সিঁদুর রাঙা মেঘ পর্ব-০২

0
1655

#সিঁদুর_রাঙা_মেঘ
পর্ব_২
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

—” আপা রান্না কি বসাবেন না?”

চিত্রাদের বাসার কাজের মেয়ে টুম্পার কথায় ধ্যান ভাঙ্গে। এতক্ষণ সে যে হারিয়ে গেছিলো ডাইরির পাতায় । চোখের সামনে যেন এ মানুষ দুটোকে দেখতে ও অনুভব করতে পাচ্ছিল সে। সন্ধ্যা প্রায় হয়েই এলো। চিত্রার সেদিকে কোনো খেয়ালী ছিল না ।
বাড়ির সব কাজ টুম্পা করলেও চিত্রা রান্নার কাজ করত। কিন্তু এখন এ মুহূর্তে চিত্রা ডায়রিটা ছেড়ে উঠতে চাইলো না। ইউসুফ-কুহু একে অপরকে ভালবেসে থাকলে আলাদা কেন? আর কুহু নিজের ভালবাসার মানুষটির বিয়ে এটেন্ড কিভাবে করবে? ভেবে পাচ্ছে না। এখন তার এক কাজ আগে এটি শেষ করবে তারপর অন্য কিছু। চিত্রা ডায়রিটা হালকা বন্ধ করে বলল,,

—” টুম্পা? আজ তুই রেঁধে ফেল বনু। আমার ভাল লাগছে না।”

টুম্পা অবাক হলো।সে ছোট বেলা থেকেই তাদের সাথে।কখনই রান্না করতে দেয়নি চিত্রা তাকে। সে যতই তার শরীর খারাপ থাকতো না কেন। আজ যে তাকে রান্না করতে বলছে? অবিশ্বাস্য।টুম্পা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ছোট করে বলল,,

—” আইচ্ছা আপা!”

চিত্রা আবার ডায়রিটা খুলে পড়তে শুরু করলো।সে এ মুহূর্তে অন্যদিকে ধ্যান দিতেই চায় না।

ঘন্টা দুয়েকের মাঝে সুমি তার দুই মেয়েকে নিয়ে পৌছে যায় তার ভাইয়ের বাড়ি। আদরের ভাতিজা ইউসুফের বিদেশ থেকেই ফিরেছে কিছুদিন হলো। আসতেই বিয়েও ঠিক হয়ে গেল হুট করে। বিয়ে উপলক্ষেই আসা তাদের। তারা দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ির সামনে। কুহু বাড়ির নেমপ্লেট টার দিকে তাকালো। সাদা পাথরে কালো কালিতে লিখা “বৃষ্টি বিলাস”।

চিত্রা চমকে উঠলো ” বৃষ্টি বিলাস ” নামটি শুনে। তার মানে এই বাড়ির অতীতে লুকিয়ে আছে এ দু মানব-মানবীর ভালবাসার তাজমহল?চিত্রার মনে আরো কৌতূহল সৃষ্টি হলো ডায়রিটা পড়ার। চিত্রা আবার পড়তে শুরু করলো….

কুহু তার মার সাথে বাড়ির মুল ফটকে পা রাখতেই মিহু বলল,,

—” মা দেখো মামা বাড়ি কত সুন্দর হইছে আগে থেকে!”

সুমি হাসলো ছোট মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,

—” হে বাড়িটি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ”

তারপর তার বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। বড় হল রুমটিতে অনেক সুন্দর সাজানো গোছানো। ঠিক মাঝা-মাঝিতে আছে সুন্দর কারুকাজ করা সিড়ি যা উপরের উঠে গেছে। কুহু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো চারিদিক। সত্যি সব কিছু পরিবর্তন করেছেন তার মামারা।

—“ও মা তোরা এসে গেছিস? মা মা দেখে যান আপনার কলিজার ধন এসে গেছে।”

মাঝ বয়সী এক মহিলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে চেঁচিয়ে ডাকলেন সবাইকে। সুমি এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেলেন তাকে,,

—” কেমন আছো ছোট ভাবি? ”

আয়শা হাসি মুখে জবাব দিলেন,,

—“আলহামদুলিল্লাহ ভাল। তা তোমরা কেমন আছো? আরে মিহু না? কত বড় হয়ে গেছে দেখ! আরে কুহু
ওখানে দাঁড়িয়ে কেন এখানে আয়।”

কুহু হেসে সামনে গেলো,,

—” কেমন আছো ছোট মামনী?

—“ভাল আছি আমি। দাঁড়িয়ে আছিস কেন বস এখানে।

কুহু বসলো। তখনি মিহু এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে বলল,,

—” ছোট মামনী নুশরা-বুশরা কই? ”

আয়শা হেসে বলল,,

—” এরা দুটা হয়েছে বাদরের মতো সারাদিন ছোটা ছুটি করে ঘুড়ে বেড়ায়। দেখ উপরে আছে হয়তো। যা!”

মিহু ছুটে উপরে চলে গেল। সুমি বলল,,

—” বাসায় কেউ নাই নাকি ছোট ভাবি? বড় ভাবি, মিশু তারা কই?”

আয়শা কাজের মেয়েকে চা দিতে বলে সুমিকে বলল,,

—” শপিং করতে বেড়িয়েছে এঙ্গেজমেন্টের বেশীদিন বাকি নেই কিনা?তার পরপরই বিয়ে। আর মা মনে হয় ঘরে আছেন।”

—” নানু ভাই যে আমার? কখন এলি তুই। নানুমাকে বুঝি মনে পড়ে নাই তোর?

তাদের কথার মাঝেই উপস্থিত হয় নাহার।অভিমানের সুরে কথাটুকু বলে উঠেন তিনি কুহুকে উদ্দেশ্য করে। নাতনিটি একে বারে তার রূপ রপ্ত করেছে যেন। লম্বা ঘন চুল। সাদা টকটকে ফর্সা গায়ের রং।ডান গালের থুতনির তিলটাও পেয়েছে তার মতোই। ছোট থেকেই এই একটি কারণে কুহুকে তিনি সব থেকে বেশি আদর করতেন। কুুহু তার নানুমাকে ঝাঁপটে ধরে বলল,,

—” কেমন আছো নানুমা! এতই যদি মনে পড়তো গেলে না কেন আমাদের এখানে? আমার এখানে না হয় আসতে মানা, কিন্তু তুমিতো যেতেই পারতে?”

অভিমান স্পট কুহুর কন্ঠেও। নাহার কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,

—” কে বলছে তোর এখানে আসতে মানা? এটা কি তোর বাড়ি না? ”

কুহু প্রতিউত্তর কিছু বলল না। যতই বলুক আসতে মানা নেই? কিন্তু তার এ বাড়িটিতে যে আসতেই ইচ্ছে করে না। শুধু একটি মানুষের জন্যই। সে মানুষটি যে তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। তার সাথে এ বাসার কিছু মানুষ যে তাকে বাঁঁকা চোখে দেখে। তা ছোট থাকতেই বুঝে ফেলে কুহু। কুহুর চোখ আবার ভিজে উঠলো। সবার অগোচরে চোখের জল টুকু মুছে নিলো। তখনি শুনা গেলো বাহিরে কিছু মানুষের কন্ঠ। যারা এদিকেই আসচ্ছে। তাদের মাঝে ভেসে আসচ্ছে একটি পরিচিত কন্ঠ। কুহুর বুঝতে বাকি নেই তার পরীক্ষা এখন থেকেই শুরু। হে পরীক্ষা! এই কঠিন মানুষটির সামনে নিজেকে শক্ত রাখার পরীক্ষা। কিন্তু কুহু কোনো মতেই এ মুহূর্তে ইউসুফের মুখামুখি হতেই চায় না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,,

—” ছোট মামনী আমার রুমটি?”

আয়শা হেসে বলল,

—” আগেরটাই!”

কুহু আর এক সেকেন্ড দাঁড়ালো। কুহু আগে তিনটি বছর কাঁটিয়েছে এই বৃষ্টি বিলাসে। তখন তার নির্দিষ্ট একটা রুম দিয়েছিল মহসিন। বড়ই আদরের ভাগ্নি ছিল তার। বলেছিল সে যতদিন এ বাড়িতে থাকবে বা পরে আসবে এ রুমটি তারই থাকবে।দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ফেললো কুহু। এদিকে ইউসুফ তার মা মাইশার সাথে কোনো কিছু নিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে বলতে বাসায় ঢুকলো। সোফায় সুমিকে বসে থাকতে দেখে চুপ করে গেল। তারপর ভাল-মন্দ জিগ্যেস করে উপরে চলে গেল সে। তখন আয়শা জিগ্যেস করলো,,

—“বড়পু কি হলো ইউসুফ চেঁচাচ্ছিল কেন?”

মাইশা শাড়ির আঁচলে কঁপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,,

—” আর বলিস না! মেয়ের বাবা এত শখ করে একটা সেরবানি কিনে দিতে চাইলো তাকে। কিন্তু তিনি মুখের উপর না করে বসলেন। তাও আবার বলেও দিল আমি এসব রং চং মাখা জামা কাপড় পড়বই না। জানিস বেয়াই সাহেবের মুখটা ছোট হয়ে গেছিল মুহূর্তেই।”

সুমি বলল,,

—” ইউসুফতো এমনি বড় ভাবি যা পছন্দ না তার, তা সে মুখের উপর বলতে দু মিনিট সময় নেয় না।”

মাইশা সুমির পাশে বসে বলল,,

—” হে ঠিক বলেছো! তা তুমি কেমন আছো? ভাবিদের ভুলেই গেছো একদম!”

সুমি হেসে বলল,,

—“তেমন কিছু না ভাবি। সময় পাচ্ছিলাম না একদম!”

নাহার বলল,,

—” ঠিক আছে এবার এসেছিস সহজে ছাড়ছি না তোকে।”

সুমি হেসে সম্মিত জানালো।

কুহু ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মিশুকে দেখতে পায় খাটে বসে পা নাড়াচ্ছে। কুহুকে দেখেই জড়িয়ে ধরে সে বলে,,

—” বড্ড বেইমান হয়ে গেছিসরে তুই। ভুলেই গেছিস একদম আমাকে?”

কুহু মলিন হাসলো। বলল,,

–” না মিশুপি ভুলি নাই তোমাকে। লজ্জায় যোগাযোগ করতে পারিনি।”

–” পুড়ানো কথা ভুলে যা কুহু। দেখ ভাইয়াও মুভ ওন করছে। তুইও করে ফেল। এসব মনে রেখে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই পাবিনা জীবনে।”

–“দুঃখ, কষ্ট কেউ তো আমায় যেচে পড়ে দেয়নি মিশুপি। আমি নিজ থেকেই অর্জন করে নিয়েছিলাম যে! ”

ধরে আসলো কুহু কন্ঠ। মিশু বিছানায় কুহুকে বসাল। বলল,,

–“সময় খারাপ ছিল তোর। এসব বাদ দে এগিয়ে চল। দেখ ভাইয়া আজ কত সাবলীল ভাবে চলা-ফেরা করছে।”

কুহু মনে মনে বলল,,” মানুষটি কি তাকে সত্যি ভুলে গেছে?পরমুহূর্তে এটি ভাবলো,, এটা কি স্বাভাবিক নয়? যাকে সে অফুরন্ত ভালবাসতো সে মেয়েটিই তাকে ধোকা দিয়ে ছিল! তাহলে কেন পারবে না তাকে ভুলতে?”

কুহু এই বিষয়ে আর কথা বলতে চায় না। পুড়ো বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলল,,

—“তোমার কথা বল? জিজু কেমন আছে? বিয়ে কবে করছো?”

মিশু খানিকটা লজ্জা পেল কুহুর কথায়। লজ্জায় গাল দুটি লাল টমেটো হয়ে গেল। বলল,,

—” ভাল আছে! ভাইয়ার বিয়ের পর আসবে তারা!”

কুহু হেসে বলল,,

—” ভালই হলো দুটি বিয়ে খেয়ে যাচ্ছি এবার!”

কুহুর কথায় মিশু অতি অবাঞ্ছনীয় এক প্রশ্ন করে বসলো,,

–“তোর খারাপ লাগচ্ছে না কুহু? ভাইয়ার বিয়ে!সে অন্য কারো হয় যাবে?”

এমন প্রশ্নে কুহু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কি বলবে সে ভেবেই পেলো না। উঠে গেল। পিছন থেকে মিশু বলে উঠলো,,

—” কুহু সত্যি বলতো? তুই তোর সেই বিলাই চোখ ওয়ালা ইউসুফ ভাইকে কখনো ভালবাসিস নি?”

কুহুর চোখ থেকে এবার জল গড়িয়ে পড়লো। কোনো এক সময় ইউসুফ তার ক্রাশ থাকলেও ভালো যে তাকেই বেসেছিল মনের অন্তস্থল থেকে। সেটাই বুঝতে আজ পাঁচ বছর কেঁটে গেল তার। কুহু জলটুকু মুছে ফেলে। ঘাড় কাত করে মিশুর দিক তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,,

—” নাহ্। ”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে