সিঁদুর রাঙা মেঘ পর্ব-০৩

0
1378

#সিঁদুর_রাঙা_মেঘ
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব_৩

আছরের নামাজ আদায় করে কুহু এসে দাঁড়ালো ছাদের কোনে। মাথার ওড়নাটি এখনো পেঁচানো। বাসায় মেহমানদের আনাগোনা শুরু হয়েছে এরি মধ্যে। তাদের সোরগোল কানে আসচ্ছে। বুকের মাঝে চিন চিন ব্যাথাটা আরো আকড়ে ধরেছে। এতটা যে শ্বাস আটকে আসছে। তাই কোনো রকম নামাজটা পড়েই ছাদে এসে দাঁড়ায়। বরাবরই এ বাড়ির ছাদটি তার খুব পছন্দের।তার একটি বিশেষ কারণ এ ছাদ জুড়ে আছে ইউসুফ আর কুহু কত শত স্মৃতি।

দূরের আকাশে আজো সেই সিঁদূর রাঙ্গা মেঘ করেছে তাকিয়ে রইলো সে দিকেই। আকাশের এই রূপ প্রতিবারেই মায়াবী লাগে কুহুর। ইউসুফের সাথে মিষ্টি স্মৃতি ভেসে উঠে চোখের সামনে। ঠিক সেদিনও করেছিলো। সেদিন কুহু ইউসুফের উপর খুব রেগে ছিল নতুন কলেজে ভর্তি হওয়ায় কিছু ফ্রেন্ড জুটে ছিল তার। তার মাঝে একটি ছেলেও ছিল সায়ান নামে। ইউসুফ তাকে মোটেও পছন্দ করতো না। কলেজ থেকে কুহুকে আনতে গিয়ে সেদিন ইউসুফের চোখ ধরা পড়ে যায় কুহু হেসে হেসে ছেলেটির সাথে কথা বলছে। ইউসুফের রাগ প্রতিবারি ছিলো আকাশ ছুঁয়া। হুট হাট রেগে যেত।কুহুর সাথে কোনো ছেলেকে দেখলে যেন কথাই নেই। সেদিনি ঠিক তাই হলো হুট হাটে রেগে কুহুকে সবার সামনে ধমকে উঠেছিল। কুহু তখন নতুন ফ্রেন্ডসদের সামনে খুব লজ্জায় পায়। এত লজ্জা যে ইউসুফের উপর বড্ড অভিমান করে বসে। ঠিক তার রাগ ভাঙ্গাতেই কুহুকে ইউসুফ ঠিক এ সময় ছাদে আসতে বলে। কুহু যখন ছাদে পা রাখে ইউসুফ তার মাথার উপর ফুলের বর্ষণ করে। কুহু খুশি হলেও মুহূর্তে মুখ ফ্যাকাসে করে নেমে যেতে নিলো। সে মূলত এসেছে মিশুর কথায়। মিশু বলেছিল ছাদ যেতে সে কফি নিয়ে আসছে দু বোন মিলে জমিয়ে আড্ডা দিবে। কিন্তু হলো উল্টো এসে দেখতে পেল ইউসুফ দাঁত কেলিয়ে হেসে যাচ্ছে তার দিক তাকিয়ে। তার বা হাতে গিটার। কুহু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে উল্টো পায়ে হাটা ধরলো। তখনি ইউসুফ গিটারে সুর তুলল,,

—” শুধু তোমায় ঘিরে,
শুধু তোমায় ঘিরে,
সিঁদুর রাঙা মেঘ করেছে দূরে
শুধু তোমার ছায়া মেঘের উপর
ঢেউ খেলে রোদ্দুরে।

অভিমানের আড়ি কেটে,
কোথায় তুমি যাচ্ছ হেঁটে
হৃদয়ের চিরকুটে তুমি খুব ডানপিটে।
আমি তোমার মান ভাঙাবো,
ভালোবাসার চোখ রাঙাবো,
মিষ্টি কোনো গান শোনাবো
গলার নরম স্বরে।

শুধু তোমায় ঘিরে,
শুধু তোমায় ঘিরে,
সিঁদুর রাঙা মেঘ করেছে দূরে
শুধু তোমার ছায়া মেঘের উপর
ঢেউ খেলে রোদ্দুরে।

পুরোনো স্মৃতি মনে পড়তেই হাসলো কুহু। কত সুন্দর না কেঁটেছিল তার দিন গুলো। কুহু মাথার কাপড় খুলে ওড়না এক সাইডে করে রাখলো।বড় চুলে করা তার হাত খোপাটি খুলে গেল বেখেয়ালি । তখনি শান্ত বাতাসের ঝাপটা এসে উড়িয়ে দিল অবাধ্য চুল গুলো। কুহুর বাধতে ইচ্ছে করলো না চুল গুলো আর। উল্টো চোখ বুজে মৃদুল বাতাস উপভোগ করতে লাগলো।
তখনি নাকের মাঝে সিগারেটে গন্ধ আসতেই খুক খুক করে কেশে উঠলো সে। কুহু কখনই সিগারেটে গন্ধ সহ্য করতে পারে না। ছাদের মাঝে এমন বিষাক্ত গন্ধ কোথা থেকে আসচ্ছে তার উৎস খুঁজতেই পিছনে ফিরে। উঁকি-ঝুকি দিতেই ছাদের অন্যপাশের সেই পরিচিত মানুষটিকে দেখে গায়ে শীতল বাতাসের স্রোত বয়ে গেল তার। পা দুটি নিশ্চল হয়ে গেল মুহূর্তেই। সেখানে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো তার শরীর পাঁচটা বছর পর লোকটির সামনে কোন মুখে দাঁড়াবে? তা ভেবেই শরীর অসাড় হয়ে এলো। চুল পরিমাণ নড়তেই পারলো না আর।

সিগারেটে শেষ ফুক দিতেই কারো পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে ঘুরলো ইউসুফ। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা চেনা পরিচিত মুখটি দেখে ইউসুফের রাগ মাথায় চড়ে গেল। কিন্তু সে ছাদের বর্ডারে হেলে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিক। আর কিছু একটা ভেবে বাঁকা হাসলো। সেই বাঁকা হাসি! যে হাসির মায়ায় কুহু হাজার বার মরতে রাজি ছিল। ইউসুফের হাতে শেষ হওয়া সিগারেট টা ফেলে দ্রুত এগিয়ে গেল কুহুর দিক। কুহু ভয়ে ছাদের দরজার পাশের দেয়ালটায় লেগে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাজার গুন বেগে হৃদপিণ্ড ছুটছে তার।

ইউসুফ কুহুর মুখোমুখি এক হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে। দুজনের মাঝে এক হাত ফাঁকা। কুহুর বড় বড় চোখে ইউসুফকে দেখছে। ডাগর ডাগর চোখ তার।এই চোখের মায়ায় পড়ে ধংস হয়েছে সে। ইউসুফ আবার হাসলো। শান্ত গলায় বলল,,

—” কেমন আছিস কুহু?”

ইউসুফের মুখে “কুহু নামটা শুনে বুক ফেঁটে কান্না এলো তার। ইউসুফ সব সময় কুহুকে “বাবুইপাখি ” বলে ডাকতো। সে যতই রেগে থাকুক না কেন। কুহুর চোখ থেকে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। ইউসুফ সাথে সাথে হাত পেতে চোখের জল টুকু ধরে ফেলল। ভ্রু কুচকে বলল,,

—” অযথা চোখের জল ফালছিস কেন? আমি কি তোকে মেরেছি নাকি বকেছি? অবশ্য এটাই করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার চোখের সামনে যখন পড়বি, গলা টিপে মেরেই ফেলবো তোকে! কিন্তু দেখ? বালের ভাগ্য আমার। তুই সামনে তবুও করতে পাড়চ্ছি না কি করি বলতো? ”

কথাটু বলেই আবার সিগারেট ধরালো ইউসুফ। এদিকে কুহুর ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। লোকটি তাকে এতো ঘৃণা করে?যে মেরে ফেলতে চায়? কুহু নিজেকে সামলে বলল,,

—” কেমন আছেন ইউসুফ ভাইয়া?”

কুহুর কথায় যেন আহত বাঘ জেগে উঠলো। চোখ দুটি মুহূর্তেই লাল হয়ে গেল। কুহুর একদম কাছে এসে রাগে,ক্ষোভে জলন্ত সিগারেট ঠেসে ধরলো কুহুর গলার ঠিক নিচটায়। কুহুর মুখ দিয়ে এক চিৎকার বের হতেই ইউসুফ অন্য হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,,

—” ঠিক এমনটাই আছি আমি। যেভাবে এখন তোর জ্বলে যাচ্ছে আমারো জলচ্ছে প্রতিটি মুহূর্ত। এতটা সুখে আছি। ”

কুহু ইউসুফকে ধাক্কিয়ে সরাতে চাইলো।যন্ত্রণায় কুহু কুকিয়ে উঠছে।চোখ দিয়ে অনড়গল পানি পড়তেই লাগলো। ইউসুফ এমন কিছু করবে কুহু ভাবতেই পারেনি। ইউসুফ আবার বলল,,

–” কি হলো নড়ছিস কেন? আমি ধরলেই ধাপাধাপি করতে মন চায়? তোর সেই আশিক যখন ধরতো? আরাম পেতি তাই না?”

কুহুর মুহূর্তে কান গরম হয়ে গেল লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। কুহু এবার নড়াচড়া বন্ধ করে দিল। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো ইউসুফের দিক। ইউসুফ কুহুকে ছেঁড়ে দিলো। ইউসুফ ছাঁদের বর্ডার ঘেষে দাঁড়িয়ে পড়লো কুহুর দিক ফিরে আবার সিগারেট ধরিয়ে কুহুকে বলে,,

—” কি অবাক হচ্ছিস? হওয়ার কথাই আমার কাছে সব কিছুর খবর আছেরে কুহু, সব কিছুর। তোর করা বেইমানির প্রতিটা হিসাবে টুকে রেখেছি। সময় মতো সব সুধে আসলে ফিরত দিবো বলে। তুই যে এতটা ক্যারেক্টার লেস হয়ে যাবি? জানাই ছিল না আমার।”

—“ইউসুফ ভাইয়া..!

সিক্ত চোখে চেঁচিয়ে উঠলো কুহুু।ইউসুফ আবার বলল,,

—” চেঁচাচ্ছিস কেন? সত্য সব সময় তিক্ত। তার উপর দেখ তুই কতটাই না নির্লজ্জ হয়েছিস? যাকে ভালবাসলি, ভুড়ি ভুড়ি স্বপ্ন দেখালি। যখন স্বপ্ন পূরেনর সময় হলো তখন লাথি মেরে চলে গেলি। আর এখন ধেই ধেই করে বিয়ে খেতে চলে এসেছিস তাও নিজের প্রাক্তনের?তোর মতো নির্লজ্জ আগে দেখিনি। ছিঃ।”

কুহু এবার সেখানেই বসে পড়লো।আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন তার মাথায়। এ মানুষটি তাকে ক্যারেক্টার লেস, নির্লজ্জ উপাধি দিবে ভাবেই নি কখনো তার এ মুহূর্তে পুড়ে যাওয়া জায়গা থেকে বেশী যন্ত্রণা দিচ্ছে ইউসুফের কথায়। কুহুতো আসতেই চায়নি ওর মা ওকে এক প্রকার জোড় করেই এনেছিল।

ইউসুফ অনেক আগেই নিচে চলে গেছে। কুহু এখনো সেখানে বসে আছে। আকাশের সিঁদুর রাঙা মেঘের ভেলা এবার উড়ে চলে যাচ্ছে। কুহু তার লাল ফোলা চোখে তাকালো সেদিকে। বিড়বিড় করে বলল,,

—” কি আশ্চর্য তাই না ইউসুফ ভাই! সেদিন আপনি আমার সামান্য রাগ ভাঙ্গার জন্য কত কিছুই না করেছিলেন! নিজের কন্ঠেগান শুনিয়ে ছিলেন আর আজকে? সেই আমাকে আপনার বাবুইপাখিকে কষ্ট দিয়ে চলে গেলেন। এক ফুঁটো আফসোস দেখা গেলো না আপনার মুখে। এতটাই খারাপ হয়ে গেলাম আমি!”

কুহু এবার বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো। চারিদিক অন্ধকার করে আসচ্ছে। পাখিরা নিজ নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু কুহু? সে কবে ফিরবে তার সঠিক নীড়ে?

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে