মিষ্টার লেখক পর্ব-০১

0
1348

#মিষ্টার_লেখক
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

কলেজ থেকে বাড়িতে আসতেই দেখি ওঠোনের একপাশে সাদা রঙের চকচকে একটা প্রাইভেট কার রাখা! এতে করে বেশ অবাক হলাম আমি, কেননা এই প্রথম বার আমাদের বাড়িতে কেউ প্রাইভেট কার এনেছে।
মেইন রোড থেকে কাঁচা রাস্তা গিয়েছে আমাদের বাড়ির পাশ ঘেঁষে।আর তাই গাড়িটা সহজেই আমাদের বাড়িতে আনতে পেরেছে।এর আগে সিএনজি,বাইক,রিক্সা এই ধরনের গাড়ি লোকজন আমাদের বাড়িতে রেখেছে কিন্তু এমন বড়লোক গাড়ি আনেনি।যাই হোক এসব বড়লোকের ব্যাপার স্যাপার আমার দেখে কাজ নেই। কলেজ থেকে আসছি ঘর্মাক্ত শরীর গোসল করে নামায পড়তে হবে।ঘড়িতে হয়তো দুইটার উপরে বেজে গেছে।
.
এই তুই কখন আসলি?আইসা এখানে দাঁড়ায় আছিস কেন? তাড়াতাড়ি ঘরে আয়।

আমাকে ওঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মু উপরিউক্ত কথা গুলো বললো। বুঝলাম না আজকে আমার আসা নিয়ে এতো বিচলিত কেন?যাক সব চিন্তা ভাবনা দূরে রেখে ঘরে গেলাম। তখন আম্মু বললো,
— তোকে পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে! তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে! সেই এগারোটার দিকে আসছে এতোক্ষণ ধরে ব‌ইসা আছে তোকে দেখবো বলে।আর তুই ফোন ধরলি না কেন?তোর আব্বু কতোবার কল করছে দেখস নাই?

— আম্মু ক্লাসের সময় কল আসবে বলে সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছি।আর কি বললে তুমি, এই ঘর্মাক্ত শরীরে আমি তৈরি হয়ে আসবো মানে কি? আমাকে এক্ষুনি গোসল করতে হবে।

— লোকজন না ব‌ইসা আছে সেই সকাল থেকে,পরে গোসল করতে পারবি। এখন যা বলছি তাই কর..

তখন আব্বু রুমে আসলো। আমি আব্বু কে বললাম,
— দেখো না আব্বু এই ঘর্মাক্ত অবস্থায় আমি মেহমানদের সামনে কিভাবে যাবো?তাই বলছি গোসল করে আসি, এখন আম্মু বাধা দিচ্ছে। তাছাড়া আমি নামায পড়বো কখন বলো তো?

আব্বু বললো,
— আচ্ছা যা তাড়াতাড়ি করে গোসল করে আয়।

আব্বুর কথায় আম্মু রেগে গেলে আব্বু তখন বলে,
— এখন তো উনারা খাওয়া দাওয়া করবেন,তাই এই সুযোগে ও গোসল করে আসুক গিয়ে।
.
.
অতঃপর গোসল শেষে নামাযে দাঁড়িয়েছি।এর মধ্যে আম্মু এসে বার বার তারা দিচ্ছে আর আমাকে বকাঝকা করছে। তাদের নাকি খাবার খাওয়া শেষ, এখন মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলছেন।তাই তাড়াহুড়ায় নামায শেষ করতে হলো “আল্লাহ মাফ করুন”।

নতুন কিছু থ্রিপিস এর মধ্য থেকে আম্মু একটা বেগুনি রঙের থ্রিপিস চুস করে দিয়ে বললো এটা পরে নে। আমি দ্বিরুক্তি না করে পরে নিলাম। সাথে ছয় পার্ট হিজাব পরে নিয়েছি।যা দেখে আম্মু শুরু করে দিল বকাবকি। আমি কেন বৃদ্ধ মহিলাদের মতো ছয় পার্ট হিজাব পরেছি, কোথায় চুল ছেড়ে স্ট্যাইল করবো তা নয় বুড়ি সেজেছি। এখন কার ছেলেরা স্ট্যাইলিষ্ট মেয়ে পছন্দ করে, আমার মতো ক্ষেত মার্কা মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

আসলে আজকাল মেয়েকে কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রদর্শন করবে সেটা ভাবে সবাই। একবার ও ইসলামের নিয়মের কথা চিন্তা করে দেখে না। কোথায় ইসলাম শুধু মাত্র পাত্র কে নিজে পাত্রী দেখার অনুমতি দিয়েছে সেখানে পাত্রের দুলাভাই,আপন ভাই,চাচা সব গুষ্টি হাজির হয়ে যায় পাত্রী দেখার জন্য। আবার এখানেও নিয়ম পাত্রীর মুখোমন্ডল শুধু দেখতে পারবে পাত্র।অথচ কিছু তা মানতে নারাজ।

তাই আম্মুর কথা তোয়াক্কা না করে মাথা নিচু করে বসে আল্লাহ তা’আলার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি আমি।এই প্রথম বার কোন ছেলে দেখতে এসেছে আমাকে!তাই খুব নার্ভাস ফিল করছি। তবে অন্যান্য পাত্র পক্ষ থেকে অনেকেই দেখে গিয়েছেন শুধু পাত্র ছাড়া। আজকে পাত্র তার বাবা মা আর এক আত্মীয় এসেছেন আম্মু বললো।
.
অতঃপর আম্মু আমার হাতে ফলের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে পাত্রের সামনে যেতে বললো। এদিকে ভয়ে আমার অবস্থা নাজেহাল। হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে।তাও যেতে হলো তাদের সামনে। গিয়ে সালাম দিয়ে ট্রি-টেবিলের উপর ফল গুলো রাখতেই একজন ভদ্রমহিলা বললেন,বস ওখানে।
আমি তিনার কথা মতো জড়োসড়ো হয়ে সোফায় বসে মাথা নিচু করে র‌ইলাম। তখন একজন ভদ্রলোক হয়তো পাত্রের বাবা বললেন, নাম কি তোমার?

আমি বললাম “ইমা”।
তিনি শুনে বললেন, শুধুই ইমা?
আমি আবারো বললাম,ইমা বিনতে ইব্রাহিম।
এবার ভদ্রলোক সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বাহ্ সুন্দর নাম, ইব্রাহিম এর কন্যা ইমা।
আমি বললাম,জ্বি।

ভদ্রলোকের দিকে তাকাতে লক্ষ্য করলাম পাশের জনকে। মুচকি হেসে তাকিয়ে আছেন আমার পানে।দেখতে শ্যাম বর্নের, চুলগুলো বেশ কায়দা করে স্টাইল করা। চোখে চশমা, দেখলে একজন নিতান্ত সুদর্শন ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে।

ভদ্রলোক এবার সবার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা কিছু জিজ্ঞাসা করলে করতে পারো। তখন বাকিরা বললো তাদের আর কিছু জানার নেই এমনিতেই আশা পর্যন্ত সব জানা হয়ে গিয়েছে।তাই আমাকে ভিতরে যেতে বলে আব্বুর সাথে আলোচনা শুরু করলেন। আমিও চলে এলাম ওখান থেকে।
আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, এতো সময় যেন প্রান পাখিটা উড়ে যাচ্ছিল ইয়া আল্লাহ।

তাদের বেশ কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনার পর আব্বু এসে জানালো তাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে আজকেই এ্যাংগেজ করে রেখে যেতে চায়। তারপর ভালো দিন তারিখ ঠিক করে বিয়ে হবে। আমার চোখ ছানাবড়া কি বলে এসব? দেখতে না দেখতেই বিয়ে! এরকম অপরিচিত জনকে বিয়ে করে নিব?
আম্মু আব্বু কে বললো,
— ছেলে ডাক্তার! তারপর সবদিক থেকে উপযুক্ত। তুমি জামাইদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে, চোখ বুজে আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করে রাজি হয়ে যাও এমন ছেলে পাওয়া মুশকিল।যারা কিনা নিজে থেকে সমন্ধ নিয়ে এসেছে।আমরা তো এমন ছেলেই খুঁজছিলাম এতো দিন। আল্লাহ তা’আলা নিজে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের মেয়ের জন্য। আলহামদুলিল্লাহ।

আব্বু অনেক সময় যাবত চুপ থেকে বললো,
— সব তো ঠিক আছে সাহিদা কিন্তু খুলনা শহর! এতো দূরে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে থাকবো কিভাবে বলো তো?

খুলনা শহরের কথা শুনে আমি যেন বিদ্যুৎ পৃষ্ঠের ন্যায় চমকে উঠলাম। খুলনা শহরের মানুষ সেদিন আমার মন থেকে উঠে গিয়েছিল যেদিন ঐ লেখক ছোট্ট একটা কারণে আমাকে ফেসবুক থেকে ব্লক করেছিল!তাও আবার মেসেজ দিয়ে “you are Blocked “!
নিজেকে এক্সপ্লেইন করার সময়টাও পায়নি সেদিন। লোকটা সাথে সাথে ব্লক করে দিয়েছিল। তবে ঐ লোকটা লেখালেখির পাশাপাশি ডাক্তার ছিলেন! আচ্ছা এদের সাথে আবার কোন যোগ সূত্র নেই তো?

আমি তাড়াতাড়ি লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে বললাম,
— আব্বু ছেলের নাম কি?
আব্বু বললো, মহিন লস্কর ।

নামটা শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম কারন ঐ ডাক্তারের নাম ছিল তুহিন আহমেদ।
তবুও খুলনার মানুষজনের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়ে গেছে তাই এই বিয়ে কিছুতেই করবো না আমি।তাই আব্বু কে বললাম,
— আব্বু খুলনার মানুষজন একদম ভালো না তাছাড়া আমি এতো দূরে তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না। আব্বু তুমি এই বিয়েতে রাজি হ‌ইয়ো না প্লিজ।বড় আপু মেজ আপুর শশুর বাড়ী খুব কাছাকাছি তারা সহজেই আমাদের বাড়িতে চলে আসতে পারে কিন্তু আমি ওখান থেকে আসতে পারবো না। তাছাড়া তুমিও অসুস্থ যখন তখন আমাকে দেখতে যেতে পারবে না অতো দূর।

আব্বু আমার কথা গুলো শুনে বললো,
— আমিও তাই ভাবছিরে মা।

কিন্তু আম্মু রেগে বললো,
— মেয়ের বয়স হচ্ছে দিন কে দিন।আর তুমি উলটো মেয়েকে উস্কানি মূলক কথা বলছো!পদ্মা সেতু হয়ে গেছে এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চলে যাওয়া যায় খুলনায়।আর তুমি মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে কিসব বলে চলেছো? এই বিয়ে যদি না হয় তাহলে তোমারা বাপ মেয়ে মিলে আমার মরা মুখ দেখবা এই আমি ক‌ইলাম!

আম্মু কে হাজার বলেও বোঝানো সম্ভব নয় বুঝতে পারছি। কিন্তু খুলনা বিয়ে করতে কিছুতেই আমার মন শায় দিচ্ছে না।
.
আব্বু নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার দুলাভাই দের সাথে আলোচনা করলো।মেজ দুলাভাই মেডিসিন কোম্পানির ম্যানেজার তাই তিনি সহজেই খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে পাত্র সত্যিই একজন সার্জারি বিশেষজ্ঞ।
আপুরা আম্মুর থেকে জেনে বললো,
— আম্মু ছেলে অনেক ভালো কোন কথা নেই বিয়ে দিয়ে দাও।
ব্যাস আম্মু ও আরো বেশি জোরদার হয়ে গেল বিয়ে দেওয়ার জন্য। এবার সবার জন্য আব্বু ও রাজি হয়ে গেল। এখন আমার অমত করার আর কোন ওয়ে থাকলো না।
অবশেষে পাত্রের মায়ের কথায় আম্মু আমাকে মেরুন রঙের মধ্যে সবুজ পাড়ের একটা শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিল।
আমিও অবলা নারীর মতো সেজেগুজে তাদের সামনে গেলাম। এবার পাত্রের পাশে বসানো হলো আমাকে। তারপর পাত্র রিং হাতে অপেক্ষা করছে আমার আঙুলে পরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি হাত গুটিয়ে বসে আছি…..

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে