অন্যরকম অনুভূতি পর্ব-২৬

0
2010

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_২৬

আরাফাত আর মাহা ওরা দুইটা দিন এখানেই কাটালো।আরাফাতের অফিস ছিলো ঠিকই তবে হাফটাইম কাজ করে দুপুরেই শ্বশুর বাড়ি ফিরে আসতো।এই দুটো দিন ওরা হেসেখেলে কাটিয়েছে সবার সাথে।মাহার মনে প্রচুর খুশি কাজ করছে।প্রথমত নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সে হাসিল করে নিয়েছে,দ্বিতীয়ত নিজের বাসায় এসে সবার সাথে এত হাসিখুশিতে সময় কাটাচ্ছে।এত আনন্দ এত খুশিতে মাহা পুরোপুরি আত্মহারা।

আনিশা ক’দিন আগে তার দাদাবাড়ি চট্টগ্রামে গিয়েছে মাসখানেকের জন্য।একারণে মাহার সাথে দেখা করতে আসতে পারে নি।তবে বেচারি আফসোস করতে করতে শেষ।কেন যে এখন এলো মাহা?সেটা বলে বারবার হাউকাউ করছে ফোনে আনিশা।মাহা শুধু হাসে আর বলে,’পরেরবার এলে তখন দুটোয় মিলে জমিয়ে আড্ডা দেবো,সো নো চিন্তা ডু ফুর্তি।’

অবশেষে আরাফাতকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে শ্বশুর বাড়ি রওনা দিলো মাহা।নাহ,কোনো কান্নাকাটি করে নি সে।কান্না শব্দটা এত সহজে তাকে ধরা দেয় না যদিও কষ্টটা একদম অন্তরে গিয়ে লাগে।মিসেস মিনারা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন।মা তো মা-ই হয়।যখন নওশিন এখানে আসে,তখন তার বিদায়ের সময়ও তিনি এভাবে কাঁদেন।অথচ নওশিনের বিয়ে হয়েছে প্রায় আড়াই বছর হতে চললো।

মাহা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাকিদেরকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।জাওয়াদ তারস্বরে চিৎকার করছে তার পুঁপি চলে যাচ্ছে বলে।মাহা ফের গাড়ি থেকে নেমে এসে জাওয়াদকে কোলে নিয়ে কীসব বলে বুঝিয়ে কান্না থামালো।তারপর তাকে মায়ের কোলে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে হাত নেড়ে টাটা দেখালো।জাওয়াদও টাটা দিলো তার ফুফুকে।সবিশেষে গাড়ি চলতে শুরু করে তার নিজ গন্তব্য অনুসারে।

মাহা উদাস নয়নে জানালার বাহিরের পানে তাকিয়ে আছে।ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোর ছটা তার মুখে এসে পড়েছে।আরাফাত বুঝতে পারলো যে তার বউটার মন খারাপ হয়েছে।পরিবারকে ছেড়ে আসতে কারই বা ভালো লাগে?আরাফাত মাহাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’মন খারাপ করো না হানি!ক’দিন পর আবারও আসবো আমরা বাবাইদের বাসায়।তখন পাক্কা এক সপ্তাহ অথবা তারও বেশিসময় এসে থেকে যাবো।’

মাহা আরাফাতের চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।কিছু বললো না প্রতুত্তরে।দুজনের মধ্যেই নিরবতা বিরাজ করছে।তবে একজন আরেকজনকে অনুভব করছে খুব ভালো করে।এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি!
____________

সময় বহমান।দেখতে দেখতেই কতগুলো দিন কেটে গেল।ঐ বর্ষার ঋতু থাকাকালীন সময়ে নওশিন এক মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছে।রিয়াজের সেই কী খুশি!প্রথমবার মেয়েকে কোলে নিয়ে বেচারা ইমোশনাল হয়ে আরাফাতকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতেই সার হলো।

বাচ্চা জন্মের সাতদিন পর অনেক বড় ও ধুমধামে আকিকা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।বাচ্চার নাম মাহা আর রিয়াজ দুজন মিলিয়ে রেখেছে।

বাবা মায়ের নামের সাথে মিল রেখে নিশাত জাহান রোজা রাখা হলো।সকলেই ভীষণ খুশি।হাসি-আনন্দে কেটেছে দিনগুলো।

মাহা সংসার সামলে এখন পাক্কা গৃহিণী।সাথে পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছে।আরাফাত তো পুরোপুরি সুস্থ তারপরও তার প্রতি মাহার সেবাযত্নের পরিমাণ বিন্দুমাত্র কমে নি।আরাফাত তো মাহাকে চোখে হারায়।ইশানী তাকে প্রায়ই বউপাগল বলে ব্যঙ্গায়।কিন্তু সে তা থোরাই কেয়ার করে।মাহা মানেই তার জান,কলিজা,ফুসফুস,হৃদয়,পরাণ,সোনা,মনা অনেককিছু!মাহা মানেই তার জীবনের সকল প্রকৃত অনুভূতির সঞ্চারিনী।এত ভালোবাসে সে মাহাকে যে যারাই তাদেরকে দেখে তারাই বলে, এক কাপল বটে!

এভাবেই হাসিখুশিতে ও দুজনের প্রেম ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে প্রায় ৬ টা মাস কেটে গেছে।
আজকে মাহা ও আরাফাতের প্রথম বিবাহবার্ষিকী।মাহা সকাল থেকেই আরাফাতের পছন্দের রান্না করতে ব্যস্ত।ইচ্ছা,আরাফাতকে আজকে বড়সড় একটা সারপ্রাইজ দেবে।

তবে আরাফাতের মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি।মাহা ভাবলো হয়তো আরাফাত ভুলে গেছে আজকে যে তাদের ফার্স্ট এনিভার্সারি।।অবশ্য তার মনে থাকবেই বা কী করে?তখন তো সে নিজের সেন্সেই ছিলো না।

আরাফাত সেই যে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে গেলো তারপর আর তার টিকিটিরও দেখা নেই।মাহা মনখারাপ করে বারান্দার দোলনায় বসে আকাশ দেখছে।আজকের দিনটা অন্তত আরাফাত বাসায় থাকতে পারতো!শনিবার,ছুটির দিন।আজকে আবার তার কীসের কাজ?

মাগরিব বাদে ইশানী কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে মাহার রুমে প্রবেশ করলো।মাহা তখনও বারান্দার দোলনায় বসে বসে পা দোলাচ্ছে আর আনমনে গুনগুন করছে।কিন্তু ইশানী এসে বেরসিকের মতো মাহার কাজে বাঁধা দিয়ে তাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে চললো।মাহা হতবাক।’কী হয়েছেটা কী ভাবীর?তিনি এমন করছেন কেন?’ মাহা ভাবতে ভাবতেই রুমে আসে।

ভাবাভাবি বাদ দিয়ে মাহা জিজ্ঞেস করলো,’কী হয়েছে ভাবী?আমায় এভাবে টেনে আনলে কেন?আর এই ব্যাগগুলো কীসের?’

ইশানী ব্যাগ খুলতে খুলতে হাসিমুখে জবাব দিলো,’আজকে না তোমাদের এনিভার্সারি!তাই আমরা একটু সাদামাটাভাবে তোমাদের এনিভার্সারিটা উদযাপন করতে চাচ্ছি।’

মাহা কিছুটা মুখ ভার করে জবাব দিলো,’ওহহ!বুঝছি!’

ইশানী শপিং ব্যাগ থেকে একটা বিয়ের গাউন বের করলো।টকটকে মেরুন রঙের গাউনটা পুরো সাদা ও সোনালী স্টোনের কারুকার্য খচিত।ভীষণ সুন্দর দেখতে।অনলাইনে একটা ভিডিওতে দেখেছিলো মাহা,এই গাউনটার দাম প্রায় এক লক্ষ পনেরো হাজার টাকা।গাউনটা দেখে মাহার চক্ষু চড়কগাছ!সামান্য এনিভার্সারি পালন করতে এই গাউনটার কী দরকার ছিলো বুঝতে পারলো না সে।হতভম্বতা কাটিয়ে উঠতে পারলো না তৎক্ষনাৎ।হা করে তাকিয়ে আছে শুধু।

গাউনের সাথে ডিজাইনার ম্যাচিং হিজাব ও দোপাট্টা।ইশানী আরেকটা ব্যাগ থেকে হাইহিল জুতা বের করলো,অন্যটা থেকে গহনাদি সব বের করলো।মাহা দেখছে আর বিস্ময়ে হতবিহ্বল হচ্ছে।এতো দেখা যায় পুরো বিয়ের বাজার করা হয়ে গেছে।আজ কী তার আবারও বিয়ে হবে নাকি?এত আয়োজনের মানেটা কী?

-‘এসব কী ভাবী?এত টাকা খরচ করার তো কোনো প্রয়োজনই ছিলো না!কোনো অনুষ্ঠান নেই কিছু নেই অথচ কাপড় চোপড় দেখে মনে হচ্ছে আবারও বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে।’ মাহার কথা শুনে ইশানী কিছু বললো না।প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সে বললো,

-‘এখন এসব কথা বাদ দিয়ে তুমি যাও গিয়ে পরনের কাপড় পাল্টে এই সেমিজ আর গাউন পরে আসো!যাও দেরী করো না আর।গো ফাস্ট!’

ইশানীর কথামতো মাহা গাউন ও প্রয়োজনীয় সব নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।মনে মনে কিছু একটা আঁচ করলো সে।মাহার মধ্যে তো আবার গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব,তাই সবকিছুতে মনটা রহস্য খুঁজে বেরায়।

গাউনটায় মাহাকে খুবই সুন্দর মানিয়েছে।ইশানী মাহাকে দেখে মুগ্ধ কন্ঠে বললো,’আজকে আমার বউপাগল দেবরটা বোধহয় পাগলই হয়ে যাবে।তোমাকে কী সুন্দর লাগছে বিনা মেক-আপেই।আর মেক-আপ করলে না জানি কত সুন্দরী লাগবে!’

মাহা লজ্জা পেল কিছু বললো না।লিসা নিসা ইতিমধ্যে মাহার রুমে এসে পড়েছে।তারা দুই বোন মাহাকে সাজানো দেখছে বসে বসে।এমনসময় আনিশা এসে রুমের ভেতর প্রবেশ করলো।আনিশাকে দেখে মাহা বসা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে।অতঃপর দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে।দুই বান্ধবীকে আটকে রাখে কার সাধ্য?

-‘দোস্ত তুই এসেছিস?জানিস তোকে আজ খুব মিস করছিলাম!’

-‘হ্যাপি ফার্স্ট এনিভার্সারি দোস্ত!আমিও তোকে খুব বেশি মিস করছিলাম।তাই তো চলে এসেছি!’

-‘খুব ভালো করেছিস!তোকে একটা সারপ্রাইজ দেবো একটু পর।এখন সবার সামনে বলবো না।’

-‘আচ্ছা অপেক্ষায় আছি সেই সারপ্রাইজের!এখন সাজতে বস যা!’ দাঁত কেলিয়ে হাসছে আনিশা।সারপ্রাইজের কথা শুনে তার মনটা আঁকুপাঁকু করছে।না জানি কী সারপ্রাইজ দেয়!

আনিশার কথামতো মাহা সাজতে বসলো।ইশানী মাহাকে গর্জিয়াস মেকওভার করে দিচ্ছে দক্ষ হাতে।কিছু কিছু মেয়েরা আর কিছু পারুক আর না পারুক মেক-আপ খুবই সুন্দর ভাবে করতে পারে।ইশানীও তেমন।

আনিশা মাহার হাতে চুড়ি,গলায় গহনা পড়িয়ে দিচ্ছে।লিসা সব এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করছে মাহাকে সাজাতে।

সম্পূর্ণ সাজগোজ শেষে ইশানী আর আনিশা হাইফাইভ করে বললো পারফেক্ট!এরপর আর কোনো কথা না বলে আনিশা ব্যতিত বাকিরা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।মাহা আনিশার কানে কানে ফিসফিস করে একটা কথা বললো।কথাটা শুনে আনিশার রিয়েক্ট বাটন কাজ করা বন্ধ করে দিছে।এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে সে।মাহা মুচকি মুচকি হাসছে আনিশার মুখভঙ্গি দেখে।খবরটা সত্যিই অবাক করার মতো।

-‘তুই সত্যি বলছিস হানি?এটা সত্যি আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!’ অবশেষে মুখে বুলি ফুটে আনিশার।মাহা আনিশার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,’সত্যি, সত্যি, সত্যি!সবার আগে তোকেই বললাম!কাউকে মনের ভুলেও জানাস না যেন।মনে থাকবে?’

-‘কী শুনাইলিরে আমায় হানি!আমার মোটেও বিশ্বাস হচ্ছে না।আচ্ছা বলবো না কাউকে তুই চিন্তা করিস না!’ মাহাকে কথা দিলো আনিশা।

কিছুক্ষণ পর ইশানী রুমে আসলো মাহাকে নিয়ে যেতে।মাহাকে নতুন কনে দের মতো করে একপাশে আনিশা ও একপাশে ইশানী দুজন ধরে নিয়ে যাচ্ছে মেইন হলের দিকে।মেইন হলে এসে মাহা হতবাক।এত অল্প সময়ের মধ্যে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে সারা হলরুম।সবথেকে বেশি অবাক আর খুশি হয়েছে নিজের পরিবারের সকলকে এখানে উপস্থিত দেখে।সকলেই হাসিখুশি ভীষণ।জাওয়াদ দৌড়ে এসে ফুপিকে জড়িয়ে ধরলো।মাহাও নিচু হয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খেল।ধীরে ধীরে সামনে হেঁটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সে।মিসেস মিনারা মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

-‘মাশা-আল্লাহ!আমার মেয়েটাকে পরীর মতো লাগছে দেখতে!’

মিসেস মুমতাহিনাও বেয়াইনের সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,’আমার সোনা মা টার যেন কারও নজর না লাগে!’ ওনার কথা শুনে মাহা সলজ্জ হাসলো।মিসেস মিনারার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-‘কেমন আছো আম্মু?’

-‘আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি মা!তুই কেমন আছিস?’

-‘আলহামদুলিল্লাহ,ভালো আছি!

মাহা বাকিদের সাথেও কুশল বিনিময় করলো।নওশিন তার ৮ মাসের মেয়েকে নিয়ে এসেছে।সাথে রিয়াজও আছে।তাদের সাথেও কথা বললো সে।এমনসময় আরাফাত,রাফি ও সাইফ বেশ কয়েকজন লোককে নিয়ে বাসার ভেতর প্রবেশ করে।দুজন হুজুর গোছের লোক।একজন কোর্ট প্যান্ট পরিহিত আর বাকিরা নর্মাল গেটআপে।

মাহার দৃষ্টি আরাফাতের দিকে আবদ্ধ হয়ে আছে।এত কিউট লাগছে তাকে দেখতে যে মাহা বরাবরের মতো আজকেও ক্রাশ খেয়েছে।মেরুন রঙের স্যুট,ভেতরে ধবধবে সাদা রঙের শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট তার পরনে।চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করা।হাতে ব্রান্ডেড গড়ি।পায়ে কালো শু।সবমিলিয়ে তাকে অপূর্ব লাগছে দেখতে।

আরাফাতও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে।তার কলিজাটাকে আজ পুরো টুকটুকে লাল বউ লাগছে দেখতে।হিজাব বাঁধায় আরও বেশি কিউটি লাগছে।আরাফাত ফিরসে ফিদা!

সাইফ ও রাহাতের কথামতো আরাফাত মাহার হাত ধরে এনে তাকে একটা সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও মুখোমুখি আসনে বসে পড়লো।তাদের অন্যপাশে আড়াআড়িভাবে হুজুর গোছের লোক ও কোর্ট প্যান্ট পরা লোক বসেছে।মাহার আর বুঝতে বাকি নেই যে তাদের আবারও বিয়ে হতে যাচ্ছে।এবং সেটা আরাফাতের সজ্ঞানে থাকা অবস্থায়।মাহার চোখে খুশিতে পানি চলে এলো।উকিল নতুন করে আবারও কাগজপত্র সব ঠিক করে এনেছেন।এখন শুধু বিয়ে পড়ানোর পালা।সকলেই উদগ্রীব হয়ে আছে বিয়ে দেখার জন্য।একটু পর আরাফাতদের কলিগ থেকে শুরু করে সমস্ত আত্মীয়রা চলে এলেন যারা আগে বিয়েতে ছিলেন না।সকলের হাতে গিফটের বক্স!কেউ খালি হাতে আসে নি।

এর কয়েক মুহূর্ত পর হুজুর বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।আরাফাত হাসিতে উদ্ভাসিতমুখে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে।কিন্তু মাহা নিচমুখে বসে আছে।আজকে লজ্জা পাচ্ছে সে ভীষণ।মনে এক অজানা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।হুজুর যখন আরাফাতকে কবুল বলতে বললেন তখন সে দ্রুততার সহিত তিন কবুল বলে দিলো।যেন তার আর তর সইছে নাহ।সকলে হাসছে তার কান্ড দেখে।

মাহাকে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন মাহা সকলের দিকে একপলক তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠে,’কবুল,কবুল,কবুল!’

সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।অতঃপর উকিলের কথামতো বিয়ের রেজিস্ট্রার পেপারে দুজনেই সিগনেচার করে দিলো।বিয়ে তো তাদের একবছর আগেই হয়ে গেছে,এখন জাস্ট আরাফাত তার নিজের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতেই আজকের এই বিয়ের পর্ব।এটাকে শুধু একটা শখের ভিত্তি বলা যায়।এখন তো আর ধুমধামে পালন করা সম্ভব না তাই মাহাকে খুশি করতেই এই ব্যবস্থা!

বিয়ে শেষে সবাইকে খেজুর খেতে দেয়া হলো।সাথে অবশ্যই মিষ্টান্নের আয়োজন করা হয়েছে।সকলেই খুব ফুর্তি করছে।মাহা আর আরাফাত দুজন চোখে চোখে প্রেম বিনিময় করছে।আরাফাত একটু পর পর মাহাকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে মারছে আর মাহা কেউ দেখে ফেলবে ভেবে লজ্জায় লাল হচ্ছে।এর একটু পরে দুজনে মিলে একসাথে কেক কেটে এনিভার্সারি পালন করলো।আরাফাত গিফট হিসেবে মাহার হাতে একটা ডায়মন্ড রিং পরিয়ে দিয়ে চুমু খেলো।আর মাহা নিজের হাতে আরাফাতের কব্জিতে একটা ব্রান্ডেড ঘড়ি পরিয়ে দিলো আগেরটা খুলে।

রাত সাড়ে নয়টার দিকে সকলকে আখনি,পোলাও ও রোস্ট খেতে দেয়া হয়েছে।দাওয়াত খেয়ে মেহমানরা সব বিদায় নিলেন।শুধু মাহার পরিবার আর রাফি, রিয়াজ তাদের পরিবার নিয়ে থেকে গেল।
_____________

মাহা ও আরাফাতের রুম গোলাপ ও রজনীগন্ধা ফুল দ্বারা খুব সুন্দর করে সজ্জিত করা হয়েছে।যেন আজকে তাদের প্রথম ফুলসজ্জা।মাহা ঘুরে ঘুরে সারা রুম দেখছে উৎফুল্ল নয়নে।এত খুশি সে জীবনেও হয় নি।আজকে কী সারপ্রাইজটাই না পেল সে,যদিও আগে থেকে কিছুটা আঁচ পেয়ে গেছিলো মাহা!

একটু পর আরাফাত রুমের ভেতর প্রবেশ করলো।মাহার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো সে।মাহাও প্রতুত্তরে হাসলো।আরাফাত রুমের দরজা লক করে মাহার কাছে এগিয়ে এসে মাহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।মাহার হাতও আরাফাতের পিঠে বিচরণ করছে।আরাফাত মাহার গালে চুমু খেয়ে বললো,

-‘তোমাকে ভীষণ কিউট লাগছে সোনা।এত মোহিত রূপের অধিকারী কেন তুমি?আমি যে বারবার তোমার মায়ায় ডুবে যাই!’

মাহা হেসে চোখ বন্ধ করে ফেললো।এত আনন্দ কেন লাগছে তার?সুখের জোয়ারে ভাসছে সে আজ।মাহা নিজের থেকে আরাফাতকে ছাড়িয়ে বললো,’আগে তুমি আমায় সারপ্রাইজ দিয়েছো!সেই হিসেবে আমার কাছ থেকেও তো একটা সারপ্রাইজ পাওনা আছে তোমার।কী বলো?’

-‘বুঝলাম না কীসের সারপ্রাইজ?’ আরাফাত ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল।

মাহা লম্বা করে একটা শ্বাস টেনে আরাফাতের হাত টেনে এনে নিজের পেটের ওপর রাখলো সে।কাঁপাস্বরে ফিসফিস করে বললো,’জনাব,কিছু কী ফিল হয় আপনার?’

আরাফাত বোকার মতো তাকিয়ে রইলো মাহার দিকে।প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝতে পারলো না।কিন্তু যখন কথাটার গভীরত্ব পরিমাপ করতে পারলো তখন বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে সে।মাহার চোখের কোণে স্বচ্ছ একফোঁটা পানি চিকচিক করছে।আবেগি কন্ঠে আবারও বললো,

-‘দুমাস ধরে পিরিয়ড মিস,মাথা ঘোরানো,বমি বমি ভাব,ভীষণ টক খেতে ইচ্ছে করে,তরকারির গন্ধ নাকে আসলেই বমি পায়।এতসব উপসর্গ দেখা দিতেই সন্দেহ হয় ভীষণ।অতঃপর দুদিন আগে দুইবার টেস্ট করেছিলাম।পজিটিভ এসেছে।কালকে ডক্টর দেখিয়ে এলাম।ডক্টর চেক-আপ করে বললেন আমি দুই মাসের প্রেগন্যান্ট।’

মাহার কথা শুনে আরাফাত অতি ইমোশনাল হয়ে পড়েছে।খুশিতে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো তার।মাহা এগিয়ে এসে আরাফাতের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-‘বাবা হতে যাচ্ছো তুমি।এভাবে কান্নাকাটি করলে চলে বলো?পরে আমার বাচ্চাও যদি তোমার মতো এমন ইমোশনাল ফুল হয়,তাহলে কিন্তু খবর আছে।’ কপট রাগ দেখিয়ে বললো মাহা।

আরাফাত কান্নার মধ্যেও হেসে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাহাকে।ভেজাস্বরে বলে,’তুমি জানো না হানি তুমি আমাকে কী শুনিয়েছো!আমি জাস্ট তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না আমার অনুভূতিটা।এটা এক অন্যরকম অনুভূতির প্রতিফলন ঘটেছে আমার হৃদয়ে।বাবা হওয়ার মতো আনন্দের আর কী-ই বা হতে পারে বলো?আমি আজ অনেক হ্যাপি হানি,অনেক হ্যাপি!আই কান্ট কন্ট্রোল মাই ইমোশনস!আই কান্ট,,বিলিভ মি!’

-‘ভালোবাসি জান!অনেক ভালোবাসি তোমায়!’ মাহা আরাফাতের কানের পিছে চুমু খেয়ে বললো।আরাফাত মাহার গালে কপালে চুমু খেয়ে আদুরে স্পর্শ করে বললো,’আই লাভ ইউ সো মাচ মাই লাইফলাইন!আমার বেবির আম্মুকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসি আমি!উম্মাহ,কলিজাটা!’

দুজনের জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে আজকে থেকে।এ এক অন্যরকম ভালোবাসার কাহিনী সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।আরাফাত মাহার প্রেগ্ন্যাসির খবর শুনে খুশিতে আত্মহারা।এত খুশি সে এর আগে কখনো হয় নি।মাহাকে সে কাপড় পাল্টাতে সাহায্য করে তাকে ফ্রেশ করিয়ে আনলো।ওয়াশরুমে একা যেতে দেয় নি।আজকে থেকে যত্নের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে চিন্তা করলো।মাহার সাথে তাদের পিচ্চিটাও আছে।এখন সবদিকে খেয়াল রাখতে হবে আরাফাতের।বাবা শুধু হয়ে গেলেই হয় না।বাবা হতে গেলে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়।

ফুলের বিছানার ওপর মাহাকে বুকে আগলে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে আরাফাত।মাহার নিষ্পাপ মুখপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।তার আদরের বউটা মা হতে যাচ্ছে, এটা যেন বিশ্বাসই হতে চায় না।খুশির ঠেলায় আরাফাতের চোখের ঘুমই উধাও হয়ে গেছে!তাই মাহাকে বুকে নিয়েই সারাটা রাত অনায়াসে পার করে দিলো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে