অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -২৫

0
1939

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_২৫

রাত সাড়ে এগারোটা বাজে,
রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে হলরুমে এসে আরাফাত মিসেস মুমতাহিনাকে বললো,

-‘আম্মু আমি রাহাত ভাইয়াদের বাসায় যাচ্ছি।রাতে ফিরবো না।’

-‘সেকি রে?এত রাতে বৃষ্টির মাঝে যাওয়ার দরকার কী?কালকে সকালে যা বরং ধীরে সুস্থে।এখনও তো রাতের খাবারও খেলি না,সেই কখন অফিস থেকে ফিরেছিস!’

-‘আম্মু প্লিজ,আমায় বাঁধা দিয়ো না এখন।অনেক জরুরি দরকার আছে আমার হানির সাথে।এক্ষুনি যেতে হবে।’ আরাফাত ব্যাকুল হয়ে গেছে যাওয়ার জন্য।

মিসেস মুমতাহিনা চাইলেও আর এখন ছেলেকে আটকাতে পারবেন না,তাই তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন,

-‘ঠিক আছে যা।ড্রাইভারকে বল গাড়ি বের করতে।এত রাতে তোকে একা ছাড়বো না আমি।’

-‘আচ্ছা ঠিক আছে।আমি এখন যাই।’

নাছোড়বান্দার মতো মাহার প্রতি একরাশ জেদ নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো আরাফাত।মিসেস মুমতাহিনা আনমনে মুচকি হাসলেন ছেলের পাগলামি দেখে।এই কয়েকটা মাসে আরাফাতের মনে মাহার প্রতি এতোটাই আসক্তি জন্মে গেছে যে একটা মুহূর্তও আর তর সইছে নাহ তার বউয়ের কাছে ছুটে যেতে।মিসেস মুমতাহিনা মনে মনে বললেন,”এমনি তো আর বাতাসে চুল পাকে নি আমার বাবা।এসব দিন আমরাও পার করে এসেছি।তুমি আমাকে যতোই বুঙ্গাবুঝ দাও,আমি তো জানি তুমি কীসের জন্য এত রাতে পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছো ও বাড়িতে!হা হা,বউপাগল ছেলে আমার!”

আরাফাত বাহিরে বের হতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে।এতক্ষণ শুধু ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর হালকা হাওয়া বইছিলো,এখন পুরোদমে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।দিনের তুলনায় রাতেই বেশি বর্ষণ হচ্ছে।তবুও এত মেঘবাদল আরাফাতকে দমাতে পারে নি।সে যাবে মানে যাবেই।

ড্রাইভার গাড়ি বের করতেই আরাফাত তাতে চড়ে বসে।মনটা ভীষণ জ্বালাতন করছে আজ।এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে রাজী নয় এই ফাজিল মনটা।কতক্ষণে যে চোখের তৃষ্ণা মেটাতে পারবে আল্লাহ মালুম।আরাফাত ড্রাইভারকে তাগাদা দিয়ে বললো দ্রুত গাড়ি চালাতে।
___________

মাহা আগেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেছে।বাকিরাও এখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।জনাব আতিক ও রাহাত ওরা তাদের রুমে শুয়ে-বসে আরাম করছে।মিসেস মিনারার ও ইরার সবকিছু গোছানো শেষ এখন তারাও নিজেদের রুমে চলে যাবেন ঘুমানোর জন্য।বেশ রাত হয়ে গেছে বলা যায়।এরমাঝে তুমুল বর্ষণ হচ্ছে বাহিরে।এমন পরিবেশে আরামের ঘুম জলদি জলদি নেমে আসে চোখে।তাই তো এত দ্রুততা।

এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে।মিসেস মিনারা আর ইরা অবাক।এই এত বর্ষণমুখর রাতে হুট করে কে এলো?দেখতে হচ্ছে তো!
মিসেস মিনারা ইরাকে না পাঠিয়ে নিজে গেলেন দরজা খুলতে।ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বেল বেজে ওঠলো।যে এসেছে তার বোধহয় আর তর সইছে নাহ।এদিকে মিসেস মিনারা দোনোমোনো করে দরজা খুলে করিডরের মতো বারান্দায় আসতেই আগত ব্যক্তিকে দেখে পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে গেলেন।অস্ফুটস্বরে বলে উঠেন,

-‘আরাফাত!’

আরাফাত মাথার ওপর থেকে বৃষ্টির পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

-‘ভেতরে আসতে দেবে না মামণি?বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি আমি।’

মিসেস মিনারার যেন সংবিৎশক্তি ফিরে এলো।তিনি হ্যা হ্যা বলে দ্রুত ঘরের ভেতর প্রবেশ করে তড়িঘড়ি করে চাবি হাতে আবার ফেরত এসে ঝড়ের গতিতে বাহিরের শক্ত গ্রিলের দরজা খুলতে শুরু করেন।সেকেন্ডের মধ্যে তালা ও দরজার ছিটকিনি খুলে মেলে ধরলেন তিনি।আরাফাত শরীর ঝাড়তে ঝাড়তে দ্রুত ভেতরে ঢুকলো।বাইরে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপতে গিয়েই প্রায় ভিজে গেছে সে।মিসেস মিনারা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে তালা মারতে মারতে আরাফাতের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘এই বর্ষার রাতে আসতে গেলি কেন বাবা?যদি কোনো সমস্যা হতো?’

-‘কীসের সমস্যা হবে?আমার মন চাইলো তাই চলে এলাম তোমাদের কাছে।কেমন আছো তুমি মামণি?’ আরাফাত সহাস্য বদনে জানতে চাইলো।

-‘এই তো বাবা, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রেখেছেন।তোর কী খবর?বিকেলে মাহা যখন এলো তখন তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম,বললো তোর অফিসে কাজ বেশি তাই তার সাথে আসতে পারিস নি।’

মিসেস মিনারা আরাফাতের সাথে কথা বলে বলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজা আটকে দিলেন।আরাফাতও তাঁর কথার বিপরীতে বললো,’আর বলো না মামণি,আমার অফিসে কাজ তো বরাবরই বেশি।এতদিন অসুস্থ ছিলাম বিধায় অফিস কামাই করতে হয়েছে।তাই এখন কাজের চাপ সব আমার ওপর এসে বর্তেছে।তাও চলে এলাম তোমাদের বাসায় থাকতে।কিছু মনে করো নি তো এত রাতে এসে ডিস্টার্ব করেছি বলে?’

মিসেস মিনারা আরাফাতের কাঁধে চাপড় মেরে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,’এক থাপ্পড় খাবি এসব উল্টাপাল্টা কথা বললে।তুই আমার ছেলে, সাথে মেয়ের জামাইও হস।তোর যখন মন চাইবে তখনই চলে আসবি এখানে।কার কী অসুবিধা হবে?বোকারাম!’

আরাফাত হাসলো শুধু কিছু বললো না।ইরা একটা তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে এসে আরাফাতের দিকে মেলে ধরে হাসিমুখে বললো,

-‘কেমন আছো ভাই?অনেকদিন পর এখানে আসলে!’

আরাফাত তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে জবাব দিলো,

-‘এই তো ভাবী ভালো আছি।রাহাত ভাইয়া কই?তাকে তো দেখছি না।’

-‘একটু আগে রুমে গেছেন ঘুমাতে,সকালে ডিউটি আছে তো তাই।’

-‘ওহহ!’

আরাফাত তার মাকে ফোন দিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত করে বললো সে এসে পৌঁছে গেছে এখানে।মিসেস মুমতাহিনা এতক্ষণ আরাফাতের ফোনের অপেক্ষাতেই সজাগ ছিলেন।ছেলে গিয়ে পৌঁছেছে শুনে চিন্তামুক্ত হয়ে ঘুমাতে গেলেন।

একটু পর ওদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে জনাব আতিক রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।আরাফাতকে দেখে অবাকের সাথে খুশিও হলেন খুব।তাদের হইচই কানে যেতেই রাহাতও চলে এলো।শুরু হলো আরেকতরফা খোশগল্প।আরাফাতের এখান থেকে ওঠে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এভাবে সকলের মাঝখানে থেকে ওঠে গেলে বিষয়টা বেয়াদবি হয়ে যায়।তাই চুপচাপ বসে তাদের কথার সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলছে।

মিসেস মিনারা অনেক জোর করলেন আরাফাতকে খাবার খাওয়ার জন্য।কিন্তু সে খেলো না।খেতে গেলেও এখন অনেক সময় লাগবে আর এই সময়টুকু খুইয়ে ফেলতে মোটেও রাজী নয় আরাফাত।মিসেস মিনারা আর জোর করলেন না।অনেক রাত হয়েছে।তাকে মাহার রুমে চলে যেতে বললেন তিনি।বাকিদেরও এখন ঘুমের প্রয়োজন।আরাফাত শুভরাত্রি বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল মাহার রুমের দিকে।বাকিদেরও চোখে তখন ঘুমঘুম ভাব।তৎক্ষনাৎই সভা ভঙ্গ করে যে যার রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।

__________

আরাফাত মাহার রুমের ভেতর প্রবেশ করে দরজা আটকে দিলো।মাহা তখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে গুটিশুটি মেরে বিছানার একপাশে ঘুমিয়ে আছে।ডিমলাইটের আলোয় মাহার চেহারা আধো চোখে পড়েছে আরাফাতের।আরাফাত ধীরগতিতে হেঁটে মাহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে।মায়াবি চেহারার পানে তাকিয়ে রয় মিনিট খানেক।এতক্ষণে যেন কলিজাটা ঠান্ডা হয়েছে তার।

আরাফাত মাহার পাশে এসে বসে তার গালে গলায় হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে।মাহা একটু নড়েচড়ে আবারও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।আরাফাত মুচকি হেসে এবার মাহাকে দুহাত দিয়ে আলিঙ্গন করে মাহার গলার ভাঁজে মুখ ডুবায়।সেকেন্ড পেরোতে না পেরোতেই ঠাস করে মাহার ঘুম ভেঙে যায়।মাহা নিজের ওপর কোনো কিছুর ভার অনুভব করতে পারলো।গলার ওপর কারও ঘনঘন ঠোঁটের ছোঁয়া আর তপ্ত নিঃশ্বাসের গরম তাপ পেয়ে শিউরে ওঠে সে।এতদিনের অভ্যাসে এতটুকু বুঝতে পারে যে এই স্পর্শ আর কারও নয়,তার প্রাণপ্রিয় স্বামী আরাফাতের।মুহূর্তেই খুশির বন্যা বয়ে গেল মাহার হৃদয় জুড়ে।দু হাতে শক্ত করে ধরে নিজের বুকের সাথে আগলে নেয় তাকে সে।চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় আরাফাতের কপাল, মাথার চুল।

আরাফাত মুখ তুলে মাহার দিকে তাকায়।মাহার গালে হাত রেখে অভিমানী কন্ঠে বলে,’আমাকে এভাবে না জানিয়ে তুমি কেন চলে আসলে?একবারও কী মনে হয় নি যে বাসায় এসে তোমায় না দেখলে আমি পাগল হয়ে যাবো!আমায় কষ্ট দিতে ভালো লাগে তোমার হানি?তুমি জানো না আমি তোমাকে কতোটা চাই?আজ এমনটা তুমি না করলেও তো পারতে!’

আরাফাত মাহাকে ছেড়ে দিতে গিয়েও পারলো না।মাহা শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে।আরাফাতের গালে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে জানতে চাইলো,’কিছু খেয়েছো তুমি?তোমার মুখ শুকনো লাগছে কেন?’

আরাফাত তাচ্ছিল্য হেসে বললো,’আমি খেলেও কী?না খেলেও কী?কারও তো কিছু এসে যায় না আর।করুনা করে বিয়ে করেছো আমায়।আমি মরে,,,’

বাকিটুকু আর বলতে দিলো না মাহা।আরাফাতের মাথার পেছনের চুল হাত দ্বারা আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে এনে আরাফাতের গালে ঠোঁট জোড়া ডুবায় সে।আরাফাতও টাইট করে জড়িয়ে ধরে তাকে।একান্ত কিছু মুহূর্ত নিরবে উপলব্ধি করতে লাগলো দুজন।কারও মুখে কোনো রা নেই।ভেসে আসছে শুধু নিঃশ্বাসের শব্দের তপ্ত উষ্ণতা আর বাহিরের আকাশের বুক থেকে ঝরে পড়া তুমুল মেঘবর্ষণের শব্দ।

বেশ কিছুক্ষণ পর মাহা আরাফাতের ওপর থেকে হাতের বাঁধন ঢিল করে মৃদুস্বরে বলতে শুরু করে,’আসলে আমি তোমার পছন্দ হওয়ার মতো তেমন একটা সুন্দরী নই।টিপিক্যালি মেয়েরা সাধারণত যেমন সুন্দরী,কিউট,নমনীয়,কমনীয়,লাজুক টাইপের হয়ে থাকে,আমি সেরকমটা মোটেও নই।এজন্য আগে তুমি আমার দিকে তেমন একটা নজর দিতে না আমি তা খুব ভালোই বুঝতে পারতাম।তোমাকে আমার অনেক আগে থেকেই ভালো লাগতো।জানো,আমার কিশোরী বয়সের প্রথম আবেগ হলে তুমি যা এখনও সুপ্ত আছে মনের গভীরে।অন্যান্য মেয়ে হলে হয়তো সেই ভালোলাগাটুকু প্রকাশ করে ফেলতো,কিন্তু চাপা স্বভাবের হওয়ার দরুন তা মুখ ফুটে কখনো বলতে পারলাম না আমি।

–তখন তুমি লামিয়ার প্রেমে পড়লে,সত্যি বলতে লামিয়া অনেক অনেক সুন্দরী।যেকোনো ছেলেই তার প্রতি ফিদা হতে বাধ্য।তুমিও হয়েছিলে।চাইলেই আমি তোমার রিলেশন নষ্ট করতে পারতাম,কিন্তু করি নি কেন জানো?আমার কাছে ভালোবাসা মানেই জোর করে ছিনিয়ে নেয়া নয়,বরং ভালোবাসা মানে হলো ভালোবাসার মানুষের সুখের জন্য স্বীয় স্বার্থত্যাগ করা।যা আমি করেছিলাম।তোমার সুখের জন্য সব ছেড়ে দিতে রাজী আমি।সব!একবার চেয়ে দেখো,হাসতে হাসতে জীবনটাও দিয়ে দিবো তোমার খুশীর জন্য।

আরাফাত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে।এই মেয়েটা তাকে এতোটা ভালোবাসতো, অথচ সে সেদিকে কোনো পাত্তাই দেয় নি।মোহের মধ্যে ডুবে গিয়ে আসল নকল চেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলো সে।আরাফাত পরম ভালোবাসা নিয়ে মাহার গলায় হাত রাখলো।কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই মাহা বলতে লাগে,

–তোমার এক্সিডেন্টের কারণ কেউ জানতো না।সবাই শুধু এটাই জেনেছিলো যে লামিয়া তোমাকে ধোঁকা দিয়েছে,এর বাকিটুকু কারও জানা নেই।অথচ তোমাকে লামিয়া ঠকাচ্ছে কী না,লামিয়ার সাথে তোমার বিয়ে হলে তুমি সুখী হবে কী না তার সব তথ্য আমি কঠিন হলেও সংগ্রহ করেছি আগে থেকে।ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যের হাতে তুলে দেবো,একটু তো খোঁজ খবর নিতেই হয় তাই না?যদিও সবাইকে সব জানাতে গিয়ে একটু দেরী করে ফেললাম।এক্সিডেন্ট হলো তোমার!সকলে দিশেহারা হয়ে পড়লো।কেঁদেকেটে সবাই নিজের কষ্ট উদগীরণ করতে পারলেও আমি পারি নি।বুকে পাথর চাপা দিয়ে তোমার পরিবারের সকলকে সামলে নিলাম।আল্লাহর কাছে নিজের হায়াতের বিনিময়ে তোমাকে চাইলাম।দান খয়রাত থেকে শুরু করে সব করেছি তোমার কল্যানের জন্য।তোমার বাঁচার কোনো আশাই ছিলো না,ভেঙে পড়তে পড়তে নিজেকে আবারও আটকালাম।এ যেন এক কঠিন তপস্যা ছিলো আমার জন্য।বাইরে থেকে আমি স্বাভাবিক ভীষণ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে যা কেউই টের পায় নি।

–সাইফ আর রাফি ভাইয়াকে দিয়ে লামিয়ার শাস্তির ব্যবস্থা করলাম।তোমাকে যে কষ্ট দিবে তাকে তো এত সহজে ছেড়ে দিতে পারি না, তাই না?হাজার হোক,তুমি আমার জীবনের প্রথম প্রেম ও আবেগ।তোমার কষ্ট কিন্তু আমারও কষ্ট!নিজের পড়ালেখা ছেড়ে ভাইয়াকে লুকিয়ে প্রতিদিন হসপিটালে যেতাম একনজর তোমায় দেখবো বলে।তোমাকে যখন বাসায় নিয়ে আসা হয় তারপর থেকে দুদিন পর পর একবার হলেও তোমার খোঁজ নিতে তোমার বাসায় যেতাম।তোমার দায়িত্ব দেয়ার জন্য মেয়ে খুঁজছিলেন মামণি আর বাবাই,কিন্তু কোনো মেয়েই রাজী হয় না।তাদের মতে,একটা পঙ্গু ও সদ্য ছ্যাঁকা খাওয়া উন্মাদ ছেলেকে বিয়ে করে নিজের জীবন নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।

–তখন লিপিকেও একই প্রস্তাব দেয়ার ফলে তার মা মামণিকে নানা কথা শুনিয়ে দেয়।এতসব সহ্য করতে না পেরে আমি মামণিকে বুঝিয়ে রাজী করাই যাতে তোমার সাথে আমার বিয়ে দেয়।আমার ভালোবাসার মানুষ এত সস্তা না যে তাকে সবাই এভাবে রিজেক্ট করবে।মানতে না পেরে মেয়ে হয়ে নিজেই প্রস্তাব রাখলাম।আমার ভাইয়া রাজী ছিলেন না এই বিয়েতে।কারণ তোমার সুস্থ হওয়ার চান্স খুব কম ছিলো।তারপরও বহু ঝামেলার পর তোমার আমার বিয়ে হয়।তবুও মাঝেমধ্যে তুমি বলো তোমায় আমি করুনা করে বিয়ে করেছি।এত ভালোবাসার পরও তোমার মুখ থেকে এমন কথা শুনতে হয়!অথচ এত বছর ধরে তোমার জন্য আমি পাগল,সেটা একবারও তুমি বুঝতে পারলে না।আফসোস!

আরাফাত মাহার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে করুন কন্ঠে বললো,’ক্ষমা করে দাও হানি প্লিজ!আমি বুঝতে পারি নি আসলে।ভুল করেছিলাম,ভুলের প্রায়শ্চিত্তও করতে হয়েছে।রাগ করো না।সরি ডিয়ার!আ’ম সো সরি!’

-‘সরি বলে কী হবে?আমি তোমার মনের মতো মেয়ে নই বা কখনো হতেও পারবো না,যাকে দেখে তুমি প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হবে!বিমোহিত হওয়ার মতো রূপজৌলুসও আমার নেই।তুমি কত সুন্দর আর কিউট একটা ছেলে।তোমার পাশে কী কখনো আমাকে মানাবে বলো?যখন তোমার আত্মীয় স্বজন কলিগ সকলে জানতে পারবে আমি তোমার স্ত্রী,তখন প্রায় সকলেই বলবে তোমার সাথে আমার যায় না।এজন্যই তুমি সুস্থ হওয়ার পর আমার দায়িত্ব শেষ করে এখানে চলে এসেছি।আমাদের বিয়েটাও তেমন জোরালো ভাবে হয় নি।জাস্ট কাগজে কলমে আমি তোমার স্ত্রী।তো এই বিয়ে ভাঙতেও তেমন সময় লাগবে না।তখন তুমি কোনো সুন্দরী দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবন সাজাবে,আর আমি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার বন্দোবস্ত করবো।’

আরাফাত মাহার ঠোঁটে হাত চেপে ধরে রাগত স্বরে হিসহিসিয়ে জবাব দেয়,’চুপ করো মেয়ে!আর একটা আউল ফাউল কথা বললে গলা টিপে মেরে ফেলবো একদম।আমি যেখানে একটাদিনও তোমাকে ছাড়া থাকার কথা চিন্তা করতে পারি না সেখানে তুমি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ভাবলে কী করে?এখনও বুঝতে পারলে না আমি তোমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি?কে কী বললো আই ডোন্ট কেয়ার হানি!আমি শুধু এটাই জানি যে তোমাকে আমার চাই।কে বলেছে তুমি সুন্দরী না,আমার স্ত্রী আমার চোখে বিশ্বসুন্দরীর চাইতেও অধিক সুন্দরী।এক মুহূর্ত থাকতে পারবো না তোমাকে ছাড়া!একটুও না।’

আরাফাত পাগলের মতো মাহার গালে,কপালে ও ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়।বিরবির করে বলে,”আই লাভ ইউ হানি!আই লাভ ইউ সো মাচ!” এতবছর পর স্বপ্নে লালিত সেই ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড গুলো কানে আসে মাহার।সুখের হাসিতে উদ্ভাসিত হয় মুখ।আনন্দের আতিশয্যে জ্বলজ্বল করে ওঠে চোখের তারা।ভালোবাসি শুনেও কেউ এত খুশি হতে পারে তা হয়তো মাহাকে না দেখলে জানা যেত না।চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে বালিশ ভিজে যায় মাহার।আরাফাত মাহার কপালে গভীর চুম্বন করে বলে,

-‘আমাদের ভালোবাসার বন্ধন মজবুত করতে প্রয়োজনে আবারও সকল নিয়মকানুন মেনে বিয়ে করতে রাজী আমি।এবং খুব শীঘ্রই সকলে জানবে যে তুমিই আমার প্রিয়তমা প্রাণভোমরা স্ত্রী।জানো আজকে আমার পরিচিত এক কলিগের বাচ্চা হয়েছে।অথচ তার বয়স আমার থেকে কম।আমার কী ইচ্ছে করে না বাচ্চা কাচ্চার বাপ হওয়ার?খুব জলদিই আমাদের দুজনের পুরোদস্তুর সংসারী হতে হবে।আর দেরী নয় আমি এই বছরের মধ্যেই বাবা হতে চাই!’

আরাফাতের মুখ থেকে এমন লাগামহীন কথা শুনে কিঞ্চিত লজ্জা পেল মাহা।আরাফাতের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো সে কিছু না বলে।আরাফাতও হাসলো মাহার কাজ দেখে।অতঃপর স্বাভাবিক হয়ে গেল দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক।

আরাফাতের খিদেটা এবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠলো।গড়গড় করে বিকট শব্দে ডেকে ওঠে তার পেট।আজকে দুপুরেও সে ঠিক মতো খেতে পারে নি যার দরুন সারাদিনের ক্লান্তি মিলিয়ে এখন প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে তার।এখন রাত অনেক হয়েছে, কী করে মাহাকে বলবে তার যে খিদে পেয়েছে?এজন্য কাচুমাচু করতে লাগলো সে।

মাহা কী করে যেন টের পেয়ে গেছে যে আরাফাতের ক্ষুধা লেগেছে।সে আরাফাতকে নিজের থেকে সরিয়ে ওঠে বসলো।চুল বাঁধতে বাঁধতে বললো,’তুমি থাকো,আমি খাবার নিয়ে আসি।’

আরাফাতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমের লাইট অন করে বেরিয়ে গেল মাহা।আরাফাতও শোয়া থেকে ওঠে বসলো চুপচাপ।বাঁধা দিলো না মাহাকে,কারণ পেটে খিদে নিয়ে একটুও ঘুমাতে পারবে না সে।

মিনিট পাঁচেক পর খাবারের ট্রে হাতে ফিরে এলো মাহা।আরাফাত খাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বিছানার ওপর জাঁকিয়ে বসেছে।মাহা আরাফাতের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো,’নিজের হাতে খাবে নাকি আমি খাইয়ে দেবো?

-‘তুমি খাইয়ে দাও!’ আরাফাতের ঝটপট জবাব।

-‘ঠিক আছে!’ মাহা হাত ধুয়েই এসেছে কিচেন থেকে।কারণ জানে আরাফাত এমন বায়না ধরবে।মাহা আরাফাতকে গালে তুলে খাইয়ে দিতে লাগলো।আরাফাত তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে।মাহার হাতে না খেলে দিনটাই ভালো যায় না, খিদে যেন থেকেই যায়!

আরাফাতের জোরাজুরিতে মাহাও দু লোকমা খেলো তার সাথে।আরাফাতকে পেট ভরা খাবার খাইয়ে মাহা রান্নাঘরের সিংকে থালাবাসন সব রেখে এলো।আরাফাত তৃপ্তির ঢেকুর তুলে শুয়ে পড়েছে বিছানায়।মাহাও রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এলো।মাহা শুয়ে পড়তেই আরাফাত মাহার ওপর ওঠে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,’আজকে একটু কাছে আসার পারমিশন দিবে আমায়?প্লিজ!তোমায় খুব কাছে পেতে মন চাইছে হানি!একটু ছোঁয়ার অনুমতি দাও!’

আরাফাতের মিনতি ফেলতে পারলো না মাহা।আজকে তার নিজেরও আরাফাতের সাথে মিশে যেতে মন চাইছে।ওয়েদারটাও ভীষণ রোমান্টিক মুডে আছে তবে তাদের রোমান্টিক হতে দোষ কী?মাহা বাঁধা দিলো না আরাফাতকে।বরং নিজে থেকে কাছে টেনে নিয়ে আরাফাতের ওষ্ঠের সাথে নিজের ওষ্ঠ মেশালো।দুজনের মধ্যে আর কোনো দূরত্ব রইলো না।ভালোবাসার তীব্র সুখের নেশার দুজনেই ডুব দিলো।
___________

সারারাত বৃষ্টি হওয়ার ফলে প্রকৃতি এখন ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার হয়ে গেছে,যদিও আকাশ মেঘ ভার করে বসে আছে।আকাশ যেন হাসতে ভুলে গেছে।সূর্যের আলোর ছটাও দৃশ্যমান নয়।তবে পরিবেশটা খুবই ঠান্ডা আর রোমান্টিক।এমন দিনে যারা বউয়ের ছায়াতল থেকে বঞ্চিত অর্থাৎ এককথায় সিঙ্গেল যাকে বলে তাদের দুঃখটা অবর্ণনীয়।সেই হিসেবে আরাফাত খুবই সুখী।স্ত্রীকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে সুখের নিদ্রায় হারিয়ে গেছে সে।মাহাও খুবই শান্তিতে আরাফাতের বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমাচ্ছে।এত শান্তি দুনিয়ার কোথায় পাওয়া যাবে জানা নেই তাদের।তবে তারা দুজনই নিশ্চিত,এভাবে ভালোবাসার মানুষটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর মধ্যে যে শান্তি আর তৃপ্তি নিহিত তা আর অন্য কোথাও নেই।

রাতে দেরী করে ঘুমানোর ফলে সকালে ঘুম থেকে ওঠতে একটু লেট হয়ে গেল তাদের।চিলের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল মাহার।আরাফাত তখনও ঘুমোচ্ছে।মাহা চোখ পিটপিটিয়ে আরাফাতের দিকে তাকালো।তাকে কত কিউটের ডিব্বা লাগছে দেখতে।মাহা মুচকি হেসে আরাফাতের গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বোলালো।নিজেকে আজ বিবাহিতা নারী হিসেবে পূর্ণ মনে হচ্ছে তার কাছে।এত সুখ, এত আনন্দ, এত উচ্ছ্বাস, এত ভালোলাগা কই রাখা যায়!নিজেকে আজ ভীষণ সুখী লাগছে ভীষণ।যাকে পাগলের মতো ভালোবাসে সেই মানুষটা অবশেষে পুরোপুরি রূপে তার হয়ে গেছে।এই মানুষটি একান্তই তার নিজের সম্পদ।

মাহা আরাফাতের কপালে মর্নিং কিস দিয়ে তার বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওঠে বসে গায়ে পাতলা চাদর জড়ালো।তারপর ওয়্যারড্রোব থেকে কাপড় চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।

আধাঘন্টা সময় নিয়ে গোসল করে তারপর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো মাহা।ততক্ষণে আরাফাতও ঘুম থেকে ওঠে গেছে।মাহা আরাফাতের দিকে তাকিয়ে প্রশস্ত করে হাসলো।আরাফাত তো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধময়ীর হাসির দিকে।কে বলেছে মাহা সুন্দরী নয়?মাহা অনেক সুন্দর দেখতে।শুধু গায়ের রঙটাই চাপা এই-যা।নয়তো তার মায়াবী গড়নের প্রেমেও বারবার ডুবে যেতে হবে।

মাহা আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বললো,’গুড মর্নিং মাই সুইট হাবি!অবশেষে তুমি ঘুম থেকে ওঠলে!’

-‘তুমি আমাকে রেখে গোসল করতে গেলে কেন বলো তো?আমাকে ডাকলে কী আমি ওঠতাম না?তাহলে তো একসাথে শাওয়ার নিতে পারতাম।’ আরাফাতের কন্ঠে অভিযোগ স্পষ্ট।

-‘আহারে,আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তোমার কথা।সো সরি ডিয়ার।পরবর্তীতে গোসল করতে গেলে তোমায় সাথে নিয়ে যাবো প্রমিজ।’ ব্যঙ্গ করে বললো মাহা।মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছে সে।আরাফাত ভ্রুকুটি করে তাকাতেই মাহা হাসি থামিয়ে বারান্দায় চলে গেল চুল ঝাড়তে।যাওয়ার আগে আরাফাতকে বলে গেল,’ওয়াশরুমে যাও,গিয়ে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসো।নাশতা করতে হবে।’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে