অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -১১

0
1638

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_১১

বিয়ের আগের দিন রাত্রে,
আনিশা ও ইরার ছোট বোন পিয়া মাহার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে।মাহাকে বিকেলের দিকে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হয়েছে তবে তা কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই।একদম সাদামাটাভাবে।

রাহাত এই বিয়ে নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে।এখন সে তদারকি করছে সবকিছুর।ছোটখাটো ভাবে বিয়ে হলেও অনেক কাজ করতে হবে।কত আয়োজন বাকি সেসব সম্পন্ন করছে সে রিয়াজকে নিয়ে।আদরের ছোট বোনের বিয়ে বলে কথা,কোনোকিছুতে সামান্যতম ভুল হলেও চলবে না।

এত ভালো একটা শুভকাজের মধ্যে আরেকটা সুখবর হলো গিয়ে,আরাফাতের এই তিন দিনে বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছে।সে এখন সবার দিকে তাকায়।কেউ কিছু বললে তা শুনতে পারে।যদিও রেসপন্স করতে পারে না।এক্সিডেন্টের ফলে কন্ঠনালি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাময়িক বাক স্বাধীনতা হারিয়েছে সে।রাহাত বলেছে কথা বলতে সময় লাগবে।তবে এখন যে এতটুকু রেসপন্স করছে তা-ই বা কম কী!মিসেস মুমতাহিনা,লিসা,নিসা,মি.এরশাদ,সাইফ,মাহা থেকে শুরু করে সবার এত এত দোয়া মোনাজাত নিশ্চয়ই বিফলে যাবে না।আরাফাত ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবে,যদিও সময়ের প্রয়োজন!

মাহা চুপচাপ বসে আছে বিছানার ওপর।পরণে আটপৌরে সুতির কলাপাতা রঙের একখান শাড়ি।শ্যামবর্ণের গায়ে রঙটা ভীষণ মানিয়েছে।ফুল স্পিডে সিলিং ফ্যান ঘুরছে মাথার ওপর।ইন্সট্যান্ট ও অর্গানিক হওয়ায় দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে মাহার হাতের মেহেদী।বিয়ে বাড়ি বলে বোঝা যাচ্ছে না,সারা বাড়ির কোথাও কোনো সাজসজ্জা নেই।গানবাজনা হচ্ছে না,বাড়িতে হাতেগোনা কয়েকজন মেহমান ব্যতিত আর কেউ নেই।

অন্যদিকে,,
আরাফাতের সাথে মিসেস মুমতাহিনা বসে বসে কথা বলছেন।আরাফাত অস্বাভাবিক ভাবে পলকহীন তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে।ওনি কতকিছু বলে যাচ্ছেন তবে আরাফাতের কানে তা ঢুকছে কিনা সন্দেহ!অতঃপর নার্স ছেলেটির ওপর আরাফাতের দায়িত্ব দিয়ে আরাফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিচে চলে গেলেন তিনি জমাকৃত টুকটাক প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সারতে।

লিসা নিসা কালকে ভাইয়ের বিয়েতে কোন ড্রেস পড়বে,কীভাবে সাজবে তার প্ল্যানিং করছে নিজেদের রুমে।মি.এরশাদ আরাফাতকে অন্য রুমে ট্রান্সফার করে আরাফাতের রুমে আরও কিছু আসবাবপত্র এড করছেন ডেকোরেশনের লোকদুজনকে সাথে নিয়ে।আরাফাত বরাবরই সাদামাটাভাবে থাকতে পছন্দ করে।তার রুমে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া বাড়তি কিছুই নেই।তবে কালকে থেকে মাহাও ঐ রুমে থাকবে,তাই কিছু বাড়তি আসবাব যোগ করা হচ্ছে মাহার সুবিধার কথা চিন্তা করে।

সবাই সবার মতো ব্যস্ততায় সময় কাটাচ্ছে।বিয়ের আয়োজন চলছে দুটি বাড়িতেই।শুধু নিজেদের মতো একা একা একটা জায়গায় চুপচাপ বসে আছে আরাফাত আর মাহা।আরাফাতের কোনো কিছু নিয়ে ভাবার কোনো উপায় নেই,কারণ সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।তবে মাহা অনেককিছুই চিন্তা করছে।একা একা থাকলে কতকিছু যে মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়,তা মাহার ক্ষেত্রে আজ বোঝা যাচ্ছে।

মাহার দুইহাতের তালুতেই আরাফাতের নাম লেখা।মাহা সেদিকে তাকিয়ে আনমনে বললো;

“মাফ করে দিও আমায় প্রিয়!কাল তোমার অজান্তেই আমি তোমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি।জানি তুমি আমায় স্ত্রী হিসেবে কখনোই পছন্দ করবে না।তুমি কখনো এটা ভেবো না যে আজ তুমি অসুস্থ বলে আমি সেটার সুযোগ নিচ্ছি।আমি শুধু তোমাকে আমার না বলা সমস্ত ভালোবাসা ও আবেগটুকু দিতে চাচ্ছি।তুমি আমায় কখনো ভালো নাই বা বাসলে,কিন্তু আমি তোমায় নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে চাই।একটা চান্স তো আমি পেতেই পারি তোমার থেকে!বারবার বিরহের আগুনে পুড়তে চাই না প্রিয়,তাই তো মামণিকে রাজি করালাম এত ঝুঁকি নিয়ে।”

মাহার ধ্যান ভাঙলো তার মায়ের ডাকে।তিনি খাবার নিয়ে এসেছেন।মাহার দুহাতে মেহেদী দেয়া তাই তিনি নিজেই তাকে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিতে লাগলেন।মাহা ছলছল নয়নে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে।ওনি নিজেও বহুত কষ্টে কান্না আটকে রেখেছেন।কিছু বলছেনও না,কারণ এখন মুখ থেকে একটা কথা বেরোনো মানে গলায় আটকে থাকা সমস্ত কান্না উগলে বেরিয়ে আসা।মাহা এত সহজে কাঁদে না ঠিকই কিন্তু ওর বুক ফেটে যাচ্ছে পরিবার ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে।এমন কিছু মেয়ে আছে যারা তাদের কষ্টের কথা অকপটে কাউকে বলতে পারে না।তাদের কষ্ট তাদের মনেই থেকে যায়।মাহাও এরকম!

মিসেস মিনারা থালাবাসন সিংকে চুবিয়ে রেখে আবারও মেয়ের কাছে এসেছেন।মাহা তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে।মিসেস মিনারা মাহাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদছেন।মাহার চোখ থেকেও দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে মায়ের কান্না দেখে।এদিকে এতো ইমোশনাল সিন দেখে নওশিন আর ইরাও কাঁদছে।সাথে আনিশা তো সেই কখন থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে।মাহা যেখানেই যায় না কেন সেই জায়গাটা পুরো সরগরম করে তুলে সে।মিসেস মিনারা কাঁদছেন আর বিরবির করে বলছেন,

-‘তুই চলে গেলে আমার সংসারটা যে খাঁ খাঁ করবে রে মা!কীভাবে তোকে না দেখে থাকবো?আমার মেয়েটা দুষ্টুমি করতো বলে সবসময় বকতাম,এখন সেই দুষ্টুমি না দেখে আমি কী করে থাকবো আল্লাহ?আমার ঘরটা যে শূন্য হয়ে যাবে!আমার বুকটা এত হাহাকার করছে কেন?’

ওনার এমন কথা শুনে বাকিরাও কাঁদছে।মাহা এই পরিবারের সকলের মধ্যমণি,এজন্যই মূলত রাহাত রাজি ছিলো না মাহাকে এখন বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে।মাহা থাকায় তাদের বাসা সবসময় জমজমাট থাকে।এমনকি নওশিনের বিয়ের পরও এতটা কমতি লাগে নি যতোটা এখন মাহার জন্য লাগছে।মাহা চলে যাওয়া মানে এখন আর বাসায় কোনো প্রকার কোনো দুষ্টুমি হবে না,বাসার পরিবেশকে নিরবতায় গ্রাস করবে।পুরোপুরি নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যাবে মাহার বিদায়ের পর।এজন্যই তো সবার এত কষ্ট হচ্ছে।

আনিশা তো কষ্টে বেদনায় জর্জরিত হয়ে গেছে পুরো।তার এই একটা মাত্র বান্ধবী,আর কেউ নেই।ওর বিয়ে হয়ে গেলে তো সেও একা হয়ে যাবে।তখন আর কারও সাথে আড্ডা দেয়া হবে না,ফোনে চ্যাট করা হবে না,ভার্সিটিতে একসাথে যাওয়া হবে না,এত এত শয়তানী করা হবে না।এরথেকে কষ্টের আর কী হতে পারে একজন বন্ধুর জন্য?

রিয়াজের মা এসে মিসেস মিনারাকে মাহার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।নয়তো তিনি এখনই কান্নাকাটি করে পাগল হয়ে যাবেন।ইরার মা আর বোন মাহাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।বলছে না কাঁদার জন্য।মাহা নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে।আনিশা তার কাঁধে মাথা রেখে নিরব হয়ে বসে আছে।

এভাবে কোনোরকম কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কেটে গেল পুরো রাতটা।তবে মাহার সারাটারাত নির্ঘুম কেটেছে।আনিশা তাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে রাতটুকু।আর কখনো এভাবে কাছে পাওয়া হবে না প্রাণের বান্ধবীকে।তাই এখনই দুই বান্ধবী একসাথে সময় কাটিয়ে নিচ্ছে।

⛓️

পরদিন সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ব্যস্ততা।আরাফাতরা দুপুরের দিকেই চলে আসবে।মাহা গোসল করে বিছানার ওপর পা তুলে জিমি আর জাওয়াদকে কোলে নিয়ে বসে আছে।তার পাশে বসে আছে আনিশা,নওশিন আর ইরার বোন পিয়া।বাকিরা কাজকর্মে ব্যস্ত।জিমি আর জাওয়াদকে আদর করতে করতে অতিষ্ঠ করে ফেলছে সে,এরপর থেকে তো আর কলিজা দুটোকে কাছে পাবে না সে।তাই এখনই বেশি বেশি করে আদর করছে।

যখন বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে,তখন মাহাকে তৈরি করতে লাগলো আনিশা আর নওশিন মিলে।মাহার জন্য বিয়েতে একটা দামী লাল রঙের বেনারসি শাড়ি পাঠিয়েছেন মিসেস মুমতাহিনা,সেটাই এখন তাকে পড়ানো হচ্ছে।সাথে গয়নাগাটি তো রয়েছেই।মাহাকে সাজাতে সাজাতে বেলা সাড়ে বারোটা বেজে গেছে প্রায়।মাহা আনিশার সাথে কথা বলছে বসে বসে।

এদিকে,,
আরাফাতের শরীর ভালো করে মুছিয়ে দিয়ে তাকে মাহা’দের বাড়ি থেকে পাঠানো সুতির পাঞ্জাবি ও পাজামা পড়িয়ে দিয়েছে সাইফ আর রাফি।আরাফাত শুধু তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়েই রইলো কোনো বাঁধা প্রদান করলো না।আরাফাতের অবস্থা আগের তুলনায় একটু উন্নত আছে,নয়তো তাকে বাসা থেকে বের করাই সম্ভব হতো না।আরাফাতের মাথায় চুল নেই বিধায় তার মাথায় একটা টুপি পড়িয়ে দেয়া হলো।হুইল চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে সে।

বাকিরাও পুরোপুরি রূপে তৈরী হয়ে গেছে।সাইফ রাফিকে নিয়ে মিষ্টান্ন কিনতে গিয়েছে।ওরা চলে আসলেই তবে সবাই রওনা দিবে।

বেলা বাজে দেঢ়টা,
আরাফাতকে নিয়ে ততক্ষণে সবাই রওনা দিয়েছে মাহা’দের বাড়ির উদ্দেশ্যে।ড্রাইভার খুবই ধীরগতিতে গাড়ি চালাচ্ছে,পাছে যদি আরাফাতের কোনো চোট লাগে এজন্য।

ধীরে গাড়ি চালানোর ফলে ২০ মিনিটের রাস্তা আধাঘন্টায় গিয়ে পৌঁছালো সবাই।রাহাত,রিয়াজ ও মি.আতিক তাদের সবাইকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত।মিসেস মুমতাহিনা ও মি.এরশাদ তাদেরকে ব্যস্ত হতে মানা করলেন।আরাফাতকে রাহাতের কথামতো খালি একটা গেস্টরুমে রেখে আসা হলো।বেশি হইচইপূর্ণ পরিবেশে থাকলে ওর সমস্যা হবে তাই।আরাফাতের সাথে রাফি তার ছেলে ও বউকে নিয়ে বসে।

মাহার বুক ধুকপুক করছে আরাফাতদের আসার কথা শুনে।আনিশা তাকে কখন থেকে পিন্চ মেরেই যাচ্ছে।অবশেষে মাহা আনিশার মাঝপিঠে দুটি কিল মেরে তবে থামালো।মি.এরশাদ ও মি.আতিক তাদের পরিচিত একজন উকিলকে সাথে নিয়ে এসেছেন।এখন তাদের শুধু রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হবে,আর আরাফাত সুস্থ হওয়ার পর ধর্মীয় মতে এবং দরকার পড়লে সাথে আবারও রেজিস্ট্রি করে বিয়ে দেয়া হবে।কোনো সমস্যা নেই।

বিয়ের কাজ দ্রুত সারার কথা জানালো সাইফ।কারণ কিছুক্ষণ পর আরাফাত হয়তো ঔষধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।সাইফের সাথে রাহাতও একমত হলো।মাহাকে নিয়ে আসার কথা বললো রাহাত ইরাকে।নওশিন একপাশে চুপচাপ বসে আছে,তাকে কোনো কিছুই করতে দিচ্ছে না রিয়াজ।ইরা রাহাতের কথা শুনে দ্রুত মাহার রুমে গেল মাহাকে নিয়ে আসতে।একমুহূর্ত পর দেখা গেল,মাহা নিজের রুম থেকে ধীরে সুস্থে বেরিয়ে আসছে।তার একপাশে ইরা,অপরপাশে আনিশা।ড্রয়িং রুমে গিজগিজ করছে নিকটাত্মীয়রা।মাহাকে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসতে দেয়া হলো।রাহাত তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

রাফি হুইলচেয়ার ঠেলে আরাফাতকে নিয়ে এলো ড্রয়িং রুমে।রাহাতের কথামতো ড্রয়িং রুমে যারা আছে তারা সবাই চুপ হয়ে গেল।রাহাত তাদেরকে অহেতুক কথা বলতে মানা করেছে তাই।আরাফাতের হুইলচেয়ার মাহার পাশাপাশি রাখা হয়েছে।মাহা একপলক আরাফাতকে দেখার সুযোগ পেয়েছে কেবল।আরাফাত চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে সবাইকে চোখ বুলিয়ে দেখলো।অতঃপর সামনে রাখা কিছু কাগজপত্রের দিকে তাকিয়ে রইলো একধ্যানে।উকিল কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।তাই সে রাহাতের ইশারায় প্রথমে মাহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো;

-‘মামণি তুমি দেনমোহর হিসেবে কতটাকা চাও তা স্পষ্ট করে বলো তো!’

মাহা একবার তার বাবা ভাইয়ের দিকে তাকালো।ওনারা নির্বিকার।রাহাত গলা খাঁকারি দিয়ে মাহাকে বললো;

-‘দেনমোহর হিসেবে তুই যা চাস,তাই বলবি!বাট তাদের সামর্থ্যের বাইরে কিছু চাইবি না!এখন বলে দে,তোর মতামতের অপেক্ষায় আছি সবাই!’

মাহা একটা দম নিয়ে স্পষ্টভাষায় বললো,
-‘টাকা তো শুধুমাত্র একটা সংখ্যা,সেটার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই।যেকোনো একটা বসিয়ে দিলেই চলবে,কিন্তু আমি এই গ্যারান্টি চাই যে আরাফাত ভাইয়া যেন সারাজীবন আমার থাকে!’

মিসেস মুমতাহিনা হেসে মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন;

-‘বোকা মেয়ে,এটার আবার গ্যারান্টি দিতে হবে নাকি?আরাফাত তোর আছে তোরই থাকবে তুই নিশ্চিন্তে থাক!’

-‘এবার ফটাফট বলে দে মা,শুভকাজে দেরী করতে নেই!’

মি.এরশাদ নড়েচড়ে বসে কথাটি বললেন।মাহা জবাব দিলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যত দিতে পারবে ততোটাকা দেনমোহর হিসেবে নির্ধারণ করতে।অবশেষে মি.এরশাদ নগদ এক লক্ষ টাকা ও বাকি চার লক্ষ টাকা সবমিলিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করে দিলেন।উকিল তা লিখে কাগজটি মাহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো স্বাক্ষর দিতে।মাহা চটপট সিগনেচার করে দিলো।এবার আরাফাতের পালা।আরাফাত তো সাইন করার অবস্থায় নেই তাই তার আঙ্গুলের টিপছাপ বসানো হলো স্বাক্ষরের জায়গায়।ব্যস সম্পন্ন হয়ে গেল তাদের বিয়েটা একরকম।দুজনে বাঁধা পড়লো এক পবিত্র বন্ধনে।

আরাফাতকে মাহার রুমের বিছানায় আধশোয়া করে বসানো হয়েছে।মাহাও আছে সেই রুমে।বিকালের পর খাওয়া দাওয়া শেষে বাসায় ফিরবে সবাই মাহাকে নিয়ে।
এখন মিসেস মুমতাহিনা আরাফাতকে খিচুড়ি খাওয়াতে চাইলে মাহা বাঁধা দিয়ে বললো;

-‘শুধু খিচুড়ি খেতে খেতে তো বিরক্তি এসে যাবে ওনার মামণি।তার থেকে ভালো মুরগির মাংস অথবা ডিম ভুনা দিয়ে নরম ভাত খাওয়াও ওনাকে,তবেই খাওয়ায় রুচি আসবে।’

মিসেস মুমতাহিনা কিছুটা বিব্রত কন্ঠে বললেন;

-‘কিন্তু তোর ভাই তো বললো বেশিরভাগ সময় খিচুড়ি খাওয়াতে।’

-‘ধ্যাত ওইসব ফাউল ডক্টরদের কথা শুনতে কে বলেছে?মাঝেমধ্যে নিয়মের বাইরে গেলে ক্ষতি হয় না বরং লাভ হয়।একবার চিন্তা করে দেখো সুস্থ অবস্থায় কোনদিন তোমার ছেলে খিচুড়ি খেয়েছে?তাহলে এখন যে এত এত খিচুড়ি জোর করে গেলাও,ওনার কী বিরক্ত লাগে না?আমার কথা শুনো,তাঁকে ডিফারেন্ট কিছু খাওয়াও,এতে খাওয়ার প্রতি রুচি বাড়বে বই কমবে না।’

বিরক্তি নিয়ে বললো মাহা।রাহাত সবসময় তার পেশেন্টদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করে।বিষয়টা মোটেও ভালো লাগে না তার।মিসেস মুমতাহিনা বোদ্ধার মতো মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন মাহার কথায়।মাহা আনিশাকে বললো আরাফাতের জন্য খাবার নিয়ে আসতে।আনিশা চলে গেল রান্নাঘরে মিসেস মিনারাকে অবগত করতে।মিনিট তিনেক পর একপ্লেট খাবার নিয়ে ফিরলো আনিশা।মাহা আনিশার থেকে প্লেটটা হাতে নিয়ে মিসেস মুমতাহিনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো;

-‘এবার খাওয়াও ওনাকে!দেখো জোর করে খাওয়াতে হবে না এমনিতেই খাবে!’

মিসেস মুমতাহিনা আরাফাতের পাশে বসে তাকে খাওয়াতে লাগলেন।প্রথমবার একটু জোর করে খাওয়ালেও দ্বিতীয়বার আর জোর করতে হলো না।এমনিতেই হা করে মুখে নিলো।খাবার বেশ মজা হয়েছে তাই তার খেতেও বেশ ভালো লাগছে।মিসেস মুমতাহিনাও আগ্রহ নিয়ে খাওয়াচ্ছেন তাকে।তার মুখে খুশির আমেজ স্পষ্ট।এতদিন ডক্টরদের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছেন তিনি।তবে আজ মাহার কথায় একটু ব্যতিক্রম হতে বাধ্য হলেন।এবং আজ আরাফাত খাচ্ছেও ভালো।

খাওয়ানো শেষে যে ক’জন এই রুমে ছিলো সবাই চলে গেল রুম ছেড়ে।মিসেস মুমতাহিনা ঔষধ খাওয়ালেন আরাফাতকে।তারপর তিনিও চলে গেলেন।কারণ ওনাদেরও খাওয়ার সময় হয়েছে।মাহা চুপচাপ আরাফাতের পাশে এসে বসলো।আরাফাতও তাকিয়ে আছে তার দিকে।তবে মুখে কোনো রা নেই।মাহা মুচকি হেসে আরাফাতের একহাতে চুমু খেলো।আরাফাত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে।মাহা কিছু না বলে মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে লাগলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে বিকালের একটু পর কনে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসলো।বিদায়ের সময় মিসেস মিনারার সেকি কান্না।মিসেস মুমতাহিনা নিজেও কাঁদছেন মিসেস মিনারার গলা জড়িয়ে ধরে।এমন দৃশ্য দেখে সবাই হতভম্ব।মাহা কাঁদবে কী,তাদের এই কিচ্ছা দেখে সে হাসি কন্ট্রোল করতে পারলো না।ফিক করে হেসে দিলো।তার সাথে বাকিরাও হাসছে।জীবনের প্রথম কেউ দেখছে কনের মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বরের মা কাঁদছে।একদমই দূর্লভ দৃশ্য।মি.এরশাদ মিসেস মুমতাহিনাকে ধমক দিয়ে বললেন;

-‘কী হচ্ছেটা কী?কই ভাবিকে তুমি সান্ত্বনা দিয়ে বোঝাবে,তা না করে তুমি ওনার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছো কেন বোকার মতো?’

মিসেস মুমতাহিনা টিস্যু দিয়ে নাকের পানি চোখের পানি মুছতে মুছতে কান্নারত কন্ঠে জবাব দিলেন;

-‘আপার কান্না দেখে আমার আর সহ্য হচ্ছে না গো।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।দেখো আপার কত কষ্ট হচ্ছে মেয়ে বিদায় দিতে গিয়ে।আমারও তো দুটো মেয়ে আছে,তাদেরও তো একটাসময় বিয়ে দিতে হবে।তখন আমি কী করবো গো!’

এই বলে তিনি আবারও ভ্যাত করে কেঁদে দিলেন।মি.এরশাদ মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।বেচারি নিজের মেয়ের বিয়ের কালের কান্না এখনই কেঁদে শেষ করে ফেলছে।সাইফ মহাবিরক্ত হয়ে মিসেস মুমতাহিনাকে জোর করে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা লক করে ফেললো।মাহা তার মা,ভাবী,বোন সবাইকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘঃশ্বাস ফেললো।কাঁদতে চাচ্ছে না সে এখন সবার সামনে।তাই নিজেকে দাঁতে দাঁত চিপে কন্ট্রোল করে রাখছে।ভাবীকে ধরা কন্ঠে বললো;

-‘পরিবারের সবার দায়িত্ব এখন থেকে তোমার ওপর বর্তালো ভাবী।তাদেরকে তুমি দেখে রেখো।আমার ভাতিজা ভাতিজীর খেয়াল রেখো।সাথে আমার বাগান আর মুরগিগুলোর দায়িত্বও তোমার ভাবী!’

ইরা মাহার কপালে চুমু খেয়ে বললো;
-‘তুমি একটুও চিন্তা করো না বোন।আমি সবদিক খেয়াল রাখবো।তুমিও নিজের খেয়াল রেখো।ঠিকমতো খাবার খেয়ো।ভালো থেকো।’

মাহা ইরাকে ছেড়ে আনিশাকে জড়িয়ে ধরে বললো;
-‘বাডি দোস্ত আমার।মাঝেমধ্যে আমাকে দেখতে যাস ওখানে প্লিজ।ভালো থাকিস।আমি ফোন দিবো সবসময়,ফোন যদি না ধরিস তাহলে তোর একদিন কী আমার যতদিন লাগে!’

আনিশা কান্নার মধ্যেও হেসে ফেললো মাহার কথা শুনে।মাহার গালে হাত রেখে বললো;
-‘নিজের খেয়াল রাখিস দোস্ত।আরাফাত ভাইয়ারও খেয়াল রাখিস।আর হ্যা আমি তোর ফোনের অপেক্ষা করবো সবসময়।’

মাহা নওশিনকে বললো;
-‘আপু আমার পুচকেটার খেয়াল রেখো তুমি।নিজের যত্ন নিয়ো সবসময়।ভালো থাকো,আর একদম কান্নাকাটি করবে না কিন্তু।

নওশিন কান্নার কারনে কিছু বলতে পারলো না।এই তো কাছেই বিয়ে হচ্ছে তার,কিন্তু সবার আচরণে মনে হচ্ছে মাহা না জানি কত দূরে চলে যাচ্ছে।সবাই ভীষণ আপসেট হয়ে আছে মাহার চলে যাওয়ার জন্য।

মাহা তার বাবা ভাইকেও জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালো।রাহাত গম্ভীর কন্ঠে মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো;

-‘আমি যেদিনই সময় পাবো তোকে দেখতে যাবো।জানি এখন আমাদের সামনে নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করে রাখছিস,পরে ঠিকই কান্না করবি!শোন একটুও কাঁদবি না।নিজের খেয়াল রাখিস।আমরা সবসময়ই তোকে দেখতে যাবো।’

মাহা নিরবে মাথা দোলালো।মি.আতিক মাহার কপালে চুমু খেয়ে বললেন;
-‘আম্মু আমার।একটুও মন খারাপ করো না।আব্বু কালকেই আসবো আমার মা’কে দেখতে।ও বাসার সবাই তোমাকে ভীষণ আদরে রাখবে।তুমি মোটেও চিন্তা করো না।নিজের খেয়াল রাখবা ঠিক আছে,আমার স্ট্রং গার্ল।’

মিসেস মিনারা তো শুধু জড়িয়ে ধরে কান্নাই করছেন।কান্নার ধমকে কোনো কথাই বলতে পারছেন না তিনি।মাহা তার মায়ের গালে কপালে চুমু খেয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললো;

-‘পরশুদিন তো আসছিই আম্মু।এত কান্না করো না প্লিজ তোমার শরীর খারাপ করবে তো!আম্মু এখন কান্না করলে আমি আর আসবো না,দেখো তো আমি কী কাঁদছি কোনো?হাসিমুখে বিদায় দিবে না তোমার মেয়েকে?’

মিসেস মিনারা বহুত কষ্টে কান্না থামিয়ে মেয়েকে বিদায় দিলেন।মাহা জিমি আর জাওয়াদকে অন্নেক আদর করে অতঃপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।মি.আতিক আর মি.এরশাদ কথা বলছেন কী নিয়ে যেন,ওসবে মাথা ঘামালো না মাহা।নতুন জীবনের দিকে পা বাড়ালো সে।যেখানে সব মানুষ অনেক আপন হলেও নিজের পরিবারের কেউ থাকবে না।

গাড়ি চলতে শুরু করলো তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।মাহার পাশের সিটে আরাফাত বসে আছে চুপচাপ।মাহা আরাফাতের ভালো যে হাত সেটা আলতো ভাবে ধরে রাখলো।এই মানুষটার সুখের জন্যেই তো আজ নিজের পরিবার ছেড়ে দিলো মাহা।নয়তো এত জলদি বিয়ের প্ল্যানিং তারও ছিলো না।

বাসায় পৌঁছে গেলো সবাই।মিসেস মুমতাহিনা মাহার হাত ধরে বাসার ভেতর প্রবেশ করলেন।আরাফাতকে তার ভাইয়েরা নিয়ে আসছে হুইলচেয়ারে বসিয়ে।মাহাকে আরাফাতের রুমে দিয়ে এলো ইশানী আর লিসা নিসা।

মাহাকে শাড়ি পাল্টাতে সাহায্য করলো লিসা।তারপর মাহা ফ্রেশ হয়ে একটা সুতির থ্রি পিস পরিধান করে রুমে এলো।এসে দেখলো আরাফাত বিছানার ওপর ঘুমিয়ে আছে।মাহা মুচকি হেসে আরাফাতের কাছে গিয়ে তার কপালে একটা গাঢ় চুমু খেয়ে সরে এলো।ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো তার স্বপ্নের রুমটা,যেখানে আরাফাতকে নিয়ে ছোট্ট একটা স্বপ্ন সাজিয়েছিলো সে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে