শোভা পর্ব-১১

0
541

#শোভা
#পর্ব_১১

– সব কথাই তো শুনলেন আন্টি? এবার বলেন আমি কি করবো ? বাবার বাড়িতে ফিরে যাবো বা সেখানে থাকবো সে রকম পরিস্থিতি ও ওখানে নেই! আমি এখন আমার শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যাবো? সেই রকম পরিস্থিতি কি আছে?

– তোর সব কথা শুনলাম! আসলেই খুবই হৃদয় বিদারক। কি করে ছিলি তুই ওখানে এতো বছর? এতো নিষ্ঠুর কি করে হতে পারে মানুষ? এতোটা বিবেকহীন মানুষ ও পৃথিবীতে আছে? আমি অবাক হয়ে যাই ভেবে! উফ! তোর প্রতিটি কথা আমার বুকে তীরের মতো এসে বিধেছে। মানুষ অর্থের প্রয়োজনে স্বার্থপর হয়, প্রয়োজনে মানুষ মানুষকে খুন করতে পারে, এটা নতুন কিছু নয়! আমি জানি কিন্তু, একজন মা কিভাবে তার সন্তানদের মধ্যে ভেদাভেদ করে, এটা আমার মাথায় আসেনা! পৃথিবী টা এতো নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে কেনো দিন দিন। তুই কিভাবে বেচেঁ আছিস এতোকিছুর পরে। আমি এই এনজিওর কারণে মেয়েদের অনেক ধরনের সমস্যা সম্পর্কে জানি, অনেক সমস্যার সলিউশান ও খুজে বের করি। বাট, তোর প্রোব্লেমস টোটালি ডিফারেন্ট। আ’ম টোটালি ডিসাপয়েন্টেড! এই সিচুয়েশানে আসলে কি করা যায় সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। তোর বাচ্চাদের হকের জন্য তুই লড়তে পারিস! বাট, ওখানে সত্যি কথা বলতে তোর শাশুড়ি যতক্ষণ বেচে আছে লিগালি তোর বা বাচ্চাদের এখন কোনো রাইট নেই। মানবিক দিক থেকে আমরা ট্রাই করতে পারি। যদি তুই চাস! কিন্তু আমি আমার পার্সোনাল অপিনিয়ন থেকে তোকে বলবো, ওদের সাথে লড়াই করে কোনো লাভ নেই!

– আমিও লড়তে চাইনা, আন্টি। আমি শুধু বাচ্চাদেরকে নিয়ে একটু বেচে থাকতে চাই! আমি আর কিছু চাইনা। কোনোরকম করে দুমুঠো ভাত আর একটু মাথা গোজার ঠাইয়ের যেনো ব্যবস্থা করতে পারি সেটুকু হলেই চলবে। আমি কারও দয়ায় বাচতে চাইনা।

– আমার কাছে যেহেতু এসেছিস চিন্তা করিস না, ব্যবস্থা একটা হবে। কিন্তু, আমি তোকে বলছিনা যে তুই তোর উপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিকে ভুলে যা; আমি চাই তোর উপর ঘটে যাওয়া প্রতিটি কষ্টকে অবশ্যই মনে রাখবি। প্রতিটি আঘাতের জন্য পালটা আঘাত দেয়ার জন্য তোকে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। এর জন্য তোকে অপেক্ষা করতে হবে। আমি চাই কোনো নারীই যেনো আর তোর মতো আর এ ধরনের অত্যাচারের শিকার না হয়।

– কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব আন্টি?আমি যে নিতান্তই দুর্বল। আমি আর ওদের মুখোমুখি হতে চাইনা এ জীবনে! আপনি শুধু আমাকে বাচার একটা রাস্তা করে দিন।

-নিজেকে এতটা উইক কেনো ভাবিস ? আমরা মেয়েরাই আমাদের উপর যে অত্যাচার হয় এর জন্য দায়ী। তুই তোর ব্যাপারটাই দেখছিস না কেনো? তুই যদি প্রথম থেকেই সবকিছু জহিরের কাছে শেয়ার করতি তা হলে তোর জীবন হয়তোবা এতটা সমস্যাপূর্ণ নাও হতে পারতো আজ। তুই যদি তোর শাশুরীকে প্রথমেই বুঝিয়ে দিতি যে তুই দুর্বল নয়, তাহলে হয়তো তোর জীবনের বাক আজ অন্য দিকে ঘুরতে পারতো। যাক যা হবার তা হয়ে গেছে। সেটা কে তো এখন আর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে তোকে আমি শুধু আমি একটা কথাই বলতে চাই, অবশ্য বলতে চাই বললে ভুল হবে আমি তোকে উপদেশই বলতে পারিস দিতে চাই ; নারী শক্তিতে বিশ্বাস করতে হবে । একজন মেয়ের মধ্যে যদি কোনো কিছু করার জন্য সঠিক আত্মবিশ্বাস থাকে এবং তা ধরে রাখার যথার্থ জ্ঞান থাকে তাহলে সে চলার পথে কোনোদিন পথ হারাবেনা। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তুই যদি অন্যকে সুযোগ দিস তাহলে সবাইই সু্যোগ নিতে চাইবে । মনে ভয় থাকলেও সেটা কারো সামনে প্রকাশ করবিনা। যাই হোক, তুই আজকে আমার সাথে অফিসে চল। দেখি তোর জন্য কি করা যায়!

শোভাকে বিলকিস বানু নামে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। উনি সংগঠনের মহিলাদেরকে তাদের যোগ্যতা আর দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের ট্রেইনিং দিয়ে থাকেন। মাঝবয়সী একজন মহিলা। ট্রেইনিং ছাড়াও মেয়েদেরকে মোটিভেটেড করার জন্যও উনি অনেক দক্ষ।

– শোভা! আমি তোমার সম্পর্কে ম্যাডামের কাছ থেকে অনেক কিছু শুনেছি তোমার সাথে আসলে যেগুলো হয়েছে খুবই দুঃখজনক। একটা মানুষের জন্য এতটা কষ্ট কিভাবে সহ্য করা সম্ভব আমার মাথায় আসেনা। যাই হোক তোমার কষ্ট গুলিকে খুঁচিয়ে আরো বাড়িয়ে দিতে চাইনা! তুমি যেভাবে সেগুলিকে ওভারকাম করতে পারবে, কিভাবে এই পৃথিবীতে সম্মানের সাথে সারভাইভ করবে, এখন সেটাই ভাবনার বিষয়।
আসলে আমাদের এই পুরুষ শাসিত সমাজের পুরূষদের চিন্তা চেতনা আর আর অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের পারিপার্শ্বিকতাই মেয়েদের অসহায়ত্বর জন্য দায়ী। মেয়েদেরর সাথে দাসী বাদীর মতো ব্যবহার করা এই সমাজের মানুষ গুলির যেনো এখন চিরাচরিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু, মেয়েরাই শুধু বিয়ে করবে, বাচ্চা মানুষ করবে, শশুরবাড়ির মানুষের গোলামী করবে, স্বামীর সাথে এডজাস্ট করে চলতে হবে, এটাই তার সারা জীবনের দায়িত্ব- এই সমস্ত পুরানা দিনের ধারণা আজ আর নেই। মেয়েরা এইসব চিন্তা চেতনা থেকে বের হতে শিখছে। শুধু শহরের শিক্ষিত মহিলারা নন, গ্রামের তথাকথিত কম লেখাপড়া জানা মহিলারাও আজ নিজেরা কিছু করে দেখাতে চাইছেন। সবাই চাইছেন নিজে কিছু টাকা রোজগার করতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে। স্বামীর বা বাড়ির পুরুষদের ওপর একান্ত নির্ভরতা অনেকসময় তাদের দুর্বলতা হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। আর দুর্বলের ওপর অত্যাচার হওয়া তো স্বাভাবিক। তাই সবদিক থেকে নিজেকে সুরক্ষা দিতে সব মেয়েই আজ চায় স্বনির্ভর হতে। কিন্তু যেহেতু অনেকে তেমন শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পান না, তাই কিছু হাতের কাজ শিখে সহজেই মেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন।

অবশ্য মেয়েদের এই পিছিয়ে পড়ার পেছনে বাবা মা ই বেশিরভাগ দায়ী। আমাদের সমাজ অনেক এগিয়ে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু নারীদের তারা এখনো পিছনে রাখতে চায়। সেই পুরানকালের মতো তাদের ঘরে বন্ধ করে রাখতে চায়। বাইরে গেলে এটা হবে, ওটা হবে। বেশি লেখাপড়া করে কি হবে,সেই তো স্বামীর রান্না করা লাগবে। চাকরি করে কি হবে,স্বামী তো রোজগার করবেই।

আর সব শেষে কি হয়? সেই নারী যখন তার সামান্য শখ পূরণ তো দূর প্রয়োজনের জন্য টাকা চাইবে, শুনতে হবে কটুকথা। শুধু স্বামীর রোজগারের উপর নির্ভরশীল একটি মেয়েকে তার পরিবারের কাছে কতো যে ছোট হয়ে থাকতে হয় সেটা ওই মেয়েটা জানে। নিজে রোজগার করবো,নিজের মতো খরচ করবো এমন আশা প্রায় সবাই করে।

কিন্তু পরিস্থিতি হয়তো তার আশা শেষ করে দেয়। সংসারের চাপে বাইরে গিয়ে চাকরি করা সম্ভব না। তাই বলে কি রোজগার করা যাবে না। এখন ইন্টারনেটের যুগে কি না সম্ভব বলো?

আমি তোমাকে আমাদের এখান কার কাজের কিছু বর্ণনা দিচ্ছি। তুমি দেখো কোনটা সবচেয়ে ভালো করতে পারো। যেটাতে সবচেয়ে বেশি তুমি উৎসাহ বোধ করবে সেই বিষয়ে তোমাকে আমরা প্রশিক্ষিত করবো।

– ম্যাডাম, আমি আমার মেয়েদুটিকে কি সাথে রাখতে পারবো? আমার তো ঢাকায় কোনো আপনজন নেই! তাই বললাম!

– অবশ্যই। আমারা পিছিয়ে পড়া, অভাগী, অভাবী, অত্যাচারিতা মেয়েদের নিয়ে কাজ করি। তাই তাদের সকল সুবিধা অসুবিধা দেখা আমাদের কাজ। তোমার মতো অনেকেই এই প্রশ্ন করে। আমরা জানি বাসায় বাচ্চা রেখে মেয়েদের কর্মস্থলে কাজ করার সময় অনেক ধরণের অসুবিধা হয়। মনোযোগ সহকারে কাজ করতে পারেনা। মন পড়ে থাকে বাসায়। আবার অনেকে বাচ্চাদের জন্য কাজেই আসতে পারেনা। তাই আমাদের এখানে এসব কথা চিন্তা করে বাচ্চাদের রাখার জন্য ডে কেয়ার আছে। তুমি চাইলে মাঝেমধ্যে বাচ্চাকে দেখে আসতে পারবে। আর চার বছরের বড় বাচ্চাদের জন্য আমাদের নিজস্ব স্কুল আছে। তুমি চাইলে তোমার মেয়েকে সেখানে ভর্তি করতে পারো।
কোনো খরচ লাগবেনা। স্কুলটি আমাদের সংগঠনের নিজস্ব ফান্ডের টাকায় চলে।

এবার কাজের কথায় আসি। তোমাকে আমি কয়েকটি কাজ সম্পর্কে ডিটেইলস ধারণা দিবো। এখান থেকে তোমার যেটা পছন্দ হয় তুমি সেটাকে সিলেক্ট করতে পারো এবং সেটার উপরেই তোমাকে আমরা প্রশিক্ষিত করে তুলবো।

– জ্বি, ম্যাডাম! বলুন।

তুমি যদি ভাল রাধুনি হও তবে আমাদের ‘ফুড হোম ডেলিভারি’ সেকশনের কাজ করতে পারো। বিভিন্ন অফিসের দুপুরের খাবার পাঠাই আমরা। বিভিন্ন ছোট ছোট অনুষ্ঠানের রান্নার কন্টাক্ট নেই আমরা। তাছাড়া পিঠা,চানাচুর,লাড্ডু জাতীয় খাবার বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি করি আমরা। এ থেকে অনেক মেয়েই স্বাবলম্বী হয়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করেছে এখন।

আবার তুমি ভালো সেলাই পারলে আমাদের বুটিক শপের কাজে জয়েন করতে পারবে। সেক্ষেত্রে অনলাইনে যে অর্ডার পাবো সেটার উপর ভিত্তি করে কাজ করতে হবে । তারপর কাস্টমারকে ডেলিভারি দেই। ঢাকার অনেক নামিদামী শোরুমেও আমাদের মেয়েদের হাতের কাজ যায়। এটার চাহিদা এবং আয় সব খাতের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে বেশি।
তুমি চাইলে ব্যক্তিগত ভাবেও ব্যবসা করতে পারো। কোনো আপত্তি নেই আমাদের। অনেকেই করছে।আমরাই ব্যাংক থেকে ওদেরকে ঋণ পেতে সাহায্য করছি।

এছাড়া নানান ধরনের হাতের কাজ যেমন অনেকে আছে খুব সুন্দর ফুল,শোপিস,পাপস,কুশন,ফুলদানি,কার্ড,ওয়ালমেট এসব তৈরি করতে পারে। এমন কোন গুন থাকলে সেগুলো তৈরি করে আমরা অনলাইনে বিক্রি করি। আবার শোরুমেও পাঠাই।

– ম্যাডাম আমার ছোটোবেলা থেকেই সেলাই কাজে অনেক আগ্রহ। আমি এটাই মনে হয় সবচেয়ে ভালো পারবো। বিভিন্ন নকশি করে ফুল তুলতে পারি।

– ঠিক আছে! তুমি তাহলে কাল থেকে শুরু করে দাও। দেখি কতটুকু পারছো তুমি! আর আমরা তো আছিই।

– ইনশাআল্লাহ! আজ তাহলে উঠি।

শোভা নতুন বাসা নিতে চাইলো কিন্তু, রুখসানা বেগম কি এক মায়ার বাধনে জড়িয়ে গিয়েছে ওদের সাথে। তাই বললো, আর কিছুদিন থাকনা, আমার বাসা তো খালিই পড়ে থাকে। এতো বড় বাসা! অথচ মানুষের আনাগোনা না থাকলে কেমন মরা বাড়ি, মরা বাড়ি মনে হয়। ছেলেটা সারাদিন কই কই থাকে? মেয়েটা ও তো সংসারের ঝামেলায় আসার সময়ই পায়না। তোর খালু ও বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে থাকে। তোর বাচ্চা দুটির কারণে ঘরটা ভরাভরা লাগে। তাছাড়া তোর আয় রোজগার আর একটু বাড়ুক। তারপরে না হয় বাসা নিস। শোভাও না করলো না। তার হাতে তেমন কোনো টাকা পয়সাও নেই যে সেটা দিয়ে সে যেমন তেমন করেও একটা বাসা নিয়ে এই মুহুর্তে আলাদা থাকবে। তাই সে রাজি হয়ে গেলো। তাছাড়া বাসার সবাই অনেক ভালোবাসে শোভা আর তার বাচ্চা দুটিকে। তাই এখানে থাকাটাই এই মুহুর্তে তার কাছে ভালো উপায় মনে হলো।

শোভা আলোর বাহনে হাতের কাজ করছে বেশ কিছুদিন হলো। জান্নাতকে ওখানকার স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। বেশ ভালোই চলছে। সকালে বের হয় আর বিকালে ফেরে। রুখসানা বেগমের স্বামী অনেক ভালো মানুষ। উনি শোভাকে অনেক স্নেহ করেন। আর রুখসানা বেগমের ছেলেও তাকে বড় বোনের চোখে দেখে।

রুখসানা বেগম মাঝেমধ্যে এনজিওর কাজে দূরে যায়। মাঝেমধ্যে রাতে বাইরেও থাকে।

সেদিন সন্ধ্যায় হুট করে রুখসানা বেগমের দেবর রায়হান সাহেব তাদের বাসায় আসলো। উনি খুলনাতে ব্যবসা করেন। বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হবে হয়তো। দুই মেয়ে আর এক ছেলের বাবা। ছেলেমেয়েরা বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। ঢাকায় এসেছেন ব্যবসায়ের কাজে। রুখসানা বেগম বাসায় নেই। উনি তিন চারদিনের জন্য একটা সেমিনারে যোগ দিতে রাজশাহী তে গিয়েছেন। সাথে তার ছেলেকেও নিয়ে গিয়েছেন। হুট করে চলে আসাতে ভাবির সাথে আর রায়হানের দেখা হলোনা।

রুখসানা বেগম শোভাকে ফোন দিয়ে ওনার পছন্দ অপছন্দ বলে দিলেন। কিভাবে আপ্যায়ন করতে হবে, কখন কি খায় সব বলে দিলেন। আর এই তিন দিনের জন্য ছুটি নিতে বললেন। শোভাকে বললো, আমার এই দেবর কিন্তু অনেক খুতখুতে আর রাগী। উপর থেকে বোঝা যায়না। এমনিতে ভালো মানুষ! ভালো করে আপ্যায়ন করিস! কোনো ত্রুটি যেনো খুঁজে না পায়! আর রহিমা তো ওনাকে জানেই ভালো করে সমস্যা হবেনা কোনো।

শোভা তাই করলো। সারাদিন ওনার পছন্দের খাবার দাবার তৈরিতে ব্যস্ত থাকলো। নিজের হাতে অনেক যত্ন করে খাবার দাবার রান্না করলো। উনি কম মসলা আর তেলের খাবার খান। ওনার দেহের গড়ণ দেখলেই বোঝা যায় অনেক স্বাস্থ্য সচেতন। সকালে টাইমলি ওনার খাবার দিলো টেবিলে। ওনার সাথে টুকটাক কথাবার্তাও হলো। বেশ আলাপী মানুষ। সবসময়ই হাসি মুখে থাকেন। সকালের নাস্তা শেষ করে বের হলেন আর রাত বারো টায় ফিরলেন। শোভা বাচ্চাদের ঘুম পারিয়ে দিয়ে ওনার আসার অপেক্ষায় বসে রইলো।

এত রাত পর্যন্ত শোভাকে বসে থাকতে দেখে উনি অবাক হয়ে গেলেন। হাত মুখ ধুয়ে ড্রইং রুমে এসে বসলেন। কাজের মহিলা টেবিলে খাবার দিয়ে শোভাকে ডাক দিয়ে বললো, আন্টি, ভাইজানের খাবার দিছি। আইতে কন।

– চাচাজি, টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে।

– আমি আসলে খেয়ে এসেছি। কিন্তু তুমি এতো রাত পর্যন্ত জেগে আছো কেনো? বুয়া বলেনি তোমাকে আমি দেরি করে বাসায় ফিরি। ও তো জানে।

– হ্যা, বলেছে। কিন্তু, এটা কেমন কথা! আমি আন্টির কাছ থেকে শুনে শুনে আপনার পছন্দ মত অল্প তেল আর মশলা দিয়ে খাবার রান্না করেছি। আর আপনি বাইরে খেয়ে এলেন! আন্টি শুনলে কি মনে করবে, বলেন? অল্প কিছু খেয়ে নিন।

– ঠিক আছে, অল্প কিছু টেষ্ট করি। কষ্ট করে রান্না করেছো। চলো, তুমিও খাবে।

– ধন্যবাদ, চাচাজি! আমি রহিমা খালা আর বাচ্চাদের সাথে খেয়ে নিয়েছি। এখন আর খাবোনা। আপনি খান।

উনি অল্প কিছু খেয়ে এসে সোফায় বসতেই শোভা উনার জন্য এককাপ চা নিয়ে আসলো।

– তুমি কিভাবে জানলে আমি শোয়ার আগে চা খাই?

– আমাকে আন্টি বলেছেন।

– তোমার রান্নার হাত মাশাআল্লাহ্! অনেক ভালো রান্না করতে পারো। তোমার কথা ভাবির কাছে শুনেছি। অনেক স্যাড স্টোরি! তো এখন কেমন লাগছে নতুন জীবন?

– ভালোই! ইনারা সবাই খুব ভালো মানুষ। আর আমার কাজটাও ভালো। খুব বেশি কষ্ট করতে হয়না। সবমিলিয়ে চলছে বেশ ভালোই। চাচাজির কি আর কিছু লাগবে?

– না, আর কিছু লাগবেনা। তুমি ঘুমুতে যেতে চাইলে যেতে পারো! শুধু রহিমা কে বলবে একটা বাটিতে করে একটু তেল নিয়ে আসতে। আমি ঘুমুতে যাবার আগে একটু তেল ম্যাসাজ করি। ঘুম ভালো হয়। এটা বহু পুরানা অভ্যাস। তোমার চাচি অসুস্থ থাকে প্রায়ই বলা যায়। রাতে ঘুমানোর সময় অনেক শব্দ করে। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ফিরি। ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই বড় মেয়েকে দিয়ে একটু তেল ম্যাসাজ করিয়ে ঘুমাতে যাই। ঘুম ভালো হয়। তাই অনেকদিনের অভ্যাস তো! এখন তেল না দিলে ঘুম হয়না।

– কি হয়েছে চাচির?

– অনেক সমস্যা! বড় সমস্যা হলো তার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে এই বছর দুই হলো।

– ও! তাহলে তো অনেক কষ্টের মধ্যে আছে চাচি! আহারে!

– হুম!

– ঠিক আছে, চাচাজি! আমি রহিমা খালাকে পাঠাচ্ছি!

– তোমার চা টা কিন্তু বেশ হয়েছে!

– ধন্যবাদ, চাচাজি!

পরেরদিন সকালে নাশতা শেষ করে রায়হান সাহেব বের হয়ে গেলেন তার কাজে! শোভা আজও কাজে যায়নি।
হঠাৎ করে রহিমা খালা এসে শোভাকে বললো, আন্টি বাড়ি থাইকে ফোন আইসলো। আমার বড় যে মিয়া ফোয়াতি কইলাম না সেদিন, ওরে হাসপাতালে লিয়ে যাচ্ছে। ব্যাদনা শুরু অইছে। আমার এখনি রওয়ানা হইতে হবে। আফনি খালাম্মাকে একটু জানায় দ্যান।

শোভা ভয় পেয়ে গেলো।

– এত বড় বাড়িতে একা কি করে থাকবো? তাছাড়া বাসায় মেহমান আছে!

– আমি তো প্রায়ই থাহি! সমেস্যা হবিনা নে। আমার মিয়ার এত আগে আগেই ডেলিবারি হবি আমি তো বুইঝবার পারিনাই। আমার যাওয়াই লাগবি।
আফনে খালাম্মারে বুঝাই কইয়েন। আর রায়হান খালুজানে তো তেমন খায়না বাসায়। আফনের কষ্ট হবিনানে। আর একদিন বাদেই তো খালাম্মায় আইসবে। চিন্তা কইরেন না। আমার এখনি রওয়ানা হইতে হবে। আমি খালাম্মারে ফোন দিছি ধরেনাই। মনে হয় ব্যস্ত!

শোভার ভয় ভয় লাগছিলো। একেতো এতবড় বাসাতে একা। তার উপর একজন অপরিচিত পুরুষ মানুষের সাথে!

আজও রায়হান সাহেব অনেক রাতে ফিরলেন। শোভার ভয় ভয় করছে। সে খাবার দিবে কিনা জিজ্ঞেস করলো।

– হ্যা, খাবার দাও। আজ খেয়ে আসিনি। তোমার হাতের এত ভালো স্বাস্থ্যকর খাবার রেখে বাইরের খাবার খেতে মন চাইলো না।

খাবার খাওয়ার শেষে চা খেতে খেতে রহিমাকে ডাকলো তেল মালিশ করে দিতে।

– চাচাজি, উনি বাসায় নেই। ওনার মেয়ে অসুস্থ। তাই গ্রামে গিয়েছে।

– ও মা তাই নাকি! তাহলে আমার ম্যাসাজের কি হবে। আজ তো রাতে আর ঘুম হবেনা। কি এক বাজে অভ্যাস বলো তো! কাল সকালে একটা ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। ঘুম না হলে তো সিক হয়ে যাবো। এমনিতেই আজকে প্রেসার টা হাই! কি করি বলোতো!

শোভা ইততস্ত করতে করতে বললো, চাচাজি আমি তেল এনে দি, আপনি লাগাতে পারবেন না?

– নাহ! নিজের টা নিজে করলে তো পারফেক্ট হয়না। তুমি যদি কিছু মনে না করো একটু কষ্ট করে লাগিয়ে দিবে?

শোভা আস্তে করে শুধু বললো, চাচাজি বাচ্চারা একারা ঘুমাচ্ছে! যদি উঠে আমাকে না পায় অনেক কান্না করবে! শোভা ভাবছে, কি করবে! কিভাবে করবে! কিন্তু, আন্টি যদি মাইন্ড করে! চাচাজি যদি তার কাছে কিছু বলে?

– আরে বাবা! উঠবেনা। মাত্রই তো ঘুমিয়েছে। আর উঠলে তুমি চলে যাবে। এইতো কাছেই। প্লিজ!

শোভা কি করবে বুঝতে পারছেনা। ভয় আর লজ্জা দুটোই তার উপর ভর করেছে। তারপরেও নিজেকে নিজে এটা বলে সাহস দিলো, উনি তো বলা যায় পিতৃসম। সমস্যা কি!

একটা বাটিতে তেল নিয়ে শোভা রায়হান সাহেবের মাথায় মালিশ করতে লাগলো।

কিছুটা ভয় আর কিছুটা লজ্জা নিয়ে সে ধীরেধীরে তার মাথায় ম্যাসাজ করতে লাগলো।
অনেকক্ষণ হয়ে যাবার পরেও রায়হান সাহেব কোনো সাড়াশব্দ না দেয়ায় সে বিরক্তিভাব লুকিয়ে আস্তে করে বললো, চাচাজি হয়েছে?

দুইবার ডাক দেয়ার পরে সে উত্তর দিলো!

– উহু! আর একটু! তোমার হাতে তো জাদু আছে। মাশাআল্লাহ্! এত দারুন করে মায়া ভরা হাতে কেউ কোনোদিন ম্যাসাজ করে দেয়নি। আর একটু, প্লিজ!

শোভা বিরক্তিকরভাবে কোনো কথা না বলে ধীরেধীরে তার চুলের মধ্যে হাত নাড়াচ্ছে।

– কি ভাবলে তুমি? জীবন টা কি এভাবেই কাটিয়ে দিবে? মানে বিয়ে সাদী আর করবেনা? ছোট ছোট বাচ্চা! ওদেরকে তো মানুষ করতে হবে! তাছাড়া তুমি তো এখনো পিচ্চি! সারাজীবন তো পড়েই আছে! এই বয়সেই এত জটিলতা! তোমার মতো বয়সে তো আজকাল মেয়েরা বিয়ের কথা চিন্তাই করে না।

রায়হান সাহেবের এরকম অবান্তর প্রশ্নে শোভা অবাক হয়ে গেলো। সে শুধু শান্ত ভাবে বললো,

– কেনো? আমিই আমার মেয়েদেরকে মানুষ করবো! আর বিয়ের প্রশ্ন এখানে আসছে কেনো? চাচাজি, বিয়ে ছাড়া একা কি একটা মেয়ে মানুষ চলতে পারেনা? আর মানুষের বিয়ে একবারই হয়!

– হুম। তা ঠিক আছে!

শোভা বিরক্তির সাথে বললো, আমি আসি চাচাজি! অনেক রাত হয়েছে।

– ঠিক আছে!

শোভা রুমে যেয়ে ভালো করে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু কেনো যেন ঘুম আসছেনা। অজানা ভয় এসে ভর করছে তার মাথায়।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে