হৃদয়াক্ষী পর্ব-১৪

0
995

#হৃদয়াক্ষী
#পর্ব_১৪
#সারিফা_তাহরিম

জীবন স্রোতে পাল তুলে সময় বইতে থাকে নিজ গতিতে। সুখ দুঃখের নানা মহরাকে সাক্ষী করে নিয়ে চলে বহুদূর। চোখের পলকেই কেটে যেতে থাকে অজস্র মুহূর্ত। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে ছয় মাস। পূর্ণতার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা ইতি টেনেছে গত দুদিন আগে। এতদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারল সে। সময়ের সাথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। পূর্ণতা আর অরিত্রের সম্পর্কেরও। এই মানুষটার প্রতি পূর্ণতার বিরক্তি নয়, বরং প্রেমাসক্তি কাজ করে। চোখ বুজলেই মুহূর্তের মধ্যে অরিত্রের ছবি আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রংতুলিরা। অরিত্রের সাথে সময় কাটাতে ভালোই লাগে তার। আজও অরিত্র দেখা করার কথা বলতেই পূর্ণতা নিমিষেই রাজি হয়ে গেল। তার বৈধ প্রেমিকের সাথে প্রেম করতে ভালোই লাগে বেশ। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এগিয়ে একটা পার্কে এলো অরিত্র আর পূর্ণতা। চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতীরা বসে গল্প করছে। কয়েকটা বন্ধুমহলের দল মিলে পিকনিক করছে। পরিবেশটা মনোরম লাগছে। চারপাশে শীতের রাজত্ব চলছে বিধায় পূর্ণতা গায়ে একটা পাতলা শাল জড়িয়ে আছে। আর অরিত্রের গায়ে কালো জ্যাকেট৷ পূর্ণতা আড়চোখে বারবার অরিত্রের দিকে তাকাচ্ছে। জ্যাকেটের হাতা হালকা উঠিয়ে রাখায় অরিত্রের ঘড়ি পড়া লোমশ হাত খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ঈর্ষা হচ্ছে পূর্ণতার। যখন তখন উনাকে এত সুন্দর দেখাতে হবে কেন! পূর্ণতার দৃষ্টি পরখ করতেই অরিত্র চাপা হেসে বলল,

‘এভাবে দেখো না সুন্দরী, প্রেমে পড়ে যাবে।’

পূর্ণতা থতমত খেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর বলল,

‘মোটেও না। আমি আপনার দিকে তাকাইনি। আমি তো এমনি ঐদিকের রাস্তাটা দেখছিলাম।’

অরিত্র হাসতে হাসতে বলল,

‘চোর ধরা পড়লে এমনই বলে।’

পূর্ণতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

‘কী! আপনি আমাকে চোর বললেন? আমি চুরি করলাম কবে?’

‘এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার মতো নিরীহ পুরুষটার দিকে কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছো! এটা তো এক প্রকার চুরি-ই।’

‘আপনি আরও নিরীহ পুরুষ! আর কতকিছু শুনতে হবে এই দুনিয়ায়! আর তাছাড়া আমি তাকিয়ে থাকলে এটা মোটেও চুরি হবে না। আমার অধিকার আছে তাকিয়ে থাকার।’

অরিত্র পূর্ণতার কাছ ঘেষে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ তাই নাকি? মিসেস অরিত্র আহসান তবে আজকাল পড়াশোনার হিসাব নিকাশের বাহিরে অধিকারের হিসাব নিকাশও রাখা শুরু করেছে! ভালোই পরিবর্তন দেখছি। এই তুমি আমার প্রেমে ট্রেমে পড়ে গেলে না তো?’

পূর্ণতা মুখ ঘুরিয়ে বলল,

‘বললেই হলো! আমি ওতো সহজে প্রেমে পড়ব না। আর পড়লেও বা কী? আপনার প্রেমে পড়ার অধিকারও আমার আছে। আর এই অধিকার শুধুমাত্র আমারই।’

এবার অরিত্র শব্দ করে হেসে ফেলল। মেয়েটা এখন অস্বস্তির গণ্ডি পেরিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। প্রতিটি কথায় চঞ্চলতামিশ্রিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। সামনে একজন মধ্যবয়স্ক লোককে হাওয়াই মিঠাই ফেরি করতে দেখে অরিত্র বলল,

‘হাওয়ায় মিঠাই খাবে?’

পূর্ণতার চেহারায় উৎফুল্লতা খেলে গেল। আহ্লাদী হয়ে অরিত্রের কাছ ঘেষে তার এক হাত জড়িয়ে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে মাথা নাড়ল। অরিত্র সাদা আর গোলাপি রঙের দুটো হাওয়াই মিঠাই কিনে পূর্ণতার হাতে ধরিয়ে দিল। পূর্ণতা বলল,

‘আপনি সাদাটা খাবেন নাকি গোলাপিটা?’

‘আমি এত মিষ্টি জিনিস খেতে পারি না। নেহাৎ তোমার ভীষণ পছন্দের বলে নিয়ে দিয়েছি নাহলে নিয়ে দিতাম না। এগুলো খাওয়া ভালো না। তবুও তোমার মতো কিছু বাচ্চার জন্য নিতেই হয়।’

পূর্ণতা পাত্তা দিল না অরিত্রের কথায়। স্বচ্ছ প্যাকেটটা খুলে খাওয়া শুরু করল। সব ধরনের মিষ্টি জিনিসের প্রতি খুব বেশি লোভ তার। হাওয়াই মিঠাই হলে তো কথাই নেই৷ একটা শেষ হতেই অরিত্রের দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। অরিত্র নিজ দায়িত্বে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,

‘সামনে একটা লেক আছে। আর ওদিকে একটা বাগানের মতো করে ছোট্ট টিলা আছে। কোথায় যাবে?’

‘টিলাটাতেই চলুন। একটু পাহাড়ে চড়ার অনুভূতি আসবে।’

‘তোমার কি পাহাড় পছন্দ?’

‘হ্যাঁ। পাহাড় আমার ভীষণ পছন্দ। পাহাড় থেকে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করা যায়। সবুজ স্নিগ্ধ সেই অনুভূতি।’

‘তাহলে চলো ওখানে যাই। রিসিপশনের পর আমাদের প্রথম ভ্রমণে পাহাড়ি এলাকায়ই যাব। কোথায় যাবে সেটা ঠিক করার দায়িত্বটা তোমায় দিলাম।’

এবার পূর্ণতা খানিকটা লজ্জা পেল। কোনো কথা বলল না সে। দুজনে বাগানের মতো দেখতে গাছপালায় ঘেরা টিলাটাতে উঠলো। এখান থেকে চারপাশে খুব সুন্দর দেখা যায়। দূর দূরান্ত পর্যন্ত সবুজের সমারোহ। একপাশ থেকে নিচের লেকটি দেখা যাচ্ছে। একটা ইউক্যালিপটাস গাছের ছায়াতলে বসল দুজন। পূর্ণতা হাতে থাকা দ্বিতীয় হাওয়াই মিঠাইটি শেষ করল। অরিত্র বলল,

‘পূর্ণতা, একটা সত্য কথা বলবে?’

‘অবশ্যই। আপনি প্রশ্ন করুন।’

‘তুমি আগে কাউকে ভালোবাসোনি?’

‘এই প্রশ্নের উত্তর তো বহু আগেই দিয়েছি। আমি আসলেই কাউকে ভালোবাসিনি।’

‘হ্যাঁ দিয়েছ ঠিক। কিন্তু কারণটা অজানা। তাই আবারও জিজ্ঞেস করলাম। তোমাদের বয়সের মধ্যে প্রেম হওয়াটা অতি স্বাভাবিক। প্রেম আসতেই পারে, প্রেমে জড়াতেই পারে। কিন্তু তুমি কারো প্রেমে না পড়া বা কাউকে ভালো না বাসার কারণটা কী? প্রেমবিদ্বেষী নাকি?’

পূর্ণতা দুহাতে ভাঁজ করা হাটুজোড়া জড়িয়ে বেশ মনোযোগী আর দায়িত্বশীল বক্তার ভঙ্গিতে বলা শুরু করল,

‘আসলে প্রেম বা ভালোবাসা ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে আমরা যতটা সহজভাবে দেখি, ব্যাপারটা ততটা সহজ না। ‘ভালোবাসা হুট করে হয়ে যায়’ এমন চিরচারিত কথাটা আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ ভুল। ভালোবাসা হুট করে আসার কোনো বিষয় না। এর জন্য সময় লাগে, বোঝার ক্ষমতা লাগে আর ভালোবাসার মনোভাব লাগে। হুট করেই যেই ভালো লাগাটা কাজ করে সেটা আকর্ষণ বা মোহ ছাড়া আর কিছুই না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ভালো লাগাটা থেকেই ভালোবাসার জন্ম হয়। কিন্তু তাই বলে এই ভালো লাগাটা ভালোবাসা না। এই যে এখনকার যুগের কথাই ধরুন না। কিশোর কিশোরী, যুবক যুবতী সব ছেলে মেয়েরাই উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে প্রেমে পড়ছে। যাকে বলা হয় ক্রাশ। এই ক্রাশটা নিছক মোহ ছাড়া আর কিছুই না। যার কারণে এই মোহ কিছু সময় পর কেটে যায়।

মায়া জিনিসটা অনেকটা চোরাবালির মতো। যতই এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা হয় ততই এটা নিজের বেড়াজালে মানুষকে ঝাপটে ধরতে থাকে। আর সেই মায়া যদি অনুরক্তির অংশ হয়ে থাকে তাহলে তো তা থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব প্রায়।

এই মায়ার জন্য ঐ মানুষটার সান্নিধ্য, সময় সেই সাথে ভালোবাসার দৃষ্টি থাকতে হয়। যদি কেউ ঠিক করেই রাখে যে সে কখনো কাউকে ভালোবাসবে না বা কাউকে দেখে যদি তার প্রতি ভালো লাগাটা প্রেমের ভালো লাগা না হয়ে থাকে তাহলে ভালোবাসাটা কি আদৌ সম্ভব? এই ক্ষেত্রে অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার কাজ করে। যারা এই ধরনের মায়াকে সহজেই প্রশ্রয় দিয়ে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে ভালোবাসতে খুব একটা সময় লাগে না। কিন্তু আমি কখনো সেই মানসিকতা রাখিনি আর না রেখেছি কোনো মায়া। এর পেছনেও আরেকটা কারণ আছে।’

একটু থামল পূর্ণতা। ছোট থেকে গুছিয়ে রাখা অসংখ্য কথাকে আজ প্রকাশ করবে সে। একটু জিরিয়ে আবার বলা শুরু করল,

‘বাবা মা অনেক কষ্ট করে আমাদের লালন পালন করে বড় করেন। কখনো নিজেদের কষ্ট বুঝতে দেন না। তাঁরা সন্তানের কল্যাণের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করেন। অথচ অনেক সন্তানেরা বড় হয়ে সেই কষ্টের মূল্য দেয় না। সেই সময় বাবা মায়েরা নিজেদের মনে যেমন কষ্ট পান, সমাজের অনেক কটু কথাও শুনতে হয়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো আরও বেশি। আমাদের কথা ই ধরুন। আমার বাবা মায়ের দুজন মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। এই নিয়ে সমাজের নানান লোকের নানান কথা। আমার বাবা মায়ের আফসোস না হলেও তাদের যেন খুব কষ্ট হয়। ছোট থেকেই শুনতাম সবাই বাবা মাকে বলছে, দুই মেয়ে দিয়ে তো জীবন যাবে না। মেয়েরা তো কখনো কামাই রুজি করে খাওয়াতে পারবে না। যত পড়ালেখা করুক না কেন সেই তো পরের বাড়ির চুলায় কাঠি ঘোরাতে হবে। একটা ছেলে প্রয়োজন। ছেলে থাকলে আর কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু আমার বাবা মা সবসময় বলতেন, আমাদের মেয়েরাই আমাদের সব। আমাদের দুই মেয়েরাই একদিন আমাদের সুখ শান্তির কারণ হবে। বাবা মা আমার ছোটবেলা থেকেই খুব কষ্ট করতেন। দুই বোনকে খুব আদরে মানুষ করেছেন।

এই পৃথিবীতে আমাদের বাবা মার চেয়ে বেশি কল্যাণকামী কেউ হয় না। মা নিজের জীবন বাজি রেখে সন্তানকে জন্ম দেন, বাবা রাত দিন খেটে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে সন্তানদের বড় করেন। তাঁরা তো কখনোই চাইবেন না যে তাঁদের সন্তানেরা অমঙ্গল হোক। সন্তানরা যেন বিপথে না যায়, তাই তো তাঁরা প্রেম থেকে দূরে রাখতে চান। অনেক ছেলে মেয়েই তো ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে অনিষ্ট ডেকে আনে। দেখা যায়, একটা ভুল মানুষের জন্য তারা নিজের বাবা মাকে ছাড়তে পর্যন্ত বাধ্য হয়। এই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি হৃদয়বিদারক। এজন্যই বাবা মা সন্তানদের কল্যাণার্থে এসব প্রেমের সম্পর্ক থেকে দূরে রাখতে চান। আমার বাবা মায়ের ক্ষেত্রেও ভিন্ন হয়নি।

হ্যাঁ আমার ক্ষেত্রে হয়তো একটু বেশিই চাওয়া ছিল। আমার বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই আমার বিয়ে করতে হতো। তাঁরা যে জোর করতেন এমন না। তবুও আমি যদি বাবার পছন্দের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য কাউকে পছন্দ করে থাকি তাহলে বাবা হয়তো মনে মনে খুব কষ্ট পেতেন। এজন্য ছোট থেকেই আমার মাথায় এসব প্রেম ভালোবাসার প্রতি ঘোর বিরোধিতা জন্মাতে থাকে। আমাদের সকল আবদার রাখতে যাঁরা সারাজীবন বিলিয়ে দেন, তাঁদের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করার সামান্য চাওয়া পূরণ করতে পারব না? আর বাবা মা তো কখনো খারাপ চাইবেন না। নিশ্চয়ই ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিবেন। এসব নিয়ে ছোট থেকেই মাইন্ড সেট ছিল যে আমি প্রেম করব না।

এছাড়া আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমি যদি কাউকে ভালোবেসেও ফেলতাম, আর তাকে যদি আমার বাবা মা মেনে না নিতেন তখন আমি নিজেই বিপর্যয়ে পড়ে যেতাম। আমার বাবা মাকে আমি কখনোই কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না। আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম যেন আমি বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছি, এমন দিন যেন কখনো না দেখান। এই ক্ষেত্রে আমি বাবা মার কথা চিন্তা করে হয়তো ছেলেটাকে ছাড়ার কথা ভাবতাম। কিন্তু সে যদি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে থাকতো, তাহলে কি সে বিনাদোষে শাস্তি পেত না? তার সাথেও প্রতারণা করা হতো। কারও মন ভেঙে আমি নিজেও কখনো সুখী হতে পারতাম। আর ধর্মীয় বিষয় তো রয়েছেই। বিয়ে পূর্ববর্তী প্রেম হারাম। তাই সবগুলো কারণ মিলিয়ে আমি সবসময় লাভ আফটার ম্যারেজে বিশ্বাসী।

যদি প্রশ্ন করেন, এখন কাউকে ভালোবাসি কিনা, তাহলে উত্তরটা হবে জানি না। হ্যাঁ আমি সত্যিই জানি না আমি ভালোবাসি কিনা। তবে আমার এই একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার সাথে অবিচ্ছেদ্য মায়ায় পড়ে গেছি। অনুরক্তির সম্পৃক্ততাই আমি আমাকে ভাবতে গেলেই তাকে মনে পড়ে।’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে