অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -০১

0
3513

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#সূচনা_পর্ব

নিজের প্রিয়তমা প্রেমিকাকে পরপুরুষের বাহুডোরে আবদ্ধ দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে আরাফাতের।দেখেই বোঝা যায় যে ওরা ভাই বোন,বা ফ্রেন্ডস টাইপ নয়।এসব কিছু ছাড়িয়ে গেছে তাদের সম্পর্কটা।লামিয়া পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে আছে ছেলেটিকে।ছেলেটিও হাসিমুখে বুকের সাথে আগলে ধরে রেখেছে তাকে।সবকিছু ছাপিয়ে শোনা গেল আরাফাতকে নিয়ে তাদের কথোপকথন।ওই ছেলেটি লামিয়াকে আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো;

—বেব,ওই খাম্বা আরাফাতটাকে কবে ছাড়ছো তুমি?আমার আর ভালো লাগছে না ওই ছেলেটাকে।কেমন ছ্যাসড়ার মতো সারাক্ষণ তোমার পিছনে পড়ে আছে।বেশি লয়্যালগিরি দেখাতে আসে বারবার।তারচেয়ে ভালো ওকে বরং ছেড়েই দাও তুমি।ওর কারণে তুমি আমায় তেমন একটা টাইম দাও না এখন।

লামিয়া ছেলেটির গালে সশব্দে একটা চুমু খেল।অতঃপর জবাবে বললো;

লামিয়া:-ছাড়বো তো জান।আরও ক’টাদিন ঘুরিয়ে তারপর ছেড়ে দিবো।অন্য আবালদের কাছ থেকে এত টাকা পয়সা পাই নি কখনো,এর কাছ থেকে যতটুকু পেয়েছি।অলয়েজ চাওয়ার আগেই দিয়ে দেয়।এজন্যই তো বলদটার এত ন্যাকামি সহ্য করি।নয়তো আমার ঠেকা পড়েছে তোমার থেকে বেশি টাইম ওকে দিতে!

—হুম,তারপরও ছেড়ে দেয়াই ভালো।দেখো না,বিয়ে করার জন্য কেমন চাপ দেয় প্রতিনিয়ত!বেশি গভীরে না গিয়ে এখনই সব শেষ করে দাও।নয়তো তুমিই ফেঁসে যাবা।

লামিয়া:-হুম,ঠিকই বলেছো।আচ্ছা দেখি কীভাবে ছাড়ানো যায়।একটু চিন্তা ভাবনা করতে হবে।

—আচ্ছা জান।যেটা ভালো বুঝো করো।আমি সবসময় তোমার সাথেই আছি।আই লাভ ইউ।

লামিয়া:-লাভ ইউ টু,সোনা।

ওদের এমনতর কথাবার্তা শুনে আরাফাত যেন নিজের বাক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছে।ভাবতেই পারে নি কখনো তার ভালোবাসার মানুষ লামিয়া এমন হতে পারে!এত এত ভালোবাসার ফল শেষপর্যন্ত এই পরিণতি?আজকে সারপ্রাইজ দিতে এসে সে নিজেও যে এভাবে সারপ্রাইজ্ড হয়ে যাবে তা কে ভাবতে পেরেছিলো!২ টা বছরের দীর্ঘ রিলেশনশিপ তাদের,তারপরও কেন তাকে এভাবে ঠকালো লামিয়া?প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়!

বেডরুমের ভেতর দুজন নরনারী নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত,দরজার সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে তারা এখনও খেয়ালই করেনি।আরাফাতের হাত থেকে কাঁচের চুড়ির বক্সটি খসে পড়ে গেল,ঝনঝন শব্দ তুলে চুড়িগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো।আরাফাত তখনও নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এহেন শব্দ শুনে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকা ব্যক্তিদের হুশ ফিরলো।দরজার দিকে তাকিয়ে লামিয়া হতভম্ব হয়ে গেল।আরাফাতকে এই মুহুর্তে এখানে মোটেই আশা করেনি লামিয়া।আরাফাত না যশোর গিয়েছিলো ৫ দিনের জন্য!তার তো আরও ২ দিন পরে আসার কথা!তাহলে এখন সে কোথা থেকে এলো?তারাহুরো করে ছেলেটির কাছ থেকে ছিটকে সরে এলো লামিয়া।ভয়ে তোতলিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল;

লামিয়া:-আ,আরাফাত, তু,তুমি, এ,এখানে?তোমার তো য,যশোরে থাকার কথা!তু,তুমি,

ভয়ে লামিয়ার মুখের কথাটা গলাতেই আটকে গেছে।আরাফাত মুখ দিয়ে টু শব্দটিও করলো না। শুধুমাত্র তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে মুহূর্তে স্থানটি ত্যাগ করলো সে।চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আরাফাতের।চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেছে তার।আরাফাতের ভালোবাসায় তো কোনো খাদ ছিল না।নিজের সবটুকু উজাড় করে ভালোবেসেছিলো লামিয়া নামক ছলনাময়ীটিকে।তাদের সম্পর্কটাকে একটা পরিনতি দেয়ার জন্য পরিবারের সবাইকে জানিয়েছিলো সে।পরিবারের সবাই তার সুখের ও খুশির কথা বিবেচনা করে এতে মতও দিয়েছিলো।
কিন্তু এখন?এখন তো সব শেষ হয়ে গেল।সব শেষ!

এতবড় ধোঁকাটা মেনে নিতে পারছে না আরাফাত।তার মনটা যে একদম ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে লামিয়া।কেন এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করলো লামিয়া তার সাথে?কী দোষ করেছিলো সে?কেন এমনটা ঘটলো তার সঙ্গে?কিছুক্ষণ আগ মুহূর্তেও তো কত হাসিখুশি ছিলো সে।ভাবতেও পারে নি কখনো তার জীবনে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে।এই দৃশ্যটা আরাফাতের মনে বারবার আঘাত হানছে।ভুলতে পারছে না সে এই দুঃস্বপ্নটাকে কিছুতেই।

চোখদুটো মুছে গাড়ি চালানােয় মন দিতে চাচ্ছে সে,তাও পারছে না।এই অবাধ্য চোখজোড়া বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ছে।ঠিক এমন সময় তার মা মিসেস মুমতাহিনা সিরাজী কল দিলেন তার ফোনে।প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেল।ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না তার এই মুহুর্তে।কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন কল করলেন ওনি তখন আর রিসিভ না করে পারলো না সে।বহুত কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকালো আরাফাত।আর একহাত দিয়ে ড্রাইভিং করছে। শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো;

আরাফাত:-হ্যা আম্মু বলো,

ফোনের ওপাশ থেকে শোনা গেল মায়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর;

মিসেস মুমতাহিনা:-হ্যালো বাবা,কই তুই?বাসায় কখন আসবি?সকালে ঠিকমতো নাস্তাও করলি না!যশোর থেকে এসেই কিছুক্ষণ রেস্ট না নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলি।কী হয়েছে বাবা তোর?এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় গিয়েছিস?

মায়ের কথা শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না আরাফাত।কান্না করে দিলো সশব্দে।ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে তার।মিসেস মুমতাহিনা চরম পর্যায়ে অবাক হলেন ছেলের এমনতর কান্না শুনে। ব্যাকুল কন্ঠে ফোনের ওপাশ থেকে বললেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-বাবা,কী হয়েছে তোর?এভাবে কান্না করছিস কেনো?বলনা বাবা কী হয়েছে?

আরাফাত কান্নার ধমকে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না।হেঁচকি তুলে বলতে লাগলো ;

আরাফাত:-আম্মু!লা,লামিয়া, আমার সাথে বি,বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আম্মু।ও আমায় ঠকিয়েছে।ও আমাকে কখনো ভালোবাসে নি আম্মু।ধোঁকা দিয়েছে ও আমায়।

আরাফাত জীবনে কখনো এভাবে কান্না করে নি। ছোটবেলায় কখন, কবে, কী কারণে কান্না করেছে তা ওর মনে নেই।কান্না শব্দটা ওর ডিকশনারীতে একদম নেই বললেই চলে।আর সেই ছেলে কিনা আজ এভাবে হাউমাউ করে কান্না করছে তাও নিজের মায়ের সামনে।এটা মিসেস মুমতাহিনা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।তার ছেলে আজ ঠিক কতটা আঘাত পেয়েছে যার কারণে সে এভাবে কান্না করছে ভাবতে গিয়ে তিনি নিজেই চোখের পানি ঝরাতে লাগলেন।নিজেকে কোনোমতে সামলে বলে উঠলেন তিনি ;

মিসেস মুমতাহিনা:-বাবা,তুই বাচ্চাদের মতো কান্না কেন করছিস বলতো?আমার ছেলেটা না কত স্ট্রং?সে তো এভাবে ভেঙে পড়তে পারে না।তুই বাসায় আয় বাবা।আম্মু আজ তোর জন্য বিরিয়ানি,

বাকি কথা আর তিনি সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। কোথা থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিয়ে আরাফাতের গাড়িটাকে উল্টে ফেললো।কান্না করতে করতে চোখজোড়া আরাফাতের ঝাপসা হয়ে ছিলো যার কারণে সামনে আগত ট্রাকটাকে সে দেখতে পায়নি ঠিকমতো।

মায়ের বলা কথা গুলো সে আর শুনতে পেল না। সব ধোঁয়াশা হয়ে গেল।গাড়ির ধাতব শরীর দুমড়ানো মোচড়ানোর শব্দ ও টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ ঠিকই মিসেস মুমতাহিনার কানে গেল। কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন তিনি,নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।সাথে সাথেই ফোনটা বিকট শব্দে কেটে গেল।হুশ ফিরতেই সারা বাড়ি কাঁপিয়ে জোরে একটা চিৎকার করে সেন্স লেস হয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লেন তিনি।তারপর আর কিছু মনে নেই ওনার।

ভার্সিটি থেকে মনের সুখে হেলেদুলে হেঁটে আইসক্রিম খেয়ে খেয়ে বাসায় ফিরছে মাহা।সাথে তার বান্ধবী আনিশা।মাহার পরনে কালো ড্রেস,গলায় সাদা একটা স্কার্ফ পেঁচানো।মাথায় উঁচু করে ঝুটি বাঁধা।চোখে মুখে সর্বদা দুষ্টামির ছাপ বিদ্যমান।আনিশার মতে মাহার মতো শয়তাইন্না মাইয়া এই দুনিয়াতে ২য় টি নেই।ভার্সিটি ও কলেজে তো সবাই তাকে একনামে চেনে।কাউকে ভয় পায় না একমাত্র তার বড়ভাইয়া রাহাত হোসাইনকে ছাড়া।তার বড়ভাইকে সে বাঘের মতো ভয় পায়।রাহাত যা বলে তা বিনাবাক্য ব্যয়ে পালন করে সে।

আনিশা ও মাহা একে অপরের জিগরি দোস্ত। কোনো ছেলেবন্ধু নেই তাদের।সেই ক্লাস 1 থেকে এখন পর্যন্ত দুজন একসাথে আছে।দুজনের বাসাও একদম কাছে।ওরা এখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।ভার্সিটিও বেশি দূরে নয়,কাছেই অবস্থান করছে।মাহা আইসক্রিম খেতে গিয়ে ঠোঁটের আশেপাশে ও নাকে লাগিয়ে ফেলেছে,তা দেখে আনিশা তার হাতে একটা টিস্যু ধরিয়ে দিয়ে বললো ;

<মাহার ডাকনাম হানি যদিও সেই নামে শুধুমাত্র তার বড়ভাই,আনিশা,বড়বোন এবং মাহার প্রিয় একজন মানুষ আছে সে সম্বোধন করে।বাকি সবাই মাহা নামে ডেকে অভ্যস্ত।>

আনিশা:-মুখটা ভালো করে মুছে নে হানি।যেভাবে মুখটা আইসক্রিম দিয়ে লেপ্টে রেখেছিস যে কেউ দেখলে বলবে তুই আইসক্রিম নামক খাদ্যটা জীবনেও খাসনি!

আনিশার কথা শুনে মাহা তাচ্ছিল্য করে দু আঙ্গুলে চুটকি বাজিয়ে হম্বিতম্বি করে বললো;

মাহা:-আবে ও হাঁদারাম কি ওলাদ!এই মাহাকে কিছু বলার সাহস এই দুনিয়ায় কারো নেই, বুঝলি?এই মাহাকে দেখলেই ভয়ে সবার হাত-পা কাঁপে কিছু কমেন্ট করা তো দূরের কথা!

আনিশা হাতজোড় করার ভঙ্গিতে বলে উঠে ;

আনিশা:-মাফ চাই,দোয়াও চাই বইন।আমারই ভুল হইছে।কারে কী বলছি আমি!হ বইন,দুনিয়ার সবাই তোরে ভয় পায়,এমনকি আমিও তোরে ভয় পাই।

মাহা আনিশার পিঠে জোরে এক থাবড়া দিলো বাহবার ভঙ্গিতে।একটুর জন্য তার আইসক্রিমটা মাটিতে পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেল।বত্রিশ দাঁত বের করে হেসে বললো;

মাহা:-এই না হলি আমার বেস্টু!অবশ্য আমি যা-তাকে বেস্টু বানাই না।তোর চৌদ্দগুষ্ঠীর কপাল ভালো বলতে হবে যে তুই আমার মতো সেরা বান্ধবীর নাগাল পাইছত।তোর জীবনডা ধন্য হয়ে গেল বুঝলি?

আনিশা:-ধন্য হইছে না ত্যানা ত্যানা হইছে সেটা আমি ভালো জানি, ~বিরবির করে~।এরকম দাঁত না কেলিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালা।বাসায় জলদি যেতে হবে আম্মু বলে দিয়েছে।~তাড়া দিয়ে~

মাহা:-হুম,চল।

দুজনে তাড়াহুড়ো করে পা চালাতে লাগলো বাসার উদ্দেশ্যে।প্রায় মিনিট পাঁচেক পর আনিশার বাসার সামনে চলে এলো ওরা।আনিশা মাহার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বাই জানিয়ে বললো;

আনিশা:-বাই দোস্ত,ফোন অন রাখিস।রাতে কল দিবো নে ৷

হাত দিয়ে টাটা দেখিয়ে সে বললো;

মাহা:-ওকে দোস্ত,বাই।

আনিশাকে বাই জানিয়ে মাহা হাঁটতে লাগলো। সামনেই তার বাসা দেখা যাচ্ছে।প্রায় মিনিট দুয়েক হাঁটার পর মাহা চলে এলো তার বাসায়৷মাহাদের বাসার সামনের দিকটা টিন শেড সিস্টেমের এবং এর পেছনের দিকে ছাদ আছে।অনেক সুন্দর ও শৌখিন।বাগানবাড়ির মতো লাগে দেখতে।

বাগানবাড়ি বলার কারণ আছে অবশ্য,মাহা ও তার বড়ভাবী প্রচন্ড বাগানবিলাসী টাইপের মেয়ে।বাগান করার শখ তো মাহার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই ছোটকাল থেকেই৷তাইতো সারা বাড়ির উঠান ও পিছনের জায়গা জুড়ে শাক সবজি ও ফুলের বাগান।নিজের রুমের বারান্দা ও ছাদ পর্যন্ত বাদ দেয়নি সে,হরেক রকমের ফুলগাছ ও ভেষজী গাছ লাগানো সে জায়গা গুলোতে।শুধু বাগানই নয় মুরগী পালার ও শখ আছে মাহার।দেশি মুরগী ও মিশরীয় মুরগী সবমিলিয়ে ১৫ টার মতো মুরগী ও ৩ টা মোরগ আছে তার।মুরগীগুলো প্রত্যেকদিন ডিম পাড়ে।

মাহা মনের সুখে গান গাইতে গাইতে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো।সদরদরজা খোলাই আছে।কাজের মেয়ে ফুলমতি বাইরে উঠান ঝাট দিচ্ছে তাই।এই মুহুর্তে বাসার ভেতর কাউকে দেখতে পেল না মাহা। এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সে তার রুমে চলে গেল।

“ওয়, টিকাটুলির মোড়ে একটা
হল রয়েছে।
হলে নাকি এয়ারকন্ডিশন রয়েছে,! ”

মাহা গুন গুন করে গান গেয়ে কলেজ ড্রেস খুলে বাসায় পড়ার কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল সারতে।এই মুহুর্তে তার কাছে সবথেকে ইম্পর্ট্যান্ট কাজ হলো গোসল করা।হেঁটে আসায় ঘেমে নেয়ে লাল হয়ে গিয়েছে মাহা।বাইরে খুব গরম পড়েছে ইদানীং।মাহার মতে,’সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চায় যেন সূর্য
আঙ্কেল ‘।

প্রায় মিনিট ত্রিশেক পর শাওয়ার শেষ করে বেরোলো মাহা।পরনে তার লাল রঙা শর্ট গাউন ও কালো প্লাজু।লাল রঙে তাকে ভীষণ মানায় ৷

আনমনে গুনগুন করে বারান্দায় গিয়ে চুল ঝেড়ে টাওয়েলটা মেলে দিয়ে এলো সে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে লিপ বামটা নিয়ে ঠোঁটে আলতো করে ঘষতে লাগলো মাহা সযত্নে।সেই সাথে আয়নায় নিজেকে খুব গভীরভাবে পরখ করতে লাগলো।

মাহা দেখতে দুধসাদা ফর্সা সুন্দরী নয়,বরং তার গায়ের রং কিছুটা শ্যামলা বর্ণের।তবে মুখের গড়ন ভীষন মায়াবি।নজরকাড়া টানা টানা ও বড় বড় পল্লব বিশিষ্ট আঁখিদ্বয় তার সৌন্দর্য্য যেন বাড়িয়ে দিয়েছে।ঠোঁটের রঙ হালকা লাল রঙা আর থুতনি বরাবর জ্বলজ্বলে কালো একটা তিলের কারনে তাকে অনেক কিউট লাগে।কোমড় অব্দি লম্বা কালো স্ট্রেইট চুল।জ্ঞানে,বুদ্ধিতে,দুষ্টামিতে সবকিছু মিলিয়ে পারফেক্ট একটা মেয়ে সে।যার কোনো তুলনা হয় না।

খিদায় মাহার পেট জ্বলে যাচ্ছে।পেটের ভেতর ইদুরগুলো অলিম্পিক রেস শুরু করেছে।রুম থেকে বেরিয়ে মাহা ডিরেক্ট ডাইনিং রুমে গেল। তখন রান্নাঘর থেকে কিশোরী ফুলমতি ডাইনিং রুমে এসে মাহাকে দেখতে পেয়ে বললো ;

ফুলমতি:-আফামনি,বড় আফামনিয়ে আন্নের লাইগা ভাত তরকারি বাইড়া রাইখা গোসল করতে গেছে।আন্নে খাইয়া লন আগে।

ফুলমতি মাহার থেকে ৩ বছরের ছোট।তাই ফুলমতি মাহাকে ছোট আফামনি এবং মাহার বড়বোন নওশিন হোসাইনকে বড় আফামনি ডাকে।নওশিনের বিয়ে হয়ে গেছে ২ বছর আগে। ওর স্বামী রিয়াজুল ইসলাম একজন আর্কিটেকচার ইন্জিনিয়ার।নওশিন বেশ কিছুদিন থাকার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে এসেছে এবার।সে ৪ মাসের প্রেগন্যান্ট।
মাহা টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললো;

মাহা:-তুই খেয়েছিস কিছু ফুল?

ফুলমতি:-হ আফামনি।আন্ডা হগলে খাইয়া লইছি৷আন্নেই খালি বাকি রইছেন খাওনের লিগা। আন্নের কিছু লাগলে আরে কইয়েন।

মাহা:-আচ্ছা,ঠিক আছে।

মাহা খাওয়া শুরু করলো।গপগপ করে খাচ্ছে সে। খাচ্ছে না বলে গিলছে বলা যায়।খিদে লাগলে সে এমনই করে।
সে যাকগে,হঠাৎ মাহার মনে হলো পুরো বাসাটা খালি।ওর আব্বু,আম্মু,ভাবী,কলিজার টুকরা ভাতিজা-ভাতিজী কেউ নেই বাসায়।থাকলে ওরা অনেক আগেই এসে হাজির হয়ে যেত।কোথায় গেল ওরা?মাহা ফুলমতিকে খাবার খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল ;

মাহা:- আচ্ছা ফুল,আজকে তো বাসায় সবার থাকার কথা!ওরা কই গেছে জানিস কিছু?

ফুলমতি অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকিয়ে বললো;

ফুলমতি:-কিডা জানি ইস্কিডেন্ট করছে,আন্নে গো আত্মীয় নাকি লাগে।কিডা যেন,আই হের নাম হুনি নাই।

মাহা অবাক হলো খুব ফুলমতির কথা শুনে। তারপরও খুঁত ধরতে ছাড়লো না।

মাহা:-বলদ,ওটা ইস্কিডেন্ট না,এক্সিডেন্ট হবে।

ফুলমতি:-ওই একডা হইলেই অইছে,চেম টু চেম।

মাহা:-আত্মীয় বলতে কাকে বুঝাতে চাইলি ফুল?আত্মীয়ের তো অভাব নেই আমাদের।নাম না বললে কী করে বুঝবো যে কার এক্সিডেন্ট হয়েছে?

ফুলমতি:-আর কইয়েন না আফামনি।আই তহন ঘর ঝাড়ু দিতে আছিলাম।বড়আব্বায় আর বড়ভাইয়ে সোফায় বইয়া কফি খাইতাছিলেন। ঠিক তহনই বড় আব্বার মোবাইলে কিডা জানি কল দিলো।বড় আব্বায় ফোনে কথা কইয়া কেমন জানি ডরাইয়া গেলেন।বড় আব্বারে ট্যানশন করতে দেইহা বড় ভাইয়ে ফোন কানে টেহাইয়া কথা কইলেন খানিক।তার হরে দুইজনই তাড়াতাড়ি কইরা রুমে গিয়া রেডি হইয়া বাইরইলেন,তানগো লগে বড় আম্মা আর বড়ভাবী ছোড মনারে (জিমি) কোলে লইয়া গাড়ি কইরা ছইলা গেলেন৷বড় মনারে (জাওয়াদ) বড় আফামনির কাছে রাইখা গেছেন।আর এই এট্টু আগে দুলাভাই আইয়া বড় আফামনির কাছ থাইকা ঘটনাডা হুইনা হেগো কাছে গেছে গা।আই এরথে বেশি কিছু কইতে হারি না গো আফামনি।

ফুলমতির কথা গুলো শুনে বেশ ভাবনায় পড়ে গেল মাহা।ভাবছে সে,কে এক্সিডেন্ট করলো! তাদের আত্মীয়ের মধ্যে কে এমন হতে পারে!ফুলমতির বোধবুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি খুবই কম।তার সামনে কেউ যদি কোনো কিছু নিয়ে বিস্তারিত আলাপও করে তাও সে বুঝতে পারে না ঠিক কী নিয়ে কথা বলেছে ওরা।কিছুটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলা যায় ওকে।এজন্য এখন কার কী হয়েছে ঠিকঠাক বলতে পারে নি কিছু।তবে কাজকর্মের ব্যাপারে সে লা জাবাব!সেটা তাকে বলে দিতে হয় না।

যাইহোক,বিস্তারিত জানতে হলে নুশু আপ্পির কাছে যেতে হবে।যেমন ভাবা তেমন কাজ।মাহা জলদি জলদি খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে টাওয়েল দিয়ে মুছে নওশিনের রুমে গেল।গিয়ে দেখলো তার আড়াই বছরের আদরের ভাতিজা জাওয়াদ নওশিনের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আই প্যাডে কার্টুন দেখছে একমনে।হঠাৎ মাহাকে দেখতে পেয়ে জাওয়াদ আই প্যাড রেখে প্রায় লাফিয়ে উঠলো।মাহাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।খুশিতে হাততালি দিয়ে আদো আদো কন্ঠে বললো;

জাওয়াদ:-পুঁপি,তুমি এতে গেচ!দানো,আমি কত মিত কলেচি তোমায়?তোমাকে তাড়া আমাল তিচু ভালো লাদে না।আমার দুম আততে না পুঁপি। আম্মু বাতায় নাই,আমায় লেখে তলে দেতে।~মনখারাপ করে~

জাওয়াদের আদো আদো কথা শুনতে মাহার ভীষণ ভালো লাগে।সে মুচকি হেসে বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে জাওয়াদকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসলো।জাওয়াদের সারা মুখে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বললো;

মাহা:-উম্মাহ,উম্মাহ,আমার সোনা ভাতিজা, আমার প্রানের ভাতিজা,আমার কলিজার টুকরা জাওয়াদ সোনা!পুঁপি এসে গেছি তো আমার বাবাটার কাছে।আর মনখারাপ করতে হবে না। আমার সোনাটা কী খেয়েছে কিছু শুনি তো?

জাওয়াদ:-হ্যা কেয়েতি তো,বল পুঁপি কাইয়ে দিয়েচে।

মাহা:-ওহহ,তাহলে ঠিক আছে।এখন আসো তো সোনা তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেই।

জাওয়াদ মাথা দুলিয়ে বললো;

জাওয়াদ:-আততা।

মাহা জাওয়াদকে শুয়িয়ে দিয়ে তার পাশে সেও আধশোয়া হয়ে তার পিঠে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে লাগলো।জাওয়াদও ভালো ছেলের মতো মাহাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো ঘুমানোর জন্য।মিনিট পাঁচেক পর ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল জাওয়াদ।তখনই ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার সেড়ে নওশিন বেরিয়ে এলো।মাহার ওপর চোখ পড়তেই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল;

নওশিন:-কীরে হানি!ভাত খেয়েছিস?তোর জন্য টেবিলের ওপর খাবার বেড়ে রেখে এসেছিলাম।

মাহা:-হ্যা আপু,এই একটু আগে খেয়ে এসেছি এখানে।

নওশিন জাওয়াদকে একপলক দেখে জিজ্ঞেস করলো;

নওশিন:-ঘুমিয়ে গেছে ছেলেটা,তাই না?

মাহা হেসে জবাব দিলো;

মাহা:-হ্যা,এখন তো ওর ঘুমানোর টাইম।ভাবীর কথা বলে অবশ্য মন খারাপ করছিলো,ওকে নাকি ফেলে চলে গেছেন।

টাওয়েল দিয়ে চুল ঝারতে ঝারতে বললো নওশিন;

নওশিন:-আর বলিস না।ওর মায়ের কথা আর তোর কথা জিজ্ঞেস করে করে পাগল করে ফেলেছিলো আমায়।আবোল তাবোল বলে কোনোমতে ভুলিয়ে রেখেছি।হসপিটালে তো আর ওকে নেয়া যাবে না,তাই ভাবি ওকে আমার কাছে রেখে গেছেন।

মাহা এবার কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে বসলো।কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল;

মাহা:-আচ্ছা আপু,ফুলের কাছ থেকে শুনলাম আমাদের আত্মীয় কে নাকি এক্সিডেন্ট করেছে!তা কে এক্সিডেন্ট করেছে আপু?মূল ঘটনাটা শুনি বলো!

নওশিন মাহার প্রশ্নের উত্তরে যার নামটা বললো, তার নাম শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না মাহা।

নওশিন:-আরাফাত ভাইয়া কার এক্সিডেন্ট করেছে রে।এখন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছে বড়ভাইয়াদের তত্ত্বাবধানে।অবস্থা খুবই শোচনীয় শুনলাম।

মাহা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে নওশিনের বলা কথা শুনে।কথাটা সে মোটেই হজম করতে পারছে না।কথা গুলো যেন কানের কাছে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে মাহার।প্রায় কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ;

মাহা:-ক,কী বলছো আপু এসব তুমি?

নওশিন চুল নাড়াচাড়া করে বিছানার একপাশে মাহার সামনে বসে বললো;

নওশিন:-হ্যা রে,আম্মুর মুখে যখন শুনলাম,তখন আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না।এত হাসিখুশি একটা ছেলে আরাফাত ভাইয়া!কী থেকে কী হয়ে গেল!আজকেই মাত্র যশোর থেকে ফিরেছে।বড়ভাইয়া নিজে ওনার চিকিৎসা করছে।আম্মুকে ফোন করেছিলাম,বললেন,আরাফাত ভাইয়ের অবস্থা নাকি খুবই আশঙ্কাজনক।ডক্টররা তেমন একটা আশা দিতে পারছেন না।মাথায় ও কন্ঠনালিতে মারাত্মক চোট পেয়েছে।একহাত ও একপায়ের হাড্ডি ভেঙে গেছে।অন্য হাতপা না ভাঙলেও মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে।এরমাঝে সে মেন্টালি ডিপ্রেসড্,বাঁচার কোনো ইচ্ছাই নেই তার,

নওশিন বাকি কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না।তার কথার পিঠে মাহা এবার আশ্চর্যজনক ভাবে ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলো;

মাহা:-লামিয়া নামক মেয়েটার কারণে এমনটা হয়েছে তাই না আপু?নিশ্চয়ই ওনি তার প্রিয়তমা গার্লফ্রেন্ডকে অন্য কোনো ছেলের সাথে দেখতে পেয়ে ব্যাপারটা হজম করতে পারেন নি।তারপর কান্নাকাটি করে গাড়ি চালাচ্ছিলো আর পথিমধ্যে এক্সিডেন্ট করে বসে,!Am i right আপু?

নওশিন হা হয়ে মাহার দিকে তাকিয়ে আছে। এতটা অবাক হয়েছে যে,সে মুখ বন্ধ করতে এবং চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে।বিস্ময়ে চোখ রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেছে তার।মাহার এমন রূপ পাল্টে কথা বলা দেখে মারাত্মক অবাক হয়েছে বেচারি।উত্তেজিত হয়ে হরবর করে বলে উঠলো ;

নওশিনঃ-তুই কী করে জানলি হানি?কে বললো তোকে?আমি তো তোকে বলি নি!তাহলে তুই কেমনে বুঝে গেলি?How?

——————–

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে