অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -০২

0
1970

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_০২

মাহা রহস্যময় এক মুচকি হাসি দিয়ে বললো;

মাহা:-আমি ড্যাম শিওর ওনি যশোর থেকে ফিরেই ওনার গার্লফ্রেন্ডকে সারপ্রাইজ দিতে ওর বাসায় গিয়েছিলেন।এবং সেখানেই বোধহয় শকটা পেয়েছেন।জানোই তো,বেচারা আরাফাত ভাইয়া সবসময় নিজের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে পসেসিভ!ওনার চাকরি যদি চলে যায় বা বিজনেস যদি লস খায় তাও ডিপ্রেশনে ভুগবে না।যদি না গার্লফ্রেন্ড ধোঁকা দেয়।লামিয়া তার জন্য ঠিক কী সেটা আর কেউ না বুঝুক,আমি ঠিকই বুঝি আপু।আরাফাত ভাইয়াকে না দেখলে জানতামই না যে কাউকে এভাবে পাগলের মতো নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা যায়।তো সেই ভালোবাসার মানুষটি যখন ধোঁকা দেয়,তখন ডিপ্রেশনে তো অটোমেটিক চলে যাওয়ার কথা।কী ঠিক বললাম না?

নওশিন:-একদম ঠিক কথা বলেছিস বোন।আমি জানি না তুই কী করে ধরতে পারলি বিষয়টা!তবে কাহিনিটা কিন্তু সেইম।মুমতাহিনা আন্টিকে নাকি ফোনে লামিয়ার ধোঁকাবাজির কথা বলে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কান্না করেছিলো আরাফাত ভাইয়া।তবে কীসের ধোঁকা দিয়েছে তা বলেনি সে।বলার আগেই এক্সিডেন্ট করে বসে।একটা ট্রাকে এসে ধাক্কা দিয়েছে তার গাড়িটাকে৷সারা গাড়ি দুমড়ে মুচড়ে গেছে একদম।আন্টি তো ছেলের এমন অবস্থা মোটেও সহ্য করতে পারেন নি।বিপি হাই হয়ে গেছে ওনার।কান্নাকাটি করে সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা।আঙ্কেল ভীষণ টেনশনে আছেন।কী করবেন ঠিক বুঝে ওঠতে পারছেন না।

—সাইফ ভাইয়া (আরাফাতের বড় ভাই) ওনার একটা কাজিনকে সাথে নিয়ে লামিয়ার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন মূল ঘটনা জানতে।কিন্তু ওখানে গিয়ে বদমাইশনীটাকে খুঁজে পান নি।পালিয়ে গেছে সে একপ্রকার।আঙ্কেল চাচ্ছেন মেয়েটার বিরুদ্ধে কেস করতে।আরাফাত ভাইয়ার এ অবস্থার জন্য তো ওই শয়তান্নীটাই দায়ী।কিন্তু এমনি এমনি তো আর কেস করা যায় না,সাক্ষী প্রমাণ সব লাগবে।এসব তো কিছুই নেই।ইনফ্যাক্ট,আসল ঘটনাই কেউ জানে না।কীভাবে কী করবেন সেসবই চিন্তা করছেন ওনারা।

দীর্ঘ সময় বক্তৃতা দিয়ে এবার নওশিন চুপ হয়ে গেল।মাহা সব শুনে আবারও শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো নওশিনকে;

মাহা:-আচ্ছা আপ্পি,আমি যদি বলি আমি সব কিছু জানি এবং সাক্ষী প্রমাণ সব আছে আমার কাছে,তাহলে কী তুমি বিশ্বাস করবে বলো?

নওশিন মাহার কথা শুনে আরেক দফা অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো।মাহার বলা কথা যেন সব তার মাথার ওপর দিয়ে গেছে।নওশিন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বললো ;

নওশিন:-কী,কীসব বলছিস হানি তুই পাগলের মতো?তোর কাছে সাক্ষী প্রমাণ আছে মানে?

মাহা রহস্যময় কন্ঠে জবাব দিলো;

মাহা:-তার আগে তুমি বলো সাইফ ভাইয়াকে কী এখানে ডেকে আনতে পারবে?যদি পারো,তাহলে একসাথে সব খোলাসা করবো।তখন সব জানতে পারবে।

নওশিন বুঝতে পারলো সঠিক সময় ছাড়া পেটে বোমা মারলেও একটা কথা বেরোবে না মাহার মুখ দিয়ে।তিন গোয়েন্দা গল্পের কিশোর পাশার মতো মাহার স্বভাব ও একই।আর মাহা এত সিরিয়াস হয়ে কথাগুলো বলছে তার মানে বিষয়টা খুব গুরুতর।এরকম মুহূর্তে জীবনেও ফান করবে না সে।নিজের বোনকে খুব ভালো করে চেনে নওশিন। তাই সেও আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ ফোন লাগালো সাইফকে।সব শুনে সাইফ ও দেরী করলো না,তার ছেলে কাজিন ও নওশিনের স্বামী রিয়াজকে সাথে নিয়ে মাহা’দের বাসার উদ্দেশ্যে ছুটলো।

🍂

আধঘন্টা পর,,
মুখোমুখি হয়ে সোফায় বসে আছে মাহা ও সাইফ। মাহার পাশে নওশিন।সাইফের একপাশে ওর কাজিন রাফি এবং অপরপাশে রিয়াজ।সবাই উৎসুক হয়ে মাহার পানে তাকিয়ে আছে।সারা ড্রয়িংরুম জুড়ে নিরবতা বিরাজ করছে।হঠাৎ নিরবতা ভেঙে মাহা কথা বলতে শুরু করলো ;

মাহা:-ভাইয়া লামিয়াকে জেলে পাঠানোর মতো যথেষ্ট প্রমাণ আমার কাছে আছে।সাক্ষীর প্রয়োজন হলে আমি আছি,আমার বান্ধবী আনিশা,ওদের বাসার কাজের মহিলা আছেন এবং লামিয়ার ফুফু এই এলাকায় আছেন ওনার কাছ থেকেও ওর ব্যাপারে যাবতীয় সকল তথ্যাদি পাওয়া যাবে।সাথে আরাফাত ভাইয়ার ফোন অথবা ল্যাপটপ ঘাটলে লামিয়ার সাথে তোলা অনেক ফটো ও কল রেকর্ড পেতে পারেন।এতে সে আরাফাত ভাইয়ার সাথে ওর সম্পর্কটাকে অস্বীকার করতে পারবে না।

সাইফ মাহার কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলো। মনে মনে চমকালেও মুখে সেটা প্রকাশ করলো না। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে চশমাটা ঠিক করে মাহাকে জিজ্ঞেস করল;

সাইফ:-নওশিন বললো মূল ঘটনা নাকি তুমি জানো!এখন Exact কাহিনীটা কী সেটা একটু বলো প্লিজ।জানতে চাই,কেন আমার ভাইটার এমন অবস্থা হলো!খুলে বলবে?

অনুরোধ মেশানো কন্ঠে বললো সাইফ।মাহা মাথা দুলিয়ে সায় জানালো।জবাব দিলো;

মাহা:-হ্যা ভাইয়া অবশ্যই।আমি কীভাবে জানলাম সেটা পরে বলি।এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো লামিয়া এঙ্গেজ্ড!

শান্ত কন্ঠে বোমা ফাটালো যেন মাহা৷সাইফ বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠে;

সাইফ:-Whatt?এইটা তুমি কী বলছো মাহা?সত্যি কী,

মাহা:-হ্যা ভাইয়া।এটাই সত্যি!প্রথমে আমারও বিশ্বাস হয়নি।কিন্তু পরে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি।৪ বছর আগে আলভি মিরাজ নামে এক ছেলের সাথে ওর এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে। আর এই ছেলের সাথেই আরাফাত ভাইয়া লামিয়াকে মেবি কিছুটা অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছেন যার কারনে উনি বিষয়টা সহ্য করতে পারেন নি।এবং এই দুর্ঘটনা ঘটে।লামিয়া প্রচন্ড লোভী এবং স্বার্থপর টাইপের মেয়ে।আরাফাত ভাইয়া ও আলভি ছাড়াও আরও বহু বড়লোক ছেলের সাথে ওর অ্যাফেয়ার ছিলো এবং আছে।এতে আলভীও জড়িত।কারণ ছেলেটা নিজেই অনেক মেয়ের সাথে টাইমপাস করে।ওদের দুজনের বিজনেসটাই এমন,বড়লোক ছেলেমেয়ে দেখে তাদেরকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে বড় করে দাও মারা,অতঃপর টাকাপয়সা সব হাতিয়ে নিয়ে সম্পর্ক শেষ করে ফেলা।অবশ্য যে মেয়ে ১২ কী ১৩ বছর বয়সে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যেতে পারে সেই মেয়ে আর কেমনই বা হবে!এবং তার লাইফ পার্টনারই বা কেমন হবে!দুই বাটপার একসাথে। ~তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে~

মাহার কথা শুনে উপস্থিত জনতারা নির্বাক হয়ে বসে আছেন।
সাইফ কী বলবে বুঝে ওঠতে পারছে না।মাহা আবারও বলে উঠে ;

মাহা:-লামিয়া আপনাদের সবাইকে বলেছিলো যে ওর আব্বু আম্মু নাকি কানাডায় থাকেন।এইটা আস্ত ডাহামিথ্যে কথা।আসল কথা হলো ওর বাবা একজন কসাই।আর ওর আম্মু ওকে ওর বাবার কাছে ফেলে রেখে অন্য একটা লোকের সাথে পালিয়ে গেছে।ওর মাও টাকার লোভে ওর বাবাকে ছেড়ে দিতে দুইবার ভাবে নি,সে জায়গায় ও আর কী হবে তা বুঝাই যায়।লামিয়ার মা চলে যাওয়ায় ওর বাবা ২য় বিয়ে করে।সৎ মায়ের অত্যাচারে বাপের বাড়িতে আর বেশিদিন টিকতে পারে নি সে।

—তারপর সে তার ফুফুর বাড়িতে চলে আসে।তখন আলভির সাথে ওর পরিনয় হয়।বেশ কিছুদিন রিলেশনের পর ওর ফুফুর বাড়িতে এসব কিছু জানাজানি হলে পরে ওর ফুফু মানইজ্জত নষ্ট হবার ভয়ে আলভির সাথে তারাতারি করে লামিয়ার এঙ্গেজমেন্ট করিয়ে দেয়।সেখানে বেশ কিছুদিন থেকে কয়েকটা মেয়ের সাথে শেয়ারে ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় সে।আলভির সাথে ওর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কীভাবে জানি আরাফাত ভাইয়ার সাথে ওর রিলেশন গড়ে উঠে।এবং আরাফাত ভাইয়ার স্ট্যাটাস দেখে এ ব্যাপারে লামিয়াকে উৎসাহিত করে আলভী।যত দিন যেতে লাগলো আরাফাত ভাইয়া ততই লামিয়ার প্রতি আরো পসেসিভ হতে লাগলেন।ওর এত নিখুঁত অভিনয় ভাইয়া ধরতেই পারেন নি।

লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে রিলাক্স হয়ে মাহা আবারও বলতে লাগলো ;

মাহা:-ঐ লোভী মেয়েটার প্রতি আপনার ভাইয়ের এতই টান যে ওর পিছে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করতো না কখনো।অন্যান্য মেয়েদের সাথে শেয়ারে থাকে বলে ১ কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনে দিতে কার্পণ্য বোধ করে নি আপনার ভাই।বার্থডে গিফট হিসেবে ডায়মন্ড রিং, ব্রেসলেট,ব্রান্ডেড ড্রেস এসব থাকতো,ঢাকার সবথেকে বড় ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে বার্থডে সেলিব্রেট করতো ওর জন্য।এতটা ভালোবাসত আপনার ভাই ঐ ছলনাময়ী লোভী মেয়েটাকে। হয়তো ভাবছেন এতকিছু আমি কীভাবে জানলাম?এসবকিছু জানতে আমার বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।এমনি এমনি সব জানতে পারি নি।

এবার রিয়াজ বলে উঠলো;

রিয়াজ:-আমি জানি আমার শালিকা অনেক ব্রিলিয়ান্ট একটা মেয়ে।তুমি যে শার্লক হোমস ও তিন গোয়েন্দার ফ্যান তাও আমি জানি।এখন কীভাবে কী জানলে আর প্রমাণ হিসেবে তোমার কাছে কী আছে তা একটু জলদি বলো তো বোন।ঝেড়ে কাশো এবার।

মাহা:-বলছি,,কাকতালীয় ভাবে লামিয়ার ফুফুর বাড়ি আমাদের এলাকার মধ্যেই পড়ে।আর আরেকটা কাকতালীয় ব্যাপার হলো আমার বেস্টু আনিশার বাড়িতে যে কাজের মহিলা কাজ করেন তিনি লামিয়ার ফুফুর বাড়িতেও আগে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন।এখন আর করেন না।একবছর হয়েছে কাজ ছেড়েছে।তবে এখনো যাতায়াত আছে ও বাড়িতে।আর সেই সুবাদে ওখানের সবার কাহিনী তিনি জানেন৷বিশেষ করে লামিয়ার হিস্ট্রি।এটা ও বাসায় বিপুল আলোচিত একটি টপিক।ওর এসব কাহিনী ওর ফুফুর বাড়ির সবাই জানে।তাই মানইজ্জত নষ্ট হবার ভয়ে ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসা থেকে বিদায় করা হয়েছে।কথায় আছে না ঝুড়িতে সব ভালো পেঁয়াজের মধ্যে একটি পঁচা পেঁয়াজ থাকলে বাকিগুলোও জলদি নষ্ট হয়ে যায়,ওর দেখাদেখি যদি ওর ফুফুতো বোনেরাও এসব করে বেড়ায় তখন এই এলাকায় আর সম্মান থাকবে না।লোকে ছি ছি করবে।তাইতো ওকে ওনার বাসা থেকে খুব দ্রুত বিদায় দিয়েছেন।

একটু থেমে আবারও বলতে লাগলো মাহা;

মাহা:-একদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে লামিয়া আর একটা ছেলেকে,তখনও জানতাম না যে ওই ছেলেটাই আলভি.ওদেরকে রিকশা করে যেতে দেখলাম কোথাও।ওদের আচার-আচরণে ভাই-বোন বলে মনে হয়নি।যে কেউ দেখলেই বলবে বিএফ,জিএফ।তখন থেকেই আমার সন্দেহের শুরু।দুদিন সাহস করে রিকশা দিয়ে তাদের পিছু নিয়েছিলাম তারা কোথায় যায় দেখার জন্য।সাথে অবশ্যই আমার বান্ধবী ছিলো।আল্লাহ আমাকে নিরাশ করেন নি।যা জানতে পিছু নিয়েছিলাম সেদিন তা জেনেই এসেছি।প্রথম যেদিন পিছু নিয়েছিলাম সেদিন অবশ্য লামিয়ার ফ্ল্যাট কোথায় তা দেখেছি এবং দ্বিতীয় দিন আলভির বাসা পর্যন্ত গিয়ে এসেছি।সেই সাথে ওদের রিকশায় থাকা অবস্থায় ছবি তুলেছি কয়েকটা।

রিয়াজ:-আচ্ছাহ,,তো তুমি বুঝলে কীভাবে যে ওটা আলভীর বাসা ছিলো?

মাহা:-দারোয়ানকে ওর সাথে কথা বলতে শুনেছি আমরা দুজন লুকিয়ে।হাবেভাবে ও ওদের কথাবার্তায় যতোটুকু বোঝা গেছে যে ওটা তারই বাসা।

রাফি:-তুমি লামিয়াকে চিনো কীভাবে?আরাফাত বলেছিলো মনে হয় তাই না?

মাহা:-হ্যা,,আরাফাত ভাইয়া ওর ছবি দেখিয়েছিলেন আমায়!আর ওদের তো এঙ্গেজমেন্টও হওয়ার কথা ছিলো।সেই সুবাদে ওকে চিনতাম।আপনি হয়তো জানেন না।আর প্রধান কথা হলো গিয়ে ওকে আলভীর সাথে বেশ ক’দিন এই এলাকায় দেখেছিলাম আমি।কিন্তু তখন তো চিনতাম না তাই ততোটা পাত্তা দিই নি।কিন্তু যখন থেকে জানলাম আরাফাত ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড,তখন থেকেই মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।এবং পুরোপুরি শিওর হওয়ার জন্যই এত কাঠখড় পোড়ানো।চাই নি একটা বহুরূপী মেয়ের চক্করে পড়ে ওনার জীবন নষ্ট হয়ে যাক।

আবারও থেমে লম্বা একটা দম নিয়ে বলতে লাগলো মাহা;

মাহা:-আরেকদিন দেখি আমাদের আমাদের এলাকার মধ্যে রিকশা নিয়ে এসে একটা বাসার সামনে থামলো।সেখানে উঁকি দিয়ে আনিশাদের বাসার কাজের মহিলাকে দেখতে পাই।জানতে পারলাম এটাই ওর ফুফুর বাসা৷বেচারি লামিয়া বোধহয় জানতো না এখানে যে আরাফাত ভাইয়ার আত্মীয়রা থাকে।জানলে জীবনেও এভাবে আসতো না।কিন্তু কথায় আছে না,অপরাধীরা একটা না একটা ক্লু তো ভুল করে হলেও রেখে যায়,যেটা দ্বারা তাদেরকে পাকড়াও করা সম্ভব হয়।তেমনই লামিয়াকে ধরার ক্লু পেয়ে গেলাম আমি তারই ভুলের কারণে।তারপর আরকি প্ল্যান মোতাবেক ওই কাজের মহিলাকে আনিশার আম্মু কৌশলে লামিয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন।মহিলাটিও কখনো পেটে কথা রাখতে পারে না।ব্যস তারপর যা হওয়ার তাই হলো।লামিয়ার সম্পর্কে গড়গড় করে সব বলে দিলো সে আর আন্টিও সেটা আমার ফোন দিয়ে রেকর্ড করে ফেললেন।

রাফি:-লামিয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত সব জানলে কীভাবে?

মাহা:-বললাম না?ওদের কাজের মহিলার কাছ থেকে।রেকর্ডিংএ তো সব আছে ওর ব্যাপারে,তারপরও আবার শুনে নিবেন।ওই মহিলা যা বলে সব সত্যিই বলে,দোষ শুধু একটাই তা হলো কথা পেটে রাখতে পারে না।আমি পুরোপুরি শিওর যে এই সেইম কথাগুলো লামিয়ার ফুফুও বলবে জিজ্ঞেস করলে।আর লামিয়াকে ফ্ল্যাট কিনে দেয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় যা যা কিনে দিতেন সব আমাকে আরাফাত ভাইয়া নিজেই বলেছেন পরে।এ কথাগুলো আর কাউকে বলেন নি তিনি।আমাকেও মানা করেছিলেন কাউকে যেন না জানাই।কিন্তু বাধ্য হয়ে আজকে আপনাদেরকে বলে দিলাম।

রাফি:-ওহহ,এখন বুঝেছি।

মাহা:-তো,,এভাবেই বেশ কিছু প্রমাণ জোগাড় করে ফেললাম আমি৷আমার ফ্রেন্ড ও আন্টি অনেক হেল্প করেছেন আমায় এ বিষয়ে।দরকার পড়লে লামিয়ার ফুফুকে একটু মানসম্মান নষ্ট করার ভয় দেখালেই পটপট করে ওর ব্যাপারে সব বলে দিবে।আর হ্যা ভাইয়া,আপনার নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপে ছবি এবং রেকর্ডিং পাঠিয়ে দিয়েছি।কষ্ট করে একবার চেক করে নিন সব ঠিক আছে কিনা!

মাহার বলতে দেরী হলো সাইফের ফোন হাতে নিতে দেরী হলো না।হোয়াটসঅ্যাপ চেক করে দেখে মাহা মোট ৫ টার মতো ছবি ও একটি ভয়েস রেকর্ডিং পাঠিয়েছে।ছবিগুলো অপেন করে দেখতে লাগলো সাইফ।তার দুপাশ থেকে রিয়াজ ও রাফি কৌতুহলবশে ঝুঁকে এলো দেখার জন্য।ছবিগুলো দেখে রাগে মাথার রগ ফুলে উঠলো সাইফের। সামনে যদি মেয়েটাকে পেত একবার সাইফ থাপড়ে মেয়েটার বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দিতো৷রাফি এবং রিয়াজ সপ্রশংস দৃষ্টিতে মাহার দিকে তাকালো।রাফি বললো;

রাফি:-তুমি জানো না মাহা এই মুহুর্তে তুমি আমাদের ঠিক কতবড় উপকার করলে!ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে যে আমার ভাইটা একজন ভুল মানুষকে ভালোবেসেছে।আজকে আমার ভাইটা মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে শুধুমাত্র ওই ধোঁকাবাজ বদমাশ ছলনাময়ী মেয়েটার কারণে।ওকে এত সহজে কী করে ছেড়ে দেই বলো?

মাহা:-ঠিক বলেছেন ভাইয়া।ওর নামে প্রতারণা,মানহানি ও এটেম্পট টু মার্ডার উল্লেখ করে মামলা ঠুকে দিন।দরকার পড়লে পুলিশকে হাত করুন তাও যেভাবে হোক ওই বদমাশ মেয়েকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করুন।এমনভাবে শিক্ষা দিন যাতে আর জীবনে কারও মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সুযোগ না পায়।

রাগে দাঁত কিড়মিড় করে কথাটি বললো মাহা।

সাইফ:-সবই শুনলাম,বুঝলাম,প্রমাণও আছে!কিন্তু ওকে পাই কোথায় বলো তো?আমি আর রাফি তো ওই মেয়ের ফ্ল্যাটে পর্যন্ত গিয়ে এসেছি,কিন্তু ওকে তো ওখানে পাই নি!কোথায় গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে কীভাবে বুঝবো?~চিন্তিত হয়ে~

মাহা:-আমি বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি ও কোথায় আছে!

শান্ত কন্ঠে বললো মাহা।কথাটা শুনে সাইফ সোজা হয়ে বসলো।ইতিমধ্যেই মাহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় সে পেয়ে গেছে।তার ওপর অগাধ আস্থা সৃষ্টি হয়ে গেছে সাইফের।অবান্তর কথা সে বলবে না এই সিরিয়াস মোমেন্টে।আরেকবার বিশ্বাস করা যায় তার কথা।রাফি জানতে চাইলো;

রাফি:-কোথায় আছে এখন সে?

মাহা:-আলভির বাসায়!আমার জানামতে সে ভাবছে এটাই তার জন্য একমাত্র সেইফ প্লেস।কারণ ওকে আপনারা চিনলেও আলভীকে চেনেন না তাই ওখানেই গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে।শহরের বিশিষ্ট শিল্পপতির কনিষ্ঠ পুত্র এক্সিডেন্ট করেছে তা বর্তমানে প্রত্যেকটা টিভি চ্যানেল ও ভার্চ্যুয়াল জগৎ ফেসবুকের আপডেট নিউজ।এতক্ষণে সারা বাংলাদেশ চাউর হয়ে গেছে মনে হয় এক্সিডেন্টের বিষয়টা।আরাফাত ভাইয়ার এক্সিডেন্টের খবর শুনামাত্রই সে চুপকে কেটে পড়েছে।কারণ জানে আরাফাত ভাইয়ার পরিবারের লোকেরা তাকে খুঁজবে হন্যে হয়ে।আর সে এও জানে যে আরাফাত ভাইয়া এ টু জেড সবকিছু নিজের মায়ের সাথে শেয়ার করেন।দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগে নি তার।এজন্যই এভাবে গা ঢাকা দিছে যাতে আপনারা কেউ তার হদিস বের করতে না পারেন।আপনারা আলভির বাসায় যান।গিয়ে দেখবেন ওখানেই পেয়ে গেছেন কালপ্রিটটাকে।আমি ঠিকানা লিখে এবং সাইনবোর্ডের একটা ছবি সেন্ড করে দিছি দেখেন!

রাফি:-ইশশ,তুমি যদি এসব আগেই আমাদেরকে জানিয়ে দিতে তাহলে হয়তো আজ এই দিনটা আমাদের দেখতে হতো না।~আক্ষেপ করে~

মাহা:-আপনি কী ভাবছেন সেই চেষ্টা আমি করি নি?বহুবার মামণিকে জানানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু সুযোগ পাই নি।বেশ কিছুদিন আগে,আরাফাত ভাইয়াকে শুধু এই কথাটা বলেছিলাম যে,”এমনও তো হতে পারে যাকে আপনি ভালোবাসেন সে একজন ছলনাময়ী,আপনাকে ধোঁকা দিচ্ছে!”জাস্ট এটুকুই বলেছিলাম।এরপর থেকে সে আমার সাথে কথা বলে না।আমাদের বাসায় আসলেও আমাকে পুরোপুরি ইগনোর করতো।বিশ্বাস তো করেই নি উল্টো আমার সাথে তার এত ভালো বন্ডিং নষ্ট হলো।এরথেকে বেশি আমি আর কীই-বা করতে পারতাম বলুন?পুরো কথা না শুনেই এমন করলো পুরো কথা শুনলে বোধহয় আমাকে ধরে থাপড়াতো।তখন আপনাদেরকে বললে আপনারাও আমার কথায় পাত্তা দিতেন না এখন যেমন দিচ্ছেন।

সাইফ:-আচ্ছা ঠিক আছে।যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে।এখন আর এসব বললেও তো কোনো লাভ হবে না।যাইহোক,অনেক ধন্যবাদ তোমাকে মাহা।এতটা হেল্প করার জন্য।এখন শুধু ওই মেয়েটাকে হাজতে ঢুকানোর অপেক্ষা~দাঁত কিড়মিড় করে~।

—এখন আমি আসি বোন।সমস্ত আপডেট রিয়াজ জানাবে তোমাদেরকে।চিন্তা করো না।শুধু আমার ভাইটার জন্য দোয়া করো।ও যাতে খুব জলদি সুস্থ হয়ে যায়।

সাইফ বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো।এতক্ষণে কথা বললো নওশিন;

নওশিন:-আমিন।চিন্তা করবেন না।আরাফাত ভাইয়া খুব জলদি সুস্থ হয়ে যাবেন,ইনশাআল্লাহ!

রাফি:-হুমম,ওকে,সাইফ চল যাই।জলদি যেতে হবে আমাদের।বহুত কাজ বাকি আছে এখনো।

সাইফ:-হুম চল।আসি আমরা,আল্লাহ হাফেজ।

এই বলে সাইফ বাকি দুজনকে সাথে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলো।মাহা একদৃষ্টিতে তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।ওরা চোখের আড়াল হতে সে দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়লো।মাহার মনে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা সে ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না।নওশিন মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো;

নওশিন:-আজ তোর জন্য আমার গর্ব অনুভব হচ্ছে জানিস!তুই কত সুন্দর করে এই বদমাশনীটার খোঁজ খবর বের করে আনলি গোয়েন্দাদের মতো করে।আজ এই তথ্যগুলো যদি ওরা না পেতো তাহলে হয়তো ঐ ছলনাময়ীটা আরাফাত ভাইয়ার মন ভেঙে পার পেয়ে যেত।আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলতো!আরাফাত ভাইয়ার এই সো কল্ড জিএফ এর ওপর হঠাৎ করে তোর এত কৌতুহল আর সন্দেহ জন্মালো কেন?তুই তো আবার কারণ ছাড়া ছোঁক ছোঁক করিস না!তবে?

নওশিনের করা প্রশ্ন শুনে মাহা এবার পড়লো বিপাকে।সত্যি কথা জীবনেও নওশিনকে বলা যাবে না।কারণ সত্যি কথা বললে নওশিন মাহাকে কী থেকে কী ভাববে পরে!তাই মাহা আমতা আমতা করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলে;

মাহা:-আসলে,সত্যি বলতে আরাফাত ভাইয়া ও তার পরিবার আমাদের পরিবারেরই একাংশ।জানোই তো আমি ওনাদের সবাইকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি।আমি বাবাইকে নিজের আপন চাচ্চু্র মতোই বেশি ভালোবাসি এবং মামণি তো আমার আরেক আম্মু।আমি ওনাদেরকে সবসময় আমার আপনজনই ভাবি।এবং এজন্যই আমি দায়িত্ববোধ থেকে লামিয়ার ব্যাপারে সমস্ত খোঁজ খবর নিতে শুরু করি।আরাফাত ভাইয়ার ফোনে যখন ঐ মেয়েটার ছবি দেখি তখনই আমার মনে হয়েছিলো যে মেয়েটি সুবিধার না।

—–আমি চাই না ওদের এত সুন্দর একটা পরিবার লামিয়ার মতো কালনাগিনীর জন্য ধ্বংস হয়ে যাক।আর ঐ আলভির সাথে ওকে দেখার পর থেকে মূলত আমার সন্দেহের শুরু।আমি শুধুমাত্র ওর আসল রূপটা তাদেরকে দেখিয়ে দিলাম ব্যস,এরবেশি কিছু না।এখন শুধু এটাই দোয়া করো যে ঐ মেয়েটা যাতে তার প্রাপ্য শাস্তি পায় এবং ওনি যাতে খুব জলদি সুস্থ হয়ে ওঠেন।আচ্ছা আমি এখন রুমে গেলাম।টায়ার্ড লাগছে ভীষণ।আরাফাত ভাইয়ার ব্যাপারে কোনো আপডেট পেলে আমায় জানিয়ো।

এই বলে নওশিনকে আর একটাও প্রশ্ন করতে না দিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটলো মাহা।ওখানে থাকলে বিপদ।প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করতে থাকবে নওশিন।আর মাহা এখন নওশিনের সামনে বেফাঁস কিছু বলতে চায় না।তাই এভাবে কৌশলে এড়িয়ে গেল।

আরাফাত তার রিলেশনের কথা নিজে থেকে জানাতো না মাহাকে,কিন্তু মাহা যেই ছোঁক ছোঁক করার বান্দা,না জানিয়েও উপায় ছিলো না।তারপরও অনেক দেরীতে জানিয়েছে তাকে আরাফাত।প্রথম থেকে জানলে মাহা আজ এমনটা ঘটতে দিতো না তার সাথে।আরাফাত মাহাকে পছন্দ করে ঠিকই কিন্তু মাহার ছোঁকছোঁকানি স্বভাবের কারণে বড্ড বিরক্তি বোধ করে সে।সবকিছুতে নাক গলানো আরাফাত মোটেও পছন্দ করে না।

এজন্য নিজের রিলেশনের ব্যাপারে পরিবার ব্যতিত আর কাউকে জানতে দিতে চায় নি আরাফাত।একেবারে বিয়ে করার সময় জানাবে ভেবেছিলো।কিন্তু বিধিবাম,এরকম কোনো খবর সবার আগে আগেই রটে যায় আত্মীয়দের মধ্যে।চাপা থাকে না।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে