শোভা পর্ব-০৭

0
524

#শোভা
#পর্ব_৭

আমার শ্বাশুড়ি যেহেতু আমার পড়াশোনা করাটা পছন্দই করেন না সেজন্য আমি পড়াশোনার স্বপ্ন মন থেকে পুরোপুরিভাবে মুছে ফেললাম। প্রতিদিনকার নাটক দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একদিন সন্ধ্যার দিকে জহির হন্তদন্ত হয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তুমি এরকম করছো কেন তোমাকে এত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন শরীর ঠিক আছে তো?

– হ্যাঁ আমার শরীর ঠিক আছে। আমি ঠিক আছি। তুমি শুধু বলো কণা কোথায়? ও কি বাসায় আছে নাকি বাসায় নেই এতোটুকু উত্তর দিলেই চলবে?

– আমি সঠিক জানিনা মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে নি।

– জহির রাগত স্বরে আমাকে বলল, জানিনা মানে কি ? বাসায় থাকো কি করতে তাহলে? বাসার মানুষ কে কোথায় আছে সে খবর তুমি জানবে না তাহলে কেমন বউ তুমি?

আমি জহির এর কণ্ঠস্বর আর ওর চোখের রং দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমি কোনদিনও এই বিয়ের দু বছরে জহির এর মুখ থেকে আমার জন্য এরকম ভাবে কথা বলতে শুনিনি।

জহির এর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমার শাশুড়ি তার রুম থেকে বের হলো। আমার উপর ধমকাধমকি করছে দেখে সে মনে মনে হয়তো খুশিই হয়েছে। তাই হাসিমুখে হাসতে হাসতে সামনে গিয়ে বলল, কি রে বাবা তুই কখন আসছিস? তোরে এমন দেখাচ্ছে ক্যান?

– মা, আগে বল কণা কোথায়?

আমার শাশুড়ি হয়তো জহিরের এই প্রশ্নে কোন কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল। সে সাবধানে ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিল!

– আইসাই কণার খবর জিজ্ঞেস করছিস ক্যান? আগে হাত মুখ ধুইয়া ফ্রেশ হইয়া নাস্তা পানি খা। তারপর কণার সাথে কথা বলিস।

আমি ঠিকই বুঝতে পারছি যে আমার শাশুড়ি কথা ঘুরানোর জন্য কণার প্রসঙ্গ টা ভুলিয়ে দেয়ার জন্য জহিরকে এসব কথা বলছে কারণ কণা ঘরে নেই।

– মা আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। তুমি বলো, কণা কোথায়? ও কি ঘরে আছে? ঘরে থাকলে ওকে ডাক দাও?

মনে মনে আমি খুশি হয়েছিলাম যে এতদিনে জহির একটা কাজের কাজ করেছে। দেখি আজ আমার শাশুড়ি কণা কে কোথায় পায়? কারণ, আমি জানি কনা আজ রাত বারোটার আগে বাসায় ফিরবে না। কালকে ওর রুম মোছার সময় ওর এক বন্ধুর সাথে আমি ফোনে কথা বলতে শুনেছিলাম। ওরা গাজীপুর না কোথায় যেন যাওয়ার প্ল্যান করছিলো। রিসোর্ট ভাড়া করেছে। সারাদিন থেকে সন্ধ্যার পরে ফিরবে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যেয়ে ভয়ে আবার কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

– বাবা, কণাতো রুমেই আছে। ঘুমাইতেছে ? কাল রাত ১২ টা ১টা পর্যন্ত বই পড়ছে আবার সকালবেলা উইঠা অনেক বই পড়ছে। তাই দুপুরবেলা খাইয়া ঘুমাইছে আমারে ডাকতে মানা করছে। এজন্য আমিও ডাকি নাই। ক্যান বাবা! কি হইছে, বল দেখি!

– মা, তোমাকে আমি বলেছিলাম যে কণা মডেলিং করে নাকি? তুমি বলেছিলে না ও মডেলিং করে না।কিন্তু, আমিতো জানতে পারলাম যে ও এখনো মডেলিং করে।

– না রে বাপ! এইসব কথা তুই কি কও? তওবা, তওবা! কণা তো মডেলিং ছাইড়া দিছে তুই যেদিন ঐসব করতে না করলি, রাগারাগি করলি, সেদিন থেকেই। এরপর তো আর কোনদিনও ছবি তুলে নাই।

– তাইলে এইসব কি? বলেই জহির কয়েকটি ছবি তার মায়ের হাতে দিলো!

একটা একটা করে ছবি দেখছে আর আমার শাশুড়ি লজ্জায় মুখ চেপে ধরছে!

– ছি! ছি! এগুলো কণার ছবি? কি বলছিস? আমি বিশ্বাস করি না। এগুলো কণার ছবি হইতেই পারে না!

– মা, এটা তো কনার ই ছবি। ভালো করে দেখো!
জহির আমার শাশুড়ির হাত থেকে ছবিগুলো নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল, দেখোতো শোভা! এগুলো কণার ছবি না?

আমি জহির এর হাত দিয়ে ছবিগুলো নিয়ে দেখলাম বিশ্রী ধরনের পোশাক পড়ে কণার ছবি! আবার কয়েকটা ছবিতে কণার সাথে অন্তরঙ্গ ভাবে আরেকটা ছেলের ছবি।

– হ্যাঁ, এত কণাই!

রিনা, বীনা দুজনেই দৌড়ে আসলো। ওরাও আমাদের সাথে সাথে ছবিগুলো দেখছিল। দেখে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে!

বীনা অমনি আমার হাত থেকে ছবিগুলো হ্যাঁচকা টানে নিয়ে ভালো করে দেখে বলল, ভাইয়া তুমি ছবিগুলো দেখেই কণাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা অনেক বেশি চিন্তা করে ফেলেছো। বর্তমান প্রযুক্তির যে কারসাজি এগুলো কণার ছবি না হয়ে অন্য কারো তো হতে পারে। শুধুমাত্র কণার মাথাটা এডিট করে এখানে এড করে দেয়া হয়েছে। আমার মনে হয় কনার কাছ থেকে আগে থেকে সবকিছু শুনা উচিত।

বীনা কিছুক্ষণ আগে আজকে এ বাড়িতে এসেছে। তাই বীনা হয়তো জানেনা যে কণা সকাল থেকেই বাসায় নেই। এজন্য সে তার মাকে বলল, কণাকে ডাকো।

আমি মনে মনে হাসছিলাম যে কোথা থেকে এখন কণাকে বের করে আমার শাশুড়ি সেটা এবার দেখবো।

কিন্তু, আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার শাশুড়ি কণার রুমে যেয়ে দরজা নক করে কণাকে বারবার ডাকছে। কণা! কণা! ঘুম থেকে ওঠ। তোকে তোর ভাইয়া ডাকছে। একটু বাইরে বের হ।

কিন্তু কয়েক মিনিট হয়ে যাওয়ার পরেও কণা যখন বাইরে বের হচ্ছিল না, আমার শাশুড়ি তখন নিজের রুম থেকে দরজার চাবি এনে দরজা খুলে দেখলো কণা ভিতর নেই।

রুম ফাঁকা থেকে আমার শাশুড়ি এমন ভাব করলো যেন সে কিছুই জানেনা। কণা বাসায় নেই সেটা সে প্রথম দেখল। কিরে কোথায় গেল? কণাতো রুমে নাই। রুম তো ফাঁকা। বাথরুমে যেয়ে চেক করে দেখলো। কণা কোথাও নেই। তখন সে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কি বউ! কণা কোথায় গেছে তুমি জানো কিছু?

মা আমি কি করে জানবো ? আমার মেজাজটা তখন গরম হয়ে গেল। আমি রাগ ভাবেই বললাম, কণা সেই সকালবেলা ভোরেই বের হয়েছে? ওকি আর বাসায় এসেছে? আর আপনি যে বললেন ও সারাদিন বই পড়েছে? কই আমি তো কিছুই শুনলাম না! আমিতো দেখলাম, সেই ভোর বেলায় ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে!
আমাদের কথার ফাঁকে আমি খেয়াল করলাম রিনা রুমের মাঝে যেয়ে কাকে যেন ফোন করছে। আমি নিশ্চিত হলাম যে কণাকেই ফোন করছিলো সে।

– কি বললা? কি বললা, তুমি বৌমা? কণা সেই ভোরবেলা বের হয়েছে! তাইলে এই সারাদিন যে বই পড়ছে, সে কি কণার ভূত? দুপুরবেলা আমাদের সাথে ভাত খাইলো সেও কি কণার ভূত ছিল? কি সব উল্টোপাল্টা বলতেছো তুমি? যখন দেখলে কণাকে নিয়ে বাসায় এত বড় ঝামেলা চলতেছে। তখনই পল্টিবাজি করা শুরু করে দিয়েছো এগুলো কি?

– মা আমি কোন মিথ্যা কথা বলি নাই কণা আজকে ভোরবেলা বের হয়েছে। এবং আমার মনে হয় আপনিও সেটা খেয়াল করেছেন। আমি তো সারাদিন ওকে দেখি নাই একবারও ঘরে। আপনি কী বলছেন এসব কথা?

জহির এত সময় চুপচাপ আমাদের সবার কথা শুনছিলো। এবার সে রাগে চিৎকার করে উঠে বললো, ঠিক আছে! আমি কনাকে ফোন দিচ্ছি। দেখি কনা কোথায় আছে তোমরা চিল্লাপাল্লা বন্ধ করো।

বলেই জহির কণাকে ফোন দিলো। ফোন দিয়ে ফোনের স্পিকার অন করল।

– হ্যালো! কনা, কই তুই?

– কেন ভাইয়া আমি তো কিছুক্ষণ আগে বাসা থেকে বের হয়েছি। ভাবি বলে নাই তোমাকে?

– না,শোভা তো কিছুই বলে নাই। শোভাতো বলে, তুই নাকি সেই ভোরবেলা বের হয়েছিস! কই আছিস এখন তুই?

– ভাইয়া, আমি মা ঘুম ছিল দেখে তারপরে রিনা আপাকেও দেখলাম বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত। তাই আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসছি। কিন্তু আমি তো ভাবিকে বলে আসলাম যে আমার আজকে আসতে রাত বারোটা একটা বাজবে অথবা রাতে নাও আসতে পারি।

– কেন? এত রাত অব্দি তুই বাইরে কি করবি, কি দরকার তোর?

– ভাইয়া! আমি যে ফ্যাশন হাউজিংয়ের ডিজাইনের কাজ করি তুমি তো জানো সামনে ঈদ কাজের অনেক চাপ তারা আমাকে এমার্জেন্সি ফোন দিয়েছে। তারপর দুদিন বাদে আমার পরীক্ষা আমি আর বের হতে পারব না দেখে আজকে আমি পুরো টাইমটা ওখানে কাজ করে দিয়ে আসবো এজন্যই আজকে আমি একটু আগে বের হয়েছি আমি আসতে চাই নাই। ওরা অনেক ফোন করে জোরাজুরি করছে দেখেই আসছি। কাজটা শেষ হলেই চলে আসবো। না হলে কালকে সকালে আসব। আমি তো ভাবিকে সবই বুঝলাম।

আমি দেখলাম জহির আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে।

– ঠিক আছে তো সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমি তোর কিছু ছবি পেয়েছি এগুলো কি তোর?

– কি ছবি, ভাইয়া?

– তুই নাকি মডেলিং করিসনা? তাহলে এই ছবিগুলি আসলো কোথা থেকে? আচছা,তুই আগে বাসায় আয়। তারপর কথা বলবো।

– ঠিক আছে, ভাইয়া!

– কি ব্যাপার! বৌ? তুমি যে বললা? কণা সকালবেলা বাইর হইছে? তাইলে কণা কি বললো! জহির, তোর বৌ কি করলো কিছু বুঝলি?

– কি আর বুঝবে মা! তোমার বউ ভাইয়ার সামনে ক্ণাকে কি ভাবে ছোট করলো কিছু বুঝলা? বললো রিনা।

– জহির, আমি কিছু বলবোনা। তুই বিচার কর, কি বিচার করবি তোর বউয়ের! এইভাবে যে আরো কতকিছু করে সবকিছুতো তোর কাছে বলিনা। তুই সারাদিন কষ্ট ক্লেশ কইরা ফেরো। তাই তোরে কোনো কিছুই জানাই না। তোর বউ কোনোভাবেই চায়না যে ওরা তিন বোন এই সংসারে থাকুক।

আমি অবাক হয়ে বললাম এসব কি বলছেন মা? আমি কখন আপনাদের সাথে কি করি? আর আজকের কথা যে বললেন আজকে তো কনা আমাকে বলেই যায় নাই! শুধু শুধু সবাই যে আমাকে দোষ দিচ্ছেন , কেন?

– একদম চুপ কর! একটা কথাও বলবে না। তুমি এত বড় দুঃসাহস কোথায় পেলে! তুমি কণা কে নিয়ে এত বড় মিথ্যে কথা কেন বললে? কেন বললে কণা সেই ভোরবেলা বের হয়ে গেছে! কেন বললে যে কনা তোমাকে কিছু বলে যায়নি? কেন বললে কণার সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না?

জহির এর গলার শব্দে আমি চমকে উঠলাম।
এত তীক্ষ্ণ শব্দে সে কোনদিনই আমার সাথে এভাবে কথা বলেনি।

– আমি তোমার কোন কেনর উত্তর দিতে পারবো না। জহির কারণ কোনো কেনোর উত্তরই আমার কাছে নেই।
আমি শুধু এটা জানি যে আমি যেটা বলেছি সেটা সত্যি কথা এর মধ্যে একবিন্দুও মিথ্যে নেই!

– তার মানে কি? কি মানে কি? বল দেখি? বৌ, তাহলে কণা আর আমরা সবাই মিথ্যা কথা বলি আর তুমি সত্যি বাদি যুধিষ্ঠির! জহির তোকে তো বলাই হয়না। আমি কোন সময় কোন কিছু নালিশ করিনা ভাবি সংসারে যাতে শান্তি থাকে। তোর বউ তোর তিন বোনকে দুই চোখ দিয়ে দেখতে পারে না। তোর বউয়ের কাছে ওরা তিনজন হইলো তিনটা শত্রুর সমান। ওদের তিনজনকে সে এইবারে দিয়ে বের করার ফন্দি আঁটছে। তুই বুঝিস না কিছু?

– শোভা, এসব কি শুনছি আমি? এতটা দুঃসাহস তোমার হলো কি করে? তুমি তো এমন ছিলেনা। কি জন্য এমন করছো? তুমি আজকে চোখের উপর আমার বোনের নামে মিথ্যে বললে। আর তুমি আমার তিনবোন নিয়ে কি ভাবো আর না ভাবো সেটা নিয়ে আবার মাথাব্যাথা নেই। তবে কথা এতোটুকুই, আমার তিন বোন আমার প্রাণ!তাদেরকে নিয়ে কখনো কোন উল্টাপাল্টা চিন্তা যেন মাথায় আসে না। এরকম উল্টাপাল্টা চিন্তা যদি মাথায় আনতে হয় তাহলে সেটা এ বাড়ির গেটের বাইরে যেয়ে করবে, এখানে না। তুমি যদি ওদের কে ভালোবাসতে পারো, দেন আমাকে ভালোবাসবে। আর ওদেরকে ভালোবাসতে না পারলে আমাকেও ভালবাসার প্রয়োজন নেই। আমি আর কিছু বলতে চাই না। মা কণা বাসায় ফিরলে আমাকে ডাক দিবে।

– ঠিক আছে বাবা, যা তুই হাত মুখ ধুয়ে আগে কিছু খেয়ে নে। ওই রিনা! বিনা! কোথায় গেলি তোরা? জহিরকে চা নাস্তা দে!

জহির আমার পাশ ঘেঁষে রুমে চলে গেল আর কোন কথাই বলল না। আমি জায়গায় দাঁড়িয়ে অনবরত কাঁদছি। ঝর ঝর করে চোখের পানি পড়ছে। আমার কিছুই বলার নেই। কই ভাবলাম যে আজকে আমার শাশুড়ির গোমর ফাঁস হবে, কিন্তু উল্টা নিজেই ফেঁসে গেলাম। কিছু না করে যখন দোষী হয় তখন আমার সবচাইতে বেশি খারাপ লাগে। জহির এর সাথে রুমে যেয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। আমি রুমে যেতেই জহির রুম থেকে বের হয়ে গেল।

রাত দশটার দিকে কণা বাসায় ফিরলো। ও বাসায় ফিরেই জহির এর সাথে দেখা করতে এলো। আমি জানতাম যে কোন আর কিছুই হবে না ও নিশ্চয়ই কোনো না কোনো নাটক সাজিয়ে এসেছে।

– ভাইয়া, আমায় ডেকেছিলে! কি খবর?

– সারাদিন কোথায় ছিলি? কি করেছিস এত রাত পর্যন্ত?

– সারাদিন কোথায় ভাইয়া! আমি তো বিকেল বেলা বের হয়েছি। তোমাকে বললাম না! আর আমি তো ভাবিকে বলেও গেছি। ভাবি কি বলেনি তোমাকে?

– তোকে তো আমি মডেলিং করতে নিষেধ করেছি তারপরও তুই সেটা কেন করছিস?

– ছি! ছি! এটা কি বলছো তুমি? ভাইয়া তুমি নিষেধ করার পর তো আমি আর মডেলিং করিনি!

– মা তোকে নিশ্চয় ছবিগুলো দেখিয়েছে। ছবিগুলো কার? ওখানে তো আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি আর তোর সাথে ছেলেটা কে?

– ভাইয়া, আমি ছবি দেখেছি। ওইখানে যে ছেলেটি ও আর আমি একইসাথে পড়ি। তবে ও ফ্যাশন ডিজাইনিং ডিপার্টমেন্ট এর নয়। অন্য ডিপার্টমেন্ট এ। কিন্তু সাথে যে মেয়েটি সে আমি না। ওই ছেলেটি আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু, আমি ওকে দেখতে পারিনা। বেয়াদব ও নেশাখোর টাইপের একটা ছেলে। ওর বাবা শিল্পপতি। টাকার অভাব নেই।যা খুশি তাই করে। অনেক মেয়ের সাথে ওর বাজে সম্পর্কের কথা আমি শুনেছি। ও আমার পিছনে অনেক দিন ধরে ঘুরছে। ও নিজেও মডেলিং করে এবং ও চায় ওর সাথে আমি মডেলিংয়ে পার্টিসিপেট করি এজন্য আমাকে অনেক জোরাজুরি করেছে। ওকে আমি সেদিন অনেক বকাবকি ও করেছি। এবং আমি বলে দিয়েছি যে আমার ফ্যামিলি থেকে এধরনের কাজ পছন্দ করেনা। তাই আমি এগুলো করতে পারব না। কারণ আমি আমার ভাইয়ার মনে কষ্ট দিতে পারব না! এটা জানার পরে ও এগ্রেসিভ হয়ে হয়তো এরকম কাজ শুরু করে দিয়েছে। ক্লাশে অনেকের সামনে অপমান ও করেছি। ও সেদিন সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমাকে থ্রেট করে বলেছিলো যে, ও আমাকে সবার সামনে ছোট করার জন্য যা করা প্রয়োজন তাই ই করবে। এই জন্য হয়তো এডিটিং করে অন্য কারো ছবিতে আমার মুখটা অ্যাড করে দিয়েছে। ও আমাকে বদনাম করার জন্য এগুলো করেছে।

– এসব কি বলছিস? এত ঘটনা ঘটে গিয়েছে আর তুই আমাকে কিছুই বলিস নি! আমি কালকেই তোর ভার্সিটিতে যাবো। আমি ওই ছেলের সাথে দেখা করতে চাই। এবং ওর গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলব! এত বেয়াদব ছেলে! ওর এত বড় সাহস!

– ভাইয়া, এসবের আর দরকার নেই আমি অলরেডি ওর নামে উপাচার্য স্যারের কাছে নালিশ দিয়েছি স্যার ওকে অনেক বকেছে। ও যদি এরপরেও কোন ধরনের বেয়াদবি করে আমি তোমাকে অবশ্যই জানাবো। ছেলেটা অনেক খারাপ। বেশি বাড়াবাড়ি করলে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। ও যদি আমার কোন ক্ষতি করে! তাই একটু অপেক্ষা করো।

– ঠিক আছে তুই যেটা বলছিস সেটাই করছি। কিন্তু, খুব সাবধানে থাকবি। এর পরে তোকে ও কোনো কিছু বললে সরাসরি আমাকে জানাবি।

– কিন্তু ভাইয়া তুমি এই ছবিগুলো কোথায় পেলে? তোমাকে এগুলো দিল কে? আগে তো সেটা একটু বল আমাকে!

– যেখানে পেয়েছি পেয়েছি। তোর সেটা জানতে হবে না। তুই যা হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে নে।

– না, না, ভাইয়া, তুমি একটু আমাকে বল। আমাকে তো জানতে হবে যে ও আসলে কিভাবে চাল চালা শুরু করেছে। সে তো আমাকে বুঝতে হবে।

– আজ আমার ফ্যাক্টরির এড্রেসে ছবিগুলো এসেছে। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সেখান থেকেই পেয়েছি।

– কত বড় বদমাশ, চিন্তা করো। ও জানে আমি বড়দের মনে কষ্ট দিতে চাইনা তাই মডেলিং ছেড়ে দিয়েছি। এজন্য জোর করে আমাকে দিয়ে মডেলিং করানোর জন্য আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে এভাবে।

– আচ্ছা, যাহ!

– কিন্তু ভাবি, তুমি ভাইয়ার কাছে মিথ্যা কথা বললে কেনো?এই ব্যাপারটা আমার মাথায় আসছে না! তুমি আমাকে পছন্দ করো না ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে এভাবে তুমি ভাইয়ের সামনে আমাকে নিচু করবে? এর কোনো মানে হয় না।

– কণা,আমি এ ব্যাপারে তোমার সাথে আর কোন কথা বলতে চাই না। কথা বাড়ালেই কথা বাড়ে। তুমি যাও। তুমি এত সময় পরে এসেছো ক্লান্ত বিশ্রাম নাও, খাবার খাও।

এভাবে চার পাঁচ দিন পার হয়ে যায় জহির আমার সাথে ঠিক মতো কথাই বলেনা এবং ওর পরিবারের বাকি সবাই আমার সাথে কেমন কেমন একটা ভাব নিয়ে কথা বলে। যেন আমি কোন মহা অন্যায় করে ফেলেছি।

একদিন হঠাৎ করে বাসার সবাই শপিংএর উদ্দেশ্যে নিউমার্কেটে গিয়েছে। বাসা একদম ফাঁকা। আমি আর খুশি বাসায়। দুপুরে খেয়ে দেয়ে একটু শুয়েছি। হঠাৎ করে জহির এর উপস্থিতি। সচরাচর ঐরকম সময় ও তেমন বাসায় আসে না। কিন্তু ওই দিন বাসায় চলে আসলো। শরীরটা নাকি খারাপ লাগছিল।

– কি ব্যাপার, হঠাৎ করে সময় তুমি বাসায়? এরকম সময় তো কখনো বাসায় আসোনা! শরীর ঠিক আছে তো?

– বিপি অনেক হাই হয়ে গিয়েছে। কেমন যেন খারাপ লাগছে তাই বাসায় চলে এসেছি। মা ওরা তো বাসায় নেই তাই না! সবাই নিউমার্কেটে গিয়েছে।

– হুম! প্রেশার মেপেছ? কোন ওষুধ দিয়েছে?

– প্রেশার মেপেছি। আর ওষুধ ও খেয়েছি। আমি একটু বিশ্রাম নেব। ঠিক হয়ে যাবে। টেনশন করো না।

আমি দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে তেতুল দিয়ে শরবত বানিয়ে নিয়ে আসলাম।

– জহির এটা খেয়ে নাও এটা খেলে তোমার প্রেশার অনেকটা কন্ট্রোলে চলে আসবে।

জহির শরবত খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো।

– ও হ্যাঁ,শোভা! আমার ব্যাগের মধ্যে দেখো দুই লাখ টাকা আছে। টাকাটা আলমারিতে তুলে রাখো।

– আচ্ছা।

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম কারণ আমাদের এই দুই বছর হয়েছে বিয়ে হয়েছে। আজ পর্যন্ত জহির টুকটাক হাতখরচ ছাড়া কোনো টাকাই আমার কাছে রাখতো না। সব তার মায়ের কাছে বা বোনদের কারো কাছে রাখে। এমনকি আমার কোন কাপড় চোপড় কেনা লাগলেও সেটা তার মা বা বোন কিনে এনে দেয়। আমি নিজে থেকে পছন্দ করে কোনোদিন কোনো জিনিস আজ পর্যন্ত কিনতে পারিনি। তবে মাঝে মাঝে জহির পছন্দ করে তার বোনদের জন্য যদি কোন কিছু কিনতো আমার জন্য ও তখন হয়তো কোনো কিছু কিনে আনতো। এছাড়া আমার পছন্দ-অপছন্দের কথা চিন্তা করে আমি কোনদিন কোন কিছুই কিনতে পারিনি। তারা আমাকে যেটা এনে দেয় সেটাই আমার একমাত্র ভরসা।

– জহির, তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম। এই কদিন ধরে বলবো বলবো করছি কিন্তু বলতে পারছিনা

– হ্যাঁ বলো, শুনছি!

– জহির, তুমি মনে হয় বাবা হচ্ছো। মানে, আমি দুই মাস হল সম্ভবত কনসিভ করেছি।

জহির বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, সম্ভবত মানে কি বলছো? তুমি এত বড় একটা গুড নিউজ সম্ভবত কেনো? তুমি ভালো করে টেস্ট করো নি? আর এই খবর তুমি আমাকে এতদিন পরে জানালে?

– আমি নিজেই তো জেনেছি এই দুদিন হলো। তোমাকে বলবো বলবো করছিলাম কিন্তু তুমি তো আমার সাথে ভালোভাবে কথাই বলছো না তাই বলা হয়নি। আজ আগে আগে এসেছো তাই বললাম। আমার সন্দেহ হওয়াতে আমি বাসায় বসে টেস্ট করেছি। পজেটিভ রেজাল্ট এসেছে। তাই তুমি যদি একটু আমাকে সময় করে একবার ডাক্তার কাছে নিয়ে যেতে তাহলে খুবই ভালো হতো। শরীরটা খুব বেশি ভালো না। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে। আরেকটা কথা আমি বাবুর খবরটা প্রথমে তোমাকে সাথে করেই জানতে চাই। আমি চাই কালকে তুমি আমাকে ডাক্তার কাছে নিয়ে যাবে, আর কেউ না।

– অবশ্যই! কাল সন্ধ্যায় তোমাকে আমিই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। তুমি বাসার সবাইকে জানিয়েছো ব্যাপারটা? মা জানলে তো অনেক খুশি হবে। রিনা বিনা কোন সবাই অনেক খুশি হবে! সবচেয়ে বেশি খুশি হবে মুহিব যখন দেখবে যে ওর ছোট ভাই বা বোন এসেছে ওর খেলার সাথে এসেছে খুবই খুশি হবে।

– না, কাউকে জানায়নি। তোমাকেই প্রথমে জানালাম। তুমি সবাইকে জানিয়ো। তাহলেই ওরা বেশি খুশি হবে।

তবে আমি জানতাম যে ওরা কখনোই খুশি হবে না। কিন্তু জহিরকে সেটা আমি বললাম না, কারণ বললে উলটো ও রাগ করতো।

সকালবেলা জহিরের মুখে সবাই খবরটা শুনে উপরে উপরে খুব খুশি খুশি ভাব দেখালো। জহির চলে যাওয়ার পরে কার মধ্যে কোনো রিয়্যাকশন দেখলাম না। ভাবখানা দেখে মনে হল সংসারে যেন কোন একটা উটকো ঝামেলা জুটিয়েছি আমি।

বিকেলবেলা ডাক্তারের কাছে থেকে আমি শিওর হলাম যে আসলেই আমি মা হতে চলেছি। জহির তো খুব খুশি!

একদিন কনা আমার শ্বাশুড়ির রুমের বারান্দায় চেয়ারে বসে ফোনে কথা বলছে কার সাথে যেন খুবই উত্তেজিত ভাবে। আমি আমার শাশুড়ির প্রেস করা শাড়িগুলো তার রুমে রাখতে গেলাম। সচরাচর আমার ওই রুমে যাওয়া হয়না।
তাই হয়তো কণা নির্বিঘ্নে ওখানে বসে জোরে জোরে কথা বলছিলো। আমি কণা কথা বলছে দেখে ইচ্ছে করেই ধীরে ধীরে ওই রুমের মধ্যে থাকার জন্য আমার শাশুরির ড্রেসিংটেবিল, ওয়ারড্রব, অন্যান্য আসবাব গুলোকে ধীরে ধীরে করে একটা নেকড়া হাতে নিয়ে মুছতেছিলাম আর গুছাচ্ছিলাম। যাতে ওর কথাটা আমি শুনতে পারি কিন্তু ও আমাকে যাতে দেখতে না পায় সেজন্য আমি একটু আড়ালে থাকার চেষ্টা করছিলাম।

– এই বদমাশ! তুই আমাকে কি পেয়েছিস? তুই এগুলো কি শুরু করেছিস? তুই সেদিন একবার ভাইয়ের কাছে ছবি পাঠিয়েছিস! তুই কি চিন্তা করছিস আমি ভয় পেয়ে যাব! নেভার। তোর সাথে আমার ব্রেক আপ হয়ে গিয়েছে।ব্রেকআপ মানে টোটালি ব্রেকআপ! তোর সাথে আমার আর কোন কথা নেই। তুই থাকত স্বর্ণাকে নিয়ে। তোর মত একটা ফকিন্নির পুতের সাথে প্রেম করে আমার কোনো লাভ নেই। আমি তোর সাথে আর কোনো মডেলিংয়ে পার্টিসিপেট করতে চাইনা। রাকিব ইজ মাই বেস্ট চয়েস। ওর সাথে পার্টিসিপেট করলে আমাকে পকেট থেকে পয়সা খরচ করতে হয় না। উল্টো পয়সা পাওয়া যায়। তুই আমাকে কি দিয়েছিস নাথিং! কালকে রাকিবের সাথে গাজীপুরে গিয়েছিলাম একদম সিঙ্গেল! ওখানে থেকেছি! রিসোর্ট ভাড়া করেছিলাম আমরা। একসাথে থেকেছি। বুঝতে পেরেছিস নিশ্চয়ই রাকিবের সাথে আমি কি করেছি?

ওপাশ থেকে কি উত্তর এলো, কি আসছে তাতো বুঝতে পারছি না। শুধু আমি কণার কথা গুলো শুনতে পাচ্ছিলাম।

– ওই শুয়োরের বাচ্চা! তুই চিনিস আমাকে? তোর এত বড় সাহস তুই আমাকে প্রস্টিটিউট বলিস?
আমি প্রস্টিটিউট হই আর যাই হই তোর মতন তো মানুষের কাছে হাত পাততে যাইনা, তাই না? আমি যেটা নিচ্ছি সেটা আমার হক! তোর কাছ থেকে তো যা পেতাম তাতে আমার হাত খরচই চলতো না।
ফোনটা রাখ, বেয়াদবের বাচ্চা! ফোন রাখ! তোর সাথে আবার কিসের কথা! আর তুই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস। তুই আমার ভাইয়া কে বলবি। তুই আমার ভাইয়াকে বললে আমার কচু হবে কচু!
পাঠিয়েছিলি না ভাইয়াকে ছবি! দেখেছিস কিছু হয়েছে আমার! ভাইয়া আমার কথা শুনে। তোর কথা শুনবে না। সো, এসব চেষ্টা করে শুধু শুধু কষ্ট করার দরকার নাই। আমার যা করার বা যেভাবে সেটআপ করার দরকার সেটা আমি করতে জানি। সো ডোন্ট ওয়েস্ট ইওর টাইম! বাই, বাই, লুজার!

আমি তাড়াতাড়ি করে আমার শাশুড়ি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম যাতে কনার চোখে না পড়ি।
কনার কাছে কথাগুলো শুনে আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছিলো। ও এতটা নিচে নেমে গেছে আমি ভেবে অবাক হয়ে গেলাম। মন চাইলো জহির এর কাছে কিছু বলি। কিন্তু, সেই সাহস আমার নেই। কারণ, আমি জানি আমি কিছু বললে শুধু আমি নিজেই ওদের কাছে আবার ছোট হব। এছাড়া আমি কোন কিছুই প্রমাণ করতে পারবো না। তাই আমি চুপ করে থাকাটা কি শ্রেয় মনে করলাম। আমি সেদিনের ঘটনার পর থেকে কণার সাথে এমনিতেই কম কথা বলি। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ওর সাথে আমি কথাবার্তা বলি না। আর আজকের ঘটনা শোনার পর থেকে ওর মুখ দেখতেও আমার ঘৃণা করছিলো। কিন্তু কিছুই করার নেই।

একদিন সকালবেলা নাস্তা শেষ করে জহির আমাকে ডেকে বললো, শোভা তোমার কাছে যে দু’লাখ টাকা দিয়েছিলাম না। ওটা নিয়ে আসো। ওটা আজকে একটা পার্টি কে দিতে হবে।

খাবার টেবিলে আমার দুই ননদ রিনা, কণা এবং আমার শাশুড়ি ও ছিল। জহির আমার কাছে টাকা রেখেছে শুনে ওরা যেন আকাশ থেকে পড়লো। আমি ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। ওদের মুখ দেখে আমার যেন হাসি পেল।

আমি রুম থেকে টাকাগুলো নিয়ে টেবিলের উপরে রাখলাম। টাকার বান্ডিলের দিকে তাকিয়ে আমার শাশুড়ি চোখগুলো যেন ঠিকরে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।

– কিরে! তুই এতগুলো টাকা ওর কাছে রাখলি যে? তোর কি বুদ্ধি জ্ঞান লোপ পাইছে? ও যদি টাকাগুলা হারাই ফেলতো?

– কেনো মা? ঘরের ভেতর থেকে টাকা কোথায় হারাবে? তাছাড়া শোভা আর কণা তো প্রায় একই বয়সের। কণার কাছে যদি রাখতে পারি আমি তো শোভার কাছে রাখলে কি সমস্যা? কণার কাছেও তো মাঝে মাঝে আমি টাকা রাখি। তুমি যখন বাসায় থাকো না এদিক সেদিক যাও তখন।আর আমি যেদিন শোভার কাছে টাকা রেখেছি সেদিন তুমি বাসায় ছিলে না। তাই আমি ওর কাছে টাকা রেখেছি। তো দোষের কি আছে? তাছাড়া ওকে তো দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে! তুমি যখন বুড়ো হয়ে যাবে তখন টাকা পয়সা কে দেখবে? তখন তো ওকেই রাখতে হবে। এখন থেকে যদি না অভ্যাস হয়, তাহলে হঠাৎ করে তখন তো দেখবো তালগোল পাকিয়ে ফেলবে! ধীরে ধীরে দায়িত্ব জ্ঞান শিখুক। ফ্যামিলির একমাত্র বউ। ভবিষ্যতে সবকিছু তো ওর একাই সামলাতে হবে। তোমারও তো বয়স হয়েছে তাছাড়া প্রেসারের সমস্যা ছাড়াও আরো হাজারটা সমস্যা তোমার দিন দিন বেড়েই চলছে।ধীরে ধীরে শোভা দায়িত্ব বুঝে নিক। তোমার একটু ঝামেলা কমবে। তুমিও ফ্রি হয়ে থাকতে পারবে। তোমার শরীরটাও ভালো থাকবে।

জহির এর কথা শুনে আমার শ্বাশুড়ীর অন্তরের ভিতরে জ্বলে পুড়ে ছাই ছাই হয়ে যাচ্ছিল। সেটা আমি ওদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু জহির সেটা কোনদিনই বুঝতে পারবেনা। আমার শ্বাশুড়ির দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম। তার মুখটা দেখার মত ছিল। আমার বিয়ের বয়সে এরকম চেহারা তার কোনদিনও দেখিনি।

– তাই বলে আমার সাথে বা আমাদের কারো সাথে কোনো পরামর্শ না করে তুই তোর বউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া শুরু করলি নাকি রে, জহির।

– কি বলছো, মা? ঐদিন আসলে আমার মনে ছিল না। আর তুমিও বাসায় ছিলা না। পরে তুমি আসার পরে মনেই ছিলনা যে তোমাকে টাকাগুলো দিতে হবে। আমার প্রেসার হাই ছিল সেদিন। এজন্য আমার আরও মনে ছিলোনা। আমি এসব নিয়ে তত দোষের তো কিছু দেখছিনা। ওর কাছে টাকা থাকলে কি সমস্যা?

– এটা মনে না থাকার তো কথা না। এটা একটা দুইটা টাকার ব্যাপার না। দুই লক্ষ টাকার ব্যাপার! আর তাছাড়া তোর না হয় যে মনে নাই বুঝলাম। তোর বউয়ের ও কি মনে নাই? আর তোর বউ জানে না যে, ঘরে টাকা পয়সা দেখার বিষয়টা আমার। টাকাটা তো আমার কাছে দিতে পারতো। এখানে কি তোর বৌয়ের কোন দোষ নাই? কি বলতে চাইস তুই?

– মা, তুমি একটা স্বাভাবিক বিষয়কে যে কেনো এরকম অস্বাভাবিক করে ভাবছো?

তাদের কথার মাঝখানে থেকে রিনা বলে উঠলো, মা! এসব কথা বাদ দাও তো! তুমি দেখছো না ভাইয়া ভাবীকে সব দায় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। ভবিষ্যতে ভাবি তো সংসারের হাল ধরবে। আর আমরা তো সব বানের জলে ভেসে যাব। তাই ভাইয়ার অনেক চিন্তা। সংসার নিয়ে ভাবি একটু বোঝার চেষ্টা করছে। শুধু শুধু তুমি কেন ঝামেলার মধ্যে যেতে চাচ্ছো?তোমার তো খুশি হওয়ার দরকার। তুমি ঝামেলামুক্ত হচ্ছো। তোমার রিটায়ার্ড এর টাইম এসে গেছে।

– রিনা, তুই এ সমস্ত পিন মারা কথা বন্ধ করতে পারিসনা। দেখছিস এমনি মা আমার উপর রাগ করেছে। কোথায় মাকে বুঝাবি। তা না তুই মাকে উসকে দিচ্ছিস। এটাতো তোর সারা জীবনের অভ্যাস। এ আর নতুন কি! তোর এই স্বভাবের কারণেই তোর কপালে এই দুর্গতি।

আসলে কথাটা জহিরের মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। আমি এতক্ষণ পরে শুধু বললাম, জহির এসব কি বল তুমি? কারণ আমি জানতাম এই প্রত্যেকটি কথার প্রভাব আমার উপরে পড়বে।

আমি কথাটা বলে শেষ করার আগেই আমার শাশুড়ি আমার উপর চিৎকার করে উঠলো।

– হারামজাদি! যা এখান থেকে রুমে যাহ! এখনই রুমে যাহ! তোকে না কতদিন বলছি, তোকে না প্রথম থেকেই বলছি যে আমরা ফ্যামিলি বিষয়ে যখন কথা বলব তখন কথার মধ্যে কোন নাক গলাবি না। আমার ছেলে আমার মেয়েকে কি বলছে কি না বলছে সেটা আমি দেখব। তোর দেখার কোন দরকার নাই। তুই একদম কথা বলবি না। আজকে সংসারের যত উল্টাপাল্টা যত কিছু হচ্ছে একমাত্র তোর কারনে হচ্ছে। তুই হচ্ছিস সব নষ্টের গোড়া!

আমার শাশুড়ির কথা শুনে আমার কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিলো। আমি আচলে মুখ চেপে ধরে দৌড়ে রুমে চলে গেলাম।

রুমে যেয়ে জহিরের আর ওদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। হয়তো আমার পক্ষে জহির প্রতিবাদ করেছিলো দেখেই চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছিলো।

এত কষ্টের মাঝেও এটা ভেবে সুখ পেলাম যে নাহ! আমার কষ্টগুলিকে কিছুটা হলেও জহির বুঝতে পারছে। আমার জন্য ওদের সাথে প্রতিবাদ করছে।
কষ্টের মাঝেও চরম প্রশান্তিতে আমার হাতটা চলে গেলো আমার পেটের উপর! আমার জান্নাতের ছোয়ায়!

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে