অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -২৭

0
1716

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_২৭

সাত মাসের ফোলা পেট নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মাহা।সাতটা মাসে কতটা পরিবর্তন এসেছে নিজের মধ্যে,দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনমনে সেটাই ভাবছিলো সে।বাচ্চাটাকে সে খুব করে অনুভব করতে পারে।তার অস্তিত্ব বারবার নাড়াচাড়া করে তাকে জানান দেয় যে আম্মু আমি আছি তোমার মাঝে!

সেদিনের পরেরদিন সকালেই সুখবরটা পরিবারকে জানায় মাহা আরাফাত দুজনে।মিসেস মুমতাহিনা তো খুশিতে কতবার যে কেঁদেছেন তার হিসাব রাখা দায়।কতটা আনন্দের সৃষ্টি হয়েছিলো সকলের মাঝে সুখবরটা শুনে তা তাদের চেহারার ঝলমলে ভাবটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো।জনাব এরশাদ সেদিন বন্ধুকে সাথে নিয়ে পাড়ার সকলকে ও অফিসে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন।সকলের এত খুশি দেখে মাহার আনন্দের সীমা ছিল না।

এরপর থেকে শুরু হয় মাহাকে চোখে চোখে রাখার পালা।মাহা এমনিতেই খুব ছটফটে স্বভাবের মেয়ে,তাই এভাবে ঘরবন্দী জীবন তার জন্য প্রচুর বিরক্তের বিষয় ছিলো।তবুও অনাগত সন্তানের জন্য তো এতটুকু সেক্রিফাইস করতেই হবে।কিছু করার নেই।কারণ একটি দূর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।এই সময়টা তাই অধিক পরিমাণে সাবধানে থাকা প্রয়োজন।

মাহা কোন বাসায় থাকবে তা নিয়ে তুমুল মধুর ঝগড়া হয়েছিলো দুই পরিবারের মধ্যে।অবশেষে বহু বাকবিতন্ডার পর ঠিক হলো বাচ্চা হওয়ার আগ পর্যন্ত সে শ্বশুর বাড়িতেই থাকবে।

ইশানী আর মিসেস মুমতাহিনা প্রচুর খেয়াল রাখেন মাহার।লিসা নিসা স্কুলের সময় ব্যতিত যতক্ষণ পর্যন্ত বাসায় থাকে ততক্ষণ মাহার সাথে সাথেই থাকে।জনাব এরশাদ আর সাইফ প্রতিদিন মাহার পছন্দের খাবার,মাছ,মাংস,শাকসবজি এনে হাজির করেন।তাদের যত্নের কোনো শেষ নেই।এদের সেবাযত্নের ঠেলায় মাহা অতিষ্ঠ।মাসে মাসে সঠিক তারিখে মাহার চেক-আপ করানোর দায়িত্বও তাদের।আর আরাফাতের কথা নাহয় বাদই দিলাম।সে অফিসে যায় ঠিকই,কিন্তু ২ মিনিট পর পর অডিও কল, ভিডিও কলের মাধ্যমে মাহার সাথে কথা বলা যেন ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।অফিসে বসে শান্তি পায় না বেচারা মোটেও।অফিস শেষে ব্যবসায়ের কাজে যতটুকু সময় ব্যয় করতো ততটুকু সময় সে মাহার জন্য ব্যয় করে।ব্যবসায় তার বাবা আর ম্যানেজারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সে নিশ্চিত।

দিনের পর দিন পার হয়ে যেতে থাকে।সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত নামে আর রাতে আকাশের বুকে চাঁদের আগমন ঘটে।মাহার প্রতিটা দিন কাটে নিজের রুমে শুয়ে বসে।মাঝেমধ্যে ড্রয়িং রুমে বসে সবার সাথে আড্ডা দেয়।তবে বেশির ভাগ সময়ই বিরসতায় কাটে।মনে শান্তি থাকে না।একটু পর পর মুড সুয়িং হয়।মাঝেমধ্যে এত রাগ ওঠে,ইচ্ছে হয় সব ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলতে।আবার মাঝেমধ্যে উদাস হয়ে বসে থাকে।সময় যত ঘনাতে থাকে তত পেট বড় হয় আর রাতে ঘুমাতে গেলে শান্তি মেলে না।মনে হাজারও আজেবাজে দুশ্চিন্তারা এসে হানা দেয়।

নিশিরাতে মাহার মনে অদ্ভুত রকমের খায়েশ জাগে।কখনো আইসক্রিম খেতে মন চায়,কখনো ফুচকা-চটপটি,বার্গার,স্যান্ডইউচ আবার কখনো বিরিয়ানি অথবা ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে মন চায়।আবার মাঝেমধ্যে আরাফাতকে ঘুমাতে না দিয়ে বলে, “আমায় বারান্দায় নিয়ে চলো,দোলনায় দোল খাবো।”
আরাফাত মোটেও বিরক্ত না হয়ে মাহার সকল আবদার হাসিমুখে মেনে নেয়।এই মেয়েটাই কিন্তু সবসময় কিছু বলার আগে আরাফাতের সকল ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝে ফেলে তার সকল আবদার মেটাতো।আরাফাতের অসুস্থতায় ঠিক কী পরিমাণে সেবাযত্ন করেছিলো মাহা তা আর বলতে হবে না।আজ সে মা হতে যাচ্ছে,তার এই সামান্য ইচ্ছা গুলি পূরণ করলে আহামরি কিছুই ক্ষতি হবে না।

এভাবেই সময় বয়ে যেতে যেতে মাহার প্রেগ্ন্যাসি এখন সাত মাসে পদার্পণ করেছে।আরাফাত আজকে বাসায়ই আছে।সে সোফায় বসে ল্যাপটপ উরুতে নিয়ে দক্ষ হাতে অফিসের প্রয়োজনীয় কীসব টাইপিং করছিলো।আর মাহা নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষণ করছে।মাহা পেটে হাত বোলাতে বোলাতে আরাফাতকে জিজ্ঞেস করলো,

-‘আচ্ছা জানু,আমি কী বেশি মোটা হয়ে গেছি?আমাকে এখন দেখতে খুব বিশ্রী লাগে তাই না?’

আরাফাত মাহার কথা শুনে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে তাকায়।মাহার দিকে তাকিয়ে বলে,’হঠাৎ এমন আজগুবি কথা তোমার মাথায় এলো কী করে হানি?’

-‘আজগুবি না,সত্যিই তো বলছি!আমাকে খুব মোটা লাগছে দেখতে।গাল দুটো তবলা তবলা হয়ে গেছে।হাত পা ও মুলোর মতো হয়ে ফুলে গেছে।চোখের নিচে কালি পড়েছে।নিজের কাছেই বড্ড বাজে লাগছে দেখতে।’ মাহা মনখারাপ করে কথাগুলো বললো।আরাফাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো।তারপর বসা থেকে ওঠে শরীরের জড়তা কাটাতে আড়মোড়া ভেঙ্গে মাহার দিকে এগিয়ে এসে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে গলায় চুমু খেলো পরপর।মাহার মুখের সামনে আসা কয়েক গাছি চুল কানের পিছে গুঁজে দিয়ে আদো আদো কন্ঠে বললো,

-‘এসব উল্টাপাল্টা কথা ভেবে মন খারাপ করবে না সোনা।তুমি জানো,গুলুমুলু হওয়ায় তোমাকে দেখতে এখন কত কিউট লাগে?আমার এখন তোমাকে আদর করতে সুবিধা হয় বেশ।আই উইশ তুমি এভাবেই সবসময় গোল আলুর মতো মিষ্টি হয়ে থাকো।’

-‘হয়েছে আর অদরকারী পাম মারতে হবে না।সবই বুঝি আমি।আমাকে এখন আর একটুও সুন্দর লাগে না।নয়তো বেশি বেশি আদর আমার প্রাপ্য হতো!’ গাল ফুলিয়ে অভিমানের সহিত বললো মাহা।

আরাফাত মাহার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট জোড়া মিশিয়ে দিয়েছে তৎক্ষনাৎ।আরাফাতের গালে হাত রেখে মাহা আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো।বেশ কিছুক্ষণ পর আরাফাত মাহার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো,

-‘তুমি বাচ্চা নও হানি,বরং বাচ্চার মা হতে যাচ্ছো।তুমি এডাল্ট একটা মেয়ে।তোমার মধ্যে ম্যাচুয়েরিটি বিদ্যমান।প্রেগ্ন্যাসির এই সময়টাতে প্রতিটি মেয়ের মধ্যেই ব্যাপক পরিবর্তন আসে।এটা স্বাভাবিক।কেউ অতিরিক্ত মোটা হয়,কারও চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল সৃষ্টি হয়,কারও মুখে ব্রন ওঠে আরও কত কী প্রবলেম!তুমি সুন্দর অসুন্দর খোঁজো না হানি,আমার চোখে আমার বাচ্চাকে নিজের মধ্যে ধারণ করা এই গুলুমুলু মেয়েটাই পরমা সুন্দরী।এসব আজেবাজে দুশ্চিন্তা না করে ভালো কিছু চিন্তা করো।নয়তো এর খারাপ প্রভাব আমাদের বেবির ওপর এসে পড়বে।তুমি না সব বুঝতে পারো?তাহলে আজ এমন অবুঝের মতো করছো কেন?বি পজিটিভ সোনা!আমি সবসময় আমার বউটাকে ভালোবাসি।’

মাহা আরাফাতকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বলে,’আমার ভয় করে জান!যদি আমি মরে যাই তবে আমাদের বাচ্চার কী হবে?আর আমার তোমার হাতে হাত রেখে অনেকদিন চলা বাকি রয়ে গেছে,মরে গেলে সেসব কীভাবে পূর্ণ হবে?এসব চিন্তা এলেই তো আমার মাথা হ্যাং হয়ে যায়।আমার আর ভালো লাগে না কিছু।’

আরাফাত মাহাকে ধরে ধরে বিছানার ওপর নিয়ে বসালো।তারপর নিজে পাশে বসে মাহাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথার ওপর চুমু খেয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,’তুমি এসব চিন্তা মোটেও মাথায় আনবে না হানি।পজিটিভ চিন্তা করো,যেমন আমাদের বাবুর নাম কী রাখবো?বাবুকে আমরা কীভাবে লুক আফটার করবো?বাবুর জন্য কী কী কিনবো?এসব ভাবো দেখবে অনেক ভালো লাগছে।আর আমি আমার বউটার সাথে আছি এবং থাকবো,সবসময়,সর্বক্ষণ।এখন চুপটি করে আমার বুকে শুয়ে থাকো তো।উঠবে না মোটেও।’

আরাফাত মাহার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।মাহা চোখ বন্ধ করে আরাফাতের হার্টবিট গুনছে।এত দ্রুত মরতে চায় না সে।আরাফাতের সাথে যুগ যুগ ধরে বাঁচতে চায়।তাদের তিনজনের একটা সুখের সংসার গড়ে তুলবে সে।এসব সুখ চিন্তায় বিভোর হয়ে একটা সময় ঘুমিয়েই গেল মাহা।মাহা ঘুমিয়ে পড়তেই আরাফাত চুপি চুপি মাহার মাথা বালিশের ওপর রেখে কপালে সন্তপর্ণে ঠোঁট দ্বারা স্পর্শ করে সরে এলো।সারারাত ঘুমায় নি মেয়েটা,এখন একটু ঘুমিয়ে নিক শান্তিতে।

আরাফাত আলমারি খুললো একটা ফাইল বের করার জন্য।এমনসময় কাপড়ের ভাঁজে রাখা দুটো নরম মলাটের ডায়েরি চোখে পড়লো তার।ভ্রুকুটি করে মনে মনে ভাবলো,এই ডায়েরি কার হতে পারে?তার তো ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই।তখনই হুট করে তার মাহার কথা মনে পড়ে গেল।”ওহ মনে পড়েছে,এই ডায়েরি গুলো আমি হানির রুমে পড়ার টেবিলে দেখেছিলাম।তার মানে ডায়েরি গুলো ওর!”

ডায়েরির ওপরে বড় করে A লেখা দেখে কৌতুহল হলো আরাফাতের।তাই সে ফাইলের চিন্তা বাদ দিয়ে একটা ডায়েরি নিয়ে বসলো পড়ার জন্য।দেখা যাক ডায়েরিতে কী লেখা আছে!

সর্বপ্রথম পৃষ্ঠায় গোটা গোটা অক্ষরে দুটো লাইন লেখা,

“আমার জীবনের ডায়েরি ঘেটে দেখো,শুধু তোমার প্রতি আমার জমিয়ে রাখা সুপ্ত অনুভূতিগুলোকেই খুঁজে পাবে।”

সাথে কতগুলো সোনালী রঙের A লেখা সুন্দর স্টিকার ইমোজি দেয়া।কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে উল্টালো সে,পৃষ্ঠাগুলোতে সুন্দর হাতের লেখা এরকম উপমা দেয়া আছে।আরাফাতের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ডায়েরিটা তাকে ডেডিকেট করেই লেখা।এত ভালোবাসতো মেয়েটা অথচ কখনোই মুখ ফুটে বলে নি।আরাফাত মায়াবী দৃষ্টিতে মাহার ঘুমন্ত চেহারার পানে একপলক তাকিয়ে ফের মনযোগ সহকারে ডায়েরি পড়তে লাগলো।

একটা পৃষ্ঠায় এসে চোখ আটকে গেল আরাফাতের।সেখানে ব্যথাতুর কিছু ছন্দ লেখা,

“বোঝাতে পারি নি তোমায়
ভালোলাগার কথা,
ইশারার ভাষাতে ভাঙে নি
তোমার নিরবতা!
আমার তো সব কথাই
তোমার আছে জানা,
তবুও আমি ছুঁতে পারি নি
তোমার মনের কোণা।
হয়তো বা আমার কথায়
জমেছে মনে বিরক্তি,
কী করবো বলো?-এ মনের
ভালোবাসা যে সত্যি!
তুমি তো কখনো চাও না
এমনতর খারাপ সাথী,
ভালোবাসি বলবো না আর
হোক না যতই দূর্গতি!
বুকের মাঝে আফসোসের
জ্বলুক আমার মশাল,
তোমার জীবনে আলো থাক
আমি পুড়ি চিরকাল!”
(সংগ্রহীত)

পৃষ্ঠায় লেখা তারিখ ও সাল খেয়াল করলো আরাফাত।তখন অর্থাৎ সেই সময়টায় লামিয়ার সাথে চুটিয়ে প্রেম করায় ব্যস্ত ছিলো সে।অথচ তার এই ভুল কাজের কারণে বিরহের তাপে দগ্ধ হতে হয়েছে মাহাকে।অনুতপ্ততা ছড়িয়ে পড়লো আরাফাতের মন জুড়ে।বড্ড ভুল হয়ে গেছে মাহাকে কষ্ট দিয়ে।মেয়েটা তাকে সেই ১৩-১৪ বছর বয়স থেকে ভালোবেসে আসছে অথচ সে তা জানতেই পারে নি।এর চাইতে বড় ব্যর্থতা আর কীইবা হতে পারে?

আরেকটা পাতায় লেখা,

“তোমাকে পাবো না জানি।সেই আশা আমি করিও না কখনো।তবে একতরফা ভাবে ভালোবেসে যেতে তো অসুবিধা নেই?যতদিন না তুমি আমার মন থেকে মুছে যাবে চিরতরের মতো ততদিন আমি নাহয় তোমায় ভালোবেসেই যাবো।”

অন্য পাতায় লেখা,

“লামিয়া নামক মেয়েটার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর তোমাকে এত খুশি আমি এর আগে কখনো দেখি নি।জানো,তোমার হাস্যজ্জ্বোল মুখ দেখতে আমার অনেক ভালো লাগে।তাই তো সবসময় চাই,তুমি তোমার প্রেমিকার সাথে সুখে থাকো।আর আমি নামক কিশোরীর মনে যে তোমায় নিয়ে আলাদা একটা সাজানো কল্পনার জগৎ আছে তা নাহয় তোমার অজানাই থেকে যাক!”

প্রতিটা পাতায় পাতায় অভিমানের পসরা সাজিয়ে রেখেছে মাহা।বুকটা ভার হয়ে আসে আরাফাতের।লামিয়া তার জীবনের প্রথম প্রেম ছিলো।আর কাউকে ভালোবাসার পর বিচ্ছেদের পরবর্তীকালে বিরহের যন্ত্রণাটা সে খুব ভালো করেই জানে।অতএব মাহার কষ্টটা উপলব্ধি করতে বেশ বেগ পেতে হলো না তাকে।একতরফা ভালোবাসার যন্ত্রণা সেই বুঝে যারা কাউকে মন দিয়ে ভালোবেসেছে একতরফা ভাবে।

ডায়েরির প্রতিটা পাতায় পাতায় আরাফাতকে নিয়ে ছন্দ অথবা উক্তি লেখা।মনের মাধুরি মিশিয়ে খুবই সাবধানে সুন্দর করে প্রতিটা লাইন লিখেছে মাহা।আরাফাত মুগ্ধ হয়ে এক রূদ্ধশ্বাসে শুধু পড়েই গেল।সারাটা পড়া শেষে বন্ধ করে আবারও আগের জায়গায় রেখে দিলো সে।রাখার আগে ডায়েরির মলাটে একটা চুমু খেতে ভুললো না।

-‘এই মেয়েটাকে হৃদয়ের মনিকোঠায় রাজ সিংহাসনে বসিয়ে রাখবো আমি!অতীতের সব বাদ।আমার বর্তমান,আমার স্ত্রী,আমার প্রেমিকা, আমার হৃদয়হরণীকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখবো আমি সবসময়।তাকে কখনো কোনো কষ্টের ছোঁয়াও পেতে দিবো না কথা দিলাম!’

আরাফাত মাহার পাশে বসে চুল ঠিক করে দিয়ে ফোলা পেটের ওপর হাত বুলিয়ে আদর করে বললো,’অনেক ভালোবাসি তোমায় প্রেয়সী!অনেক!এই জীবনে কভু তোমার হাত ছাড়বো না।আগলে রাখবো আমার সন্তানের জননীকে!’
___________

ডেলিভারি হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের ৩ দিন আগে আরাফাত মাহাকে নিয়ে প্রাইভেট হসপিটালে শিফট হয়ে গেছে।হসপিটাল কর্তৃপক্ষ রাহাতের পূর্ব পরিচিত হওয়ায় মাহার সেবাযত্নের কোনো ত্রুটি হচ্ছে না।আর আরাফাত ও তার পরিবারের সকলে তো আছেই।মাহার মুখ চোখ বসে গেছে যেন।সে অহেতুক দুশ্চিন্তা করতে করতে পাগল হওয়ার জোগাড়।বেশির ভাগ চিন্তা ভাবনাই এমন,যে সে মরে গেলে আরাফাত যদি আবারও বিয়ে করে নেয়,তাহলে এত কষ্ট করে তাকে হাসিল করে লাভটা কী হবে?আরাফাত এসব শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।শত বলেও মাহার মাথা থেকে আবোলতাবোল চিন্তা গুলো সরানো যাচ্ছে না।

সঠিক সময়ে তিন দিন পরই মাহার ডেলিভারি পেইন ওঠে।আরাফাত ভেঙে পড়তে গিয়েও পারছে না।সে ভেঙে পড়লে মাহাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে?

মাহাকে অটিতে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে মাহা ফোঁপাতে ফোপাঁতে আরাফাতের হাত ধরে বললো,’কথা দাও আমি মরে গেলেও তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করবে না!বলো!’

আরাফাত মাহার গালে কপালে চুমু খেয়ে বললো,’শীঘ্রই দেখা হবে আমাদের সোনা!বি স্ট্রং।আমাদের বাচ্চাকে নিয়ে দ্রুত ফিরে আসো।অপেক্ষা করছি তো।আমার বউ থাকতে অহেতুক আমি কেন আরেকটা বিয়ে করতে যাবো বলো তো?ডোন্ট বি প্যানিক,ওকে!’

আরাফাতের কথা শুনে মাহা যেন একটু বল পেল।সে আরাফাতের হাতের পিঠে চুমু খেয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে ক্রমাগত।বাকিরা সবাই মাহাকে মোটিভেট করছে।অবশেষে মাহাকে অটিতে নিয়ে যাওয়া হলো।

রাহাত ডোনার থেকে শুরু করে সব আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছে।সে একজন বড় মাপের ডক্টর, তার কথার গুরুত্ব অন্য ডক্টরদের কাছে অনেক বেশি।তাই বাকি ডক্টররা খুবই মনযোগের সহিত,যত্ন নিয়ে মাহার ডেলিভারি করছে।

আরাফাতের টেনশনে হাঁটু কাঁপছে।না জানি মাহা এখন কেমন অবস্থায় আছে।আর ভালো লাগছে না।আজকে সময়ও যেন ফুরচ্ছে না।বিপদের কালে সময় যায় না আজকে তা আবারও প্রমাণিত হলো।আরাফাতকে রাহাত আর সাইফ টেনশন করতে মানা করছে,কিন্তু আরাফাতের মন তো আর মানে না।ওয়াশরুমে ঢুকে কতক্ষণ নিরবে কান্নাকাটি করে এলো সে।দূর,সময় কেন যায় না!আর ধৈর্য্য ধরতে পারছে না সে।মাহাকে দেখার জন্য মনটা খুবই আইঢাই করছে তার।এত অশান্তি জীবনেও হয় নি!

অবশেষে প্রায় একঘন্টা সময় পেরোতেই একজন নার্স তোয়ালে মোড়ানো অবস্থায় বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।আরাফাত প্রায় দৌড়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো,

-‘আমার হানি কেমন আছে নার্স?দ্রুত বলুন!’ আরাফাতের মৃদু ধমকানোতে থতমত খেয়ে গেছে নার্স।সে কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে।রাহাত আর সাইফও দ্রুত এগিয়ে এলো।নার্স নিজেকে সামলে জবাব দিলো,

-‘চিন্তা করবেন না।মিসেস হাসান সুস্থ আছেন।তবে ওনার শরীর একটু দূর্বল।একটু পর ওনাকে কেবিনে শিফট করা হবে।তখন চাইলে দেখা করতে পারেন।’

মাহা সুস্থ আছে জেনে আরাফাতের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো।এতক্ষণে বাচ্চার দিকে নজর পড়ে তার।নার্সও বাচ্চাকে আরাফাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-‘অভিনন্দন জনাব হাসান সাহেব,আপনি ফুটফুটে এক ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছেন।’

আরাফাত খুশিমনে ছেলেকে কোলে নিলো।ওদের কথা শেষ হতেই রাহাত এবার নার্সের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আরাফাত অপলকভাবে তাকিয়ে আছে বাচ্চাটার দিকে।এত ছোট ছোট হাত পা তার।ফর্সা চিকন চিকন আঙ্গুল গুলো মাঝেমধ্যে নড়েচড়ে ওঠছে।খুশিতে আরাফাতের চোখ থেকে দুফোঁটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।ছেলের কপালে চুমু খেয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে সে।মিসেস মুমতাহিনা এসে ছেলের কোল থেকে নাতিকে নিলেন।পরিবারের সকলে মাঝে সুখের বন্যা বয়ে গেল।একটু পর জনাব আতিক নাতির কানের কাছে আযান দিলেন।লিসা নিসা খুশিতে টগবগ করছে তাদের ভাতিজা হওয়ার খুশিতে।সবচাইতে বেশি খুশি হয়েছে জাওয়াদ আর রিহাদ।তারা তাদের খেলার সঙ্গী পেয়ে ভীষণ আনন্দিত।

আরও ঘন্টা খানেক পর মাহার সাথে সবাই দেখা করে আসে।মাহার চেহারা মিষ্টি হাসিতে উদ্ভাসিত।ছেলেকে বুকের ওপর রেখে শুয়ে আছে সে।বেঁচে ফিরে আসার আনন্দে আনন্দিত সে।যাক,এই যাত্রায় আরাফাতকে দ্বিতীয় বিয়ে করার সুযোগ দিচ্ছে না সে।

একে একে সবাই দেখা করে বেরিয়ে যাওয়ার পর কেবিনের ভেতর আরাফাতের প্রবেশ ঘটে।মাহা আরাফাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

-‘তোমাকে আর কারও হতে দেখলে মরে গিয়েও শান্তি পাবো না তাই এবারের যাত্রায় বেঁচে ফিরে এলাম।তুমি আমার মানে আমারই।অন্য কারও হতে দিবো না কখনো।প্রয়োজন পড়লে মৃত্যুর পরও আত্মা হয়ে সারাজীবন সাথে সাথে থেকে আগলে রাখবো তোমায়।তাও আমি তোমার দাবি ছাড়বো না।’

মাহার চোখ থেকে পানি পড়ছে ঠিকই কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই আছে।আরাফাত এগিয়ে এসে মাহার গালে, কপালে, থুতনিতে একের পর এক কিস করছে উন্মাদের মতো।অতঃপর মাহার ঠোঁটের ওপর গাঢ় করে চুম্বন করে বললো,

-‘তুমি জানো,আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছিলো।তুমি কত ব্যথা সহ্য করে কাতরাচ্ছিলে আর আমার মনে হচ্ছিলো এক্ষুনি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো।তুমি আমার সব হানি।বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন।এটা কোনো ফেলনা নয়।তুমি আমার দুই দুইবার বিয়ে করা স্ত্রী।এত সহজে কীভাবে ছেড়ে দিই তোমায় বলো?’

দুজনের মধ্যে নিরবতা নেমে এলো।মাহা ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আরাফাতের কপালের সাথে নিজের কপাল মিশিয়ে শুয়ে আছে।আরাফাতের খসখসে দাঁড়িতে অনবরত স্বীয় হাত ঘষছে সে।মাহা আরাফাতের চোখের পানে দৃষ্টি রেখে বললো,

-‘বাবুর নাম কী রাখবো বলো তো?অবশ্যই তোমার নামের সাথে মিলিয়ে একটা নাম বলবে!’

আরাফাত কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে জবাব দিলো,

-‘আমাদের দুজনের নামের সাথে মিল রেখে আমার ছেলের নাম আরিহান মাহিদ হাসান রাখবো।আরাফাত হাসান ও মাহা হোসাইনের ছেলে আরিহান!’

-‘ওয়াও,নামটা ভীষণ সুন্দর আর ইউনিক!তাহলে এটাই ঠিক রইলো।’

-‘হ্যা!’

-‘ভালোবাসি জান!কখনো ছেড়ে যেও না!সহ্য করতে পারবো না।’ করুন কন্ঠে বললো মাহা।

আরাফাত মাহার নাক ছুঁয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,

-‘সব ছাড়তে পারি অনায়াসে কিন্তু তোমাকে নয় মধুতমা।ছেড়ে দেয়ার জন্য ভালোবাসিনি,বরং বুকের মাঝে আগলে রাখার জন্যই ভালোবেসেছি!’

দুজনেই ডুবে গেছে প্রেমের সাগরে।বাচ্চা হওয়ায় যেন আরও গভীর হয়ে গেছে দুজনের ভালোবাসাটা!

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে