শোভা পর্ব-০৮

0
455

#শোভা
#পর্ব_৮

এতদিন আমার শাশুড়ি ননদেরা আমার উপর যে ধরণের মানসিক নির্যাতন করতো, সেদিন জহির আমার পক্ষে সাপোর্ট দেয়ার পর থেকে সেই নির্যাতনের ধরণ আর মাত্রা দুটোই বেড়ে গিয়েছে।
আমি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে সারাদিন ঘরের সব কাজ একাই করি। খুশি আমাকে সাহায্যের জন্য আসলে ওরা ওকে ডাক দিয়ে নিয়ে সারাদিন ওদের পার্সোনাল কাজে ব্যস্ত রাখে। ওদের রুম পরিষ্কার করতে ডাকবে, এটা সেটা আনতে বাইরে পাঠাবে, কাপড় ধোয়ানো, আরো কত কাজ! দেখা গেলো খুশি বসে আছে আমি খুশিকে কোনো কাজের জন্য ডাকলাম, অমনি খুশিকে আমার শাশুড়ি বা ননদেরা কেউ ডেকে বলবে, খুশি চুলে একটু তেল মেখে দেতো। আমার শাশুড়ি বলবে, আমার কোমোরের ব্যাথাটা বাড়ছে, একটু হাত পা ম্যাসাজ করে দেতো! আমার ওদের এইসব কাহিনী দেখে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।

ওদের এইসব দেখে অতীষ্ঠ হয়ে একদিন জহিরকে বললাম, আমার শরীরটা তো দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে, সারাদিন কতো কাজ সংসারে! কয়েক মাসের জন্য একজন কাজের মানুষের ব্যাবস্থা করা যায়না?

– ঠিক আছে! দেখছি!

পরের দিন সকালবেলা খাবার টেবিলে বসে জহির আমার শাশুড়িকে বলল, মা! শোভার শরীর দিন দিন তো খারাপের দিকে যাচ্ছে। এই কয়েক মাসের জন্য একজন কাজের মহিলা রাখা যায় না?

শুরু হয়ে গেলো কুরুক্ষেত্রের কাহিনী! এই ভয় টাই আমি পাচ্ছিলাম।

– তোর বউয়ের জন্য কি লাগবে আর কি না লাগবে সেইটা বুঝি আর আমি বুঝিনা না? কি ভালো হবে আর কি মন্দ হবে, সেইগুলো আমরা বুঝিনা ভাবছিস? আমরা কি ওর শত্রু নাকি? তুই কি মনে করছিস আমি বুঝতে পারি নাই যে এই সব কথা তোর বউ তোরে বলছে যে কাজের মানুষ লাগবে! কি লাগবে আর কি লাগবে না সেটা আমি জানি! এ বিষয়ে তোর নাক না গলালেও চলবে! পোয়াতি অবস্থায় কাজকাম করতে হয়। এটা শরীরের জন্য ভাল। একটু কষ্ট হলেও সেটা করা উচিত। মা হওয়াতো এতো সস্তা না! আমরাও চার চারটা পোলাপাইনের মা হইছি। আমাদের কয়জন কাজের মানুষ ছিল?
আর তাছাড়া, ভারি কাজগুলো তো আমরাই করে দি। সব কাজে সাহায্য করি, আমরা কি নাই? আমরা এতগুলো মানুষ থাকতে আবার বাইরের মানুষ লাগবে, তার মানে কি আমরা কোন কাজে সাহায্য করি না? যেইটা ভালো বুঝিস সেইটা কর, আমার আর কিছু বলার নাই।

– ঠিক আছে মা! তোমরা যেটা ভালো বোঝো আমি কোনো কথাই বলব না! আমি তো কোনো কথা বললেই দোষ হয়।

আমি বুঝতে পারলাম যে এবারের ধাক্কাও আমার সামলাতে হবে। এই ঘটনার পর আমার শাশুড়ি আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না।

কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম! দেখলাম, আমার শ্বাশুড়ি একদম চুপচাপ! আমাকে কোন কথাই বললো না।

-কি ব্যাপার,মা! তুমি যে ভাবি কে কিছুই বললে না?

– কিছু বলি নাই। কারণ, কিছু বলার সময় এখন না। আমি জানি কখন কি বলতে হবে। এখন পরিবেশ গরম। পাল্লা বউয়ের দিক কাইত। কথা শুইনা রাখছি। এখন কি বলবো আর বউ বানাইয়া আবার কি বলবে? সময়ের অপেক্ষায় আছি।
ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না হঠাৎ কইরা জহির এইরকম হইলো ক্যান?

– আমিও তো সেটা ভাবি, মা! ভাইয়া এরকম হয়ে গেল কেন?

– আচ্ছা বাদ দে। এইখানে ওইটুকু মাইয়া আমাদের কিছুই করতে পারবে না। টেনশন করিস না। আমি পাক্কা খেলোয়াড়!

এরপর থেকে দেখতাম জহির যখন বাসায় থাকতো ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমার শাশুড়ি ননদেরা আমার সাথে সাথে কাজে সাহায্য করতো। কিন্তু বাসা দিয়ে গেলে আবার সেই আগের মত!

আমি স্পেশাল ভাবে কোন কিছুই খেতাম না। জহির দুধ, ডিম, বিভিন্ন ধরনের খাবার, ফলমূল এনে রাখতো। আমাকে খাওয়ার জন্য বলতো কিন্তু আমার কেন যেন লজ্জা লাগতো। আর ভয় করতো আমার শাশুড়ি আবার কি না কি বলে। খাবার আনার আগেই দেখতাম শেষ হয়ে যেতো। আমি যদি কিছু হাত দিয়ে ধরে খেতাম, আমার শাশুড়ি, ননদরা কেমন যেন খোঁচা মারা কথা শুনাতো। আমার শাশুড়ি বলতো, পোয়াতি মানুষের এত বেশি খাওনের দরকার নাই, এতে বাচ্চার ক্ষতি হয়। আমি জহির এর কাছেও লজ্জা আর কোনো কিছুই বলতাম না। কারণ আমি জানতাম জহিরের কাছে কোন নালিশ করলে, আমার উপরে আবার নতুন করে কাহিনী শুরু হয়ে যাবে!

আমি আল্লাহর কাছে শুধু এটাই চাইতাম যেন আমার নরমাল ডেলিভারি তে বাচ্চা হয়। কারণ সিজারে বাচ্চা হলে আমাকে দেখাশোনা করার মতো কেউই নেই। কিভাবে আমি চলবো! বাবা,আভাকে পাঠাতে চাইলেন। আমার শাশুড়ি নিষেধ করলো। সে বললো, আমরা এতগুলান মানুষ কি করতে আছি। ওইটুক পুচকি মাইয়া আইসা কি করবে?ও কি বুঝে? শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার? আমি বুঝতে পারলাম যে আভার আসাটা তাদের পছন্দ না! তাই জহিরকে ও বললাম যে, আমার কারো লাগবেনা। মা তো আছেই। আর তুমি থাকলেই চলবে। আল্লাহ আমার ডাক শুনলেন। আমি নরমাল ডেলিভারি তেই আমার সন্তানকে জন্ম দিলাম। পৃথিবীতে আসলো আমার প্রথম মেয়ে জান্নাত। ও খুবই দুর্বল হলো। দুই কেজি বা তার একটু বেশি এরকম হয়তো ওর ওজনটা ছিল। ওখানকার শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বলেছিলো যে অপুষ্টিজনিত কারণে নাকি ওর এই অবস্থা। বেশি বেশি করে পুষ্টিকর খাবার খেলে আজকে ওর এই অবস্থা হতো না। ডাক্তারের কথাশুনে জহির একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে একবার তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কারো মুখে কোন উত্তর নেই। কিন্তু আমার শাশুড়ি যা বোঝার তা ঠিকই বুঝে গেল। সে শুধু বললো, কিছুই খাইতে পারতো না। যা ই খাইতো বমি কইরা ফেইলা দিতো। এইজন্যই তো বাচ্চার এই দশা! আমরাতো খাওন দাওনে কোন দিক দিয়ে ঘাটতি রাখি নাই। দুইদিন হাসপাতালে থাকার পরেই আমি বাসায় আসলাম। সে সময়টাতে যদি জহির আমার পাশে না থাকতো তাহলে হয়তো আমাকে আরো কত না নাটকের সাক্ষী হতে হতো।

জহির মেয়ের নাম রাখল জান্নাত! জান্নাত কে দেখে ওর দাদী ফুফুরা খুশি হলো নাকি অখুশি হলো আমি সেটাই বুঝতে পারলাম না! কেমন যেন সব কিছুতে তাদের একটা বিরক্তি বিরক্তিভাব! ওরা আমার বাচ্চার কাছে আসে। এসে দূর থেকে একটু হাই-হ্যালো করে চলে যায়। কিন্তু কখনো কোলে তুলে নিতোনা। আমার শাশুড়ি ও একইরকমভাবে শুধুমাত্র জহির এর সামনে এসে একটু মাঝেমাঝে বাবুকে তেল মালিশ করে দিয়ে যেতো। এছাড়া তাকে খুব একটা বাবুর পাশে আমি দেখিনি! বাবুর জন্মের দশ দিন পরেই আমি রান্নাঘরে যেয়ে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছিলাম। এইদিন কটা আমার শাশুড়ি রান্নাঘরের কাজ সামলেছে। আমাকে সকালের নাস্তা খেতে দেওয়া হতো এগারোটায়, দুপুরের টা খেতে দেওয়া হতো চারটা কি পাঁচটায়। আমি ক্ষুধায় অস্থির হয়ে যেতাম কিন্তু কেউ আমাকে কোন খাবার দিতোনা। ইচ্ছে করেই দেরি করে রান্না করতো। আমি একদিন লজ্জা শরম রেখে জহির কে বললাম, জহির আমার তো খুব ক্ষুধা লাগে। বারবার মায়ের কাছে তো খাবার চাওয়া যায় না। আমাকে কিছু শুকনো খাবার কিনে দিবে? যেটা আমি খাটের নিচে রেখে মাঝে মাঝে খেতে পারি? জানিনা, সেদিন জহির কি বুঝেছিল! ও আমার চোখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো। এবং ওর চোখ দুটি অশ্রুসজল ছিলো। জহির কে আমার আর কিছু বলতে হয়নি। জহির নিজে থেকেই কিছু শুকনো খাবার লুকিয়ে নিয়ে এসে আমার খাটের নিচে রেখে দিয়ে বললো, এটা কাউকে দেখাবে না এমনকি মুহিব কেও না। আর আমি যে ফলমূল আনি ওগুলো তুমি খেও। আমি যাওয়ার সময় রুমে রেখে যাব। এমনিতেই আমার জান্নাতের ওজন কম তার উপরে যদি তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করো তাহলে বাবু কিভাবে খাওয়া পাবে? আর ওর গ্রোথ কিভাবে হবে, বলো?

বাবুর সব কাজ আমাকে এক হাতেই করতে হতো। তবে জহির অফিসে যাওয়ার আগে বাবুর কিছু কাজকর্ম করে দিয়ে যেত আর কেউই কখনো আমাকে সাহায্য করতে আসেনি। এমনকি খুশীও না! খুশি কে সবসময় বিভিন্ন ধরনের কাজে ওরা ব্যস্ত রাখত। খুশি আমার কাছে এসে বাবুকে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে দেখলেই ওরা চিৎকার দিয়ে ওকে ডাকতে থাকতো! ওখানে যেয়ে পুতুপুতু করলে চলবে না। কাজ না করলে খাওয়া হবে কি করে? একজন তো বাচ্চা জন্ম দিয়ে মাচায় উঠে বসে আছে। তুমিও যাও তার সাথে গল্প করতে থাকো! আমরা আর বাচ্চা জন্ম দেইনাই! যত্ত সব! বললো আমার বড় ননদ রিনা।

তাদের কথার খোঁচায় আমি দশ দিনের বেশি আর থাকতে পারলাম না। যখন দেখলাম যে আমি একটু ঠিক হয়েছি, এরপরে আমি পাকঘরে যেয়ে রান্নাবান্নার কাজে হাত দেওয়া শুরু করলাম। আমি রান্নাঘরে কাজ করছি দেখে তারা যেন সবাই আবার রিটায়ার্ড করলো। কেউ আর এদিকে উঁকি মেরেও দেখে না। আমার দশদিনের বাচ্চা ঘরে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে কিন্তু তারা কেউ যেন টেরই পায় না, আমি এক হাতের উপর বাবুটাকে নিয়ে ঘরের রান্নাবান্নাসহ অন্যান্য কাজ করতাম।

যাহোক, সে অনেক বিশাল ইতিহাস বলতে শুরু করলে হয়তো সারাদিনেও বলা শেষ হবে না। এরপরে এভাবে কেটে গেলো আমার মেয়েকে নিয়ে একটি বছর।

আমার মেয়ের জন্য দেখা যেতো অনেক সময় অনেক ধরনের খেলনা নিয়ে আসতো জহির। কিন্তু প্রতিদিন ওইভাবে মুহিবের জন্য হয়তো সে আনতো না। এটা দেখে আমার শাশুড়ি, রিনা, বীনা আর কণা অনেক ধরনের কথা বলাবলি করতো, যেগুলো আমাকেই শুনতে হতো। আগে যেমন জহির অফিস থেকে ফিরেই রিনা, বীনার বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতো এখন সে ওভাবে ওদের সাথে সময় কাটায় না। সে জান্নাতের সাথে সময় কাটাতো। এটা দেখে তার বোনেরা হিংসেয় সারাদিন জ্বলতে থাকতো। জহির জান্নাতের জন্য শখ করে বিভিন্ন ধরনের খেলনা, কাপড়চোপড়, আরো কত কিছু আসার সময় হাতে করে নিয়ে আসতো! কিন্তু সেভাবে সে বোনের বাচ্চাদের জন্য আনতো না দেখে আমার শাশুড়ি ও আমাকে অনেক কটু কথা শোনা তো।

আগে বাসায় এসেই হয় মায়ের রুমে না হয় ড্রইংরুমে বসে ভাইবোনেরা মিলে আড্ডা দিত। কিন্তু এখন সে তার মেয়ের সাথে আড্ডা দেয় এটা তারা সহ্য করতে পারছিল না। আর প্রায়ই ওদের বাপ মেয়ের আড্ডায় আমিও পার্টনার হতাম এতে ওদের আরও অসুবিধা হতো। যাইহোক এভাবে চলছিল আমাদের সংসার।

কিছুদিন ধরে জহির একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য কথা বলছিল একটা পার্টির সাথে। হয়তো কেনার কথাবার্তা মোটামুটি পাকা হয়ে গিয়েছিলো। একথা আমাদের ঘরের সবাই মোটামুটি জানতাম।

একদিন দুপুরের খাবারের পর আমার শাশুড়ি আমাকে ডেকে বলল, আজকে জহির বাসায় ফেরলে আমার সাথে কথা বলতে বলবা। ওর সাথে আমার দরকারী কথা আছে। আজকাল তো সে আবার আমাদের সাথে কথা বলার সময় পায় না।

আমি বুঝতে পারলাম কোন দিকে ইঙ্গিত দিয়ে সে কথাটি বলেছে কিন্তু আমি কিছু না বলে শুধু চুপচাপ বললাম ঠিক আছে, মা! আমি আসলে বলব।

রাতে ড্রইংরুমে জহির ও তার তিন বোন মিলে মিটিং বসলো। সাথে আমার শ্বাশুড়িও ছিল। আমি পাশে চেয়ে দাড়াতেই আমার শাশুড়ি আর ননদ আমার দিকে যেভাবে তাকালো তাতে আমি সেখানে দাঁড়ানো টাকে সমীচীন মনে করলাম না। তাই আমি দূরে সরার জন্য ডাইনিং রুমে যেয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।

– ভাইয়া, তোমার ফ্ল্যাট কেনার কতদূর? মা যেটা দেখেছিল ওটাই তো কিনছো নাকি? নাকি অন্য কেউ আবার কোনোটা পছন্দ করে দিয়েছে?

– অন্য কেউ আবার পছন্দ করবে এটা কেমন কথা বলছিস! মা যেটা পছন্দ করেছে, সেটাইতো কিনছি। তোরাও তো দেখেছিস। ওইটার কাগজপত্র নিয়েই তো এতদিন ঘাটাঘাটি করছি। দেখছিস না কিছু?

– না, আজকাল তো মায়ের চেয়ে ইম্পরট্যান্ট অনেকে আছে তোমার জীবনে, তাই বলছিলাম!

– কিরে বীণা! তুইও আজকাল রিনার মতো পিন দিয়ে কথাবার্তা শিখে গেছিস!

– শুধু শুধু তো আর বলছি না, ভাইয়া! বলার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে বিধায় এরকম কথা আমরা বলি। আজকাল তো মায়ের সাথে দেখছি যে তোমার ব্যবহার কেমন হচ্ছে। আজকাল মার খোঁজখবর নেওয়ার টাইম তোমার খুব বেশি হতে তো দেখিনা! আমাদের খবর না হয় বাদই দিলাম! আমরা মেয়েরা, আমরা তো আর পারিনা মাকে ফেলে দিতে। আমাদের কাছে মা ই আমাদের সব!

– কেন? দুদিনের মধ্যে কি এমন হয়েছে যে মা তোদের অনেক আপন হয়ে গেলো। আর আমি মায়ের একদম পর হয়ে গেলাম!

– ভাইয়া, পর হওয়ার মতই তো কাজ করছো। শুধু শুধু তো আর বলছেনা বীনা। আমরা সারাদিন পথ চেয়ে বসে থাকি, কখন তুমি আসবে! আসার পরে তোমার সাথে বসে আমরা আড্ডা দিব! আর তুমি কি করো? তুমি এসেই তোমার বউ বাচ্চার কাছে চলে যাও। আমরা যে কতগুলো মানুষ তোমার পথ চেয়ে আছি। তোমার সাথে গল্প করবো সারাদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি, তোমার সেই সময়টুকু এখন আর হয়না। এমন কি মুহিবের আর বীনার মেয়ে আশার জন্যও তোমার টাইম হয়না। এখন আমরা তোমার কাছে বাসায় প্রতিবেশীর মতো।

– রিনা, তোরা কি আমাকে এসব কথা বলার জন্য এখানে ডাকছিস! নাকি অন্য কোন কথা আছে তাই বল? তোরাই মনে হয় আমাকে প্রতিবেশী মনে করা শুরু করেছিস। এজন্য হয়তো এমন ভাবছিস! আচ্ছা, এইসব কথা বাদ দে। মা, তুমি চুপচাপ কেনো? কিছু বলছো না যে?

– কি আর বলবো? তোরাই তো অনেক কথা বলিতেছিস! তোর ফ্লাটের দলিল কবে? আমি আবার একটু কয়েকদিনের জন্য গ্রামে যাবো তো।
আমারে কি কোনো দরকার আছে? নাকি আমি চলে যাবো? একটু জরুরি কাজ আছে!

– জহির কিছু বলার আগেই কণা বলে উঠলো, মা, তোমার যতই কাজ থাক, ভাইয়ার কাজ আগে! তাইনা, ভাইয়া? ফ্লাটের দলিল তুমি ছাড়া কিভাবে করবে?

– ক্যান, আমারে কি দরকার?

– ওমা! তোমাকে ছাড়া ভাইয়া দলিল করবে কার নামে? ভুলে গেলা আমরা চার ভাই বোন মিলে এই বাড়ির দলিলও পুরোটা তোমার নামে ট্রান্সফার করেছি। মা, আব্বা মারা যাবার পরে তুমি আমাদের জন্যও যথেষ্ট করেছো, আমরা কি এটুকু তোমার জন্য করতে পারবোনা? আমরা চার ভাই বোন চাইনা আমাদের অবর্তমানে তোমাকে কেউ কোনদিন কিছু বলুক। এজন্য আমরা আমাদের শুধুমাত্র এতোটুকু সম্পত্তি কেনো, এর চেয়ে বেশি ও যদি কিছু থাকতো তাহলে তাও তোমার নামেই করে রাখতাম।

কণার কথা শুনে জহির বলে উঠলো, হ্যাঁ! মা! কণাতো ঠিকই বলেছে। তুমি বাড়িতে যাবে কেন? সামনের মাসে যেও! এমাসে ফ্লাটের দলিলটা শেষ হোক। তারপরে যেও! আর ফ্লাটের চাবি পাওয়ার সাথে সাথেই নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাব। আর এই একতলা বাড়ি ভেঙে এখানে নতুন বহুতল ভবনের কাজ শুরু করে দিবো।

– ঠিক আছে, বাবা তোরা যেইটা ভালো মনে করিস। আমিতো সম্পত্তি টম্পত্তি কোন কিছুই চাইনা আমার নামে। তোরা ভালো থাকলেই আমার ভালো থাকা। আমার কাছে থাকা আর তোদের কাছে থাকা তো একই কথা। শুধু শুধু আমাকে কেন যে তোরা এই ঝামেলার মইধ্যে টানতে যাইস!

বিনা উঠে বলল, আহা মা! তুমি এটাকে ঝামেলা বলছো কেন? আমাদের জন্য এতোটুকু ঝামেলা তুমি করতে পারবা না! এটা আমাদের ভালোবাসা! আমরা তোমাকে ভালোবাসি!

– ঠিক আছে, মা। আমি উঠছি অনেক ক্লান্ত লাগছে। হাত মুখ ধুয়ে আসি। তোরা কেউ টেবিলে খাবার দে।

আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম যে, আজকের এই নাটকের প্লট ওরা অনেকদিন ধরে সাজাচ্ছিলো। আর জহিরও ওদের ট্রাপে পড়ে গেলো। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

রাতে শোয়ার সময় জহিরকে শুধু বললাম ফ্লাট টা মায়ের নামে কিনবে? কেন, এটা তোমার নামে কিনলে ভালো হতো না!

– শোভা, মা অনেক আশা করে হয়তো কথাটি বলেছে। মা নিজের মুখে হয়তো তার নামে ফ্ল্যাট কেনার কথা বলেনি। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি। মা যেহেতু মামা বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছে, ফ্ল্যাটের দলিল কবে করবো এগুলো জিজ্ঞেস করেছে, তখনি আমি বুঝেছি। মায়ের মনে তো আমি কষ্ট দিতে পারিনা। মায়ের নামে থাকা আর আমার নামে থাকা তো একই কথা।
মা কি কখনো আমাদের কে ফেলে দিবে?

– ফেলে দিবে না ঠিক আছে! কিন্তু তার পরেও তো তুমি এখন বাবা হয়েছো! তোমার নিজের বলতেও তো কিছু থাকা উচিত! এজন্য বলছিলাম। মায়ের নামে ফ্লাট দিয়েছো তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমরা যে বাড়িতে থাকছি এটাও তো মায়ের বাড়ি নাকি! সে কি আমাদের কে ফেলে দিয়েছে? কিন্তু তাই বলে তুমি নিজের জন্য কিছুই করবেনা! তোমার আজকে একটা মেয়ে আছে কালকে তোমার আরো সন্তান হয়তো আল্লাহ দিবে! তো ওদের বাবার নিজের বলতে কি কিছুই থাকবেনা। আমার কথাগুলি হয়তো তোমার কাছে কাঁটার মতো বিধবে, ভালো লাগবেনা, তাও বলছি। এই পৃথিবীতে বেচে থাকতে গেলে অর্থ সম্পত্তির কোনো বিকল্প নেই। আর পৃথিবী বড়ই স্বার্থপর! আজ তোমার কাছে যে বড়ই আপন, কাল সে অর্থ লোভে স্বার্থান্ধ হয়ে যে কোনো কিছু করতে পারে। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে। আর আমাদের উচিত ইতিহাস থেকে শেখা। আমার হয়তো তোমার মতো অনেক বেশি বুদ্ধি নেই। কিন্তু, সৎ মায়ের ঘরে বড় হয়েছি তো, তাই বাস্তবতাটা একটু বেশিই শিখে ফেলেছি।

– আমি জানি, তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছো। এখন তুমিও একজন মা হয়েছো। তাই তুমিও তোমার সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করবে এটাই স্বাভাবিক। আমি তোমার কথায় কিছুই মনে করিনি। তোমার প্রতিটি কথাই সত্য। কিন্তু শোভা, আমার বোনেরা আর আমার মা অন্য বাকি সব মা আর বোনদের মতো নয়। যাইহোক টেনশন করো না। মায়ের নামে ফ্ল্যাট টা কিনি। এরপরে কোন সম্পত্তি করার তৌফিক যদি আল্লাহ দেয় অবশ্যই সেটা তোমার নামে করবো।

– জহির, আমি কখনোই বলিনি যে তুমি আমার নামে তোমার কোন সম্পত্তি করো। আমি বলেছি তোমার নামে তো কিছু থাকা দরকার। আমার নামে তুমি কেন করবে? তোমার টাকা দিয়ে অবশ্যই তুমি তোমার নামে করবে। আমার কোনো সম্পত্তি দরকার নেই। আমার পাশে শুধু তুমি থাকলেই চলবে।

– বুঝতে পেরেছি। মহাজ্ঞানীর সাথে তর্কে যেয়ে লাভ নেই। রাত ফুরিয়ে যাবে। বলতে বলতে জহির হেসে উঠলো!

এভাবে জহির কাছ থেকে তারা জহিরের ফ্ল্যাটটি তার মায়ের নামে রেজিষ্ট্রি করে নিলো।

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে