শোভা পর্ব-১০

0
433

#শোভা
#পর্ব_১০

কণার বিয়ে ঠিক হলো। পাত্রের নাম আজমল। বয়স তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি হলেও বেশ টাকা পয়সা আছে। দুবাইয়ে থাকে। কণাকে বিয়ের পরে সাথে নিয়ে যাবে। কণা প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে পাত্রের টাকা পয়সার কথা চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলো। জহির বাদে ঘরের সবাই অনেক খুশি। জহির কণাকে বিদেশে পাঠাতে রাজি নয়। কিন্তু, বাকি সবাই রাজি দেখে সেও রাজি হয়ে গেলো। আমার শাশুড়ি তো মেয়ের স্বভাব চরিত্রের খবর জানতো তাই সে কোনো অমত করলো না।
সবচেয়ে বেশি খুশি আমি। আমি এটা ভাবতেই খুশি হতাম যে, একটা আপদ তো বিদায় হবে। অন্তত বীনার মতো প্রতিদিন এসে তো জ্বালাবে না। আর ও যেসব খারাপ কাজকর্ম করতো সেগুলিও বন্ধ হবে। ঘরটা পাপমুক্ত হবে। ভাবতেই ভালো লাগছে।

– যাক, অবশেষে একটা মালদার জামাই পাচ্ছিরে, বীনা আপা। ডাইনিং টেবিলে আপেল খাচ্ছে আর বলছে, কণা। টাকা পয়সা আছে দেখেই ওই লোকটারে বিয়ে করতেছি। নাইলে ওই টাকলু আঙ্কেল ধরনের লোককে কে বিয়ে করে? আমার চয়েজ এত খারাপ না! যাই হোক দুবাই একবার যেয়ে নিই, নিজে থেকেই কোন চাকরি-বাকরি করবো, স্বাধীন জীবন! ওই টাকলু আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় নেই!

– কিরে কণা, অনেক খুশি তাইনা! আমার আর রিনা আপার তো ভালো মন্দ বোঝার আগেই বিয়ে হয়েছে তাই বিয়ের আনন্দ বোঝার টাইম পাইনি। যাক, তুই যে খুশি এতেই আমরা খুশি। মাশাআল্লাহ্! সেই সমন্ধ পেয়েছি। শশুরবাড়ির সংসারের কোনো ঝামেলাই পোহাতে হবেনা। আর জামাইর টাকা পয়সার তো অভাব নেই। আমাদের আবার ভুলে যাসনা। দুবাইর গোল্ড অনেক ভালোরে! আমার নতুন ডিজাইন এর বালার খুব শখ। তখন আবার বলিস না টাকা পয়সার সমস্যা। আর আশার জন্য ও একটা সুন্দর চেইন পাঠাবি। আমি কিন্তু তোর জন্য অনেক করেছি।

– কিরে, কি শুরু করলি তোরা বীনা আর কণা? কোথায় রইছে কি? এখন পর্যন্ত বিয়ের খোঁজখবর নাই! বিয়ের মাত্র কথাবার্তা হইছে। এখনই তোরা এইটা সেইটা আনা আনি করতেছিস? এত বেশি আশা করা ভালো না। আগে বিয়েটা হইতে দে তারপরেরটা তারপরে দেখা যাবে! আর আজ বাদে কাল যে তোর জামাই হবে তারে তুই আঙ্কেল বলতেছিস কেন? সমস্যা কি তোর?

আমার শাশুড়ির ধমক শুনে ওরা দুই বোন একটু চুপ হলো। আমি রান্নাঘরে বসে ওদের কথা শুনছিলাম আর মনে মনে হাসছিলাম। এত লোভ ওদের।

সপ্তাহ খানেক পর ও বাড়ি থেকে লোকজন কণাকে আংটি পড়াতে আসবে। তাই বাসায় অনেক কাজ। কণার বিয়ের খুশিতে আমার ননদেরা আমার সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছিলো। আমার ভালোই লাগছিলো। বাড়িতে কেমন একটা উৎসব উৎসব আমেজ। কোনদিনই এ বাড়িতে এরকম পরিবেশ এতটি বছরে তৈরি হয়নি।

নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যার দিকে বর পক্ষ থেকে প্রায় বিশ জন লোক এসেছে। আমি রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত। বীনা আর রিনা দুজনে মিলে কণাকে ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করে ড্রইংরুমে অনেক চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি রান্না ঘরের কাজ রেখে ড্রইং রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। সেখানে যেয়ে যা দেখলাম আর শুনলাম তাতে আমি পুরাই অবাক হয়ে গেলাম।

– মামা, আমি সত্যি বলছি তুমি এই মেয়েকে চেনো না। ওকে আমার চাইতে ভালো এই পৃথিবীতে আর কেউ চেনে না। ও টাকা ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই বোঝেনা।

– আহ! সিয়াম কি শুরু করেছিস তুই? কণা দুদিন পরে তোর ছোট মামার বউ হবে। আর তুই তাকে নিয়ে কি কথা বলছিস?

– মা! আমি যা বলছি জেনেশুনে বলছি। তুমি এই বিয়ে ভেঙ্গে দাও। এ বিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব না।

– কেনো? কণার সাথে কি তোর আগে পরিচয় ছিল? তুই কি ওকে চিনিস?

– অবশ্যই চিনি, মা! ওকে আমার মত ভালো আর কেউ চেনে না। এমনকি ওর পরিবারের মানুষ জানে না যে ও কি? আমি মামার সাথে কথা বলতে চাই।
মামা, একটু সাইডে চলো, প্লিজ!

কি কথা হলো জানিনা। শুধু তারা বললো বিয়ে সম্ভব নয়। শুধুমাত্র এক সাইডে জহিরকে ডেকে নিয়ে ওরা কি যেনো বললো, জহির চিৎকার করে উঠলো। ওরা জহিরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সবাই বের হয়ে যেতে লাগলো।
জহির আমাকে দেখে বললো, তুমি ওদের কে থামাও শোভা। ওদের সাথে আমার কথা আছে।

ওদের এত বড় সাহস ওরা কণার নামে এত বাজে কথা কি করে বললো?

আমি বললাম, আজমল ভাই আপনারা যাবেন না। আগে ভালো করে সবকিছু শুনি তারপরে দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। প্লিজ, আপনার বোনকে বোঝান। আপনারা একটু পরিষ্কার করে বলেন, কি হয়েছে?

– ভাবি, যা হয়েছে তা বলার মতো ভাষা আমার নেই। বিভিন্ন কারণবশত বিয়ে করতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছে। তাই বলে তো আমি যাকে তাকে বিয়ে করতে পারিনা। আর আপনারা কিভাবে পারলেন? এই রকম একটা মেয়েকে আমার ঘাড়ে চাপাতে। যাই হোক বিয়েটা হওয়ার আগেই টের পেয়েছি। না জানলে কি হতো?আমার মান ইজ্জত সব এক নিমেষেই শেষ হয়ে যেতো। উফ! মানির মান আল্লাহ রক্ষা করে।

– কিন্তু, ভাই আমাদেরকে না বললে আমরা বুঝবো কিভাবে? আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আপা, বসুন। তারপরে কথা বলি। প্লিজ!

– আপা , আপনাদের বুঝিয়ে বলার তো কিছুই নেই। এত বড় সত্য তো আপনাদের কাছে অজানা থাকার কথা নয়। আপনার ননদ তো পুরাই বিজনেস উম্যান ছিলো। আপনাদের কি সেটা ও অজানা ছিলো? সত্যি করে বলেন তো! আপনারা পারেন ও। অচল মাল আমার ভাইয়ের ঘাড়ে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

জহির রাগে থরথর করে কাঁপছিল। আমার শাশুড়ি আর ননদেরা চেঁচামেচি শুরু করলো। কণা, আমাকে বারবার ওদের বের করে দিতে বলছিলো।

– ভাবি, ওদেরকে আর এক মূহুর্তো এখানে দেখতে চাইনা। ওদের কাছ থেকে কোনো ব্যাখ্যা শোনারও দরকার নেই। এখনই চলে যেতে বলো।

কিন্তু,আমি তো জানতাম কণাকে জহিরের সামনে এক্সপোজ করার এর থেকে ভালো কোনো রাস্তা আর পাবোনা।

আমি তাদের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ে না ভাংগার অনুরোধ করতে লাগলাম। তারা যখন না মানতে চাইলো, তখন আমি তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত ভাবে সত্যিটাকে শোনার জন্য কণার সাপোর্ট দিয়ে তাদেরকে উস্কে দেয়ার জন্য বিয়ে ভাংগার অপরাধে বেশ কিছু কটু কথা শোনাতে লাগলাম।

আমি দু একটা শুরু করতেই আজমলের ভাগিনা সিয়াম শুরু করে দিলো কণার আদ্যোপান্ত ইতিহাস। এবং প্রত্যেকটি কথার সাথে প্রমাণ দেওয়ার কথাও উল্লেখ করে। এই সিয়াম কণার গাজিপুরের রিসোর্টের ঘটনা থেকে শুরু করে আরো ডজনখানেক ছেলের নাম উল্লেখ করলো যাদের সাথে কণার বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কের কথা বললো সে। আমি চুপচাপ শুনছিলাম আর আড় চোখে জহিরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। জহির মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। যেন পাথরের মূর্তীতে রূপ নিয়েছে। কণা চিৎকার করে করে বাড়ি মাথায় তুলছিলো। সাথে আমার শাশুড়ি আর রিনা, বীনাও।

সব মিলিয়ে বিয়ের কাহিনী শেষ। সবার আশা ভরসা সব শেষ। বাসায় যা ঘটার তাই ঘটছে। জহির ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে। মা বোনদের কে যা খুশি বলছে। সে কণাকে টানতে টানতে ওর রুম থেকে বের করে এনে সবার সামনেই শরীরের সব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মারতে শুরু করলো। রিণা দৌড়ে এসে কণাকে জহিরের হাত থেকে মুক্ত করলো। তার মাকে জিজ্ঞেস করলো, তার মেয়ে যে রাতের পর রাত বাইরে থেকেছে সে কি কিছুই জানতোনা? আমার শাশুড়ি নির্বাক। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি সব সত্যি কথা বললাম, যে কণা বাইরে থাকলে আমার শাশুড়ি আমাকে বলতে নিষেধ করতো। সে যা বলতো আমি তাই বলতাম। জহিরের যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেলো।

অনেকক্ষণ বোঝাতে বোঝাতে জহির একটু শান্ত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ওরা তিন বোন তখনো সবকিছু অস্বীকার করছে। আমার শাশুড়ির ভাব বুঝতে পারছিলামনা। কোনো কথা বলছেনা। থমথমে ভাব নিয়ে বসে আছে। হয়তো মেয়ের কুকর্মের জন্য মনে মনে পস্তাচ্ছে। বেচারির জন্য মায়া হচ্ছিলো। বেচারি মেয়েদের কে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো। কণা যা বোঝায় উনি তাই বোঝে।

জহির কাঁদছে আর বলছে, আমি কি করিনি তোদের জন্য? নিজের সন্তানের থেকে বেশি ভালোবাসি তোদের কে! আর তোরা তার এই প্রতিদান দিলি? ভালোই করেছিস! আর যে মাকে আমি আমার বেহেশত ভাবি, যাকে আমি পৃথিবীতে সব চাইতে বেশি বিশ্বাস করি, সে তার মেয়ের সর্বনাশ নিজের হাতে করেছে।

শোভা, এই বাড়িতে একই ছাদের নিচে আর নয়। ওদের ছায়া আমার মেয়েদের উপর পড়ুক তা আমি চাইনা। আমি বাসা দেখছি। তুমি কাপড় গোছাও। এই রাতের বেলা বাসা পেলে আজই চলে যাবো। বলেই জহির নিচে চলে গেলো।

জহির বাসা দিয়ে নামার সাথে সাথেই কণা আহত বাঘের মতো দৌড়ে এসে আমার চুলের মুঠি ধরেই ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ওরা যে এত নিচেও নামতে পারবে আমি ভাবতে পারিনি। সাথে সাথে রিনা আর বীনাও এসে তিনবোন মিলে আমাকে যে যেদিক দিয়ে পারছে মারছে। আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। আমার মেয়ে দুটি ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।
ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছে আমিই যেনো বিয়ে ভেঙেছি।

– তোর কারনে আজকে ভাইয়া এসব কথা আমাদের কে বলেছে। তোর কারনে আজকে ভাইয়া আলাদা বাসা নেয়ার কথা বলছে। যে ভাইয়া কোনোদিন আমার সাথে উচু আওয়াজে কথা বলেনি সে আজ আমার গায়ে হাত তুলেছে। তোকে কে বলেছে আমার বিয়ের জন্য ওদের কাছে হাত জোর করতে। বেয়াদব , মনে করেছিস আমরা কিছু বুঝিনা! ভাইয়াকে শোনানোর জন্য নাটক রচনা করছিস আমরা বুঝিনাই, না? আমরা মিনিটে দশটা নাটক রচনা করি আর তুই আসিস আমাদের কে নাটক শিখাইতে না?

ওরা এসব করছে এর মধ্যে কেন যেন জহির এসে হাজির। জহির এসব দেখে পাগলের মতো হয়ে গেলো। সে দৌড়ে এসে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো।

– বাবা,বাবা জানো ফুপিরা সবাই মিলে আম্মুকে অনেক মেরেছে। চুল টান দিয়েছে, ধাক্কা দিয়েছে আর আম্মুকে অনেক বকেছেও। আমি বলেছি না ওরা অনেক পচা। ওরা আমাকেও মারে,জিনাতকে ও মারে, আম্মুকেও মারে। ওরা তোমাকে ও মারবে! কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো জান্নাত!

এবার বাসার অবস্থা আরো ভয়ানক হয়ে গেলো। এবার জহির আগের থেকেও বেশি ক্ষেপে গেলো।
অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি হলো। সে রেগে গিয়ে তার বোনদের কে বলল আমি কেনো এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছি? আমি কি পাগল হয়ে গেছি নাকি? এ বাসা তো আমার। আমার কষ্টের টাকায় কেনা এই ফ্লাট। তোরা সবগুলো আমার বাসা থেকে বের হ! এক মুহূর্ত আমি তোদেরকে আমার বাসায় আর দেখতে চাইনা! গেট আউট! যাদের মনে আমার বউয়ের জন্য সম্মান নেই, আমার বাচ্চাদের জন্য ভালোবাসা নেই সে রকম বোনদের আমার না হলেও চলবে। আর মা তুমি ডিসিশন নিতে পারো কার সাথে থাকবে? মেয়েদের সাথে যাবে নাকি আমার সাথে থাকবে?

এতক্ষণ পরে আমার শাশুড়ি নড়েচড়ে বসলো।সে উঠে বললো, আমার মেয়েরা কোনো জায়গায় ও যাবে না। এইটা আমার বাসা। এইটা আমার ফ্ল্যাট। এইটা আমার নামে কেনা। তুই যদি মনে কইরা থাকিস আমার মেয়েরা খুব বেশি অন্যায় কইরা ফেলেছে তাইলে তোর আর তোর বউয়ের জন্য দরজা খোলা আছে। তুই তোর বউ বাচ্চারে নিয়া যেইখানে খুশি সেইখানে যাইতে পারিস আমার কোন আপত্তি নাই। আমার ধারনা ভুল হইতে পারেনা। আমি জানতাম, এইরকম দিন কোনো না কোনো দিন আসবে! কারন তোর বউরে আমার কোনদিনই পছন্দ না! তোর বউ তার রূপ ঠিকি দেখাই দিছে। এই জন্যই সব সম্পত্তি আগেই আমি নিয়া নিছি। আমার মাইয়ারা আমারে মিথ্যা বলছিলো না। সময় মতো কামের কাম সাইরা ফেলছি। যা কোথায় যাবি, যা। এখন কই যাবি দেখবো! বেয়াদব মাইয়া।

আমার যে পোলাপানের মাঝে আজ পর্যন্ত ঝগড়া-ফ্যাসাদ ও লাগে নাই আজকে সেই ভাই বোনের মধ্যে ও আগুন লাগাই দিছে। তুই তোর বউ নিয়া এক্ষুনি বাইর হ। ওই বউ সাথে নিয়া আর আমার সামনে আসবিনা। আর পোলাতো জন্ম দেয়ার মুরোদ নাই, দিছে দুইটা মাইয়া জন্ম। তা পুরাই ওর মতো শয়তান। দাদি, ফুফুরে দেখতে পারেনা।

জহির ওর মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যেয়ে বললো, মা এসব কি বলছো তুমি। আর তুমি এখনো তোমার মেয়েদের সাপোর্ট দিচ্ছো? আর তোমার নাতনী দের নিয়ে কি বলছো? ওরা কি তোমার কিছু হয় না ? আর তোমার সম্পত্তি কি আমার কিছু না ?

– না! আমার যা কিছু তা শুধু আমার তিন মাইয়ার।এইখানে তোর কোনো অধিকার নাই। বলেই আমার শাশুড়ি রুমে যেয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।

জহির আর কোনো কথা না বলে রুমে যেয়ে চুপচাপ বসলো। অনেকক্ষণ পরে আমাকে খুব শান্ত স্বরে বললো, আজ তো বেশ রাত হয়ে গেছে। আজ আর ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় যাই বলো? কাল সকালে খুব ভোরে এক কাপড়ে পারবেনা আমার সাথে বের হতে?

আমি ওর এত শান্ত মেজাজ দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। এত কিছুর পরে হঠাৎ করে এত শান্ত সে কি করে হয়ে গেলো? আমার কোনো জবাব দেয়ার আগেই ও চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর বন্ধ চোখ দুটি দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি অতি যত্নে আচলে ওর চোখের পানি মুছে দিলাম।

পরের দিন অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে তখনো ওর ঘুম ভাঙছেনা দেখে আমি ডাকাডাকি করতে লাগলাম। ও সাধারণত ফযরের পরে আর ঘুমায় না। কিন্তু আজ নামাজের জন্য না উঠায় আমি প্রথমে মনে করলাম, হয়তো কালকের ব্যাপার নিয়ে অনেক ক্লান্ত তাই ঘুমুচ্ছে। আমি এজন্য আর আগে তাকে ডাকিনি। পরে অনেক ডাকতে ও যখন উঠছে না আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভয় পেয়ে আমার শাশুড়িকে ডাকলাম। তারাও প্রথমে ভেবেছে আমি কোনো চালাকি করছি তাই আসলোনা। পরে আমার কান্নার শব্দ শুনে ওরা দৌড়ে আসলো। কত কিছুই করছি সবাই মিলে কিন্তু,জহিরের কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারাতারি করে বীনার হাসবেন্ড অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসলো। হসপিটালে নিয়ে জানতে পারলাম জহির ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করেছে। আমার পায়ের নিচের মাটি শুন্য হয়ে গেলো। আমি চতুর্দিক অন্ধকার দেখতে লাগলাম। কেউ আমার সাথে কথা বলছেনা। যে যার মতো ব্যস্ত। কাকে জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছিনা।

বাচ্চাদের কে সাথে করে নিয়ে সাহস করে ডাক্তারদের কাছে যেয়ে ওর রিপোর্ট এর রেজাল্ট জানতে পারলাম। জহিরের মস্তিষ্কের শিরায় রক্ত জমে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর এই অবস্থা হয়েছে অনেক আগেই, বেশ কয়েক ঘন্টা আগে। আরো আগে টের পেলে হয়তো এত ক্ষতি হতোনা। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারিনি। আমি কি করে বুঝবো? আমি তো দেখেছি ও ঘুমাচ্ছে। ওর মস্তিষ্কের ওই শিরার নিকটস্থ কোষগুলো দ্রুত মারা যেতে শুরু করছে। খুব দ্রুত ওকে ভালো নিউরোলোজিস্ট এর আন্ডারে ট্রিটমেন্ট শুরু হলো। জহিরের অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে। ওকে আই সি ইউ তে শিফট করা হলো। তখন এক নজর আমি ওকে দেখেছি। আর দেখা হয়নি আমাদের! তখনো বুঝিনি আমার সাথে জহিরের এই ই শেষ দেখা। আমি হাসপাতালেই নামাজে বসে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে জহিরের প্রাণ আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাইলাম। কিন্তু, আল্লাহ আমার ডাক আর শুনলোনা। সারাদিন না খেয়ে বাচ্চাদুটি নিয়ে রাত বারোটা একটা পর্যন্ত ওখানে অপেক্ষায় থাকলাম কোনো ভালো খবরের। কিন্তু? কোনো খবর আর এলোনা। রাতে বীনার হাসবেন্ড আমাকে, বীনাকে আর শাশুড়ি কে বাসায় পাঠিয়ে দিলো। কণা, রিনা আর সে হাসপাতালেই থাকলো। একরকম জোর করে আমাকে পাঠিয়ে দিলো। সারারাত ঘুমালামনা। নফল ইবাদত করতে থাকলাম। দোকান থেকে পাউরুটি এনে রাতে বাচ্চাদের খাইয়েছি। পরদিন হাসপাতালে খাবার রান্না করে নিয়ে আবার গেলাম। কিন্তু জহিরকে দেখতে পেলাম না। এভাবে পাচ ছয় দিন শুধু যাই আসি। জহিরের কোনো পরিবর্তন নেই। আমার সাথে বীনার হাসবেন্ড ছাড়া আর কেউ কোনো কথা বলতোনা। এমনকি আমার বাচ্চাদের সাথেও না।

এক সপ্তাহ পরে খবর পেলাম যে জহির আবার স্ট্রোক করেছে। দিশেহারা হয়ে গেলাম। কোনো ভালো সংবাদ তো পাচ্ছিনা। শুধু খারাপের দিকেই যাচ্ছে। জহিরের সাথে কেউ দেখা করা যাচ্ছেনা। এমারজেন্সি যদি কাউকে লাগে তবে শুধু কণাই যাচ্ছে। আমার কথা কেউ মনেই করছেনা।

এর দুদিন পরে কণা বাসায় এসে বললো, ভাইয়াকে আই সি ইউ তে রাখতে আর খরচ চালাতে অনেক খরচ হচ্ছে যার কাছে যা আছে বের করো।

আমি দৌড়ে গিয়ে জহিরের কিছু টাকা ঘরে রাখা ছিলো তা বের করে দিলাম। এরপর মনে পড়লো গহনার কথা। গয়নার বাক্স শাশুড়ির হাতে দিয়ে বললাম, এইখানে আড়াই লক্ষ টাকার গয়না আছে।এটা বিক্রি করে যে টাকা হয় সেটা দিয়ে ওর চিকিৎসা খরচ চালান।

গয়না দেখে সবার চোখ চড়কগাছে পরিণত হলো।

– এতো টাকার গয়না কবে কেনলা?

– মা, এই কয়েকদিন আগেই আপনার ছেলে দিয়েছিলো।

– আমাদের দেখাও নাই ক্যান?

– মা, ওই পরে দেখাতে বলেছিলো। আমি আপনাদের দেখাতাম। কিন্তু, বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে ভুলে গিয়েছি।

অমনি বীনা আর ক্ণা এসে আবার শুরু করে দিলো। যত ধরনের বাজে কথা আর গালি আছে সব শুরু করে দিলো। আমি একটা উত্তর ও সেদিন দিলাম না। ওরা ওইদিন ও আমাকে মারলো। আমার আর আমার বাচ্চাদের কারনেই নাকি জহির স্ট্রোক করেছে তাই ও বাড়িতে আমার জায়গা নেই। ওরা বোনেরা মিলে আমার আর বাচ্চাদের কিছু কাপড় কোনোরকম করে ব্যাগে ভরে আমাকে আর মেয়েদুটিকে টানতে টানতে গেটের বাইরে বের করে দিলো। আমার ব্যাগ বাসার গেটের বাইরে ছুড়ে ফেললো। মেয়ে দুটি ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো। আমি দৌড়ে গিয়ে শাশুড়ির পা ধরে মাফ চাইলাম। বললাম, জহির সুস্থ হওয়া পর্যন্ত একটু ঠাই দেন। ও সুস্থ হলে আমি নিজেই চলে যাবো। আর কোনোদিন ফিরে আসবো না। কিন্তু আমার কোনো কথা ওরা শুনলোনা। আমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিয়ে দরজা দিয়ে দিলো। আমি সেখান থেকে গেলাম হাসপাতালে। সেখানে যেতেই রিনা আমাকে যা খুশি তাই বলা শুরু করলো। আমি তারপরেও সন্ধ্যা নাগাদ ওখানে থাকলাম। সন্ধ্যায় আবার বাসায় গেলাম। কিন্তু কেউ দরজা খুললো না। শেষে উপায়ন্তর না পেয়ে সারাদিনের ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে রাতের গাড়িতে পাবনায় ফিরলাম। পাবনায় যেয়েও দিনে কয়েকবার ওদের কারো না কারো নাম্বারে ফোন দিতাম কিন্তু সবসময়ই ফোন বন্ধ পেতাম। হয়তো আমার নাম্বার ব্লক করে রেখেছিল। অন্য কাউকে দিয়ে ফোন দেয়ালে জহিরের কথা জানতে চাইলেই ফোন কেটে দিতো। দিন দশেক পরে আমার এক খালা আর খালাতো ভাইকে সাথে নিয়ে আবার ঢাকা আসলাম। সরাসরি হাসপাতালেই গেলাম। কিন্তু সেই একই অবস্থা। ওর কোনো পরিবর্তন নেই। আমাকে দেখার অনুমতি দেয়া হলোনা। আমার খালা আর খালাতো ভাইয়ের সাথে ওদের অনেক তর্কাতর্কি হলো। কোনো লাভ হলোনা। আবার পাবনায় ফিরে এলাম। হাতে টাকা পয়সাও নেই। কোনোবার আভার কাছ থেকে কোনোবার চাচাতো ভাইদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কয়েকদিন পর পর আমি ঢাকায় ছুটে আসতাম, কিন্তু,খালি হাতেই ফিরে যেতাম। এক নজর দেখা মিলতো না তার সাথে আমার। বাসায় যাওয়ার সাহস পেতাম না। বাচ্চাদুটি কে নিয়ে আবার খালি হাতে ফিরে আসতাম। আল্লাহর দরবারে প্রতিদিন কান্নাকাটি করতাম। সবকিছু আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলাম। হঠাৎ একদিন আতিক ভাই খবর দিলো ঢাকায় যেতে হবে। জহির অসুস্থ বেশি। আমার যা বোঝার আমি বুঝে গিয়েছিলাম। আসল কথা হলো, ছোট মামা ইতালি বসে ফেইসবুকের মাধ্যমে জহির চলে যাবার একদিন পরে জানতে পারে যে জহির মারা গেছে। এভাবে ঢাকায় আসি। এসে জানতে পারি যে জহিরকে দাফন করাও শেষ। আর আমার প্রতি ওদের সেই একই অবস্থা। আমাকে এক রাত কোনোরকম থাকতে দেয়। সকালবেলা বের করে দেয়। শেষ দেখাও পেলাম না আমি তার! আমার মেয়েরা আজও জিজ্ঞেস করে ওদের বাবা কোথায়? কবে আসবে? কবে চকলেট নিয়ে আসবে ওদের জন্য?

কি উত্তর দিবো জানা নেই। চলছি নিরুদ্দেশের পথে!

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে