তাই নওশিন তাকে ফেসিয়াল করে দেয় মাঝেমধ্যে।এখনও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না।

ইরা জিমিকে নিয়ে গেল খাওয়ানোর জন্য।জাওয়াদ মিসেস মিনারার কাছে গেছে।রিয়াজ আর মি.আতিক বিয়ের ব্যাপারে ডিসকাস করছেন ড্রয়িং রুমে বসে।রাহাত হসপিটালে চলে গেছে বিকালেই।সে রাগে ফুলে ঢোল হয়ে আছে,এখন তাকে কিছু বলা মানে বারুদের কারখানায় আগুন জ্বালানো।তাই ভয়ে কেউ তাকে ঘাঁটছে না।

⛓️

রাত সাড়ে বারোটা বাজে,
মাহা একা একা নিজের রুমে শুয়ে আছে।রুমের বাতি নেভানো,সাথে দরজাও আটকানো।এতে সে একটুও ভয় পাচ্ছে না।তার মনে জ্বীন ভুতেরও ভয় নাই।সে আনমনে চিন্তা করছে আরাফাতের কথা।সে যতটুকু বুঝতে পারছে,আরাফাতের সেবাযত্নে যথেষ্ট অবহেলা হচ্ছে।সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তার দিকে যে কেউ বিশেষ নজর রাখতে পারছে না তা মাহা ঢের বুঝতে পারছে।আরাফাতের চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না মাহার,পুরোটা রাত ছটফট করতে করতেই কেটে যায়।এতটা ভালোবাসার জন্যই তো মাহা অন্য কোনো দিকে মনযোগ দিতে পারে না।তার চিন্তা চেতনা সমস্তটা জুড়ে শুধুই আরাফাতের বসবাস,আর কিছু নেই।

চোখ বন্ধ করে চুপচাপ ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে।নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়ে বোঝালো যে আর মাত্র হাতেগোনা ক’টাদিন,তারপর থেকে আরাফাত সারাজীবনের জন্য তার হয়ে যাবে।আরাফাতের সাথে ছায়ার মতো লেপ্টে থাকবে সে,কখনো নিজের থেকে দূরে সরতে দেবে না।
এসব ভেবে ভেবেই ঘুমিয়ে পড়লো মাহা।রাতে সজাগ থাকলে বিয়ের সময় তার চেহারা মলিন দেখাবে তাই একটু দ্রুতই ঘুমিয়ে গেল।

এদিকে,
আরাফাত সেই কবেই হাই পাওয়ারের মেডিসিনের প্রভাবে ঘুমিয়ে গেছে।তার সাথে বিছানার পাশে নার্স ছেলেটিও আছে।মিসেস মুমতাহিনা একবার ছেলেকে এসে দেখে তারপর চলে গেছেন।আরাফাত জানেও না তার জীবন যে আর ক’দিন পরে মাহার সাথে জুড়তে যাচ্ছে।তার কোনোদিকে কোনো ধ্যান নেই।মানসিক ভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে তার আজ এই অবস্থা।না জানি কবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠতে পারবে সে।আদৌ পারবে কিনা তা-ই বা কে জানে?

⛓️

সকালে ঘুম থেকে ওঠে মাহা তার নিয়মমাফিক প্রতিটা গাছে পানি দিলো,মুরগির কুটিরের দরজা খুলে তাদের বের করে দানা পানি খেতে দিলো।যে ডিমগুলো কুটিরে ছিলো সেগুলো ঝুড়িতে ভরলো।সবকাজ শেষে বাসার ভেতর প্রবেশ করার সময় দেখতে পেল সদরদরজার সামনের বারান্দায় নওশিন মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে দাঁত ব্রাশ করছে।মাহাকে হাত নেড়ে হাই দিলো সে,মাহাও রিপ্লাই দিয়ে ভেতরে চলে গেল।মাহা একদম স্বাভাবিক।বিয়ের বিষয়টা তার ওপর এত প্রভাব ফেলতে পারে নি,তার কাছে সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

একটু পর একে একে বাসার সকলে ঘুম থেকে ওঠলেন।শুরু হলো সবার নিত্যদিনের কাজকর্ম।রাহাত রাতে বাসায় ফিরে নি।সার্জারী ছিলো তার রাতে।সে দুপুরের আগে বাসায় ফিরে এলো।এসেই রুমে গিয়ে গোসল করে ঘুমিয়ে গেছে।ইরা আর খাওয়ার জন্য ডাকে নি ভয়ে,লোকটা কখন কোন মুডে থাকে বলা যায় না।

আনিশা আসায় মাহা আর নওশিন ওরা তিনজনে মিলে আড্ডা দিতে লাগলো মাহার রুমে বসে।ওদের সাথে ইরাও এসে যোগ দিলো।

এদিকে,
মিসেস মুমতাহিনা ইশানীকে সাথে নিয়ে শপিংমলে গেছেন দুপুরের পর।সারা মার্কেট চষে মাহার জন্য বিয়ের লেহেঙ্গা,ভারী কারুকাজ করা ও আটপৌরে অনেকগুলো শাড়ি কিনলেন।রেডিমেট সেলোয়ার-কামিজ,আনরেডি থ্রি পিস,জুতা,আন্ডারগার্মেন্টস,অর্নামেন্টস,মেকআপসব কিনেছেন।মিসেস মিনারার জন্য শাড়ি,নওশিনের জন্য শাড়ি আর থ্রি-পিস,ইরার জন্য শাড়ি,ফুলমতির জন্য থ্রি পিস,বাচ্চাদের জন্য কাপড় সব কেনা শেষ।এখন শুধু রাহাত,মি.আতিক আর রিয়াজের পোশাক কেনা বাকি রয়েছে।সেসব আজ সময় করে সাইফ এসে কিনে নিয়ে যাবে।

এদিকে আরাফাতের জন্য মি.আতিক আর রিয়াজ গেছেন ছেলেদের কাপড় চোপড়ের শো-রুমে।আরাফাতের জন্য,মি.এরশাদের জন্য,সাইফের জন্য,আর রিহাদের জন্য কেনাকাটা করলেন অনেক সময় নিয়ে।মেয়েদের কেনাকাটা মেয়েরা করবে,এ সম্পর্কে তাদের কোনো আইডিয়া নেই।তাই শুধু সব পুরুষ মানুষের জন্য কেনাকাটা করা হয়েছে।নিজেদের জন্যেও কিছু কেনাকাটা করলেন মি.আতিক।বিয়েতে যা যা দিতে হয় লিস্ট অনুযায়ী সব কেনা শেষ।এখন শুধু বাজার সদাই বাকি আছে।সেসবও কাল পরশু কেনা হয়ে যাবে।

আজকে সারাদিন এভাবেই টুকটাক প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতে করতে কেটে গেল।

পরদিন,,
দুপুরের খাবার খাওয়া শেষে মাহা,আনিশা,ইরা জিমিকে নিয়ে শপিংয়ের জন্য বেরোলো।লিসা নিসা কথা অনুযায়ী শপিংমলের সামনে অপেক্ষা করবে তাদের জন্য।নওশিনকে রিয়াজ এভাবে কোথাও যেতে দেয় না,প্রেগ্ন্যাসির এ সময়টায় বাসা থেকে না বের হওয়াটাই ভালো।রিয়াজ তাই রিস্ক নিতে চায় না।এজন্য আজ শপিংয়েও যেতে দেয় নি।

মাহা,আনিশা আর ইরা শপিংয়ের সামনেই লিসা নিসাকে পেল।ওদের সাথে রাফি,তার বউ মুন্নি ও ছেলে পিয়াসও আছে।ওদের সাথে কুশল বিনিময় করে মলের ভেতর প্রবেশ করলো ওরা।শুরু হলো শপিং।কেনাকাটা শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে।সবাই একটা রেস্তোরাঁয় ওঠে হালকা নাশতা সেড়ে যে যার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

সারাটাদিন প্রচুর ব্যস্ততায় সময় কেটেছে।জাওয়াদ কান্না করতে করতে শেষ,কারণ তাকে মাহা রা সাথে করে নিয়ে যায় নি তাই।পিচ্চিটার অভিমান ভাঙতে অনেক গুলো চকোলেট আর নতুন জামা দিতে হয়েছে।তারপর তার রাগ কমেছে।মাহা হাসছে তার ভাতিজার কাজ দেখে।

আজকে বিয়ের সমস্ত তথ্যাদি পাঠিয়ে দিয়েছেন মিসেস মুমতাহিনা।মাহার রুমে তার বিয়ের লেহেঙ্গা শাড়ি,গহনা,জামা,জুতা,কসমেটিকস, অর্নামেন্টসের পসরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে।নওশিন সব দেখাচ্ছে একে একে,মাহা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে।প্রতিটা জিনিসই প্রচুর দামী দামী কিনেছেন মিসেস মুমতাহিনা।সকলে ওনার পছন্দের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।পরিবারের সকলের জন্যই কাপড় চোপড় পাঠিয়েছেন তিনি।কোনোকিছু বাদ রাখেন নি।

ইরা আনিশা আর নওশিন সবকিছু গুছিয়ে রাখলো ঠিকঠাক মতো।মাহা তো বিয়ের কনে,সে বর্তমানে নবাবী হালে বসে আছে।সবাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।অন্যদিনের মতো আজকেও মাহার চোখে ঘুম আসছে না।তাই সে কিছুক্ষণ বসে বসে একমনে ডায়েরি লিখলো।লিখতে লিখতেই চোখ জোড়ায় ঘুম নেমে এলো তার।ডায়েরি খোলা অবস্থায় রেখেই সে হারিয়ে গেল ঘুমের অতলে।

ফ্যানের বাতাসে ফরফর করে উড়ছে ডায়েরির পাতার কোণা।সেই পাতাটিতে লেখা;

“আমার নির্ঘুম রজনী কাটানোর মূল সংঙ্গা হলে তুমি,কেন তুমিহীনা নিজেকে একটিবারও কল্পনা করতে পারি না?নিজের অজান্তেই ভেবে যাই প্রিয় প্রাণপুরুষের কথা,তোমার কথা মনে না হলে যে নিজেকে ব্যাখ্যাহীন বইয়ের মূল্যহীন পৃষ্ঠার মতো মনে হয়!তোমার কথা ভাবলেই আমার মনে হয়,জীবনটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর।এবং সেই সৌন্দর্য্য অদ্ভুত এক অন্যরকম অনুভূতিতে ঘেরা,যা প্রতিনিয়ত আমায় গভীর মোহে ফেলে।”

“জানো তো,আমার ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটা ভিন্ন।সেটা জানতে হলে তোমায় আমার অনুভূতির গভীরে প্রবেশ করতে হবে।এবং শপথ সেই অনুভূতির,তুমি একবার তা বুঝতে পারলে আর কখনোই চাইবে না সেই ভালোবাসার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে।এবং সেই সময়টার আর বেশি দেরি নেই।খুব শীঘ্রই দুজনের মনের মিলন হতে যাচ্ছে।খুব শীঘ্রই।আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি সেই মুহূর্তটার!ভীষণ অধীর আগ্রহে!ভীষণ!”

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে