হৃদয়াক্ষী পর্ব-১৫

0
1000

#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_১৫
#সারিফা তাহরিম

‘যদি প্রশ্ন করেন, এখন কাউকে ভালোবাসি কিনা, তাহলে উত্তরটা হবে জানি না। হ্যাঁ আমি সত্যিই জানি না আমি ভালোবাসি কিনা। তবে আমার এই একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার সাথে অবিচ্ছেদ্য মায়ায় পড়ে গেছি। অনুরক্তির সম্পৃক্ততাই আমি আমাকে ভাবতে গেলেই তাকে মনে পড়ে।’

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো পূর্ণতা। ছোটকাল থেকে এই মনোভাব পোষণ করে আসছে সে। প্রেমে না জড়ানোর প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। মিফতা আর দিনা ছাড়া আর কেউ পূর্ণতার এই মনোভাব সম্পর্কে তেমন জানে না। মূলত পূর্ণতাই বলেনি কাউকে। আজ অনেকদিন পরে কথাগুলো আবারও কাউকে মন খুলে বলেছে। মানুষটা যে তার খুব আপন! তার সাথে মন খুলে কথা বলতেও এক প্রকার শান্তি কাজ করে। অরিত্র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব মনোযোগ দিয়ে পূর্ণতার কথা শুনলো। এই বিষয়টা অবশ্য নতুন না। অরিত্র সবসময়ই তার প্রতিটা কথা মনোযোগ সহকারে শুনে। তাই এই মানুষটার কাছে সব কথা বলে পূর্ণতা তৃপ্তি বোধ করে। এই মুহূর্তে পূর্ণতার কথা শুনে অরিত্রের মনেও প্রশান্তি বয়ে গেল। ভালো লাগার শীতলতা খানিকটা গ্রাস করল তাকে। চোখ বন্ধ করে প্রাণখোলা শ্বাস ফেলল। তারপর পূর্ণতার দিকে চেয়ে বলল,

‘আজকালকার ছেলে মেয়েরা উন্নত বা স্মার্টনেস বলতে প্রেমকে সমর্থন করাকেই বোঝে বলে মনে করতাম। কিন্তু তুমি আমার ধারণাটা পাল্টে দিলে। আসলে সবাই প্রেমে জড়ালেও এর পরিণতি কি হতে পারে তা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। যদ ভাবতো তাহলে এত শত প্রেমঘটিত আত্মহত্যা ঘটত না। বাবা মা কষ্ট পেতেন না। তাদের জীবনটা হয়তো আরও সুন্দর হতো। কিন্তু এত কিছু ভাবার সময় কোথায় তাদের? দিনের পরদিন কোনো কিছু বিবেচনা না করে প্রেম করতে থাকে। এক প্রেমে ব্যর্থ হলে তার বিরহ কাটাতে আরেকটা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এভাবেই কাটতে থাকে জীবন। এই যুগের মেয়ে হয়েও এতকিছু ভাবো, বিষয়টা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি ভাগ্যবান এমন একজনকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে।’

অরিত্র একটু থেমে হালকা হেসে বলল,

‘আজকাল বেশ সুন্দর গুছিয়ে কথা বলো দেখছি। কিছু রোমান্টিক কথাবার্তা। আমার তো ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে পূর্ণতা। তুমি কি রোমান্টিকতার ট্রেনিং নিচ্ছো নাকি?’

‘কেন আমি বুঝি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না?’

‘এক সময় যে রাগে ফোঁপাতে ফোঁপাতে কথাই বলতে পারত না সেই মেয়ে পরবর্তীতে অস্বস্তিতে মুড়িয়ে গেল। লজ্জা আর অস্বস্তিতে গলার স্বর বের হতে ভীষণ কষ্ট হতো। আর বর্তমানে সেই মেয়ে প্রেমময় কথা বলছে, নিজের অনুভূতিগুলোকে জানান দিচ্ছে, বিষয়টা কি আশ্চর্যজনক না?’

‘মোটেও আশ্চর্যজনক না। প্রথম প্রথম আপনার প্রতি একটা অযাচিত রাগ ছিল ঐজন্য কথা বলতে ইচ্ছে করত না। পরে নিজের বোধশক্তি ফিরে পেয়ে যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলাম তখন অস্বস্তি হতো আর পরবর্তীতে আপনার কথাবার্তায় লজ্জা পাওয়ার কারণে কথা কম বলতাম। সেই সময় একটা দূরত্ব ছিল। তাই জড়তা কাজ করতো। সময় গড়িয়ে যেতেই দূরত্বটা ঘুচে গেছে। তাই কোনো জড়তা ছাড়াই সব কথা বলতে পারি। বুঝলেন জনাব?’

‘বুঝতে পেরেছি আমার বেগম সাহেবা।’

দুজনেই হাসলো। পূর্ণতা অরিত্রের একটা বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। এই কাঁধটাতে মাথা রাখলে প্রশান্তির ছায়া জেঁকে বসে মনে। একটা অধিকারবোধ কাজ করে। এটা পূর্ণতার নিজস্ব অধিকার! কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পূর্ণতা বলল,

‘আচ্ছা আপনি তো এখনো আমার সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন না।’

‘কোন প্রশ্ন?’

‘আপনি আমাকে চিনেছেন কিভাবে, কবে দেখেছেন? আমি তো আগদের আগে আপনাকে দেখিনি। অবশ্যই মা ছবি দিয়ে গিয়েছিলেন, আমি ইচ্ছে করেই দেখিনি। কিন্তু সরাসরি আপনার সাথে তো দেখা হয়নি। তাহলে কবে দেখেছিলেন আমায়? এই প্রশ্নগুলো আপনাকে আগেও করেছি উত্তর দেননি।’

‘সেই এক বিস্তর কাহিনী। এর আগে যখন প্রশ্ন করেছ তখন তোমার মনের অনুভূতি নিয়ে সংশয়ে ছিলাম তুমি কি না কি ভেবে বসো, তাই বলিনি।’

‘এখন তো নিশ্চয়ই কোনো সংশয় নেই। তাহলে এখন বলুন।’

অরিত্র মুচকি হেসে দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বলা শুরু করল,

‘ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের। আমি তখন মাস্টার্স কমপ্লিট করে জবে ঢুকেছি। সেই সুসংবাদটা দেওয়ার জন্য কলেজের সকল স্যারদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কলেজের অফিস রুমে সবাই ছিল কিন্তু তোমার বাবা ছিলেন না। আমি আবার উনাকে খুব পছন্দ করতাম। তাই স্যার অর্থাৎ বাবার সাথে দেখা করা ছাড়া যাব না ভেবে ছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেছিলাম। পরে জানতে পারি, স্যার ডিসি অফিসের কাজে ওখানে গিয়েছেন। কখন আসবেন ঠিক বলতে পারছিলেন না কেউ। তাই হতাশ হয়ে ফিরে আসছিলাম। ভেবেছিলাম পরেরদিন এসে দেখা করে যাব। তাই নিচে নেমে এলাম।

তখন ছিল গ্রীষ্মের কাঠফাঁটা গরম। কিন্তু আকস্মিক চারপাশ আঁধার হয়ে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল চারপাশে। সারাদিন বৃষ্টির কোনো আলামত ছিল না বলে সাথে করে ছাতাও নেইনি সেদিন। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। কিন্তু সেই যে বৃষ্টি! থামার কোনো নামই ছিল না। খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম। সারাদিন খাটাখাটুনির পরে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। কিন্তু পরক্ষণের ঘটনায় মনে হলো আল্লাহ বোধহয় এক অদ্ভুত অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ করানোর জন্য আমায় অপেক্ষা করাচ্ছিলেন। মাঠের বাম পাশের রাস্তা থেকে ছাতা হাতে একটা মেয়েকে খুব সাবধানে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছিল। তার পরণে ছিল লাল সেলোয়ার কামিজ। মাথায় ওড়না দিয়ে ছাতাটা নিয়ে এগিয়ে আসছিল সে। ঝুম বৃষ্টির দাপটে ছাতাটা ধরে রাখা সেই শুকনো মেয়েটির পক্ষে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ভীষণ। কিন্তু সে থেমে না থেকে যত দ্রুত সম্ভব কলেজের দিকে এগিয়ে আসছিল। হ্যাঁ, মেয়েটা আর কেউ না। আমার হৃদয়াক্ষী। মেয়েটাকে দেখে সারাদিনের ক্লান্তি নিবারণ হয়ে অদ্ভুত শিহরণ হয়েছিল। লাল ওড়নায় জড়িয়ে থাকা চিন্তার রেখা টানা আধভেজা শুভ্র মুখটুকু দেখে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়েছিলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। একজন ব্যক্তি যে মেয়েটাকে এত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সেটা সে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। সে কলেজ ভবনে ঢুকে ছাতা বন্ধ করে তড়িৎ গতিতে আমাকে এড়িয়ে দপ্তরি খালার কাছে যেতেই আমার ধ্যান ভাঙলো। নিজের কর্মকাণ্ডে নিজে অবাক হয়ে খানিকটা শাসিয়েছিলাম নিজেকে। কিন্তু তেমন একটা লাভ হয়নি। আবারও মেয়েটাকে দেখার জন্য অবাধ্য চোখজোড়া পিছু ফিরে চাইলো। মেয়েটা ভীষণ চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘খালা লেকচারার মঈনুল হাসান স্যারকে দেখেছেন? কোথায় আছেন উনি?’

‘না উনারে তো দেহি নাই। তয় মনে অয় দুই তালার স্যারেগো রুমে থাইকতে পারে। আফনে কেডা?’

মেয়েটা খালার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে দৌঁড়ে দ্বিতীয় তলার দিকে পা বাড়াল। আমারও কৌতুহলের মাত্রা বাড়ল। মঈনুল হাসান স্যারের সাথে মেয়েটার এত জরুরি কাজ কিসের? কে হয় সে? এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? রহস্য উদঘাটনের উদ্দেশ্যে আমিও তার পিছু পিছু দ্বিতীয় তলায় গেলাম। মেয়েটা অনুমতি চেয়ে অফিস রুমে ঢুকল। আনার কি হয়েছিল জানি না। কারও কথা লুকিয়ে শোনার অভ্যাস আমার কোনো কালেই ছিল না। কিন্তু সেদিন হুট করেই বাচ্চামি করে বসলাম। আমি অফিস রুমে না ঢুকে এক পাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম কথা শোনার উদ্দেশ্যে। মেয়েটা ক্লাসে ঢোকার পর সালাম দিতেই একজন স্যার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,

‘আরে তুমি পূর্ণতা না? আমাদের মঈনুল স্যারের বড় মেয়ে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন মা? কিছু হয়েছে?’

এবার আবারও মেয়েটার গলা শোনা গেল। সে বলল,

‘আঙ্কেল সকাল থেকে আমার বোনের ভীষণ জ্বর উঠেছে। স্কুল থেকে এসেই বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে মা হুট করে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছেন। প্রেশারটা মেপে দেখলাম, অনেক হাই। আম্মুর নাকি খারাপ লাগছে। বাবাকে ফোন করছি কিন্তু বাবার ফোন বন্ধ। এই ঝড়ের মুহূর্তে কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না, আমারও আশেপাশে কোনো ফার্মেসি চেনা নেই। পাশের বাসায় শুধু একজন দাদু আছেন বাকিরা বাড়িতেই নেই। সেই দাদুকে মায়ের কাছে রেখে আমি এখানে এসেছি বাবার খোঁজে। আমার বাবা কোথায় আঙ্কেল?’

কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটা কান্না করে দেয়। খুব মায়া হচ্ছিল মেয়েটার জন্য। তখনই একজন ম্যাডাম বললেন,

‘তোমার বাবা তো ডিসি অফিসে গিয়েছেন। দাঁড়াও আমরা ডিসি অফিসে যোগাযোগ করছি। তুমি কান্না কোরো না।’

কিছুক্ষণ মেয়েটার হালকা হালকা কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। খানিকক্ষন পর সেই ম্যাডাম বললেন,

‘তোমার বাবা মিটিং এ ছিলেন আর ফোনের চার্জ শেষ হওয়ায় যোগাযোগ করতে পারেননি। আমি বিষয়টি জানানোতে তিনি এখনই আসছেন বলে জানিয়েছেন। তুমি চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। চলো আমি তোমায় বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। দপ্তরী রাসেলকে দিয়ে একজন ডাক্তার ডাকিয়ে নিলে হবে।’

ম্যাডামের কথা শুনে আমি নিজেও আশ্বস্ত হয়েছিলাম। ছোট মেয়েটার মনে কত ঝড় চলছিল কে জানে! আমার নিজেরই তো ঘটনাটা শুনে বেশ অস্থির লাগছিল। আমি এবার ধীর পায়ে নিচে নেমে আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। যেহেতু ম্যাডাম আর সেই মেয়েটি আমাকে দ্বিতীয় তলায় খেয়াল না করে। মেয়েটা বের হওয়ার সময় কান্না না করলেও হালকা হালকা ফোপাচ্ছিল। মূলত কান্নার রেশ ছিল ওটা। পারলে আমি নিজেই তাকে সাহায্য করতে যেতাম। কিন্তু এমন অপরিচিত কারো কাছ থেকে সাহায্য তো নিবে না বরং ভয় পেয়ে যেতে পারে। তাই আর যাইনি। আমি আরেকটাবারের মতো মেয়েটার চেহারা দেখতে পেলাম। কান্না করার কারণে টানা চোখগুলো লাল হয়ে গিয়েছিল। পুরো মুখ আর নাক হালকা ফুলে একদম লাল হয়ে উঠেছিল। শুভ্র রঙের মুখ আর লাল রঙের ছাপ, দুই মিলিয়ে পুরো বউ বউ লাগছিল তাকে।

অন্যকেউ হয়তো প্রেমের প্রস্তাব দিত বা একটু কথা বলতে চাইতো, কিন্তু আমার মনে কেন জানি তাকে আমার অর্ধাঙ্গিনী করার ইচ্ছে জেঁকে বসল। আল্লাহর কাছে আমি কখনো তাকে আমার প্রেমিকা হিসেবে চাইনি, সবসময় আমার বউ হিসেবে চেয়েছিলাম। আর সবশেষে আমি তাকে পেয়েছি। প্রথমবারই একবার খুব গভীরভাবে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। একদম হৃদয়ের আঁখি দিয়ে। তাই তো মেয়েটি আমার ‘হৃদয়াক্ষী’।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে