মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-১১+১২

0
1180

#মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-১১+১২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
আহনাফের রাগ যেন আকাশ ছুঁলো। মস্তিষ্কের ভেতর ভোঁতা এক যন্ত্রণা ভেতরকার সবকিছু কেমন যেন তছনছ করে দিতে লাগল। আহনাফ আভার হাত নিজের আঙ্গুলের ভাঁজে চেপে ধরলো। আহনাফের শক্ত হাতের স্পর্শে নরম দেহী আভার হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দাগ পড়ে গেছে হাতের কব্জিতে। আভা চোখ খিচে নিল। আহনাফ গভীর তথা রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
–’ আমাকে আর ভালো লাগছে না? ‘
আভা চমকে উঠল। কিভাবে বলবে সে, মা বাবার পরে আহনাফ আভার জীবনের সর্বশ্রেষ্ট ভালো লাগা। আভা দুনিয়া ভুলে যাবে তবুও এই মানুষটাকে কখনো ভুলে যেতে পারবে না। মৃত্যু আপন করবে অথচ ওপরপাশের মানুষকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে না।
আভা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। মৃদু স্বরে বলল,
–’ বোধহয় না। ‘
আহনাফের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে আহনাফ ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। এ তো আভা নয়। কোনো অন্য বটে। আহনাফ হাতের বাঁধন হালকা করল। আভা হাত বটে নিল। লাল হয়ে আসা কব্জির ঘষে কাতর চোখে আহনাফের দিকে চাইল। আহনাফ শান্ত কণ্ঠে সুধাল,
–’ তাহলে এতদিন এসব কি ছিল? মোহ? ‘
আভা চুপ থাকল। উত্তর দিল না। বরং এড়িয়ে গেল। বলল,
–’ যেতে হবে আমার। বাবা অপেক্ষা করছেন। ‘
–’ করুক। যার যা ইচ্ছে করুক। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কি চলছে এসব? ‘
আভা এবার আহনাফের দিকে চাইল। আহনাফের ওই দু চোখে আভার চেয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আহনাফের দু চোখ তো চোখ নয়। আস্ত এক সাগর। আভা সেই সাগরের নীল জলে অতলে ডুবে যাচ্ছে। আভা চোখ নামাল। হার মানল। মৃদু স্বরে বলল,
–’ নিজের মনে প্রশ্ন করুন। আমি আপনার কাছে কি ছিলাম। যেদিন এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন। আমার কাছে আসবেন। আমার উত্তর জানিয়ে দিব। শুভ বিদায়। ‘

আভা লাগেজ হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আহনাফ পেছনে স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে রইল। আভার এই নতুন পরিবর্তন বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে। কি বলে গেল আভা? প্রশ্ন এবং উত্তর?
আহনাফের ধ্যান ভাঙল। ফোনের কর্কশ শব্দে মেজাজ তিড়িং করে তুঙ্গে লাফাল। আহনাফ ফোন তুলল। দিহানের কল।
–’ আহনাফ, কই তুই? গাড়ি সেই কখন থেকে এসে বসে আছে। দ্রুত আয়। ‘
–’ আসছি। ‘
আহনাফ ফোন কেটে পা চালাল পেছনে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে হাজার প্রশ্ন। অনুভূতিরা উকিঝুকি দিচ্ছে মনের কোণে। আভা আহনাফের কাছে কি? আহনাফ জানে না। কেমন যেন চেনা অজানা প্রশ্নের কাছে হার মানছে সে।

আভার বাবা জুনায়েদ অপেক্ষা করছেন। আভা বাবার দিকে এগিয়ে আসে। আভা বাবাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
–’ কেমন আছো, বাবা? মিস করেছি খুব। ‘
–’ আমিও করেছি। কেমন কাটল সাজেক ট্রিপ? ‘
আভার ভাবনারা হামলে পড়ল মস্তিষ্কের আনাচে-কানাচে। মনে পড়তে লাগল, সাজেকে আহনাফের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত। আভা মৃদু স্বরে বলল,
–’ অনেক ভালো কেটেছে। নতুন কিছুর সাথে পরিচিত হয়েছি। এমন নতুন অনুভূতি যা আগে কখনো অনুভব করি নি। ‘
–’ ভালো করেছ। সর্বদা নতুন কিছু জানতে হবে। নতুন বিষয় আমাদের সবসময় আনন্দ দেয়। ‘
আভা বাবার দিকে চেয়ে হাসে। জুনায়েদ মেয়ের লাগেজ নিজের হাতে নিয়ে বলেন,
–’ এবার যাওয়া যাক। ‘
আভার মনে পড়ে একটা বিষয়। আভা তাড়া দেখায়। বাবার থেকে চেয়ে ইশারা করে বলে,
–’ বাবা, পাঁচ মিনিট। একটা ফোন কল আছে। ‘
–’ যাও। দ্রুত আসবে। তোমার মা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। ‘
–’ আসছি। জাস্ট ফাইভ মিনিটস। ‘
আভা বাবার থেকে একটু দূরে এসে দাড়ায়। কল দেয় কামরুলকে। দুবার রিং বাজতেই কামরুল কল রিসিভ করে। আভা বলে,
–’ কামরুল ভাই, কোথায় তোমরা? ‘
– ‘ বাইকে আমি। বাসায় যাচ্ছি। ‘
–’ আর সে? ‘
–’ কে সে? ‘
কামরুল টিপ্পনী কেটে উঠে। আভা লজ্জা পায়। তবু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
–’ তোমাদের অ্যাটিটিউড কিং। গুমড়া মুখো। ‘
–’ আহনাফ? ‘
–’ হ্যাঁ। কই সে? ‘
–’ ও গাড়িতে। বাঁধনদের সাথে আসছে। আমি বাইকে একা।’
–’ আচ্ছা, আমার কিছু কথা বলার ছিল। মন দিয়ে শুনবে। ‘
–’ মন আছে। বলো। ‘
–’ তোমার কাছে আমার ফোন নাম্বার আছে। এই নাম্বার তাকে দিবে না। সে অনুরোধ করলেও না। এটা আমার অনুরোধ। ‘
–’ কিন্তু কেন? তোমাদের ঝগড়া হয়েছে? ‘
–’ আমাদের বলতে এখনো কিছু হয় নি, কামরুল ভাই। শুধু আমি আর সে হবে। আর না, আমাদের ঝগড়া হয় নি। এমনি বললাম। সে চাইতে পারে আমার নাম্বার। তার কাছে নাম্বার নেই। যদি চায়, দিবে না। ‘
–’ আচ্ছা দিলাম না। কিন্তু কেন দিব না সেটা তো বলো। ‘
–’ তার দরকার পড়লে সে কষ্ট করে খুঁজে নিবে। কিছু পেতে হলে কষ্ট করতে হয়। পরিশ্রম ছাড়া কিছু পেয়ে গেলে তার মূল্য ফিকে হয়ে যায়। কষ্ট করে যা পাওয়া যায়, তা অমূল্য হয়ে থাকে। ‘
–’ বাহ। অনেক জ্ঞ্যান দিচ্ছ তো। তা নাম্বার না দিলে আমি কি পাব? ‘
–’ দেখা হলে নিজের হাতে চা খাওয়াব। চলবে? ‘
–’ চলবে, চলবে। আচ্ছা রাখছি এখন। বাইকে আছি। ‘
–’ আচ্ছা, বাই। ‘

আভা ফোন ব্যাগে রেখে বাবার দিকে এগিয়ে আসে।
– ‘ কথা বলা শেষ? ‘
–’ হ্যাঁ। চলো। ‘

আভারা বাসায় পৌঁছে। আভার মা তিনদিন পর মেয়েকে দেখে আহ্লাদে আটখানা। শেষ বয়সে হাজার দোয়ার পর পেয়েছেন এই মেয়ে। মিনহাজ হওয়ার পর তারা ছেলে মেয়ের মুখ দেখেনি নি প্রায় দশ বছর। এই দশ বছরে অনেক ডাক্তার, কবিরাজ দেখান হয়েছে। কিছুতেই কাজ হয় নি। বরাবরই মেয়ের শখ ছিল আভার মায়ের। মেয়ে হয় নি দেখে ভেঙে পড়েছিলেন একদম। কত ইচ্ছে ছিল, নিজের হাতে মেয়েকে পুতুল সাজাবেন। অথচ এত বছরেও আল্লাহ তায়ালা তাদের ঘরে জান্নাত দেন নি। দশ বছর পর যখন আভার মুখ দেখেন, তাদের সকল কষ্ট ছুটে পালায়। আভার বাচ্চা মুখ দেখে এতদিনের অপেক্ষার কষ্ট সব ভুলে চেয়েছিলেন হাতে থাকা বাচ্চা পুতুলের দিকে। ভেবেছিলেন, আল্লাহ এতদিন তাদের অপেক্ষা করিয়ে ভুল করেন নি। অপেক্ষার ফলস্বরূপ এই ফুটফুটে মেয়ে পেয়েছেন। এই বা কম কিসের? আল্লাহ তাদের কোল ভরিয়ে দিয়েছেন। শুকরিয়া তাকে।
বাবা মায়ের আহ্লাদে আভা হয়েছে ননীর পুতুল। এটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারে না। কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যায়। যখন যা চেয়েছি, তাই পেয়েছে। আভার বাবা মা মেয়েকে সত্যিকারের পুতুলের ন্যায় বড় করেছেন।
খাবার দাবারের পর্ব শেষ করে আভা গোসলে যায়। লম্বা এক গোসল সেরে মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে।
আভার মা চা দিয়ে গেছেন। আভা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জানালার কাছে আসে। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকায়। আহনাফকে এতগুলো কথা শুনানোর পর মনটা ভালো নেই তার। কেমন যেন করছে ভেতরে। অসহ্য লাগছে সব। আহনাফের অস্থিরতা দেখে নিজেকে সেসময় ঠিক রাখতে পারেনি। ইচ্ছে করছিল, ছুটে তার বুকে ঝাপটে পড়তে। অথচ পারে নি আভা। পরিকল্পনা মোতাবেক আগাতে হবে। আহনাফের মুখে ভালোবাসা স্বীকার করাতে চাইলে এটুকু ধৈর্য্য ধরতে হবে। শক্ত মনের অধিকারী হতে হবে। নাহলে আহনাফ যা মানুষ। বুক ফাটবে তবু মুখ ফুটবে না। এত সহজে প্রেম স্বীকার করবে না এই ছেলে। কসরত করতে হবে।
আভার অপেক্ষার প্রহর শুরু হল। আজ থেকে আভা প্রতিটা ক্ষণ অপেক্ষা করবে। জানালার কাছে মাথা ঠেকিয়ে চেয়ে থাকবে অদূরের পিচড়ালা সড়কের পানে। আহনাফ কবে আসবে?

#চলবে

#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
আর তিনমাস পর আভার ভর্তি পরীক্ষা। এইচএসিতে পরীক্ষা শেষ করে মস্তিষ্ক ঝরঝরে করতে দুদিনের ট্রিপে সাজেক গিয়েছিল। মস্তিষ্ক ঝরঝরে হয়েছে বটে তবে মস্তিষ্কের ভেতর লবণাক্ত সমুদ্রের ন্যায় প্রবাহিত হচ্ছে প্রেমের ঢেউ। বয়স আঠারো পেরিয়ে গেলেও মেধা-মনন এখনো চঞ্চল কিশোরীর ন্যায়। উড়ে বেড়াতে চায়, হাত বাড়িয়ে মেঘ ছুঁতে চায়, ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় নিয়ে রাস্তা পেরুতে চায়। এমন হাজারো কৈশোরী ইচ্ছে ডানা ঝাপটায় আভার ছোট্ট হৃদয়ে। সেই ফলস্বরূপ এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে বাবার কাছে বায়না ধরেছে, সাজেক যাবে। ছোট্ট মেয়ে। জুনায়েদ একা দিতে চান নি। এর আগে বহু জায়গায় ঘুরতে গেছে। একা একা। কখনো স্কুল কিংবা কলেজের পিকনিকে কিংবা একা ট্যুর টিমের সাথে। আভা বরাবরই একা ট্রাভেল করতে ভালোবাসে। কিন্তু আদরের মেয়ে তো। ভয় হয় আভার বাবার। তাই মেয়েকে বড্ড জোর করে ক্যারাটে শিখিয়েছেন। ভবিষ্যতে যেন নিজের রক্ষা নিজে করতে পারে। আজকাল যে যুগ এসেছে। কখন কে ক্ষতি করে বসে ইয়ত্তা নেই।

আভা পড়তে বসেছে। পড়তে ভালো লাগছে না। ক্যালকুলেটর নিয়ে অযথাই খুঁচিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ল আভার, আহনাফের বয়স কত? আভার সাথে তার বয়সের পার্থক্য কত? আভা অনুমানের ভিত্তিতে কিছুক্ষণ ক্যালকুলেটার চাপল। না, অনুমানের ভিত্তিতে বয়স দেখা ঠিক হচ্ছে না। আভা ঠোঁট কামড়ে কয়েক পল বসে রইল। হঠাৎ মনে পড়ল, সেদিন কামরুল বলছিলে আহনাফরা আর এক বছর পড়লেই মেডিকেল পাশ করবে। তবে আভার বয়স এখন আঠারো। মেডিকেল পাশ করতে লাগবে পাঁচ বছর। আহনাফরা চতুর্থ বছরে পড়ছে। তাহলে আহনাফের বয়স বাইশ কিংবা তেইশ বছরের কাছাকাছি। আভার সাথে তার বয়সের পার্থক্য চার থেকে পাঁচ বছরের। আভার মুখে অন্ধকার নেমে এল। চার কিংবা পাঁচ বছরের পার্থক্য কি খুব বেশি? আহনাফের পাশে আভা কে কি খুব বাচ্চা দেখাবে? আহনাফের সাথে আভাকে মানাবে না? আভা ছোট বলে কি আহনাফ তাকে ছেড়ে দিবে? বলবে, যাও তো মেয়ে। তোমার সাথে আমার যাচ্ছে না।

আভার মনে ঝড় বইয়ে গেল। ছোট্ট মন ভেঙে গুড়িয়ে যেতে লাগল। আভা টেবিলে ঢলে পড়ে বসে রইল। অযথাই খাতায় আঁকিবুকি করল কিছুক্ষণ। লিখল এটাসেটা। গান লিখল, ছন্দ লিখল, আহনাফের নাম লিখে আস্ত দু পেইজ ভরিয়ে ফেললো। অথচ মনের জ্বালা মিটল না।
এই আহনাফটা বড্ড খারাপ। এই যে আভার রাতের ঘুম কেড়ে নিল, মনের শান্তি শুষে নিল। আভা খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে। বারবার তার কথা মনে পড়ে কষ্ট পায়। অথচ তাকে দেখো? এখন অব্দি একটা কল করে নি। তার কি আভার কথা মনে পড়ছে না? খারাপ লোক।

–’ চান্দের রাইত? টেবিলে ঘুমাচ্ছিস কেন? ‘
মিনহাজের ভরাট কণ্ঠ শুনে আভা ধড়ফড়িয়ে বসে পড়ল। আহনাফের নাম লেখা খাতা চট করে বন্ধ করে ফেলল। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে বলল,
–’ ভাই, ভেতরে আসো। ‘
মিনহাজ শার্টের টাই ঢিলে করতে করতে আভার পাশের চেয়ারে এসে বসল। সারা বেলা কাজ করে ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে মিনহাজের। তবুও বোনের পাশে বসে কিছুক্ষণ এটাসেটা নেড়ে বলল,
–’ ঘুমাচ্ছিস কেন? দুদিন পর পরীক্ষা, ভুলে গেছিস? ‘
–’ না, ভুলি নি। মনে আছে। ‘
–’ তাহলে পড়ছিস না কেন? ‘
–’ পড়ছি ত। এই দেখো, ফিজিক্সের অঙ্ক করছিলাম। অথচ একটা অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছি না। তাই টেবিলে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। ‘
–’ কোন অঙ্ক? দেখা। ‘
আভা চিন্তায় পড়ে গেল। এখন কোন অঙ্ক দেখাবে সে? আভা ত মাত্রই পড়তে বসল। একটা পড়া পড়েনি। মিনহাজ ভাইকে কি দেখাবে? আভা ঠোঁট ভেঙে হেসে বলল,
–’ তোমার কষ্ট করে দেখান লাগবে না, ভাই। গাইড আছে7। আমি দেখে নিব। সমস্যা হবে না। ‘
মিনহাজ অবশ্য শুনল না। বরং ধমক দিয়ে বলল,
–’ দেখা বলছি। আমি করে দিব। তুই করতে পারলে, এতক্ষণে করে নিতি। পারিস নি, সারারাতেও পারবি না। দেখা এখন। ‘
আভা বই খুললো। অনেক খুঁজে খুঁজে একটা কঠিন অঙ্ক বের করে মিনহাজকে দেখাল। মিনহাজ অঙ্ক দেখে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর চট করে আভাকে অঙ্ক করে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল। আভা অবাক। মিনহাজ বরাবরই মেধাবী ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনয়ারিং নিয়ে পড়ে এখন ভালো চাকরি করছে। তার পক্ষে ফিজিক্সের অঙ্ক করা হাতের চুটকির সমান। মিনহাজ প্রশ্ন করল,
–’ আর কোনো সমস্যা আছে? ‘
–’ না, নেই। ‘
–’ সমস্যা হলে বলবি। আমি সলভ করে দিব। ‘
মিনহাজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আভার মাথায় থাপ্পড় দিয়ে আভার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। আভা মাথা ঘষে ভাইকে গালি দেয়। এতক্ষণ কত সুন্দর ব্যবহার করছিল। অথচ যাওয়ার আগে ভালো ব্যবহারের উপর গো মুত্র ছেড়ে গেল। সব জলে গেল। খারাপ ভাই!

মিনহাজ নিজের কক্ষে প্রবেশ করার আগে মাকে চিৎকার করে চায়ের কথা জানাল। নিজের কক্ষে প্রবেশ করে প্রথমেই জামা কাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকল মিনহাজ। সারা গা ঘেমে বিচ্ছিরি অনুভব হচ্ছে। ঠাণ্ডা জলের নিচে না দাড়ালে গরমে এই মুহূর্তেই যেন লুটিয়ে পড়বে মিনহাজ।

বিছানায় বসে চা খাচ্ছি মিনহাজ। ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ রিং বাজল। অতঃপর ওপর পাশের মানুষ কল ধরল।
–’ হ্যালো। ‘
–’ এতক্ষণ লাগে কল রিসিভ করতে? ‘
–’ বাসায় মানুষ ছিল।’
–’ ওহ। কি করছিলে? ‘
–’ জিজ্ঞেস করবে না কে এসেছে? ‘
আরোহীর প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে গেল মিনহাজের। সে কণ্ঠে খাদে নামিয়ে থমথমে কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
–’ কে? ‘
–’ পাত্রপক্ষ। ‘
–’ তোমার বোনকে দেখতে? ‘
–’ না। আমাকে। ‘
–’ হোয়াট? ‘
মিনহাজ কিছুটা বিস্মিত হয়ে পড়ল। আরোহীর ভেজা কণ্ঠ শুনে বুঝতে বাকি রইল না মিনহাজের কিছু। মিনহাজ শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করল,
–’ বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেছে? ‘
–’ না, আমার মতামত নিয়ে ঠিক হবে। ‘
–’ তা, তোমার মতামত কি? ‘
মিনহাজের সোজাসাপ্টা স্পষ্ট প্রশ্ন। আরোহী এবার কেঁদেই ফেলল। আর আটকে রাখা সম্ভব হল না চোখের জল। মুক্তোর ন্যায় চোখের সমুদ্র থেকে ঝরে পড়তে লাগল বৃত্ত-জল। মিনহাজের আর শোনার প্রয়োজন পড়ল না আরোহীর উত্তর। সে নিভল খানিক। গলার স্বর থৈথৈ সমুদ্রের গভীরতায় ঢেলে জিজ্ঞেস করল,
–’ আমায় বিয়ে করবে, আরোহী? ‘
আরোহী থমকাল। কান্না থেমে গেল চকিতেই। আরোহী আর ভাববার অবকাশ পেল না। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে হেসে জবাব দিল,
–’ হ্যাঁ। বিয়ে করব। একশোবার করব, হাজার বার করব। ”
মিনহাজ মৃদু হেসে উঠে। আরোহী বিয়ের কথা শুনে পাগল হয়ে গেছে। আরোহী বরাবরই মিনহাজ বলতে উন্মাদ। প্রেমের শুরুটা মিনহাজের দ্বারা হলেও, প্রেমটা জমে উঠেছে আরোহীর কারণে। মিনহাজের মাঝেমধ্যে মনে হয়, মিনহাজের জন্যে আরোহী সঠিক। আরোহী ছাড়া মিনহাজকে আর কেউ ভালো বুঝতে পারে না। মিনহাজ হাসল। মৃদু স্বরে বলল,
–’ আমি আসব। তোমায় বাম পাঁজরের হাড় বানানোর জন্যে আমাকে যে আসতেই হবে। অপেক্ষা করবে? ‘
–’ সারাজীবন অপেক্ষা করব। ‘
মিনহাজ হাসে। চায়ের স্বাদ আজ একটু বেশি ভালো লাগছে। চারপাশ এত মধুর ন্যায় মনে হচ্ছে কেন? আরোহীকে নিজের করে পাবে বলে কি এত সুখ?
____________________________________
আহনাফ বসে আছে বারান্দার মেঝেতে। আকাশের দিকে অনিমেষ চেয়ে রইল। আজ আকাশের অত্যন্ত সুন্দর এক চাঁদ উঠেছে। বাঁকা চাঁদ। যেন চাঁদের দুহাত দুদিকে মেলে রেখেছে, কোমড় দুলিয়ে নৃত্য করছে। চাঁদ যেন আজ খুব খুশি। এত খুশি কেন সে? সেও কি নিজের প্রিয় মানুষ পেয়েছে?
আহনাফ গিটার নিয়ে বসল। গিটারে টুংটাং সুর তুলল। আজ কণ্ঠে গান আসছে না। গলাটা কেমন যেন বসে আছে। আহনাফের আকাশ আজ বিষন্ন। আভার আকাশ কেমন?
আভা কি আহনাফের জন্যে খুব ছোট নয়? আভা মাত্র কলেজে পড়ে। আবেগে ভেসে বেড়াচ্ছে। আহনাফের প্রতি ভালো লাগা তার আজ আছে, কাল নাও থাকতে পারে। আহনাফ যদি আভার ক্ষণিকের মোহ হয়? জীবনের কোনো এক পর্যায়ে অলস বিকেলে বারান্দায় কেদারায় বসে বিবশ মনে আভার যদি মনে হয়, আহনাফ আভার জন্যে শ্রেষ্ট পছন্দ ছিল না? কি করবে আহনাফ? আভাকে ছেড়ে দিতে পারবে না। কিন্তু আভার অপছন্দ হয়ে বেচেও থাকতে পারবে না। আভা কি আদৌ বুঝে, ভালোবাসা কি? তার যন্ত্রণা পুষে রাখা কতটা কষ্টের? আভা ভালোবাসতে জানে। অথচ যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট সহ্য করতে জানে না। ভালোবাসার অপর নাম কষ্ট। কষ্ট ছাড়া ভালোবাসা সম্ভব নয়। আভার মন কি কষ্ট সহ্য করতে সক্ষম? আহনাফ দ্বিধায় জড়াল। কি সিদ্ধান্ত নিবে ঠাহর করতে পারল না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে