হৃদয়াক্ষী পর্ব-০৮

0
1013

#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_ ০৮
#সারিফা_তাহরিম

বৃহস্পতির চন্দ্ররাজ সূক্ষ্ম রেখায় কৃষ্ণবর্ণ আকাশে আলোর পরশ বুলাচ্ছে। রাত্রির গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে আলোর প্রখরতা কমছে যেন। তবে বাতাসে একটা স্নিগ্ধ ঘ্রাণ ভেসে আসছে। এই বুঝি বর্ষার আগমনী বার্তা! অরিত্র সব ব্যস্ততা আর কাজ শেষে বারান্দার মেঝেতে বসে আছে। গায়ে পাতলা টি-শার্ট জড়ানো। শান্ত সেই দৃষ্টি গ্রিলের ফাঁক গলে আকাশে নিবদ্ধ। এই মুহূর্তে তার চোখে চশমা নেই। হাতে গিটার নিয়ে মাঝেমধ্যে টুংটাং সুর তুলছে আনমনেই। পাশে রাখা ফোনটা মেসেজ টোনে বেজে উঠতেই অরিত্রের ঘোর ভাঙলো। ফোন হাতে নিয়ে পূর্ণতার মেসেজটা ভেসে উঠতেই বিস্মিত হলো অরিত্র। কিয়ৎক্ষণ পরে নিজের বিস্ময় ভাবটা কাটিয়ে উঠতেই প্রশান্তির হাসি হাসলো।

____

গতকালের আবহাওয়ার রেশ ধরে আজকেও শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে। সূর্যের তাপ আজ নরম। হাসনাহেনা ফুলের সুবাস ভাসছে চারপাশে। পূর্ণতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার মায়ের কার্যকলাপ দেখছে। নাজিবা হাসান খুব যত্নসহকারে মেয়েকে শাড়ি পড়াতে ব্যস্ত। নীল রঙের ইন্ডিয়ান মসলিন জামদানী শাড়িটা পূর্ণতার ধবধবে শরীরে বেশ ভালো লাগছে। নাজিবা হাসান মনোযোগ দিয়ে কুচিগুলো গুছাচ্ছেন। আজ হুট করেই যেন তিনি চঞ্চল কিশোরী হয়ে উঠলেন। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়গুলো খেয়াল করে মেয়েকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছেন। আর নিজের কাজ সুন্দরভাবে হচ্ছে দেখলেই চঞ্চল হাসি ফুটে উঠছে তাঁর মুখে। মায়ের এমন কর্মকাণ্ডে হালকা হাসলো পূর্ণতা। মা বাবার মুখের হাসিটাই তো দেখতে চায় সে।

নাজিবা হাসান পূর্ণতাকে শাড়ি পড়িয়ে দিলেন সুন্দর করে। একবার মেয়েকে দেখে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে হাসলেন। তারপর সূরা পড়ে পূর্ণতার গায়ে ফুঁ দিলেন যেন কুনজর না পড়ে। তারপর বললেন,

‘ বাকিটা তুমি করো, সেজে নাও। আমার কাজ আছে। অরিত্র আসবে আর আমি এত কাজ ফেলে এখানে পড়ে থাকলে হবে!’

‘ মা, সাজগোজ নিয়ে থাকতে অস্বস্তি হবে আমার। তাও আবার গরমকালে!’

‘আজ অতো গরম নেই। আবহাওয়া স্বাভাবিক আছে। আর তাছাড়া শাড়ির সাথে একটু না সাজলে ভালো লাগে না। তোমার যখন অস্বস্তি হবে তাহলে অল্প করেই সুবিধা মতো সাজো।’

নাজিবা হাসান চলে গেলেন। পূর্ণতা মুখে পাউডার দিয়ে চোখে কাজলের রেখা টানলো। তারপর ঠোঁটে ম্যাজিক লিপস্টিক দিল, যার কারণে ঠোঁটজোড়া পুরোপুরি রঙিন না হলেও হালকা গোলাপি আভা ধারণ করল। মেক আপ শেষে কোমর ছাড়িয়ে পড়া চুলে চিরুনি চালালো কয়েকবার। মা বলেছেন চুল খোলা রাখতে। সব শেষে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিল পূর্ণতা। সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। হয়তো মায়ের পড়িয়ে দেওয়া শাড়িটার কারণেই সৌন্দর্য ক্রমিক হারে বেড়েছে। এমনটাই ধারণা হলো পূর্ণতার। রেডি হয়ে চুপচাপ বসে রইলো বিছানায়। ঘড়িতে দশটা বাজার চার মিনিট বাকি। অরিত্র বলেছে দশটায় আসবে।

আজ প্রথমবারের মতো অরিত্রের সাথে ঘুরতে বের হবে ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। আগে কখনো ঠিকমতো কথা অবধি বলেনি আর আজ সারাদিন তার সাথে কাটাবে! অস্বস্তি, ভয় আর সংকোচ একসাথে মিলিত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে কলিং বেল বেজে উঠলো। পূর্ণতা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল, দশটা বাজছে। এত পারফেক্ট টাইমিং! অরিত্র কি তবে এসে গেছে! অস্বস্তিতে ঢোক গিলল পূর্ণতা। অল্প কিছুক্ষণ পরে মৌনতা এসে লাফাতে লাফাতে বলল,

‘ ও আপু রে… আমার জিজু এসে গেছে। ইয়াহু…।’

পূর্ণতা আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ তো? কী হয়েছে তাতে? মনে হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে ফেলেছিস?’

‘ আরে তুই কি করে বুঝবি আমার আনন্দ! আমার জিজু না বরং আমার বড় ভাইটা এসেছে। আমি খুশি হবো না? ভাইয়ার সাথে তো আমার কথা হয়, আমি সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছিলাম আমার ভাইটা আসবে! অবশেষে আমার ইচ্ছা পূর্ণ হলো। জানিস আপু, অরিত্র ভাইয়া আমার বড় ভাইয়ের অভাবটা ঘুঁচিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এতে তোর অবদানও আছে, কিন্তু তোকে কোনো প্রকার ধন্যবাদ জানাতে আমি রাজি নই। যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যে বাহিরে চলে আসিস। মা ডেকেছে। ভাইয়াকে নাস্তা দিবে। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে, আমি যাই।’

মৌনতার এমন উত্তেজনা আর দরদ দেখে পূর্ণতা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। খানিকটা ঈর্ষান্বিত হলো মনে হয়। কই মৌনতা তো নিজের বোনের জন্য এতটা মমতা দেখায় নি! তবে অরিত্র যে মৌনতাকে স্নেহ করে তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল। একটা মেয়ে সবসময় চায় তার স্বামী যেন তার বাবা মাকে নিজের বাবা মায়ের মতো সম্মান আর শ্রদ্ধা করে, ভাই বোনদেরকে নিজের ভাই বোনের মতো স্নেহ করে, ভালোবাসে। পূর্ণতার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। অরিত্র তার বোনকে খুব স্নেহ করে ব্যাপারটা জেনে খুব ভালো লাগলো। আর পূর্ণতার বাবা মাকে সম্মান আর শ্রদ্ধা করার কথা তো বলাই বাহুল্য। পূর্ণতার ভাবনার সুতো ছিড়ল কারো কাশির আওয়াজে। পূর্ণতা পিছনে ফিরে দেখল অরিত্র রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটু কাশি দিয়েছিল। পূর্ণতা তার দিকে ফিরতেই অরিত্র বলল,

‘আসবো?’

‘ আসসামু আলাইকুম। জ্বি আসুন।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’

বলে অরিত্র পূর্ণতার রুমে প্রবেশ করল। পূর্ণতা অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে আছে। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। অরিত্র পূর্ণতাকে দেখে ‘মা শা আল্লাহ’ বলল। এতে পূর্ণতা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অরিত্র বলল,

‘কেমন আছো? ‘

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

অস্বস্তি নিয়ে চাপা স্বরে বলল পূর্ণতা। অরিত্র লক্ষ্য করল আজ পূর্ণতার মধ্যে আগের সেই রাগটা নেই। যা আছে তা হলো সংকোচ আর অস্বস্তি। অরিত্র হেসে বলল,

‘ কেউ কারো থেকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে সৌজন্যমূলকভাবে তার কথা জিজ্ঞেস করতে হয়।আমাকে জিজ্ঞেস করবে না আমি কেমন আছি?’

অরিত্রের কথায় পূর্ণতা লজ্জায় পড়ে গেল। আসলেই তো! অস্বস্তিতে পড়ে কেমন বোকামি করে ফেলল সে! জড়তা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনি কেমন আছেন?’

মৃদু শব্দে হাসলো অরিত্র। গতকাল অন্যমনস্ক হয়ে পূর্ণতা প্রথম তাকে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করেছিল। এছাড়া আগে কখনো জিজ্ঞেস করেনি। এই নিয়ে অরিত্র কৌতুক করেনি। সে জানতো কিছু বললে হয়তো পূর্ণতা রেগে যাবে। তাই আর কিছু বলেনি। অরিত্র বলল,

‘ আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। মা তোমাকে বাহিরে যেতে বলেছেন। তাই ডাকতে এলাম।’

অরিত্র বের হয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। পূর্ণতার মা’কে সে ‘মা’ বলে ডাকছে! অবাক হলো পূর্ণতা৷ অরিত্র হাঁটা থামিয়ে পেছন ফিরে বলল,

‘ তোমার কোনো কিছুতে অসুবিধা বা অস্বস্তি হলে আমায় বলবে। তোমার একটু ভালো থাকার উপায় যে করেই হোক আমি বের করব।’

____

ব্যস্ত নগরীর রাস্তায় আজ গাড়ি তুলনামূলক হারে কম। শুক্রবার সকাল হওয়ার কারণেই হয়তো এমন। সময় বাড়তে বাড়তে রাস্তাঘাট আবারও জনমানবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। অরিত্র আর পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে। অরিত্র কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে কপাল কুচকে সিএনজি খুঁজছে। তার পড়নে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবী। পেছন থেকে চোরা চোখে এটুকুই লক্ষ্য করল পূর্ণতা। এখন অবধি এই মানুষটাকে ভালো করে দেখা হয়নি তার।

খানিকটা দূরে একটা মেলা বসেছে। আপাতত সেখানে যাবে তারা। সেখানে ঘুরাঘুরি করে অরিত্রের এক বন্ধু আসাদের বাসায় যাবে। আসাদদের বাড়িটা খানিকটা গ্রাম সাইডে। নদীর ধারের বেশ সুন্দর ছোট্ট একটা বাড়ি। এখানের মেলাটা ছোট খাটো হলেও খুব সুন্দর। প্রতিবছর এই সময়ে মেলাটা বসে। আসার সময় অরিত্র অবন্তী ও মৌনতাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল, কারণ এরা দুজন থাকলে পূর্ণতা কিছুটা স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তাদের মায়েরা কড়া কণ্ঠে নিষেধ করে দিলেন। তাঁরা চান অরিত্র আর পূর্ণতা একটু একান্তে সময় কাটাক।

অরিত্র সিএনজি ভাড়া করার জন্য একটা সিএনজি থামালে পূর্ণতা একটু এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বলল,

‘মেলা তো এখান থেকে কাছে। সিএনজি নেওয়ার দরকার কী? রিকশা দিয়েই তো যাওয়া যাবে।’

অরিত্র এক পলক তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,

‘যাওয়া তো যাবে ঠিকই, কিন্তু সেই যাত্রা যে আপনার জন্য মঙ্গলকর হবে না ম্যাডাম। একই রিকশায় আমি আপনার পাশে বসলে অস্বস্তি আর সংকোচে একপাশে চাপতে চাপতে কোন সময় রিকশা থেকে পড়ে যান তার কোনো ঠিক নেই। এর দায় ভার আমি নিতে পারব না। তাই সিএনজি করে যাওয়াটাই শ্রেয়।’

আবারও লজ্জায় পড়ে গেল পূর্ণতা। লোকটা কি জানে না এভাবে বলতে হয় না? মনে মনে চাপা রাগ পোষার চেষ্টা করল পূর্ণতা। কিন্তু পারল না। চুপচাপ সিএনজিতে উঠে বসল। অরিত্র সিএনজিতে উঠে বসতেই সিএনজি চলা শুরু করল। তাদের দুজনের মধ্যে এক হাত দূরত্ব। বাতাসে পূর্ণতার চুলগুলো উড়ছে। সে গম্ভীর মুখে বাহিরে তাকিয়ে আছে। অরিত্র দৃশ্যটা উপভোগ করল। আজ তার হৃদয়াক্ষীকে হৃদয়ের গভীর নয়ন দিয়ে দেখতে আরও স্নিগ্ধ লাগছে। নাকের ছোট্ট ডায়মন্ডের নাকফুলটা যেন সৌন্দর্যকে কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। অরিত্র বলল,

‘ আমাদের বিয়ে হয়েছে, একটা সুন্দর সম্পর্ক হয়েছে ঠিক, কিন্তু আমরা কি আদৌ সেই সম্পর্কের আওতায় এসেছি? আমরা তো এখনো একে অপরকে ঠিক মতো জানলামই না। তুমিই দেখো, আমার পুরো নামটাও হয়তো জানো না। আর আমি তোমাকে জানলেও পুরোপুরি জানি না।’

পূর্ণতা এবার গম্ভীরতা ঠেলে চিন্তা করল। আসলেই সে অরিত্রের পুরো নামটা জানে না। কখনো জানার প্রয়োজনবোধ করেনি। তবে এখন কৌতুহলী হয়ে উঠেছে। অরিত্র আবারও বলল,

‘ বৈবাহিক বন্ধনের কারণে না হলেও অন্তত বন্ধুত্বের কারণে সম্পর্কটা এগিয়ে যাক? একটা নতুন মায়ার পরাকাষ্ঠা গঠিত হোক? চলো না দুজন বন্ধুত্বের মাধ্যমে পরিচিত হই আবারও। আমি অরিত্র আহসান। আপনার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আপনি আমায় বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে কৃতার্থ করুন হে সুন্দরী তনয়া।’

অরিত্র হাত বাড়িয়ে দিল। পূর্ণতা অরিত্রের হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার মুখে লাজুক হাসি। এই হাসিটা অরিত্রের চোখ এড়ালো না। সম্পর্কটা হয়তো স্বাভাবিক হচ্ছে। পূর্ণতা হাতটা না ধরলেও তার অপ্রকাশিত সম্মতিতে প্রশান্তির হাসি হাসলো অরিত্র। আর পূর্ণতা ভাবছে,

‘ বন্ধুত্বতার ছদ্মবেশ ধরে হলেও আপনার প্রতিটি কথা যে প্রেমের পরাকাষ্ঠা গঠন করতে ব্যস্ত তা কি আপনি জানেন জনাব?’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে