অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -০৮

0
1591

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_০৮

আরাফাতের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মনটা জানি কেমন করে ওঠলো মাহার।ফর্সা চেহারা একদম মলিন হয়ে আছে তার,কালচে লাল ঠোঁট জোড়া শুষ্ক অবস্থায় আছে।চোখ দুটো কোটরের অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে।আগের সেই আকর্ষণীয় রূপটা হারিয়ে গেছে আরাফাতের।এত সুদর্শন একটা ছেলের আজ এই অবস্থা,বিষয়টা খুবই দুঃখজনক।

একটা শর্ট টাওজার ও হাতাকাটা পাতলা গেঞ্জি গায়ে জড়ানো তার।ভাঙা হাত পায়ে ব্যান্ডেজ।মাথার একপাশে সেলাইয়ের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।মাহা আরাফাতের পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।লিসা আর নিসা স্বাভাবিক ভাবেই নিলো বিষয়টা।ছেলে নার্স দুজনের একজনকে প্রয়োজন নেই বলে বিদায় দেয়া হয়েছে।অপরজন আছে।সে নিচে গেছে দুপুরের খাবার খেতে।

লিসা নিসা দুই বোন ভাইয়ের দুপাশে মলিন মুখে চুপচাপ বসে আছে।যতবার ভাইকে দেখতে আসে ততবারই তাদের মনখারাপ হয়ে যায়।আরাফাত সুস্থ থাকতে তার কাছে আবদারের ঝুড়ি খুলে বসতো দুই বোন।সাইফ তাদেরকে কড়া শাসনে রাখলেও আরাফাতের কাছে তারা আশকারা পেত সবসময়।তাই আরাফাতের এমন অবস্থা মেনে নিতে তাদের অনেক কষ্ট হয়।মনেপ্রাণে আল্লাহর কাছে দোয়া করে দুই বোন,যাতে তাদের ভাইয়া আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যায়!

মায়ের ডাক শুনে লিসা বেরিয়ে গেলো,আর নিসা গেল ওয়াশরুমে।রুমে শুধু আরাফাত আর মাহা।
মাহা দৃষ্টিতে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে আরাফাতের কপালে গাঢ় করে একটা চুমু এঁকে দিলো।আজ জীবনের প্রথম আরাফাতকে এমন গভীরভাবে স্পর্শ করলো মাহা।আরাফাত ঘুমের মধ্যেই হালকা কেঁপে ওঠে।মাহা আরাফাতের মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে বললো;

মাহা:-আর মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যাপার,খুব শীঘ্রই আমি তোমাকে আমার নিজের করে নিবো।তোমার স্ত্রী রূপে এই বাড়িতে আসবো আমি।তোমাকে নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে ভালোবাসবো,সেবাযত্ন দিয়ে সুস্থ করে তুলবো।একদম আমার নিজের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবো তোমায়,কারও কুনজর পড়তে দেবো না আমার ভালোবাসার উপর।কারও না।অনেক ভালোবাসি তোমায়।আফসোস শুধু একটাই,তুমি আমার ভালোবাসার গভীরতাটা খতিয়ে দেখলে না!

নিসা আসতেই মাহা সরে বসলো আরাফাতের কাছ থেকে।মিনিট দুয়েক পর আরাফাতকে দেখাশুনা করে যে ছেলেটা সে চলে আসলো।সে আসতেই নিসা ও মাহা রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

মিসেস মুমতাহিনা এদের সবাইকে নিয়ে ডাইনিং এ খেতে বসলেন।মাহা খেতে চায় নি,কিন্তু মামণির চোখ রাঙানি দেখে ভয়ে চুপচাপ বসে পড়লো।নিরবেই খাওয়া সারলো ওরা।ইশানীও ছিলো তাদের সাথে।ইশানী একটু চুপচাপ ধরনের মেয়ে তাই সে কোনো গল্প গুজবে কখনো এটেন্ড থাকে না।ঘর সংসারের কাজ চুপি চুপি সারতেই পছন্দ করে সে।এমন চুপচাপ টাইপের সংসারী মেয়েই সাইফের পছন্দ।তাই তো কনে দেখতে গিয়ে প্রথম দেখায়ই বিয়ে ফিক্সড করতে হয়েছে তার জন্য।

বিকালের দিকে বাসায় ফিরে আসে মাহা।তাকে আনতে মি.আতিক গিয়েছিলেন।মাহা একা একা চলাফেরা করতে পারে ঠিকই কিন্তু তার বাবা ভাই তাকে একা কোথায় যেতে দিতে চান না।তাদের মতে এখনকার এই নিষ্ঠুর যুগে মেয়েদের এত সাহস দেখানো মানায় না।কখন কী দুর্ঘটনা ঘটে বলা তো যায় না।সবসময় নিজেকে সেইফটির সাথে রাখা উচিৎ।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই ডায়েরি নিয়ে ছাদে চলে গেল মাহা।একটা ডায়েরি দুবছর আগেই শেষ হয়ে গেছে লিখতে লিখতে।এখন আরেকটায় লিখে।এই ডায়েরি দুটো তার একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস।যেখানে সবিস্তরে বর্ণনা করে লেখা আছে আরাফাতকে নিয়ে তার মনের সেই অন্যরকম অনুভূতিগুলোর কথা।মনের সবটুকু মাধুর্য ঢেলে দিয়ে প্রতিটা ভালোবাসাময় পঙক্তি সাজিয়েছে সে আরাফাতের জন্যে।ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে তার আলাদা একটা কল্পনার জগৎও আছে,যেখানে আরাফাত ব্যতিত অন্য কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ।

মাহা তার গাছ থেকে দুটি নয়নতারা ফুল ছিঁড়ে ডায়েরির ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখলো।এবং লিখলো,

“তোমায় আমি নয়নতারা ফুলের মুগ্ধতায় ঘেরা রঙের ন্যায় ভালোবাসি!পরিস্ফুটিত বেলি ফুলের মাতাল করা সুভাষের ন্যায় পাগল আমি তোমার জন্য!এই ভালোবাসার নেই কোনো পরিমাপ,গাত্র,বর্ণ।আছে শুধুই একরাশ প্রেমময় আবেগ,যা কখনো কোনো পরিস্থিতিতে কেটে যাবে না!বরং আজীবন থেকে যাবে!
তোমায় ঘিরে আমার অনুভূতিগুলো সত্যি আরাফাত,অনেক অনেক ভালোবাসি তোমায়!”

পঙক্তিগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে ডায়েরিটা বন্ধ করে মাহা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ আকাশ পানে তাকায়।চোখের তারায় তার অদ্ভুত সব ইচ্ছেগুলো খেলা করছে।নিজের স্বপ্নপূরনের প্রয়াসে কয়েকধাপ এগিয়ে গেছে সে,সেই খুশিতে আত্মহারা মাহা।

“আল্লাহ এতদিনের চাওয়া অবশেষে পূর্ণ হতে যাচ্ছে আমার।অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় আমার স্বপ্ন এভাবে পূরণের পথ দেখিয়ে দেয়ার জন্য।হাজার হাজার শুকরিয়া তোমার দরবারে।এবার কোনো ভেজাল ছাড়াই যেন আমার সাথে আরাফাতের বিয়েটা হয়ে যায় মাবুদ।তুমি দেখাে প্লিজ।”

অনুরোধ ঝরে পড়ে মাহার বলা কথাতে।মনেপ্রাণে দোয়া করছে সে আল্লাহর কাছে।কাউকে কতটা নিজের করে চাইতে পারলে এভাবে আকুতি মিনতি করা যায়।ভালোবাসার মর্ম এতটাই গভীরত্বে ভরা।

ভাবীর ডাকে বাস্তবে ফিরে এলো মাহা।নিচ থেকে জোরে জোরে ডাকছে ইরা তাকে।মাহা তড়িঘড়ি করে ছাদ থেকে নেমে আসে।

“মাহা জলদি আসো,নাশতা করবে!”

মাহা “আসছি ভাবী” বলে জবাব দিলো।রুমে ঢুকে ডায়েরিটা আলমারির ভেতরের একটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে তালা মেরে আলমারি লাগিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

-‘পুঁপি,তুমি তই তিলে?আমি তোমায় পাইনি তেনু?’
জাওয়াদ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কথাটি বললো মাহাকে।মাহা জাওয়াদকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বললো,

-‘আমার কলিজাটা আমায় কেন খুঁজছে শুনি তো?’

-‘পুঁপি,পাপা আমায় তকলেট কিনে দেয় না।দাদুও দেয় না।বলে দাঁতে পোতা হবে।তিন্তু আমি এত্তু তকলেট কাবো পুঁপি,এত্তু দাও না পিলিত।’

মাহা জাওয়াদের আদো আদো কথা শুনে অধর জোড়া প্রশস্ত করে হাসে।জাওয়াদের গাল টেনে দিয়ে ফিসফিস করে বললো;

-‘সোনা আমি তোমায় চকোলেট দিবো,তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না ঠিক আছে।নয়তো পরে তোমার সাথে আমিও বকা খাবো।’

জাওয়াদ খুশি হয়ে মাহার গালে চুমু দিয়ে বললো;

-‘আততা পুঁপি তাউকে বব্বো না আমি।’

-‘এইতো গুড বয় আমার।’

মাহা জাওয়াদকে নিজের রুম থেকে একটা কিটক্যাট চকোলেট এনে খুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোফার উপর বসিয়ে দিলো।জাওয়াদ চকোলেট পেয়ে কী খুশি!কোনোদিকে না তাকিয়ে খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে গেছে সে।মাহা মুচকি হেসে ডাইনিং এ চলে আসে নাশতা করার জন্য।ইরা আর ফুলমতি ব্যস্ত হয়ে নাশতা এনে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখছে।মাহার আম্মু রান্নাঘরে সবার জন্য চা বানাচ্ছেন।

⛓️

-‘শুনো আমার একটা জরুরি কথা আছে তোমার সাথে!’

মিসেস মুমতাহিনার কথা শুনে ওনার স্বামী এরশাদ ভ্রু কুচকে জানতে চাইলেন;

-‘কী কথা?বলো শুনছি!’

মিসেস মুমতাহিনা সোজাসাপটা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন;

-‘আমি মাহাকে আমার ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করেছি।আমি চাই আরাফাতের সাথে মাহার বিয়ে হোক।মাহার মতো মেয়ে আমি হাজার খুঁজলেও পাবো না আমাদের আরাফাতের জন্য।তাই আমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে চাই আতিক ভাইয়ের বাসায়।’

মি.এরশাদের বিষম লেগে গেল বউয়ের কথা শুনে।চোখ থেকে চশমা সরিয়ে চায়ের কাপ বিছানার পাশের টেবিলের ওপর রেখে টানটান হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন;

-‘হঠাৎ এই ভুত তোমার মাথায় কে ঢুকিয়েছে?মাহা এখনও বাচ্চা একটা মেয়ে।ওকে এখন রাহাত বিয়ে দেবে না।আর আরাফাত সবসময় ওকে বোনের নজরেই দেখে এসেছে।তবে বিয়ে কীভাবে সম্ভব?’

-‘রাখো তোমার ছেলের কথা।’ধমক দিয়ে বললেন তিনি।
‘বাজারি একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক রেখে নিজের কী হাল করেছে সে।ভাবলে কীভাবে আবারও তোমার ছেলের পছন্দের তোয়াক্কা করবো আমি?এখন আমি যেটা বলবো সেটাই হবে।মাহাই হবে আমার ছেলের বউ।মেয়েটাকে জন্ম থেকে দেখে আসছি।আমাদের কোলেপিঠেই সে মানুষ হয়েছে।তোমার ছেলেকে যদি কেউ মন থেকে ভালোবেসে থাকে তবে সেটা মাহা।অন্য কোনো মেয়ে না!’

-‘কী করে বুঝলে?’কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন মি.এরশাদ।

-‘আরাফাতের এক্সিডেন্টের পর থেকে মেয়েটা আমাদের সাথে হসপিটালে ছিলো।সবদিক তদারকি করেছে সে একা একা।আমাকে সামলেছে,তোমার মেয়েকে সামলেছে।তোমারও খাওয়ার দিক খেয়াল রেখেছে।না বললেও বুঝতে পেরেছিলাম মেয়েটা রাতে মোটেও ঘুমাতো না।কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে ছেলেটার প্রাণ ভিক্ষা চাইতো।বাসায় আসার পর,নিজের গাছের তাজা শাকসবজি যেগুলো আরাফাত খেতে পারবে সেসব নিয়ে এসেছে।মুরগির ডিম বাসার কাউকে না দিয়ে,জমিয়ে এনে দিয়ে গিয়েছে দুইবারে পঞ্চাশটা।আর একদিন পর পর তো এসে দেখেই যায় আরাফাতকে।নিজের আপন কেউ তো একবার দেখতেও আসে নি।অথচ ওর পরিবারের সবাই দুই দিন পর পরই আসে।এতেই বোঝা যায় কতোটা ভালোবাসে সে আমাদের ছেলেকে।’

মি.এরশাদও মনে মনে স্বীকার করলেন।স্বীয়বন্ধু ও তার পরিবারের ঋণ শোধ করা কখনোই সম্ভব নয়।তাদের কাছে তিনি আজীবন ঋণী হয়ে থাকবেন।তিনি মিসেস মুমতাহিনার কথার বিপরীতে বললেন;

-‘তা বটে।ওদের কাছে এমনিতেই আমরা ঋণী,কিন্তু এখন আতিকের কাছে মাহাকে কীভাবে চাই বলো তো!বিষয়টা একটু অড হয়ে যায় না।আর রাহাত তো প্রায়ই বলে নওশিনকে যত দ্রুত বিয়ে দিয়েছে,মাহাকে তেমন দিবে না।তার ইচ্ছা মাহা পড়াশোনা কমপ্লিট করে নিজের পায়ে দাঁড়াক।তো এমতাবস্থায় কেমনে কী?’

দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন মিসেস,

-‘পড়াশোনা সে বিয়ের পরও করতে পারবে,ওসব ফ্যাক্ট না।কথা হলো তুমি আতিক ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব দিবে।যেখানে মাহা নিজেই রাজী সেখানে তাদের দ্বিমত মানায় না।মেয়েটা এখন বড় হয়েছে,তার আলাদা মতামত রয়েছে।আর তুমি তোমার বন্ধুর কাছে চাইলে তিনি জীবনেও তোমায় ফিরিয়ে দিবে না এটা আমি শিওর।’

-‘আচ্ছা আমি দেখি কী করা যায়।’

-‘দেখি আবার কেমন কথা?সবকিছু ফিক্সড করতে যাবো আমরা পরশু তাদের বাসায়।আজকে জানিয়ে দাও যে আমরা পরশু আসছি।’

বউয়ের কথায় ভরকে গিয়ে আমতা আমতা করে জবাব দিলেন তিনি,

-‘ঠিক আছে বলবো।তবে আরাফাতকে এই অবস্থায় বাসা থেকে বেরোতে দেয়া ঠিক হবে না।’

-‘ওকে নেবো না।শুধু আমি,তুমি আর সাইফ যাবো।ইশানী রিহাদ,লিসা,নিসাকে নিয়ে বাসায় থাকবে।আর ওই ছেলে তো আছেই আরাফাতকে টেককেয়ার করবে।’

-‘আচ্ছা,তাহলে ঠিক আছে।’

-‘সত্যি করে বলো তো মাহাকে তোমার পছন্দ না?’

মি.এরশাদ প্রতুত্তরে জবাব দিলেন;

-‘কী যে বলো না তুমি?মাহাকে অপছন্দ করার মতো কোনো উপায় আছে?বন্ধুর মেয়ে বলে বলছি না,ওর মতো মেয়ে পেতে ভাগ্য লাগে ভাগ্য।লাখে একটা মেয়ে।সে যদি আমাদের আরাফাতের বউ হয়ে আসে না তবে আমার থেকে খুশি বোধ হয় আর কেউ হবে না।’

মিসেস মুমতাহিনা তৃপ্তির হাসি হাসলেন স্বামীর কথা শুনে।মনে মনে বললেন,
“এবার ভালোয় ভালোয় সব মিটে গেলেই হয়!”

⛓️

মাহা টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে পিয়াজু একটা হাতে নিয়ে সস লাগিয়ে মুখে পুরে দিলো।এমনসময় রাহাত নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।আজকে নাইট ডিউটি আছে ওর তাই এখন বাসায়ই রেস্ট নিচ্ছে শুয়ে-বসে।রাহাতের কোলে তার মেয়ে জিমি।রাহাত এসে মাহার মুখোমুখি আসনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো;

-‘কীরে?সারাদিন কই টইটই করে বেড়াস?পড়াশোনা নেই?

মাহা মিনমিন করে জবাব দিলো,”পড়ি তো ভাইয়া,আজকে এমনি মামণিদের বাসায় গেছিলাম।বাসায় থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি।”

-‘তা ভাল্লাগবে কেন!খালি তো ঘুরাঘুরি করার ধান্দা।আমি ছেলে হয়েও তোর মতো এত টইটই করি না যতোটা তুই একাই করিস।দুষ্টামি ঘুরাঘুরি এসব বাদ দিয়ে পড়ায় মন দে।পড়াশোনা ছাড়া জীবনে কিছুই করতে পারবি না।’

মাহা ভাইয়ের কথা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।প্রতুত্তর করার সাহস পাচ্ছে না বেচারি।এখন কিছু বলতে গেলেই হিতে বিপরীত হতে পারে।থাক বাবা দরকার নেই কথা বাড়ানোর।চুপচাপ খাওয়াই ভালো।

ফুলমতি চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো তাদের সামনে।মি.আতিকও আসলেন তাদের সাথে নাশতা করার জন্য।তিনি জাওয়াদকে কোথাও দেখতে না পেয়ে বললেন;

-‘আমার নাতী কোথায়?তাকে কেন দেখছি না?’

মি.আতিকের কথার জবাব জাওয়াদ নিজেই দিলো,’এই দে দাদু,আমি এতানে!’মাহা জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো।চকোলেট খেতে গিয়ে মুখের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে ছেলেটা।বান্দরের মতো লাগতেছে তাকে।রাহাত চোখ কপালে তুললো ছেলেকে দেখে,

-‘এসব কী জাওয়াদ?আব্বু মানা করি নি তোমায় যে চকোলেট খাবে না?কে দিয়েছে তোমায় চকোলেট?’

মাহার হাসি বন্ধ হয়ে গেছে রাহাতের কথা শুনে।জাওয়াদ ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
‘আমি নিদে পাইতি,নিদে খাইতি।কেউ দেয় নাই পাপা!’

মি.আতিক হাসতে হাসতে শেষ জাওয়াদের কথা শুনে।মাহাও হাসছে।বেচারা তার ফুপ্পিকে বাঁচানোর জন্য নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিয়ে নিসে।রাহাত এবার মাহার দিকে তাকিয়ে বললো;

-‘তোর কারণে ছেলেটা গোল্লায় যাচ্ছে।আমি কতদিন মানা করছি ওকে চকোলেট না দিতে?কেন শুনিস না তুই।আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে দিচ্ছিস।ওর দাঁতে যদি পোকা ধরে তাহলে আমি তোকে সবার আগে ধরবো মনে রাখিস।’

রাহাতের হুমকি দেয়া দেখে মাহা এবার তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বললো;

-‘আব্বু ভাইয়া খালি আমায় বকে কেন?আমার কী দোষ?চকোলেট তো আমিও খাই,কই দাঁতে তো পোকা হয় না।তাহলে আমার ভাতিজার কেন হবে?’

মেয়ের কথায় সায় দিয়ে মি.আতিক জবাব দিলেন;

-‘এই রাহাত আমার মেয়েকে কিছু বলবে না তুমি।এত খিটখিটে মেজাজী মানুষ আমার পছন্দ না।আমার নাতি খাক চকোলেট।একটা দুটা খেলে কিছু হয় না।’

-‘প্লিজ আব্বু,তুমি অন্তত আর লাই দিও না।তোমার মেয়ের সাথে থেকে থেকে আমার ছেলেও দিন দিন বজ্জাত হয়ে উঠছে।ছেলে আমার কথাই শুনে না।’

-‘শুনবে কীভাবে?এভাবে কাউকাউ করলে কেউই কথা শুনবে না।আমাকে দেখাে,বাচ্চাদেরকে কত আদরে মানুষ করেছি আমি।কখনো এতটুকুও বকা দেই না তোমাদেরকে।আমার মেয়ে যতই দস্যিপনা করুক না কেন আমি নিষেধ করলে ঠিকই আমার কথা শুনে।তাই না মা?’

মাহা মি.আতিকের কথার জবাব দিয়ে বললো,’হ্যা আব্বু।’

মিসেস মিনারা এসে ওদের কথার মধ্যে বাগড়া দিয়ে কপট স্বরে বললেন;
-‘চুপচাপ নাশতা সেড়ে যে যার কাজে যাও।অদরকারী কথাবার্তা যেন আর না শুনি।’

মি.আতিক বললেন,’আচ্ছা তবে দরকারী কথাই বলি কেমন?’

মিসেস মিনারা স্বামীকে চোখ রাঙানি দিয়ে জাওয়াদকে কোলে নিয়ে বেসিনের কাছে গিয়ে কল ছেড়ে ওর মুখ হাত পরিষ্কার করে দিতে লাগলেন।

-‘এরশাদ ফোন করেছিলো একটু আগে।বললো পরশু দিন ওরা এখানে আসবে।’

রাহাত বললো,

-‘হঠাৎ কী মনে করে?কোনো উপলক্ষ আছে নাকি?আর আরাফাতের এই অবস্থায় ওকে নিয়ে আসাটা তো ঠিক হবে না।’

-‘ওকে ছাড়াই আসবে বোধ হয়।কী জরুরি কথাবার্তা আছে বললো আমাদের সাথে।’

-‘ওহ তাহলে আসুক।সমস্যা না।’

ওদের কথোপকথন শুনে মাহার অন্তর জুড়ে এক শিহরণ বয়ে গেল।আর কেউ না জানলেও সে তো জানে যে ওরা কেন আসতে চাইছে এখানে।চুপচাপ নাশতা করে হাত ধুয়ে বাইরে চলে এলো মাহা।তাদের আর কোনো কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নি।

সন্ধ্যার আযান পড়বে একটু পর।মুরগিগুলো সব কঁক কঁক শব্দ তুলে নিজের কুটিরে একে একে গিয়ে ঢুকছে।দরজা মেলে দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে মুরগিদেরকে আ আ শব্দে ক্রমাগত ডেকে চলেছে মাহা।বাচ্চাওয়ালা মুরগিদেরকে আলাদা জায়গায় রাখলো সে।সবগুলো ঢুকে যেতেই দরজা লাগিয়ে তালা মেরে দিলো।একহাতে একটা ঝুড়ি,তাতে তিনটা ডিম রাখা।ডিমগুলো খালি কুটিরে ছিলো।তাই তুলে নিয়েছে।

ইদানীং ডিমগুলো সে নিজে না খেয়ে জমিয়ে আরাফাতকে খাওয়ানোর জন্য তার মামণির কাছে দিয়ে আসে।এই ডিমগুলো আরাফাতের শরীরের জন্য ভালো তাই কাউকে ডিমগুলো ছুঁতেও দেয় না সে।এই তো, তিনদিন আগেও ত্রিশটা ডিম দিয়ে এসেছে আরাফাতের জন্যে।মিসেস মুমতাহিনা তো সেই খুশি।তার ছেলের কথা কত ভাবে মাহা!

মাহা তার বাগান একবার পরিদর্শন করে বাসার ভেতর চলে গেলো।ডিমগুলো একটা চালভর্তি ড্রামের ভেতর রেখে হাত ধুয়ে নিজের রুমে চলে আসে সে।এখন নামাজ আদায় করে পড়তে বসতে হবে,নয়তো ভাইয়ের বকা ফ্রী!

⛓️

আরাফাতকে মিসেস মুমতাহিনা নরম খিচুড়ি জোর করে খাওয়াচ্ছেন।ছেলেটা নরম খিচুড়ি কোনোকালেই পছন্দ করে না,তবুও জোর করে খাওয়াতে হয়।ডিমটা অনায়াসে খাওয়ানো যায়,কিছু বলে না।খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা ডক্টর বলেছেন।কারণ বেশি শক্ত খাবার খাওয়াটা তার জন্যই রিস্কি।তাই তো এত সতর্কতা অবলম্বন।

বহুত কষ্টে জোরজার করে কয়েকচামচ খাওয়াতে পারলেন ওনি।তারপর পানি খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে ঔষধ খাওয়ালেন।আরাফাত একদৃষ্টিতে অন্য কোথাও তাকিয়ে আছে।চাহনি অস্বাভাবিক তার।মিসেস মুমতাহিনা ছেলের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললেন;

-‘সোনাবাবা,আম্মুর দিকে একবার তাকাবি না।একটু স্বাভাবিক হো বাপ আমার,তোকে এই অবস্থায় যে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

এই বলে মিসেস মুমতাহিনা কান্না করে দিলেন।আরাফাতের কোনো হেলদোল নেই।সে আগের ন্যায় এখনও চুপচাপ বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।চোখ দুটি অন্য কোথাও স্থির।মিসেস মুমতাহিনা শাড়ির আঁচল দ্বারা চোখের জল মুছলেন।ইশানী এসে শ্বাশুড়িকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো;

-‘মা,তুমি এভাবে কেঁদো না প্লিজ।কান্না করলেই সব সমাধান হয়ে যায় না।ভাইটার জন্য মনেপ্রাণে দোয়া করো শুধু,দেখবে সে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

-‘কবে রে মা,অনেকগুলো দিন তো পেরিয়ে গেলো।ছেলেটা আমার হাঁটতে পারে না,হাত নাড়াচাড়া করতে পারে না,কথা বলে না,ডাকলে সাড়া দেয় না।আমার হাসিখুশি ছেলেটার আজ এ কী অবস্থা হয়ে গেছে,আমি যে আর সহ্য করতে পারি না।’

এই বলে আবারও চোখের জল মুছলেন তিনি।ইশানী ওনাকে দু’হাতে আগলে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে।কিছুক্ষণ পর নার্স ছেলের ওপর দায়িত্ব দিয়ে মিসেস মুমতাহিনাকে নিয়ে ইশানী রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো।নয়তো ওখানে থাকলে তিনি আরও কান্না করবেন।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে