হৃদয়াক্ষী পর্ব-০৭

0
1034

#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_ ০৭
#সারিফা_তাহরিম

‘ প্রেয়সীর সেই হাসিতেই যে আমার প্রাণটা যায় ভাসি,
মিষ্টি মুখের হাসিটা যে বড্ড ভালোবাসি।’

অরিত্রের আবৃত্তিতে ঘোর ভাঙলো পূর্ণতার। এতক্ষণ পরে খেয়াল হলো, সে অরিত্রের সাথে কথা বলছে। পরক্ষণেই ভাবলো এটা তার ভ্রম নয় তো! একবার কান থেকে ফোন নামিয়ে স্ক্রিনে চোখ বুলালো। না, এই মুহূর্তে সে অরিত্রের সাথেই কথা বলছে। কোনো ভ্রম নয়। কিছুক্ষণ আগে নিজের বলা ‘পূর্ণতারাণী খুব ভালো আছে। আপনি কেমন আছেন?’ কথাটা মনে পড়তেই খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ইশ! পূর্ণতা খুশির জোয়ারে ভেসে কিসব বলে ফেলেছে! এখন অরিত্র নিশ্চয়ই ভাবছে পূর্ণতা তার সাথে কথা বলতে পেরে অনেক খুশি হয়েছে৷ কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তো ভিন্ন। এই মুহূর্তে নিজের করা বোকামির জন্য নিজেরই কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। অরিত্রের কথায় পূর্ণতার ভাবনায় ছেদ পড়লো। অরিত্রের স্নিগ্ধ শীতল কণ্ঠে বলল,

‘ আজ পূর্ণতারাণীর মন ভীষণ ভালো মনে হচ্ছে। খুশি খুশি লাগছে খুব। তা এই খুশির কারণ কী আমায় বলা যাবে?’

পূর্ণতার অস্বস্তি আরেক ধাপ বাড়ল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। এই প্রথমবারের মতো অরিত্রের সাথে কথা বলার সময় তার রাগ হচ্ছে না। কেমন যেন অস্বস্তি ঘিরে ধরছে। এটা কী অরিত্রের ‘ পূর্ণতারাণী’ ডাকটা জন্য? হয়তো তাই। পূর্ণতা জড়ানো স্বরে বলল,

‘ না তেমন কিছু না। কোচিং এর পড়া তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে পেরেছি তো তাই খুশি লাগছে।’

কোনো রকমে মিথ্যা বলল পূর্ণতা। অরিত্র তা বুঝতে পারল ঠিকই, কিন্তু তাকে আর ঘাটাল না। কারণ অরিত্র জানে পূর্ণতা এখনো তার সাথে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি। এখনও পূর্ণতা তার সাথে মন খুলে সব কথা শেয়ার করবে না। অরিত্রও এই বিষয়ে জোরাজুরি করতে চায় না। সে চায় পূর্ণতা যখন পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে তখন নিজ থেকেই যেন অরিত্রের সাথে কথা শেয়ার করে। কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে নাক গলানো অরিত্রের স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। পূর্ণতা তার অর্ধাঙ্গিণী হওয়ায় তার উপর অরিত্রের অধিকার আছে ঠিক, কিন্তু সে চায় পূর্ণতা যেমন তাকে দূরে রেখেছে তেমনই একটা সময় যেন নিজেই অরিত্রকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। অরিত্র কথা ঘুরিয়ে বলল,

‘ তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?’

‘ এইতো মোটামুটি ভালোই।’

‘ পরীক্ষা কবে থেকে?’

‘ আগামী মাস থেকে।’

‘ ওহ আচ্ছা। তাহলে তো আরও বেশ কয়েকদিন সময় আছে হাতে। শুনেছি, তুমি নাকি এয়াত দিন এক করে পড়ছো। হাতে তো সময় আছে, একটু রিল্যাক্স হও। তুমি মা শা আল্লাহ ভালো স্টুডেন্ট। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ে নিলেই ভালো করতে পারবে। কিন্তু বেশি চাপ নিতে গেলে তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। নিজের একটু খেয়াল রাখবে প্লিজ।’

অরিত্রের কণ্ঠে অনুনয়। অবাক হলো পূর্ণতা। এই লোকটা তার খেয়াল রাখার জন্য তারই কাছে অনুনয় করছে! এই বিষয় নিয়ে তেমন না ঘাটালেও চাপা স্বরে বলল,

‘ এভাবে বলার কী আছে? আমি তো নিজের খেয়াল রাখছি।’

অরিত্র হালকা হেসে বলল,

‘ খেয়াল রাখাটা তো আমার দায়িত্ব। নিজের দায়িত্ব থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে। এই দূরত্বের কারণে তোমাকে নতুন করে বলতে হচ্ছে। নাহলে তোমাকে বলতে হতো না। আমার ব্যক্তিগত মানুষটার যত্ন আমি নিজেই করতাম।’

পূর্ণতা কিছু বলল না। চুপ করে রইলো। অন্যদিন রাগের উত্তাপে অরিত্রের কথা ঠিক মতো শুনতোই না। আজ চুপচাপ তার কথা শুনছে। মনোযোগ দিয়ে কথাটা শুনছে। আসলেই মানুষটা সুন্দর করে কথা বলে। কণ্ঠটা শান্ত, মনোমুগ্ধকর। নিরবতার রেশ ছিড়ল অরিত্রের দ্বিধান্বিত কণ্ঠের তোড়ে। সে বলল,

‘ পূর্ণতা, একটা কথা বলব? রাগ করবে না তো?’

পূর্ণতা অবাক হলো। এই প্রথমবারের মতো লোকটাকে দ্বিধায় পড়তে দেখছে। দেখছে বললে ভুল হবে, প্রথমবার শুনছে। সে নিচু স্বরে বলল,

‘ আমি অযথা রাগ করি না। আপনি বলুন।’

অরিত্র কৌতুকের স্বরে বলল,

‘ তাই নাকি ম্যাডাম? আপনি আরও রাগ করেন না! এই ব্যাপারটাও আমায় বিশ্বাস করতে হবে? আসলেই, মেয়েদের মন বোঝা খুবই কঠিন।’

একটু থেমে স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘ আমার মা আর তোমার মায়ের মধ্যে প্রায়সময় কথা হয়, সেটা নিশ্চয়ই অজানা নয়?’

‘ জ্বি, আমি জানি।’

‘ তাঁরা দুজন আলাপ করে ঠিক করেছেন আমাদেরকে বাহিরে কোথাও ঘুরে আসতে বলবেন। তাদের মতে, বিয়ের পর দেখা সাক্ষাৎ করতে হয়, টুকটাক ঘুরতে যেতে হয়। কিন্তু সেই হিসেবে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ই হয়নি, ঘুরতে যাওয়া দূরের ব্যাপার। গতকাল মা আমাকে বিষয়টি জানিয়েছেন। আমি স্পষ্ট কিছু জানাইনি তোমার মতামত নিব বলে। কিন্তু আজ জোর আদেশ দিয়েছেন, আগামীকাল শুক্রবারে যেন তোমাকে নিয়ে বের হই। ব্যাপারটা এতটুকু হলে তাও সামলানো যেত, কিন্তু তা হয়নি। তোমার আম্মুও ফোন করে বলেছেন যাতে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাই। এতকিছুর পরে যদি মানা করে দিই, তাহলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। উনারা দুজনই কষ্ট পাবেন। তবুও আমি তোমার মতামত জানতে চাইছি। তুমি যেতে না চাইলে আমি ভেবে দেখব কিভাবে উনাদের ম্যানেজ করা যায়। এখন তোমার মতামতটা জানতে চাই।’

পূর্ণতা স্তব্ধ হয়ে রইল। মা ভেতরে ভেতরে এতকিছু ভাবছেন সে তা একেবারেই আঁচ করতে পারেনি। কী বলবে বুঝতে পারল না সে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

‘ আমার একটু সময় লাগবে। একটু ভেবে তারপর জানাই?’

‘ সমস্যা নেই, তুমি সময় নাও। তবে আজ রাত বারোটার মধ্যে জানিয়ে দিও প্লিজ। আমার আবার পরিকল্পনা করতে হবে মাকে কী বলব। ‘

‘ আচ্ছা ঠিক আছে।’

‘ এবার তাহলে রাখি। আল্লাহ হাফেজ। ‘

‘ আল্লাহ হাফেজ। ‘

ফোন রেখে অরিত্র চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির হাসি হাসলো। এই প্রথমবার তার ‘হৃদয়াক্ষী’ তার সাথে এত শান্তভাবে কথা বলেছে ৷ তাও এত সময় ধরে। ভাবতেই শান্তি লাগছে। পরক্ষণেই অজুহাত কি দিবে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। সে জানে, পূর্ণতা তার সাথে ঘুরতে যাবে না। এই কথা ভাবাটাও যেন তার জন্য বিলাসিতা।

_____

পূর্ণতা খাবার নাড়াচাড়া করছে৷ খেতে পারছে না ঠিক মতো। আজ অনেকদিন পরে পরিবারের সাথে একসাথে খেতে বসেছে পূর্ণতা। এতদিন যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছিল তাদের মধ্যে। আজ সেই দেয়াল ভেঙে আবার সেই আনন্দ রশ্মি উপোভোগ করছে পূর্ণতা। মা কিছুক্ষণ পরপর মা তার প্লেটে এটা সেটা তুলে দিচ্ছেন। পূর্ণতা মন ভরে সেই দৃশ্য দেখছে। খাবার শেষে রান্নাঘরের টুকটাক কাজে মাকে সাহায্য করতে যায় পূর্ণতা। নাজিবা হাসান বললেন,

‘ তোমার কাজ করতে হবে না। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। অল্প কিছু কাজ আছে, এগুলো আমি করে ফেলতে পারব।’

পূর্ণতা কথা বাড়াল না। আসলেই সে ক্লান্ত। এখন শুলেই ঘুম নেমে আসবে চোখে। পূর্ণতা রুমের দিকে পা বাড়াতেই নাজিবা হাসান বললেন,

‘পূর্ণতা, শুনো আম্মু।’

‘ জ্বি মা বলো।’

‘ কাল অরিত্র আসবে। তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হবে। ছেলেটা কাজের চাপে দেখা করতে পারে না। কাল সময় করে নিয়েছে তোমাকে নিয়ে বেরুবে বলে। কাল শুক্রবার হলেও সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠো। কাল নীল রঙের জামদানি শাড়িটা পোড়ো কেমন? আমি শাড়ি পড়িয়ে, সাজিয়ে দিব তোমাকে।’

পূর্ণতা কিছু বলল না। মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেল। মায়ের আগ্রহ অনেক বেশি। কথাগুলো বলার সময় তাঁর মুখে চঞ্চলতা উপচে পড়ছিল। কাল ঘুরতে বের হলে বাবা মা দুজনই ভীষণ খুশি হবে। এসব ভাবছিল। খানিক বাদে আবার মনে হলো, সে যদি অরিত্রকে নিষেধ করে দেয়, তাহলে অরিত্র তা সরাসরি কাউকে জানাবে না। নিজের গড়া মিথ্যা অজুহাত দেখাবে। কিন্তু এতে পূর্ণতার মায়ের মনে তার ব্যাপারে একটু খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। অরিত্রকে বলার পরেও সে পূর্ণতাকে নিয়ে ঘুরতে বের নাহলে কিছুটা অবাধ্যতার ঘ্রাণ পাবেন হয়তো। কিন্তু আজ কেন জানি পূর্ণতার সেটা ভালো লাগছে না। মানুষটা তো আসলে তেমন না৷ তাহলে তার ব্যাপারে কেউ খারাপ কিছু ভাববে? অরিত্রকে নিয়ে কারো মনে খারাপ চিন্তা আসবে তা পূর্ণতার মোটেও ভালো লাগল না। সে ফোন নিয়ে অরিত্রকে মেসেজ পাঠাল,

‘ আমি যাব ঘুরতে। আমাকে নিতে আসবেন।’

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে