সিঁদুর রাঙা মেঘ পর্ব-০১

0
2916

#সিঁদুর_রাঙা_মেঘ
পর্ব_১
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

চিত্রা তার বাবার সাথে কিছুদিন হলো ময়মনসিংহের একটি পুরাতন দোতলা বাড়িতে শিফট হয়েছে। সুন্দর পরিপাটি এই দোতলা বাড়িটির নাম “বৃষ্টি বিলাস”। খুটিয়ে খুটিয়ে বাড়িটির প্রতিটি কোনা দেখতে ব্যস্ত সে। আপাদত ভার্সিটি বন্ধ তার। কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না সে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবাই তার সব। সরকারী চাকরী করাতে তাদের কয়েক মাস বা বছর গড়াতেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় শিফট হতেই হয়। এবং তাদের করে দেয়া নির্ধারিত জায়গায় থাকতে হয় চিত্রাদের।সেই সুবাদে এ বাড়িটিতে থাকতে আসা। চিত্রার এ বাড়িটি খুব মনে ধরছে। বিগত যত বাসা পাল্টেছে সব দম বন্ধের মতো লেগেছে তার। এই “বৃষ্টি বিলাস” বাড়িটিতে যেন সে মন খোলে শ্বাস নিতে পারছে। বাড়ির বাহিরে বাম সাইডে বৃহৎ ফুলের বাগান থেকে আসা চেনা-অচেনা কত শত ফুলের ঘ্রাণে মন মুগ্ধ করে তুলছে চিত্রাকে। চিত্রা প্রতিটি রুম হেটে হেটে দেখচ্ছে।কিছু রুম কালা বদ্ধ৷ যেগুলো তালা খোলা সেগুলো খুব সুন্দর করে গোছানো। বুঝতেই পাড়ছে। বাড়িটি যাদের ছিল তারা নিশ্চয় অতি রুচিশীল আর সৌখিন মানুষ ছিলেন। বাড়ির প্রতিটি কোনে তারই আভিজাত্যের ছোঁয়া লাগা যেন।

চিত্রা হাঁটতে হাঁটতে এ বাড়ির লাইব্রেরী রুম সামনে এসে দাঁড়ায়। রুমে ঢুকতেই তার চোখ কঁপালে। এত এত বইয়ে ঠাসা। চিত্রার বরাবরই বই পড়তে পটু। অবসরেই বই নিয়ে বসে পড়ে সে। লাইব্রেরী ঘরে এত এত বইয়ের তাকে ঠাসা বই দেখে মন তার ফুরফুরে হয়ে গেল।

চিত্রা বই গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো। খুশিতে তার চোখ জোড়া চকচক করছে। কিছুটা হলেও তার একাকীত্ব কাটবে তা ভেবেই ছোট শ্বাস ফেললো চিত্রা। চিত্রা হাত দিয়ে প্রতিটি বই ছুঁয়ে দেখছে তখনি টুং টাং তার ফোন বেজে উঠলো। সে বিরক্ত নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো “নেওয়াজ কলিং “।
বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো চিত্রা। ফোন কেঁটে সাইলেন্ট করে দিলো সে। এখন তার কল রীতিমত আসতেই থাকবে। লোকটি তার ফোন না তোলা পর্যন্ত কল করতেই থাকবে। সে দিকে আর পাত্তা দিল না চিত্রা ফোনটি টেবিলের কোনে রেখে আবার বই দেখায় মন দিলো।

চিত্রা একটি বই পছন্দ হলো তা টান দিতেই হুড়মুড় করে কিছু বই পড়ে গেল চিত্রার উপর। খানিকটা ভয় পেয়ে গেল চিত্রা। বই ছিড়ে ছুঁড়ে গেলে না তাকে বকা দেয় বাবা। তাড়াতাড়ি করে তুলতে লাগলো সে। তখনি একটি ডাইরি হাতে লাগে তার। হালকা লাল রঙ্গা ডায়রিটি। যার উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “সিঁদুর রাঙা মেঘ ”

চিত্রা সব বই তুলে এই ডায়রিটা হাতে নিলো। বড় উৎসুক নিয়ে ডাইরিটি খুলতেই বুঝতে পারে এটি কারো পার্সোনাল ডায়রি। দ্বিধান্বিত তো পড়ে গেল চিত্রা। পড়বে কি না। কিছুক্ষণ দোনামোনা করে খুলেই ফেলল চিত্রা। এবং পড়তে লাগলো সে। প্রথম পেইজে একটি ছন্দ লিখা। তা পড়লো প্রথমে,,

“মনে পড়ে কি সেই দিনটির কথা?
যেদিন হয়েছিলাম আমি তোমার ঠোঁটের কোনের হাসি?

মনে পড়ে কি সেই রাতের খোলা আকাশের তারার কথা?
যারা হয়েছিল আমার তোমার ভালবাসার সাক্ষী?

মনে পড়ে সে মধ্যরাতের মুঠো ফোনের কথা? যার এপার ওপার ছিল তোমার আমার নিশ্বাসের শব্দ?

মনে পড়ে কি সেই শেষ বিকেলের গোধূলি লগনের কথা?
যখন সিঁদুর রাঙা মেঘ উড়ে যেতো? তুমি বলতে ভালবাসি।”

ছন্দটা খুব মনে ধরলো চিত্রার। পরের পৃষ্ঠা উল্টে পড়তে লাগলো সে,,

সময়টা ছিল শীতকাল।ডিসেম্বরের শুরুতেই হাড় কাঁপানো কনকনে শীত । সকাল তখন সাতটা বাজে কিন্তু চারিদিকে কুয়াশা চাদরে ঢাকা দেখে মনে হয় যেন কাক ডাকা ভোর।কখন থেকে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। কোনো এক সমস্যা হয়েছে মাইকিং করে বলেছে। কুহু এবার ট্রেনের বাহিরে তাকালো। ঘন কুয়াশার মাঝে কিছু মানুষ আগুন ধরিয়েছে। যার লিক লিকে আলো দেখা যাচ্ছে। কুহু এবার তার পাশে তাকালো। তার মার কাঁধে মাথা পেতে তার থেকে দু বছরের ছোট বোন ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। কিন্তু কুহুর চোখ জোড়ায় ঘুম নেই। আছে শুধু এক রাশ অস্থির আর ভয়। তখনি পাশ থেকে তার মা সুমি তার ছোট বোন মিহুর গায়ে চাদর টেনে কঠিন সুরে বলে উঠলো,,

—” ইউসুফের থেকে দূরে থাকবি। আর ও বাড়ির সবার থেকেও। দরকার ছাড়া কোনো কথা বলবি না। তুই যা করেছিলি তাদের সাথে! ভেবেছিলাম বাপের বাড়িটা আমার হারিয়েছে কিনা! কিন্তু তাদের বড় মন দেখেছিস? ইউসুফের বিয়েতে আমাদের ঠিকি ইনভাইটেশন দিয়েছেন তারা। আমি চাই না তোর জন্য আরো ঝামেলা বাড়ুক। ”

কুহু সুমির কথায় বিরক্ত হলো। এই জন্যই তার বিন্দুমাত্র যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না সেই বাড়িটিতে। না দ্বিতীয়বার পড়ার ইচ্ছা ছিল সেই মানুষ গুলোর সামনে। সে বলল,,

—” আনতে গেলে কেন আমায়? আসতে তো চাইনি আমি! তুমি জোড় করলে কেন তাহলে?”

রেগে গেলেন সুমি। কুহুর এমন কথার তেজ কখনোই পছন্দ ছিল না তার।বাড়িতে একা মেয়েকে রেখে আসার সাহসটুকু হচ্ছিল না । যে দিন পড়েছে একা মেয়ে বাসায় থাকা অনেক রিস্কি।নয়তো কখনো আনতেন না তাকে। তিনি চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,,

—” একদম তেজ দেখাবি না। নয়তো মানুষের সামনেই পিঠে দু ঘা বসিয়ে দিবো!”

কুহু প্রতিউত্তর কিছু বলল না। নিরবে ছোট শ্বাস ফেলল। তার জানা আছে সুমির খবর এখন সকলের সামনে তিনি মারতেও পারেন। কুহু এবার বাহিরে তাকালো। ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে সবে। ইটের দালান আর বড় বড় গাছ-পালা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে তারা নিজ গন্তব্যে। কুহু এবার চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। সীটের সাথে মাথা এলিয়ে দিতেই চোখ দুটি সিক্ত হয়ে গেল। তার ভালবাসার মানুষটির বিয়ে হতে চলেছে। আর সেই বিয়ের দাওয়াত খেতে যাচ্ছে কুহু। কি ভাগ্য তার! এমন ভাগ্য কজনেরই বা হবে? নিজের ভালবাসার মানুষটি অন্যকারো হয়ে যাবে আর তা দাঁড়িয়ে দেখবে কুহু পাড়বে কি তা সহ্য করতে??ও যে মরণ যন্ত্রণার চেয়েও কম নয়!

কুহু এসব ভাবনা থেকে বের হতে চাইলো। চোখ দুটি মুছে কল্পনায় হারিয়ে যেতে চাইলে সে মানুষটির ।

আকাশে আজ এক বড় রূপালী চাঁদ যেন পূর্ণিমা। তার দিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কুহু বলল,,

—” ইউসুফ ভাইয়া দেখেছেন চাঁদটা আজ কত সুন্দর।”

কুহুর মুখে মায়া মায়া হাসি। সেই চাঁদটার দিক ইউসুফের কোনো খেয়াল নেই যে। ইউসুফ কুহুর দিক মাদক দৃষ্টি মেলে তাকালো। ঠোঁটে তার সেই ভুবন ভোলানো হাসি। বলল,,

–” হে দেখছিতো! কি সুন্দর সেই চাঁদের হাসি।এ জন্য তাকে এত ভালবাসি !”

কুহু ভ্রুকুটি কুচকে ফেললো। ইউসুফের কথা তার বোধগম্য হলো না। ইউসুফের দিক তাকিয়ে কথাটা ধরতে চাইলো।তার সেই বাঁকা হাসি দেখে যখন বুঝলো সে কোন চাঁদের কথা বলছে।সাথে সাথে লজ্জা পেল।মুখে তার লালীমা ফুটে উঠলো। মৃদু বাতাসের ঝাপটে সামনে এসে পড়া চুল গুলো গুঁজে দিল কানের পিছনে। নজর নিচু করে আবার আড় চোখে চাইলো। বলল,,

–” চাঁদের গায়ে কিন্তু বহুত দাগ থাকে ইউসুফ ভাই! সে ওই দূর আকাশের চাঁদ হোক বা রক্ত মাংসে গড়া চাঁদ হোক।”

ইউসুফ হেসে আকাশের চাঁদের দিক তাকালো। সত্যি চাঁদটা আজ বেশি জ্বলজ্বল করছে। দৃষ্টি সেখানে রেখেই জবাব দিলো,,

–” ওই দূর আকাশের চাঁদটার গায়ে দাগ বলেই সবার কাছে প্রিয়! যার মাঝে দাগ বা কমতি নেই? সে তো পরিপূর্ণ হয়। কিন্তু পরিপূর্ণ কিছুর মাঝে যে শান্তি নেই। ঠিক তেমনি ওই চাঁদের যদি দাগ না থাকতো? তাহলে কেউ তার প্রতি আকৃষ্ট হতো না। ”

কথাটুকু বলে থামলো ইউসুফ।এক গাল হাসলো। কুহু তাকিয়ে রইলো তার টোল পড়া গালে। কি সুন্দর হাসি। ইউসুফ বলল,,

–” তাইতো আমিও ভালবাসি। সেই দাগে ভরা রক্ত মাংসে গড়া মানুষটিকে!”

কুহুর চোখ মুহূর্তে ছল ছল করে উঠলো। এ লোকটা তাকে এতো ভালবাসে কেন?
ইউসুফ এগিয়ে এলো। চোখের কোনের পানি মুছে বললো,,

–“চাঁদের গায়ে সেই জ্বলজ্বল করা আলো হতে চাই। দিবি বাবুইপাখি? আমাকে সেই আলো হতে?”

কুহু এবার জড়িয়ে ধরলো ইউসুফকে। তার বুকে মুখ গুঁজে হু হু করে উঠলো। ইউসুফও যেন তার উত্তর পেয়ে গেল। কুহুকে বাহুডোরে শক্ত করে আবদ্ধ করে রাখলো। মৃদু আওয়াজে বলল,,

—” ভালবাসি বাবুইপাখি! খুব খুব বেশি!”

ইউসুফের মুখে ভালবাসি কথাটুকু শুনে সেদিন কতই না কেঁদে ছিল কুহু। সেদিনের মতো আজও কাঁদচ্ছে কুহু। কিন্তু তাদের মাঝে কান্নার কারণটা ভিন্ন। তখন কেঁদেছিল ভালবাসার মানুষটির মুখে ভালবাসি কথাটি শুনে। আর আজ কাঁদছে সে মানুুষটি তার থেকে কত দূর সে চলে গেছে সে কথা ভেবে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে