অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -০৯

0
1526

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_০৯

রবিবার সকাল,
আজকের দিনটা বেশ হাস্যোজ্জ্বল।মাহার মন আজ ভীষণ ফুরফুরে।কারণ আজকে মিসেস মুমতাহিনা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন মাহার জন্য।এই খুশিতে গত দুদিন ধরেই মাহা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না।যতবারই খেতে বসে ততবারই মনে হয় পেট ভরা।ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে মেয়েটা।

সকালে আনিশাও এসে উপস্থিত হয়েছে।বাসা একদম কাছে থাকায় যখন তখন আসতে পারে সে।আর আজকে আগে থেকেই আসার কথা বলে রেখেছিলো মাহা তাকে।এখন দুই বান্ধবী গল্পগুজবের সহিত বাগান পরিষ্কার করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছে।বাগানে বেশ আগাছা জমে গেছে,একা এসব পরিষ্কার করা সম্ভব না তাই সেগুলোই এখন কেটেকুটে সাফ করছে দুজন।

আনিশা টুকরিতে আগাছা তুলতে তুলতে নিচুকন্ঠে জানতে চাইলো,

-‘হ্যা রে হানি,তুই কী আজকে শাড়ি পড়বি?আজকে তো তোর জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসবেন ওনারা!তবে তুই সাজগোজ না করে বাগান পরিষ্কার করছিস কেন?’

আনিশার বোকার মতো কথা শুনে মাহা কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে জবাব দিলো,

-‘এমন উষ্টা মারবো তোরে,কোমড় সোজা করে আর হাঁটতে পারবি না,বলদ।’

আনিশা মাহার রাগ মিশ্রিত কথা শুনে হাবলার মতো তাকিয়ে রইলো।অবাক হয়ে বললো,

-‘ওমা আমি আবার কী করলাম?’

-‘কী করলাম মানে?আবালের মতো প্রশ্ন করিস কেন?মামণি বাবাই জীবনের প্রথম আমাকে দেখতে আসছে নাকি যে তাদের সামনে আমার কনেদের মতো করে শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করে যেতে হবে!এই কমনসেন্সটাও তোর মাঝে নাই কানা?’

আনিশা মাথা চুলকে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললো,

-‘ওহহ, আমার মনে নাই, ভুলে গেছিলাম সরি।’

-‘ভুলবিই তো।এখন বকবক না করে লাউয়ের মাচার ওপর থেকে আগাছা গুলো সরা।আমি ওপাশের বেগুন আর টমেটোর মাচা থেকে সরাচ্ছি।’

-‘আচ্ছা,আর হ্যা শুন।’

-‘বল!’

-‘আম্মু বলছে ওনাকে তোর লাউ গাছের কিছু পাতা দিতি,শুঁটকির তরকারি নাকি রান্না করবে।’

মাহা কাজ করতে করতে জবাব দিলো,

-‘আচ্ছা,যাবার সময় মনে করে নিয়ে যাইস।’

-‘ওকে।’

দুই বান্ধবী আবারও কাজে মন দিলো।বাগানের কাজ শেষে মুরগির কুটির পরিষ্কার করলো মাহা।কাজ করতে করতে বেলা এগারোটা বেজে গেছে প্রায়।একটানা কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছে দুজন।বাইরে পেতে রাখা চেয়ারে বসে হাঁপাচ্ছে মাহা আর আনিশা।আনিশার অবস্থা করুন।মাহা তাকে দিয়েই বেশি খাটিয়েছে।মাহা হেসে ফেললো আনিশার দিকে তাকিয়ে।আনিশা মুখ ঝামটি দিয়ে বললো;

-‘একদম হাসবি না হারামি।দাঁত ভেঙে ফেলবো এভাবে দাঁত কেলালে।এত কাজ আমি আমার বাসায়ও কোনোদিন করি নাই।নিজেকে আজ কামের বেডি ছকিনা মনে হচ্ছে।শুধু তোর কারণে।’

আনিশার কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলা কথা শুনে মাহা হাসতে হাসতে শেষ।মাহা হাসতে হাসতেই বললো;

-‘আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোকেও তো বিয়ে দিতে হবে তাই না,এখন তুই যদি কামেকাজে অষ্টরম্ভা থাকোস তবে তোর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তোকে প্রথম দিনই ঝাড়ুর সহিত অভ্যর্থনা করে বিদায় দিবে।বেস্টফ্রেন্ড হয়ে তো আমি এটা সহ্য করতে পারি না,তাই তোকে এসব কাজ শেখাচ্ছি।’

মুখ বাঁকিয়ে বললো আনিশা,
-‘ব্যাঙ শেখাচ্ছেন তিনি আমায় হুহ!নিজে অল্প একটু করে বাকি কাজ আমার ঘাড়ে ছেড়ে শান্তি।’

-‘আহা এমন করছিস কেন?তোকে কত ভালোবাসি না আমি?আমার জানে জিগার দোস্ত তুই।আচ্ছা যা আজকে তোকে আমি আমার হাতের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই করে খাওয়াবো।সাথে আমার গাছের শাকসবজি দিবো তোরে গিফট হিসেবে।হ্যাপি?’

-‘লোভ দেখাবি না একদম।সর তুই আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।’

মুখ ঝামটি দিয়ে বসা থেকে ওঠে চলে গেল আনিশা।মাহা দাঁত কেলিয়ে হাসছে বসে বসে।মিসেস মিনারা সদরদরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে মাহাকে ডেকে বললেন;

-‘মাহা ঘরে আসার সময় গাছ থেকে শিম আর বেগুন পেড়ে নিয়ে আসিস তো।তোর মামণি দের জন্য সবজি রান্না করবো।ওনারা দুপুরের দিকেই চলে আসবে।আর হ্যা মরিচ আর ধনেপাতা থাকলে আনিস,আজকে তরকারি ওয়ালা আসে নি তাই কিনতে পারি নি।’

মাহা জবাব দিলো;

-‘আচ্ছা আম্মু আমি নিয়ে আসছি।’

-‘জলদি নিয়ে আয়।’

মিসেস মিনারা ভেতরে চলে গেলেন।মাহা বাগানের মধ্যিখানে গেল।ধনেপাতা কমে গেছে প্রায়,কিছু আছে আর।এখন এগুলোই তুলে নিয়ে যাবে মাহা।দশমিনিট লাগিয়ে সবজিসব ছিঁড়ে ছোট বালতিতে ভরলো সে।তারপর হাঁটা ধরলো বাসার দিকে।বাসায় প্রবেশ করে মায়ের হাতে বালতি ধরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

মাহা রুমে প্রবেশ করেছে আর ওই একই সময়ে আনিশাও ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে।মাহা ওকে একটা টাওয়েল এগিয়ে দিয়ে নিজে একটা টাওয়েল ও কাপড় চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।আনিশা একা একা বিছানার ওপর বসে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো।

মাহা গোসল সেড়ে বের হয়ে জানতে পারলো মিসেস মুমতাহিনারা এসে পড়েছেন।মাহা দ্রুত ফিটফাট হয়ে আনিশাকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো ড্রয়িং এ।

মিসেস মুমতাহিনা মাহাকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরেন।আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

-‘কেমন আছিস মা আমার?’

মাহাও খুশিমনে জবাব দেয়,

-‘এইতো মামণি খুব ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?’

-‘আমিও খুব ভালো আছি।’

মি.এরশাদ ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললেন,

-‘শুধু মামণিকে চোখে দেখলে হবে,আমাকে কেউ দেখি পাত্তাও দেয় না!’

মাহা হেসে ফেললো বাবাইর কথা শুনে।বললো,’কী যে বলো না বাবাই,তোমাকে তো সবার আগে দেখেছি আমি।’

মিসেস মুমতাহিনা আনিশার সাথেও কুশল বিনিময় করলেন।তারপর তিনি মিসেস মিনারার সাথে সুখদুঃখের গল্পে মশগুল হয়ে গেলেন।সেখানে ইরাও যুক্ত আছে।মি.এরশাদ ওনার প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সাথে আলাপে মত্ত।রাহাত হসপিটালে।আসতে অল্প দেরী হবে।সাইফও আসে নি তবে এসে যাবে কিছুক্ষণ পর।যে উদ্দেশ্যে ওনারা এখানে এসেছেন সেই উদ্দেশ্যের কথা এখনো খোলাসা করেন নি কেউ,রাহাত আর সাইফ আসলে তবেই বলা হবে সবকিছু।

মাহা আর আনিশা জাওয়াদ ও জিমিকে নিয়ে সময় কাটাচ্ছে।বেচারি মাহার ভেতর আকুপাকু করছে পরের পর্বে কী হয় তা দেখার জন্যে।কোথায় লজ্জায় লাল নীল হবে তা না সে উৎসুকভাবে বসে আছে কী হয় নাহয় তার কারণে।আনিশা তো একের পর এক খোঁচা দিচ্ছে তাকে এ নিয়ে।মাহা এতে কান দিচ্ছে না।সে তার ভাই ও সাইফের আসার অপেক্ষা করছে অধীর আগ্রহে।

বেশ কিছুক্ষণ পর সাইফ আর রাহাত বাসায় এলো।দুজন প্রায় একসঙ্গেই এসেছে বলা যায়।সাইফ ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছে আর রাহাত গেছে ফ্রেশ হতে।

মিনিট দশেক পর সবাই একজোট হয়ে বসলো ড্রয়িং রুমে।রাহাতও আছে সেখানে।মাহা আর আনিশা ড্রয়িং রুমের সবথেকে কাছাকাছি যে রুম যেখানে সব কথা স্পষ্ট শোনা যাবে সেখানে চুপচাপ বসে আছে।বড়দের কথাবার্তার মাঝখানে তাদেরকে মানায় না।তাই ওখানে যাচ্ছে না দুজন।

এ কথা সে কথার পর মিসেস মুমতাহিনা আসল প্রসঙ্গে তুললেন,
-‘বলছিলাম অভয় দিলে একটা কথা বলতে পারি আতিক ভাই!’

মি.আতিক হাসিমুখেই বললেন;
-‘এত সংকোচের কী আছে ভাবি?যা বলার বলে ফেলুন।আপনজনদের মধ্যে আবার কীসের লুকোছাপা?’

রাহাত অভয় দিয়ে বললো;
-‘বলো মামণি কী বলবে?আমরা শুনছি!’

মিসেস মুমতাহিনা আড়ষ্টভাব বজায় রেখে বললেন;

-‘আসলে আমি আর সাইফের আব্বু চাইছিলাম যে আমাদের চোখের মণি মাহাকে আরাফাতের সাথে বিয়ে দিতে!আজকে এ বিষয় নিয়েই মূলত কথা বলতে আসা।’

মিসেস মুমতাহিনার প্রস্তাব শুনে রাহাত একটু গম্ভীর হয়ে গেল।মি.আতিক নির্বিকার।মিসেস মিনারার চেহারায় ফুটে ওঠেছে একরাশ বিস্ময়।ইরাও অবাক।মাহা আর আরাফাতকে নিয়ে জীবনেও কেউ এমনটা চিন্তা করে নি এটা তাদের চেহারার এক্সপ্রেশন দেখলেই বোঝা যায়।মাহার বুক ধুকপুক করছে ওনার কথা শুনে।বেচারি বেশ নার্ভাস হয়ে বসে আছে।
সাইফও জানতো না কিছু এ ব্যাপারে।সে গলা খাঁকারি দিয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করলো;

-‘এসব তুমি কী বলছো আম্মু?যা বলছো ভেবেচিন্তে বলছো তো?ওদেরকে তো ভাইবোন ব্যতিত অন্য নজরে দেখি নি কখনো আমরা।আরাফাতও মাহাকে সবসময় ছোট বোনের নজরে দেখে।তাহলে ওদের বিয়ে কীভাবে সম্ভব?’

মিসেস মুমতাহিনা দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন;
-‘ভাইবোন তো কী হয়েছে?তাদের বিয়ে কী অসম্ভব কিছু নাকি?এরকম কত কাজিনদের অহরহ বিয়েশাদি হয়।তোর ফুপা ফুপিও তো কাজিন।তাদের কী বিয়ে হয় নি?এসব কোনো ব্যাপার না।মাহাকে তো একসময় না একসময় ভালো ছেলের কাছে পাত্রস্থ করতেই হবে।তাহলে দূরে কোথাও বিয়ে না দিয়ে মেয়েটাকে বরং নিজেদের কাছেই রাখা যাক।এতে আমার আরাফাতও মাহার মতো ভালো একটা মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাবে আবার আমাদের মাহাকেও দূরে কোথাও যেতে হবে না!’

এবার রাহাত মার্জিত ভাবে জবাব দিলো;
-‘আসলে মামণি তুমি যা বলছো তা এখন মোটেও সম্ভব নয়।আরাফাতের সাথে হানিকে মানাবে না।আরাফাতের জন্য এর থেকেও ভালো কাউকে তুমি পাবে খুঁজলে।হানি সবসময়কার উড়নচণ্ডী টাইপের মেয়ে।ওকে আরও ম্যাচুয়ের হতে হবে।আর আমিও চাচ্ছি না ওকে এখন বিয়ে দিতে।ওর পড়াশোনা কমপ্লিট করার পর বিয়ের ব্যাপারে ভেবে দেখবো আমরা।’

রাহাতের কথা শুনে মাহার স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ার পথে।বেচারি কত কত আশা বুনে রেখেছে তার মনের মধ্যে তা তার ভাইয়ের এই কথাগুলোতেই ছিঁড়ে যেতে বাধ্য।মাহা এত সহজে কাঁদে না।এখনও তাই।কান্নার ছিটেফোঁটাও নেই তার চোখে,তবে মনে ঘুর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে।আনিশা সহানুভূতির দৃষ্টিতে মাহার দিকে তাকিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলো।আনিশা মনে মনে শিওর হয়ে গেছে যে আরাফাতের সাথে মাহার বিয়েটা হবে না।তবে মাহার চেহারা অন্য কথা বলছে।

এদিকে,
রাহাতের কথা শুনে মিসেস মুমতাহিনা একটুও ঘাবড়ালেন না।বরং তিনি শান্ত কন্ঠে জানতে চাইলেন;
-‘কেন সম্ভব নয়?অসম্ভবের কী আছে এখানে?মাহা উড়নচণ্ডী তা আমরা জানি।মাহা ম্যাচুয়ের মেয়ে নয় সেটাও তো আমরা জানি।তোদেরকে আমরা সেই জন্মলগ্ন থেকেই দেখে আসছি।তোদের কার কেমন স্বভাব সব জানি।তোদের তিন ভাই বোনের নাড়িনক্ষত্র সব জানা আছে আমাদের।ছোট থেকে কোলেপিঠে করে আমার ছেলেমেয়ে আর তোদেরকে একসাথে বড় করেছি আমি আর আপা।সব জানি বলেই তো মেয়েটাকে চাইছি আমি।আমি যদি মাহাকে জোর করে নিয়ে যাই কেউ কিছু বলতে পারবে?পারবে না।কারণ মাহা আমাদের সবারই অতিরিক্ত আদরের।হোক সে ছেলেমানুষ,তারপরও মেয়েটাকে আমার ঘরেই নিয়ে যেতে চাই আমি।জাস্ট ফরমালিটি মেইনটেইনের জন্য তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করছি,নয়তো এমনিতেই নিয়ে চলে যেতাম।’

মিসেস মুমতাহিনার কথা শুনে মি.আতিক আর মিসেস মিনারা হেসে ফেললেন।মি.এরশাদও হাসছেন।ব্যতিক্রম শুধু সাইফ আর রাহাত।ওরা দুজন এত সহজে মেনে নিতে পারছে না।তাদের কাছে মনে হচ্ছে এই সম্বন্ধটা পাকা হওয়া ঠিক হবে না।মি.এরশাদ এবার হেসে হেসে অমি.আতিকের দিকে তাকিয়ে বললেন;

-‘ভাই রে দিয়ে দে তোর মেয়েকে আমাদের কাছে।নয়তো আমার পাগল বউ এখন যা-ও বা জিজ্ঞেস করছে,পরে জিজ্ঞেস না করেই নিয়ে চলে যাবে।শেষে কেঁদেও কূল পাবি না।’

হাসলেন মি.আতিক মি.এরশাদের কথা শুনে।তিনি বর্তমানে দোটানায় আছেন।এমন একটা পরিস্থিতি যে বন্ধুকেও মানা করতে পারছেন না আবার এদিকে ছেলের ভিন্নমত।আগের বার নওশিনের বিয়েটাও তিনি তাঁর পছন্দে দিয়েছিলেন তখন রাহাত বলেছিলো যে মাহার বিয়ে সে তার পছন্দে দিবে।এখন কী করে যে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন বুঝতে পারছেন না।

প্রায় আধাঘন্টা ধরে সবার মধ্যে বেশ বাকবিতন্ডা চললো।একদিকে রাহাত মানা করছে আরেকদিকে মিসেস মুমতাহিনা নাছোড়বান্দার মতো গোঁ ধরে বসে আছেন।তিনি রাজি না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাবেন না।এদিকে রাহাত ভেবে পাচ্ছে না কী করবে।আরাফাত যথেষ্ট ভালো একটা ছেলে এটা সে জানে,কিন্তু তাই বলে ওর সাথে নিজের বোনকে কীভাবে বিয়ে দেবে সে?আরাফাত অসুস্থ একটা ছেলে।বিয়ে হলে তো তার সেবাযত্নের সমস্ত ভার মাহার ওপর এসেই বর্তাবে!রাহাত এটা চায় না।কিন্তু সে সোজা মুখে না ও করতে পারছে না মিসেস মুমতাহিনাকে।

এবার মিসেস মুমতাহিনা কেঁদে দিলেন।তিনি রাহাতের দিকে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন;
-‘আমি তো বুঝেছি তুই যে আমাদেরকে তোর আপন বলে মনে করিস না।এজন্যই আজ এমন করছিস তাই না?মাহাকে কী আমরা কম ভালোবাসি!তুই-ই বল?তবে রাজি হচ্ছিস না কেন?ঠিক আছে,আর আসবো না আমি তোর বাসায়।ভালো থাক।’

মিসেস মুমতাহিনা যে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছেন তা আর কেউ না বুঝলেও মাহা ঠিকই বুঝতে পারলো।মুচকি হাসছে সে ওনার ন্যাকা কান্না শুনে।আনিশা ড্রয়িং রুমের কর্মকাণ্ড কিছুই বুঝতে পারছে না।সে হাবলার মতো সব শুনে যাচ্ছে শুধু।

মিসেস মুমতাহিনার কান্না দেখে মি.আতিক বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন।ওনি অপ্রস্তুত কন্ঠে বললেন;
-‘আহা ভাবী কাঁদবেন না প্লিজ।আচ্ছা ঠিক আছে আমরা দেখছি বিষয়টা।আপনি চিন্তা করবেন না।’

রাহাত নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে গেছে ওনার কান্না দেখে।সে টিস্যু দিয়ে ওনার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বিব্রত কন্ঠে বললো;
-‘মামণি এখানে আমরা রাজি নারাজির কিছু না,হানিরও তো একটা মতামত আছে।সে হয়তো আরাফাতকে বিয়ে করতে রাজি হবে না।তাই আমিও চাচ্ছি না ওর বিরুদ্ধে যেতে।সে চায় পড়াশোনা কমপ্লিট করতে।আমিও সেটাই চাই।’

মাহা মুখ বাঁকালো ভাইয়ের কথা শুনে।মাহা জানে যে রাহাত কোনোমতে প্রস্তাবটা নাকচ করে দেয়ার তাল করছে।মনে মনে বললো মাহা,”আহ কী চিন্তা আমার ভাইয়ের।আমি চিন্তায় মরে যাই আরাফাতকে বিয়ে করার জন্যে,আর সে বলছে আমি নাকি রাজি না।মগের মুল্লুক নাকি?বিয়ে তো আমি করবোই তাও আরাফাতকে।পড়াশোনা গোল্লায় গেলে যাক।আমার আর ভাল্লাগে না পড়তে।বিয়ে হলেই বাঁচি।”

মিসেস মুমতাহিনা রাহাতের কথা শুনে বললেন;
-‘ডাক মাহাকে,আমি ওর মুখ থেকে শুনতে চাই সে রাজি কী না!পড়াশোনা কী বিয়ের পর করতে পারবে না?টাকা পয়সার কোনো কমতি আছে নাকি আমাদের?সে যতদূর পড়তে চায় ততদূর ওকে পড়াবো,আমাদের কোনো সমস্যা নেই।মাহার বিয়ে হলে একমাত্র আমার ছেলের সাথেই হবে।এখনের যুগে মাহার মতো ভালো মেয়ে পাওয়া আর হাতে চাঁদ পাওয়া সমান কথা।আমি এই সুযোগ মোটেও হাতছাড়া করবো না।ডাক মাহাকে,দেখি ও কী বলে?’

রাহাত ইরাকে ইশারা দিয়ে বললো মাহাকে নিয়ে আসতে।ইরা সায় জানিয়ে ওই রুমে চলে গেল মাহাকে আনতে।মাহা ঠিকঠাক হয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে হেঁটে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।মাহা মনের ভুলেও রাহাতের দিকে তাকাচ্ছে না।মিসেস মুমতাহিনা সব জানার পরেও আবার জিজ্ঞেস করলেন;

-‘মা,আরাফাতকে বিয়ে করতে তোর কী কোনো আপত্তি আছে?’

মাহা চুপচাপ একবার নিজের বাবা মায়ের দিকে তাকালো।মি.আতিক হাসিমুখে বললেন;
-‘তোমার লাইফ তুমি জানো মা,আরাফাতকে যদি তোমার লাইফ পার্টনার হিসেবে ভালো লাগে তবে বলে দাও।তোমার মতের বাইরে গিয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিবো না।তুমি যা বলবে তাই হবে মা!এবার বলো তুমি কী চাও?’

মাহা সবার দিকেই তাকাচ্ছে একে একে শুধু রাহাত বাদে।কারণ মাহা জানে রাহাতের দিকে এখন তাকালেই সে চোখ দিয়ে ইশারা করে না করতে বলবে।এজন্যই মনের ভুলেও তাকাচ্ছে না সে ওদিকে।কিছুক্ষণ নিরবতায় কেটে গেল।সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার মুখপানে তার জবাব শোনার আশায়।অবশেষে মুখ খুললো মাহা।বললো;

-‘আমার আরাফাত ভাইয়াকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই ঠিকই কিন্তু বড়ভাইয়া যদি রাজি না থাকেন তাহলে আমি কিছু বলতে পারবো না সরি।কারণ ভাইয়ার কথা ছাড়া আমি এদিক ওদিক কোনোদিকেই যাই না,আর বিয়ের মতো এত বড় একটা সিদ্ধান্ত আমি একা কী করে নিতে পারি!তাই যা সিদ্ধান্ত নেয়ার বড়ভাইয়া নিবে,ওনাকে জিজ্ঞেস করো সবাই।’

এই বলে ঘটনাকে কমপ্লেক্স বানিয়ে মাহা ড্রয়িং রুম থেকে প্রস্থান নিলো।মাহা সুযোগ বুঝেই তীর ছুঁড়েছে।এখন হাজার অরাজি হলেও রাহাতের বিষয়টাকে মেনে নিতেই হবে আত্মীয়তা রক্ষার খাতিরে হলেও।মাহা তো বিন্দাস।এখন আর কোনো টেনশন নেই তার।কারণ এমন চাল চেলেছে সে যে রাহাত রাজি হতেই হবে।আহ এখন শান্তি!

রাহাত পড়েছে মাইনকার চিপায়।মাহা যদি সরাসরি মানা করে দিতো তাহলে কারও কিছু করতে হতো না।কেউ এ নিয়ে টু শব্দও করতে পারতো না কারণ যার বিয়ে সেই যদি মানা করে দেয় সেখানে কারই বা কী বলার আছে?এখন তো মাহা তাকেই ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলো।রাহাত যদি এখন রাজি না হয় তবে তার বাবার এত বছরের ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট হয়ে যাবে,সাথে তাদের এত ভালো ফ্যামিলি বন্ডিংটাও ভেঙে যাবে।এমন একটা কাজ সে মোটেও করতে পারবে না।

সাইফ রাহাতের ঘাড়ে হাত রেখে বললো;
-‘বলে দেয় ভাই।মাহা তো তোর ওপর সব ছেড়ে দিয়ে গেল।এবার তোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেয় আমাদের।’

মি.এরশাদও বললেন;
-‘হ্যা বাপ বলে দে এবার তোর মতামত কী!আমাদের দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে।আরাফাত সহ বাকিরা বাসায় একা।’

মিসেস মুমতাহিনা করুন কন্ঠে বললেন;
-‘অনেক আশা করে এসেছি বাপ,ফিরিয়ে দিস না।তোর আব্বুর সিদ্ধান্ত আমাদের জানা আছে এখন শুধু তোর কথাটা শোনার অপেক্ষায় আছি।নিরাশ করিস না বাপ,তোর বোনকে আমরা রানীর হালে রাখবো।আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখিস।’

ওদের এত এত রিকোয়েস্ট কীভাবে নাকচ করবে বুঝতে পারছে না রাহাত।এ কোন সিচুয়েশনে তাকে ফেললো মাহা?সে তো চায় না আরাফাতের সাথে মাহার বিয়ে দিতে।নিজের বোনের ফিউচারটা এভাবে নষ্ট করতে চায় না সে।কিন্তু এখন কী করবে সে?মানা করারও তো কোনো উপায় রইলো না।

অবশেষে মনের সাথে যুদ্ধ করে নিমরাজি হলো রাহাত।ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বিরস কন্ঠে নিজের সিদ্ধান্ত জানালো;
-‘আমি রাজি,তোমাদের যা ভালো মনে হয় করো।মানা করবো না।’

সবাই সমস্বরে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।মাহার চোখে খুশিতে পানি চলে এসেছে কথাটা শুনে।আনিশা নিচুস্বরে ইয়ে বলে মাহাকে দুহাত দ্বারা ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।মাহার ঠোঁটের কোণে একটুকরো তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠলো।

মিসেস মিনারা ও মি.আতিক আরাফাতকে সবসময়ই পছন্দ করেন,এমনকি এত এত কান্ড ঘটে যাওয়ার পরও।অবশ্য এতে আরাফাতের কোনো দোষ নেই।সে তো ভালোবেসেছিলো আর যাকে ভালোবেসেছিল তাকেই তো বিয়ে করতে চেয়েছিলো।কিন্তু আফসোস তার ভাগ্য তার প্রতি বিরুপ ছিলো।

মিসেস মিনারা ততক্ষণে ফোন লাগিয়েছেন নওশিনকে।রিয়াজকে কল করে জানিয়ে দিয়েছেন মি.আতিক।ইরা ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে এলো।সবাই মিষ্টি খাচ্ছে খুশিমনে।মি.এরশাদ মি.আতিকের মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে কোলাকুলি করে বললেন;
-‘আমাদের সম্পর্কটা আরও মজবুত হতে যাচ্ছে রে আতিক।আমরা এবার বন্ধু থেকে বেয়াই হবো।আমার ভীষণ খুশি লাগছে।’

মি.আতিকও হাসিমুখে জবাব দিলেন;
-‘আমিও খুব খুশি হয়েছি এ সিদ্ধান্তে।ভালোই হলো,আমার মেয়েটা আমার থেকে দূরে কোথাও গেলো না।মন চাইলেই দেখে আসতে পারবো।’

সবার মনেই খুশি বিরাজ করছে।রাহাতের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে খুশি না বেজার।ইরার ভয় লাগছে।সে নিশ্চিত ওনারা চলে যাওয়ার পর তান্ডব চলবে বাসায়।এখন তো সে না পারছে বলতে,আর না পারছে সহ্য করতে।

এদিকে আনিশার সাথে মাহাও ধুমধারাক্কা সেলিব্রেশন করছে রুমের দরজা বন্ধ করে।দুইটাই ব্যাঙের মতো লাফঝাঁপ দিচ্ছে উরাধুরা।এটার নাম হচ্ছে হুলো ড্যান্স।যা মানুষ অতিরিক্ত খুশিতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে করে।তাদেরও হয়েছে একই অবস্থা।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে