হৃদয়াক্ষী পর্ব-০৯

0
1024

#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_ ০৯
#সারিফা_তাহরিম

‘ বন্ধুত্বের ছদ্মবেশ ধরে হলেও আপনার প্রতিটি কথা যে প্রেমের পরাকাষ্ঠা গঠন করতে ব্যস্ত তা কি আপনি জানেন জনাব?’

বলা হলো হলো না কথাটা। পূর্ণতা বাহিরে তাকাল আবারও। মনে মনে অরিত্রের দিকে বন্ধুত্বের হাতটা ঠিকই বাড়িয়ে দিয়েছে সে। অরিত্র কি সেটা খেয়াল করেছে?

মেলার কাছে আসতেই অরিত্র ভাড়া চুকিয়ে নেমে পড়ল। পূর্ণতাও সাবধানে নামল। অরিত্র পূর্ণতার দিকে ফিরতেই গভীর নেত্রযুগলের মিলন হলো। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা অরিত্রের গভীর চোখগুলোতে যেন সম্মোহন মেশানো। পূর্ণতা তড়িৎ গতিতে চোখ সরিয়ে নিল। ঐ চোখে তাকিয়ে থাকার সাহস তার নেই। অরিত্র বলল,

‘ এবার তাহলে যাওয়া যাক?’

পূর্ণতা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। অরিত্র পূর্ণতাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। টিকিট কিনে মেলায় ঢুকল। অন্যদিন সকালবেলা মেলায় মানুষ থাকে না বললেই চলে। তবে আজ শুক্রবার হওয়ায় মোটামুটি মানুষ এসেছে। দোকানের তিনটা সারি দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো স্টল বসেছে। বিশেষ করে মেয়েদের চুরি, কানের দুল ও বিভিন্ন সাজ সরঞ্জামের স্টলই বেশি। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল অরিত্র আর পূর্ণতা। সামনে একটা আচারের স্টল দেখা গেল। হরেক রকমের আচার বিক্রি করছে। অরিত্র জানে আচারের প্রতি বেশিরভাগ মেয়েদের অদ্ভুত লোভ কাজ করে। পূর্ণতাও নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম হবে না। পূর্ণতার দিকে তাকাল অরিত্র। তারও দৃষ্টি আচারের স্টলটার দিকে। আচারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে পূর্ণতা জড়তার জন্য তাকে কিছু বলবে না সেটা খুব ভালো করেই জানে। তাই কিছু না বলেই অরিত্র স্টলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘ পূর্ণতা, কোন আচারগুলো ভালো? আমি তো আচার খাই না। তবে আজ ভাবছি একটু খেয়ে দেখি। তোমরা মেয়েরা তো খুব আচারপ্রেমী হও, তাই তোমার কাছে জিজ্ঞেস করলাম।’

পূর্ণতা চঞ্চল স্বরে বলল,

‘ তেতুল চাটনিটা বেশ ভালো। টক স্বাদের হওয়ায় ভালোই লাগে খেতে। চালতা আর জলপাইয়ের আচারও মজা। আর রইল আমের আচার, আচারের মধ্যে এটা বেস্ট।’

অরিত্র পূর্ণতা, মৌনতা আর অবন্তীর জন্য আচার কিনল। এত এত আচার দেখে পূর্ণতার চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দিল। এখনই খেতে ইচ্ছে করছে তার। তবে লজ্জায় কিছু বলল না অরিত্রকে। অরিত্র ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিল। এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট। দুপুরে আসাদের বাসায় দাওয়াত হওয়ায়, লাঞ্চ ওখানেই করবে। জুমার নামাজ পড়ে তারপর টুকটাক কথাবার্তা বলে খেতে বসতে সময় লাগবে। সব মিলিয়ে লাঞ্চ করতে দেরি হবে। আর পূর্ণতা নাস্তা করেছে সেই সকালে। এতক্ষণ না খালি পেটে কিভাবে থাকবে মেয়েটা!

আরও কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলো তারা। অরিত্র পূর্ণতাকে বেশ কয়েকবার বলল কিছু পছন্দ হলে বলতে। কিন্তু পূর্ণতা কিছুই বলল না। একজোড়া অ্যান্টিকের কানের দুল খুব সুন্দর লাগলো অরিত্রের। সে পূর্ণতার জন্য কানের দুল জোড়া আর কয়েক ডজন চুড়ি কিনল। নীল চুড়িগুলো পড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পূর্ণতার কথা ভেবে নিজের ইচ্ছাকে ধামাচাপা দিল। একটা স্টল ছিল দেশীয় শাড়ির। অরিত্র বলল,

‘আম্মুদের জন্য কোন শাড়িগুলো ভালো হবে দেখো তো?’

পূর্ণতা দুটো বেগুনি রঙের শাড়ি বেছে নিল। দুটো প্রায় একই ধরনের। শাড়ি দুটো বেশ সুন্দর। অরিত্রেরও পছন্দ হলো। শাড়িগুলো নেওয়ার পর অরিত্র একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি নিল। পূর্ণতা বলল,

‘শাড়ি দুটো তো নেওয়া হয়েছে। অবন্তী তো শাড়ি পড়ে না। তাহলে এটা কার জন্য?’

‘তোমার জন্য। কেন সুন্দর লাগছে না এই শাড়িটা?’

পূর্ণতা পুলকিত হেসে চাপাস্বরে বলল,

‘আপনার পছন্দ করা জিনিসগুলো সুন্দর।’

অরিত্র মৃদু শব্দে হেসে বলল,

‘ আমার পছন্দের তালিকায় কিন্তু আপনিও লিপিবদ্ধ আছেন ম্যাডাম।’

পূর্ণতা লজ্জা পেল। লোকটা কি ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে সুন্দর বলল? নাকি সে যে পূর্ণতাকে পছন্দ করে সেটা জানাল? ঠিক বুঝতে পারল না পূর্ণতা। এই মানুষটা যে কেন প্রতিবার কথার বেড়াজেলা তাকে ফাঁসিয়ে ফেলে! মেলায় ঘুরার বেশ অনেকটা সময়ই তাদের মধ্যে টুকটাক গল্প চললো। গল্প চললো বললে ভুল হবে। মূলত অরিত্রই তার ছোটবেলার কিছু ঘটনা বলেছে। আর পূর্ণতা চুপচাপ শুনলো তার কথা। বাসার বাকিদের জন্য টুকটাক জিনিস নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়ে এলো প্রেমীযুগল। অরিত্র সময় দেখে নিল। পৌনে বারোটা বাজছে। পূর্ণতাকে নিয়ে রাস্তার ওপারের রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। পূর্ণতাকে কিছু খাওয়াতে হবে। অরিত্র তো সকালে নাস্তা করার পর পূর্ণতাদের বাসায়ও খেতে হয়েছে। যার কারণে তার খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। পেট ভরপুর। কিন্তু পূর্ণতার জন্য তাকেও অল্প করে খেতে হবে। নাহলে মেয়েটা খেতে সংকোচবোধ করবে।

রেস্টুরেন্টটা বেশ উন্নত মানের। কিন্তু অবেলা হওয়ার কারণে মানুষ নেই তেমন। কয়েকজন মেয়ে বসে গল্প গুজব করছে আর কফি খাচ্ছে। তাদের দেখে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে মনে হচ্ছে। অরিত্র আর পূর্ণতা রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই সবাই যেন কৌতুহলী চোখে তাকাল তাদের দিকে। পূর্ণতাকে খানিকটা বিচলিত দেখাল হয়তো। সে অরিত্রকে বলল,

‘ চলুন কর্নারে বসি।’

অরিত্র দ্বিরুক্তি না করে কর্নারে গিয়ে বসল। এদিকে মেয়েগুলোর কৌতুহলী দৃষ্টি তেমনটা পড়বে না। হাফ ছাড়ল পূর্ণতা। ওয়েটার অর্ডার নেওয়ার জন্য আসতেই অরিত্র পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করল। পূর্ণতার কথামতো রামেন আর কোল্ড কফি অর্ডার করল দুজনের জন্য। রেস্টুরেন্টটার একটা ভালো দিক লক্ষ্য করা গেল। অর্ডার দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে খাবার চলে এলো। খাওয়া শুরু করতে করতে অরিত্র বলল,

‘ পূর্ণতা, একটু তাড়াতাড়ি খেতে হবে। এখান থেকে আবার আসাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। সেখান থেকে আসাদের সাথে নামাজ পড়তে যাব। আজ আরও জুমাবার। দেরি করা যাবে না।’

‘জ্বি৷ বুঝতে পেরেছি।’

অরিত্রের খাওয়ার মুড নেই। সে ধীরে ধীরে কোল্ড কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল,

‘এতদিন রেগে থাকার কারণটা এখনো জানতে পারিনি ম্যাডাম।’

পূর্ণতা আড়চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘কিসের রাগ? কে রাগ করেছে?’

পূর্ণতার কথায় সশব্দে হেসে উঠলো অরিত্র। হাসতে হাসতে বলল,

‘এতদিন ধরে যে রাগে আমার ছায়াটাও দেখতে পারত না, কণ্ঠটাও শুনতে পারত না সে আজ বলছে কিসের রাগ! ব্যাপারটা অদ্ভুত না? আসলেই নারীমনের মতো বিশাল রহস্য এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। যতই এর রহস্য উদঘাটন করার জন্য আলোক রশ্মি প্রেরণ করা হোক না কেন, ব্ল্যাকহোলের মতো সবকিছুই অন্ধকার দেখায়। আর যেসকল পুরুষ এই রহস্য সত্যিই উদঘাটন করতে পারে, তারা মহাজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্য।’

পূর্ণতা কিছু না বলে চুপচাপ খেতে লাগলো। অরিত্র আবারও জিজ্ঞেস করলো,

‘ আচ্ছা তোমার সেই না করা রাগ অর্থাৎ গম্ভীরতার কারণটা কী?’

পূর্ণতা এবার খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলল,

‘ আসলে বিয়েটা আমার জন্য পুরোপুরি আনএক্সপেক্টেড ছিল। হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে তা কস্মিনকালেও ভাবিনি আমি। মূলত পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে বিয়ের কল্পনা মাথায় আনার কথা ভাবিওনি। তবুও বাবা মায়ের খুশির জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। এমনিতেই আমার কোনো পছন্দের কেউ ছিল না, বাবার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করতাম। তাই ভাবলাম বিয়েটা নাহয় কিছুদিন আগেই হবে। নিজেকে বুঝালাম। কিন্তু বিয়ের দিন বাবা মা আমাকে ভুল বুঝলেন। সেদিন থেকে গত কয়েকদিন আগে পর্যন্ত বাবা মা আমার সাথে ঠিক মতো কথা অবধি বলেননি। আমি অনেক চেষ্টা করেও এতদিন উনাদের ভুল দূর করতে পারিনি। এজন্য মন মেজাজ খারাপ থাকতো সবসময়। তাই আপনাকে দেখলেই কেন জানি রাগ হতো খুব।’

শেষের কথাগুলো বলার সময় গলার স্বর আরও মিইয়ে গেল পূর্ণতার। অরিত্র বলল,

‘ বিনা অপরাধে শাস্তি পেলাম তাহলে?’

অরিত্রের কণ্ঠ খানিকটা গম্ভীর শোনালো। পূর্ণতার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করল। এই প্রথমবার অরিত্র তার সাথে গম্ভীরভাব কথা বলেছে। কোনো এক অজানা কারণে ভীষণ খারাপ লাগছে পূর্ণতার। খাওয়া শেষে বিল চুকিয়ে দুজনই বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। সিএনজি ঠিক করে আসাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এর মধ্যে আর একটা কথাও বলল না অরিত্র। পূর্ণতার মনে বিষন্নতা নেমে এসেছে। মানুষটা কি রাগ করেছে তার সাথে? অরিত্রের এমন গাম্ভীর্যতা মেনে নিতে পারছে না পূর্ণতা ৷ কষ্ট হচ্ছে তার। পূর্ণতার মনের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশেও মেঘ জমেছে। যখন তখনই মেঘ গলে বৃষ্টিরা পাড়ি জমাবে ধরনীতে।

বারোটা চল্লিশের দিকে আসাদদের এলাকার সামনে গিয়ে থামলো সিএনজি। অরিত্র আর পূর্ণতা দুজনই নেমে পড়ল। এখানে কাঁচা রাস্তা হওয়ায় কোনো গাড়ি না যাওয়াটাই শ্রেয়। আসাদদের বাড়ি অবধি হেঁটে যেতে হবে। কয়েক পা এগিয়ে গেল অরিত্র। তার পিছুপিছু পূর্ণতাও এগুলো। অরিত্র এখনো চুপচাপ। সে রেগে আছে ভাবতেই আরেক রাশ বিষন্নতা জড়ো হলো পূর্ণতার মনে। সে অরিত্রের পাশাপাশি গিয়ে বলল,

‘সরি’

কথাটা হয়তো অরিত্রের কান অবধি পৌঁছালো না। ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। অরিত্র পূর্ণতার হাত ধরে সামনের টং দোকানে গিয়ে দাড়ালো। পূর্ণতা আর অরিত্র দুজনই খানিকটা ভিজে গেছে। দোকানদার ছাড়া আর তেমন লোকজন নেই আশেপাশে। তবুও হালকা ভিজে উঠা ‘স্ত্রী’ নামক সুন্দরী এই রমণীকে লোকচক্ষুর আড়াল করতে এক হাতে জড়িয়ে নিল। যাতে দোকানদার বা বাহিরের কেউ তেমনটা খেয়াল না করে। আজানের সময় মাথায় সুন্দর করে আঁচল টেনে নিয়েছিল। এখনো সেভাবেই আছে। তাকে দেখে বউ বউ লাগছে। অরিত্রের শুভ্র পাঞ্জাবিটা ভিজে উঠেছে। অরিত্রের বুকের অনেকটা কাছাকাছি পূর্ণতা। সুন্দর একটা ঘ্রাণ ভেসে আসছে অরিত্রের পাঞ্জাবি থেকে। পূর্ণতা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল অরিত্রের দিকে। চোখে চশমা, গালে চাপ দাড়ি, সুঠাম দেহের এই পুরুষটা নিঃসন্দেহে সুদর্শন। পূর্ণতার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। কিন্তু তিনি রাগ করে আছেন পূর্ণতার উপর। ভাবনাটা মাথায় আসতেই পূর্ণতা দৃষ্টিতে বিষন্নতা নামল। কাজলটানা চোখে তা স্পষ্ট ধরা দিল। তখনই অরিত্র তার কানের কাছে ফিসফিস করে,

‘কোনো এক নির্দিষ্ট মানুষের কাছে অপরাধের জন্য ‘সরি’ না, ‘ভালোবাসি’ বলতে হয়।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে