মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-২৯+৩০(শেষ পর্ব)

0
1609

#মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-২৯+৩০(শেষ পর্ব)
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
বাঁধন চলে যাবার পর সবার ভ্রমণের আনন্দ ময়লা হয়ে পড়ে। আহনাফ আর এক মুহুর্ত সেখানে থাকে না। সবাইকে নিয়ে চলে আসে হোটেলে। আসার পথে ক্ষুধা লাগায় মৌলভীবাজার পানসি রেস্টুরেন্টে উঠে সবাই টুকটাক খাওয়া দাওয়া করে। হোটেলে ফিরে যে যার কক্ষে ঢুকে গোসল সেরে নেয়। আভা গা চুলকাচ্ছে। তাই সেও গোসলে ঢুকে। আভার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, বাঁধন ওভাবে চলে গেল কেন? আহনাফের মুখ পুরো রাস্তা বেশ মলিন ছিল। কোনো কথা বলেনি। চিত্রা খাবার কথা বলায় চুপ কর গাড়ি থেকে নেমে সবাই খাবার খেয়েছে। রাস্তায় আভা নানা কথা বলেছে। সব কথার উত্তরে আহনাফ হু, হা করেছে। আহনাফের কি মন খারাপ? একজন বন্ধু চলে যাওয়ায় বাকিদের সে চোখে দেখছে না? এমন কেন সে? আহনাফের মন খারাপ আভা সহ্য করতে পারে না। মন কাঁচের টুকরোর ন্যায় ভে’ঙে গুড়িয়ে পড়ে। হৃদয়ে কা’মড় দিয়ে উঠে যেন। কোনো এক ম্যাজিক হতে পারে না? সে ম্যাজিকের ছোঁয়ায় আহনাফ আবারও আগের ন্যায় হাসুক, বাঁচুক, চিন্তামুক্ত হোক।

আহনাফ গোসল থেকে বেরিয়ে আসে। কোমড়ে টাওয়াল পেঁচানো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ফুলো বাহু, প্রশস্ত দেহ খানা যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রতিদিন নিয়মমাফিক ওয়ার্কআউটের। আহনাফ বাঁধনের মোবাইলে কল করেছে। অনেকবার, বারবার বাঁধনের ফোন বন্ধ দেখিয়েছে। শেষবারের মত চেষ্টা করল আহনাফ। এবারও একই কাহিনী। আহনাফ রাগে পাগল হয়ে গেল। ফোন বিছানার উপর আ’ছাড় দিয়ে ফেলে দুহাতে ঘন চুল খা’মছে ধরল। যে ভয়টা পেয়েছিল, সেই ভয়ই শেষ অব্দি সত্যি হল। নিয়তি এমন ধুরন্তর কেন? একহাতে বন্ধুত্ত্ব অপরহাতে ভালোবাসা। দুটোকে সবসময় এক পাল্লায় মাপতে চেয়েছিল আহনাফ। চেষ্টাও করেছিল। অথচ আজ সবকিছু কেমন উল্টেপাল্টে গেল।
আহনাফ টিশার্ট প্যান্ট পড়ে বিছানায় বসল। ফোন হাতে নিয়ে দেখে বাবার ফোন থেকে কল এসেছে এগারোটা। আহনাফ হকচকিয়ে গেল। এতবার বাবা কল করেছে? কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে? আহনাফ সঙ্গেসঙ্গে কল ঘুরাল। প্রথমবারেই কল রিসিভ হল।
‘ বাবা, কল ক…..’
‘ স্যার, বড় স্যার স্ট্রোক করেছেন। আপনি জলদি অ্যাপোলো হসপিটালে আসেন। আমরা সেখানেই ভর্তি করছি স্যাররে। ‘
আহনাফের মাথায় সমস্ট পৃথিবী যেন ধ্বসে পড়ল। আহনাফ বিস্মিত কণ্ঠে শুধাল,
‘ কখন হয়েছে এসব?
‘ সকালের দিকে। রুমের মাটিতে পড়ে ছিলেন। আমরা ধরাধরি করে উঠাইসি। এখনও ডাক্তার কিছু বলে নাই। আপনি আসেন স্যার। আমার খুব ভয় করতাসে। ‘
‘ আম.আমি আসছি শহিব। এক ঘণ্টার মধ্যে আসছি। ‘
‘ জ্বি আইচ্ছা। ‘
আহনাফ ফোন কাটে। পাগলের ন্যায় বিছানা ছেড়ে উঠে। ঝড়ের বেগে লাগেজ সকল কাপড় চোপড় এলোমেলো ভাবে ঢুকিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। আভার দরজায় এসে কড়া নাড়ে। আভা মাত্রই গোসল থেকে বেরিয়েছে। চুলে গামছা পেচানো। আহনাফের বারবার ডাকাডাকিতে সে দ্রুত এসে দরজা খুলে।
‘ বাবা স্ট্রোক করেছে, আভা। আমি ঢাকা যাচ্ছি। তুমি যাবে ঢাকা? না যেতে চাইলে কামরুলদের সাথে চলে যেও। ‘
আহনাফের কণ্ঠ কাঁপছে। চোখ লালচে হয়ে আছে। বড্ড অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। আভা কোনোরকম আহনাফের কাঁধে হাত রাখল। বলল,
‘ আমি দু মিনিটে তৈরি হচ্ছি। একসঙ্গে যাব। চিন্তা করো না। আঙ্কেল ঠিক হয়ে যাবেন। ‘
আভা দ্রুত কক্ষে ঢুকে তৈরি হয়ে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্লেনের টিকেট পাছে না। শেষ অব্দি ডাবল টাকা দিয়ে টিকেট কিনেছে। প্লেনে উঠে আহনাফ মুখাখনা থমথম করে বসে রয়েছে। আভা পাশে একনজরে আহনাফের দিকে চেয়ে আছে। আহনাফের চিন্তাগ্রস্ত চেহারা বড্ড মলিন। আভা আহনাফের কাঁধে হাত রাখে। আহনাফ বিড়বিড় করে আওড়ায়, ‘ আমার খুব টেনশন হচ্ছে আভা। বাবা ঠিক না হলে.. উফ! ‘
আহনাফের অস্থিরতা বলে দিচ্ছে, সে তার বাবাকে কতটা ভালোবাসে। আভা আহনাফের হাতে হাত রাখে। মৃদু চাপ দিয়ে ভরসা দিয়ে বলে,
‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না। ‘
____________________________
আহনাফের বাবা এই মুহূর্তে আইসিইউ থেকে আছেন। অবস্থা বেগতিক। বাঁচা মরার সাথে লড়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আহনাফের মুখের দিকে চেয়ে দেখা যাচ্ছে না। লাল হয়ে আছে সম্পূর্ণ মুখ। থমথমে মুখে একবার আইসিইওর দরজার দিকে তাকাচ্ছে আরএকবার মেডিকেল রিপোর্ট দেখছে। হয়ত আশা খুঁজে বেড়াচ্ছে। আভা সেই কখন থেকে আহনাফের পাশে বসে আছে। আহনাফ একসময় বলল,
‘ বাসায় চলে যাও, আভা। এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবে? ‘
‘ যতক্ষণ তুমি আছো। ‘
‘ কষ্ট হবে। ‘
‘ হোক। নিজের পরিবারের জন্যে কষ্ট করলে কিছু হয় না। ‘
আহনাফ আর কথা বাড়াল না। চেয়ার থেকে উঠে ডাক্তারের কাছে চলে গেল। আভা সেখানেই স্থির হয়ে বসে রইল। চোখ মেলে পুনরায় দেখল আহনাফের অসুস্থ বাবাকে।
কিছুক্ষণ পর আহনাফ ক্লান্ত পায়ে এসে বসে আভার পাশে। হাতে খাবারের প্যাকেট। প্যাকেট থেকে একটা মাঝারি আকারের কেক বের করে আভার দিকে এগিয়ে দেয়। বলে,
‘ খেয়ে নাও। ‘
‘ তুমি খাবে না?
‘ না। ‘
‘ কেন? না খেলে এত দৌঁড়াদৌঁড়ি কি করে করবে?
‘ খেতে ইচ্ছে করছে না। বেশি প্রশ্ন না করে খাও। ‘
আভা আর কথা বাড়াল না। চুপ করে কেক নিয়ে খেতে লাগল। আহনাফের মুখে কেক তুলে দিলে আহনাফ মুখ সরিয়ে নেয়। আভা আর জোড় করে না। মন ভালো নেই তার। এখন শত জোড় করলেও খাবে না।
খানিক পর আইসিইউ দরজার পাশে এসে দাঁড়ালেন এক মধ্যবয়স্ক মহিলা। আভা লক্ষ্য করল মহিলা আহনাফের বাবার দিকে চেয়ে কাঁদছেন। গা ছুঁয়ে রয়েছে সাধারণ সুতি শাড়ি। চেহারা ক্লান্ত, অস্থির, অবসন্ন। আভা ভাবল, একবার জিজ্ঞেস করবে কে তিনি? কিন্তু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই আহনাফকে দেখা গেল। হন্তদন্ত পায়ে মহিলার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
‘ মা তুমি এখানে? ‘
মহিলা তাহলে আহনাফের মা। ভীষন সুন্দর তিনি। এই বয়সেও রূপ যেন উপচে পড়ছে। আহনাফ তাহলে তার মায়ের গড়ন পেয়েছে। আহনাফের মা কান্না করে ছেলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আহনাফ বেশ দক্ষ হাতে মাকে সামলে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
‘ কান্না করো না। বাবা সুস্থ হয়ে যাবেন। ‘
তবুও আহনাফের মায়ের কান্না থামল না। আজ যখন খবর পেলেন তার স্বামী স্ট্রোক করে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, অভিমান সব যেন নিমিষেই তুচ্ছ হয়ে গেল। স্বামীকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনায় চোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। এতদিন এক জ্বালায় স্বামীর থেকে দূরে ছিলেন। এখন একেবারে হারিয়ে ফেললে তিনি আর বেঁচে থাকতে পারবেন না। যন্ত্র’নায় ছটফট করে ম’রে যাবেন। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে আর কষ্ট দিবেন না। আল্লাহ!
________________________
দশ ঘন্টা পর আহনাফের বাবার জ্ঞান ফেরে। তাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। সবার প্রাণে যেন পানি এসেছে এবার। ডাক্তার এসে দেখে গেছে মাত্রই। যাবার আগে আহনাফ ও তার মাকে বলে গেছে,
‘ দেখো আহনাফ, তোমার বাবা মারাত্মক পরিমাণে টেনশন করেন। তাছাড়া অতিরিক্ত সিগারেট খাওয়া দরুন উনার ফুসফুসে সমস্যা দেখা গেছে। দেখে রাখবে যেন উনি টেনশন ফ্রি থাকেন। আর সিগারেট থেকে দূরে রাখবে। আশা করি, ইউ ক্যান ডু ইট প্রপারলি। ‘
আহনাফ একপল মায়ের দিকে তাকাল। আহনাফের মায়ের চোখে জল। বারবার দূর থেকে কেবিনে শুয়ে থাকা স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন। কে বলেছে এত চিন্তা করতে থাকে? চিন্তা করতে করতে একবারে চিন্তাবিদ হয়ে গেছে? নিজের শরীরের যত্ন নেয় না ঠিকমত। দেবদাস হয়ে গেছে? রাগ হচ্ছে ভীষন। রাগে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।
ডাক্তার চলে গেলে আহনাফ মায়ের দিকে চায়। বলে,
‘ কিছুসময় বাবার কাছে থাকো তুমি। আমি আর আভা একটু বাইরে যাচ্ছি ঔষধ আনতে। ‘
আহনাফের মা বিস্ময় গলায় বললেন,
‘ আভা কে? ‘
আহনাফ মৃদু হেসে আভাকে বলে,
‘ এদিকে এসো। ‘
আভা গুটিগুটি পায়ে আহনাফের পাশে এসে দাঁড়ায়। শির নত করে রাখা। গালে এক চিমটি লজ্জা। আহনাফ মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
‘ তোমার হবু বউ। ‘
‘ হবু বউ? ‘
আহনাফের মা চমকে উঠেন। আভা আহনাফের মাকে জড়িয়ে ধরে। আহনাফের মা ছেলের দিকে চেয়ে আভার পিঠে হাত রাখেন। মুচকি হেসে বললেন,
‘ সুখী হও। ‘
‘ ধন্যবাদ , মা। ‘
‘ মা? ‘
আভা সরে দাঁড়ায়। মৃদু হেসে বলে,
‘ বিয়ের পর হুট করে মা ডাকতে পারব না। তাই এখন থেকেই অভ্যাস করছি।
আহনাফের মা হেসে ফেলেন। বলেন,
‘ মা বলেই ডেকো। ভালো লাগছে শুনতে। ‘
আহনাফ আর আভা কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। কেবিনের সামনে নিজের বন্ধুমহলকে দেখে খানিক অবাক হয় আহনাফ। দিহান, কামরুল, চিত্রা এগিয়ে আসে। আহনাফকে প্রশ্ন করে,
‘ আঙ্কেল কেমন আছে এখন?
‘ আগের চেয়ে ভালো। ‘
কামরুল বলে,’ শালা, দু ঘন্টা জ্যামে বসে ছিলাম। জ্যাম না হলে আরো দু ঘন্টা আগেই পৌঁছে যেতাম। ‘
দিহান আহনাফের কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘ আন্টি এসেছে?
আহনাফ মৃদু হেসে বলে, ‘ হ্যাঁ, বাবার কাছেই বসে আছে। ‘
এ কথা শুনে আহনাফের সকল বন্ধুরা জোরে চিৎকার করে উঠে। আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ কংগ্রাচুলেশন বন্ধু। তোমার তো লটারি লেগে গেছে। খুব খুশি তুই, না? ‘
আহনাফ ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘ মনে হচ্ছে আমার জীবন অনেকদিন পর পূর্ণতা পেল। ‘
সবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আহনাফের চোখ গেল দূরের কর্নারে। বাঁধন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর চোখে আহনাফকে দেখছে। হঠাৎ হঠাৎ আভাকে পরখ করছে। আহনাফ এগিয়ে আসে। বাঁধনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আচমকা শক্ত করে বাধনকে জড়িয়ে ধরে। বাঁধন কিছুটা পিছিয়ে যায়। আহনাফ বিড়বিড় করে আওড়ায়, ‘ সরি রে। বড্ড স্বার্থপর হয়ে পড়েছিলাম। ‘
বাঁধন মৃদু হেসে আহনাফের পিঠে হাত রেখে বলে,’ ইটস ওকে। ‘
আহনাফ বাঁধনের কাঁধে হাত রেখে বন্ধুদের দিকে এগিয়েছে। আভার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দুজনের দিকে চেয়ে বাঁধন মলিন হেসে বলেছে,
‘ দুজনের জন্যে শুভকামনা। আভা, ট্রিট দিতে হবে কিন্তু। ‘
আভা হেসে বলে,
‘ বিরিয়ানি চলবে?
আহনাফের বাকি বন্ধুরা চেঁচায়,
‘ চলবে না দৌড়াবে। ‘
চিত্রা পাশে দাড়িয়ে থাকে। কান্না পাচ্ছে। আজ বাসে করে ঢাকা আসার পথে কামরুল আভা এবং আহনাফের রিলেশনের কথা সবাইকে বলেছে। বাকিরা এতে খুশি হতে পারলেও চিত্রা পারেনি। বুকে মোচড় দিয়ে ধরেছে। কষ্টে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনি গলা টিপে নিজেকে মেরে ফেলতে। আহনাফ তার কথা রাখেনি। সে বলেছে, সে কাউকে ভালোবাসবে না। অথচ আভাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছে। চিত্রা কি দোষ করেছে? ওর কি আহনাফের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা ছিল না? চিত্রা এগিয়ে আসে। বুকে পাথর চেপে আভাকে জড়িয়ে ধরে।
‘ কংগ্রাচুলেশন, আভা। আহনাফকে সুখে রেখো। ও তোমায় বড্ড ভালোবাসে।
আভা মিহি হেসে উত্তর করে, ‘ চেষ্টা করব। ‘

#চলবে

#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – শেষ পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________
মিনহাজ এই মুহূর্তে বাবার ঠিক মুখোমুখি বসে আছে। তার দৃষ্টি স্থির। বুকে পুষে রেখেছে কনফিডেন্স। প্রিয়তমাকে নিজের করে পাওয়া তীব্র ইচ্ছা। জুনায়েদ গম্ভীর চোখে ছেলেকে আগাগোড়া লক্ষ্য করে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর বললেন,
‘ মেয়েটার নাম কি?
মিনহাজ ঢোক গলাধঃকরণ করে মিহি স্বরে বলল,
‘ আ-আরোহী। ‘
‘ কোথায় থাকে?
‘ আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে। ‘
‘ তুমি তাহলে এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাও? ‘
‘ হ্যাঁ। যদি তোমাদের মত থাকে। ‘
‘ আমরা মত না দিলে? ‘
‘ ভাবব, আমার চাওয়ার মধ্যে ভুল ছিল। ‘
জুনায়েদ হাসেন। মিনহাজকে অবাক করে দিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
‘ বিয়ের প্রস্তুতি নাও। আগামী মাসে বিয়ে হচ্ছে। ‘
মিনহাজ বিস্ময় নিয়ে চায় বাবার পানে। বাবা এত সহজে আরোহীকে মেনে নিবেন ভাবতে পারেনি মিনহাজ। মিনহাজের চোখের কোনায় জল জমে। হুট করে জড়িয়ে ধরে বাবার গা। জুনায়েদ মুচকি হেসে ছেলের পিঠে হাত রেখে দোয়া পড়েন। জুনায়েদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলে মিনহাজ মায়ের পাশে এসে বসে। সাহারা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘ মেয়েটা কি ভীষন সুন্দরী রে, মিনহাজ? ‘
মিনহাজ হাসে। বলে,
‘ একদম তোমার মত সুন্দর। ‘
সাহারা খাতুনের মন প্রাণ ভরে যায়। ছেলের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। রাজা ছেলে তার!
___________________________
অতঃপর মিনহাজের বিয়ে হয় ভীষন ধুমধামে। কবুল বলার সময় আরোহীর কান্না সবার মন খারাপ করালেও মিনহাজের কবুল বলার নির্লিপ্ততা সবাইকে ভীষন হাসিয়েছে।
আভা বাসর ঘরে তার সদ্য ভাবীকে এনে বসায়। আরোহী লজ্জায় নেতিয়ে। চোখ তুলে তাকাবার জো হচ্ছে না তার। লজ্জায় যেন দম বন্ধ লাগছে। আভা আরোহীর লেহেঙ্গা ঠিক করে দেয়। বলে,
‘ ভাবি, তোমার জামা কাপড় সব ভাইয়া আগেই আলমারি ভর্তি করে রেখেছে। গরম লাগলে গোসল করে নিবে। একদিন দুইবার গোসল করবে। কি আর করার। বাসর ঘর বলে কথা। ‘
ইশ,ইশ! আরোহী ম’রে যাচ্ছে এসব কথা শুনে। আভা মেয়েটা এত ঠোঁটকাটা কেন? একদম ভাইয়ের মুখ পেয়েছে। মিনহাজও এমন ঠোঁটকাটা। যখন তখন লাগামহীন কথা বলে আরোহীকে লজ্জা দেয়। ভাইবোন সব এক ধাচের। আভা আরোহীকে প্রয়োজনীয় সব কথা বলে। আরোহী মন দিয়ে শুনে। মিনহাজ এসে সোফার উপর বসে। আরোহী আড়চোখে তাকায়। মিনহাজের গায়ে শেরওয়ানি নেই। মাত্রই গোসল সেরে এসেছে। চুল ভেজা, কপালে এখনো পানির বিন্দু লেগে আছে। মিনহাজ চোখ টিপ্পনী দেয়। আরোহী লজ্জায় আর তাকাতে পারে না। চোখ সরায়। আভা আরোহীকে ছেড়ে ভাইয়ের সামনে এসে দাড়ায়।
আভা হেসে ভাইয়ের দিকে হাত পাতে। মিনহাজ ভ্রু উচুঁ করে বলে,
‘ ভিক্ষা নেই, যা। ‘
‘ ভিক্ষা চাইছে কে? আমি বখশিশ চাইছি। পাঁচ হাজার টাকা বের করো ঝটপট। ‘
‘ পাঁচ হাজার টাকা? ওই, টাকা কি গাছে ধরে? ‘
‘ না, গাছে ধরে না। পকেটে ধরে। বের কর জলদি। ‘
‘ টাকা নেই, ফুট। ‘
‘ আছে। তুমি কি বের করবে? ‘
‘ বললাম না নেই। ‘
আভা ভাইয়ের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলে। মিনহাজও নাছোড়বান্দার ন্যায় তর্ক করে যায়। একপর্যায়ে আরোহী বলে,
‘ আভা, আমি দিচ্ছি টাকা। আসো এদিকে। ‘
আভা মিনহাজের দিকে চোখ রাঙিয়ে চেয়ে ভাবির দিকে যায়। আরোহী তার ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা আভার হাতে ধরিয়ে দেয়। মিনহাজ আসার সময় দিয়েছিল এই টাকা সবাইকে দেওয়ার জন্যে। আভা হেসে উঠে আরোহীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আরোহী হাসে। ভাই-ভাবীকে বাসর ঘরে একা রেখে আভা দরজা ভিড়িয়ে চলে যায়।
মিনহাজ সোফা থেকে উঠে। আরোহীর দিকে এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে। আরোহী জমে যায় সেখানেই। একহাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে রাখে। বুক ক্রমশ উঠানামা করছে। যেন এক্ষুনি মিনহাজের এমন বেহায়া চাওনিতে ম’রণ হল তার। মিনহাজ আরোহীর পাশে এসে বসে। আরোহীকে গহীন চোখে পরখ করে। আরোহীর ঠোঁট কাপছে। মিনহাজ এগিয়ে এসে আরোহীর কপালে চুমু খায়। গভীর করে ঠোঁট ঠেসে রাখে আরোহীর কপালে। শিহরণে আরোহীর চোখ খিঁচে ফেলে। মিনহাজ মৃদু স্বরে বলে,
‘ আমার অর্ধাঙ্গিনী। ‘
ইশ, আরোহী এবার সত্যি সত্যি ম’রে গেল।
____________________________________
আভা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে আজ প্রায় চার বছর। প্রতিদিন মেডিকেলে যাওয়া আসার কারণে শরীর প্রায় নেতিয়ে। আইটেম, কার্ড ,ভাইভা এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিজের দিকে তাকাতেই ভুলে গেছে প্রায়। আহনাফের পড়াশোনা শেষ। এখন চাকরি করছে। সম্পর্কটা ভালোই চলছে দুজনের। একে অপরকে চোখে হারায়। আভা সেই আগের ন্যায় আহনাফকে ছাড়া এক বিন্দু কিছু ভাবতে পারে না। আহনাফের বুকেই তার সকল সুখ! আহনাফ এখনও অবাক হয়, একটা মেয়ে আহনাফের ন্যায় সাধারণ এক পুরুষে এত মজল কিভাবে? আভার ভালোবাসা আহনাফকে ছাড়িয়ে চলে যায় বহুদূর, বহুদূর এবং বহুদূর!

সময়ের ঘন্টা এগিয়ে চলেছে সামনে। আভা আহনাফের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে এ মাসের দশ তারিখ। আভার খুশি আর দেখে কে? খুশিতে যেন নেচে উঠছে সে। আহনাফকে জ্বালাচ্ছে ক্রমাগত। বিয়ের পর এই করবে, সেই করবে! কতশত কথা তার। স্বপ্নেরা উকিঝুকি দিচ্ছে মনের আঙিনায়। আহনাফও বাধ্য প্রেমিকের ন্যায় আভার সকল জ্বালাতন সহ্য করছে। আর মাত্র কটা দিন। তারপরই তার ঘরের লক্ষ্মী তার ঘরে আলতা রাঙা পা রাখবে। মুখরিত করবে সারা বাড়ি। ক্লান্ত বিকেলে এক কাপ চায়ে দুজন দুজনার মধ্যে হারাবে। ধোঁয়া উঠা গরম ভাত একে অপরের মুখে তুলে দেবে। ইশ! সময়টা এত সুন্দর কেন? জীবন এত মুগ্ধময় কেন? একটা নারীকে ঘিরে এত সুখ কেন?

বিয়ের সানাই বাজল অবশেষে। আভা বধূ সেজে আহনাফের পাশে বসে আছে। আভার গায়ে লাল বেনারসি, পা ভর্তি আলতার লাল রঙ, গায়ে গহনা! সবই আহনাফের পছন্দের। আহনাফ নিজ হাতে বিয়ের সব বাজার করেছে। আভাকে অবাক চোখে চেয়ে দেখছে আহনাফ। বিয়ের সাজে আভাকে সবসময় কল্পনা করত আহনাফ। আজ আভাকে বধূ বেশে তার কল্পনার থেকেও সুন্দর দেখাচ্ছে। আভার চোখে সুখের ঝলক। যেন অতি সুখে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে সে। আহনাফ সবার অলক্ষে শক্ত করে আভার কোমড় চেপে ধরে। কানের কাছে বিড়বিড় করে সুধায়,
‘ বউরে, আজ তুমি শেষ! ‘
আভা লজ্জা পায়। লজ্জায় কথা বলতে পারে না। মৃদু স্বরে বলে,
‘ অসভ্য কোথাকার। ‘
আহনাফ হাসে। বলে,
‘ পাঁচ পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছি। অসভ্য হতে ইচ্ছে করলেও বৈধ নই বলে করিনি। এখন তুমি আমার জন্যে বৈধ। এবার আর তোমার রক্ষে নেই। এখন থেকে আমি তোমায় লজ্জা দিয়ে দিয়েই মে’রে ফেলব। ‘
আভা শিউরে উঠে। গা কাঁপে। এত ভয়ংকর কথা সে কখনো শুনে নি। আহনাফের হাতে আভার মরন! ইশ, ইশ, ইশ! এত সুখ সইবে তো কপালে? আভা আহনাফের গা ঘেঁষে বসে। আহনাফ লক্ষ করে, আভার গা গরম হচ্ছে। লজ্জায় নাকি ভয়ে, বুঝতে পারল না সে।

পুনশ্চ…
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আভা এবং আহনাফ। আভাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আহনাফ। আভার ঘাড়ে আহনাফের চিবুক। আভার পেটে বিচরন করছে আহনাফের দুষ্ট হাত। বিয়ের এত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আহনাফের দুষ্ট হাতের স্পর্শ নিতে অক্ষম আভা। এখনো আহনাফের ঠোঁটের স্পর্শে আভা লজ্জায় আলুথালু হয়ে পড়ে। গায়ে ভয়ংকর কাঁপুনি শুরু হয়। লোকটা এত ভয়ংকর প্রেমিক কেন? তার বুকেই এত সুখ কেন? সেই সুখে ভেসে যেতে ইচ্ছে হয় আভার। আহনাফ মৃদু স্বরে বলে,
‘ বউরে, ভালোবাসি। ‘
বিয়ের পর আহনাফ শতবার আভাকে ভালোবাসি বলেছে। তবুও যেন আভা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয় না। এখনি সেই কথাটা শুনলে বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করে উঠে। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় একসাথে হাতে হাত রেখে।
‘ বন্ধু, প্রেম পড়ে করো। গিটার নিয়ে এসেছি। গান করব। চল। ‘
কামরুলের কথা শুনে আভা আহনাফের বাহুবন্ধনে ছটফট করে উঠে। বন্ধুদের সামনে প্রেম করতে লজ্জা হয়। আহনাফ মৃদু হেসে আভাকে ছেড়ে দেয়। আভা একপাশে এসে দাঁড়ায়। চিত্রা আভাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে সাগর পাড়ে বসে। কামরুল, দিহান, বাঁধন ও আহনাফ একসঙ্গে গান ধরে।

আমার মন বসে না শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাই তো আইলাম সাগরে,
তাই তো আইলাম সাগরে
মন বসেনা শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
এই সাগর পাড়ে আইসা আমার
মাতাল মাতাল লাগে
এই রুপ দেখিয়া মন পিঞ্জরায়
সুখের পক্ষী ডাকে (২ বার)
পারতাম যদি থাইকা যাইতে
এই সাগরের পাড়ে
ঝিনুক মালা গাইথা কাটায়,
দিতাম জীবনটা রে
আমার মন বসে না শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাই তো আইলাম সাগরে,
তাই তো আইলাম সাগরে
মন বসেনা শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
এই নীল জলেতে ভাসায় দেবো
মনের দুঃখ যতো
আর জল দিয়া পূরন করিবো
হাজার শুকনো ক্ষত (২ বার)
পারতাম যদি থাইকা যাইতে
এই সাগরের পাড়ে
ঝিনুক মালা গাইথা কাটায়,
দিতাম জীবনটা রে
আমার মন বসে না শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাই তো আইলাম সাগরে,
তাই তো আইলাম সাগরে
মন বসেনা শহরে
ইট পাথরের নগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে
তাইতো আইলাম সাগরে।।

বন্ধুরা সব হেলেদুলে বেশ উচ্ছল কণ্ঠে গান করছে। পাখিরা সব ভিড় জমিয়েছে আকাশে। মেঘেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। গা ছুঁয়ে বইছে সাগরের শীতল বাতাস। গায়ের জামা দেহ ছুঁয়ে উড়ে যেতে চাইছে। ভালোবাসাগুলো ডানা মেলছে। আভা পেরেছে আহনাফের মন ছুঁতে। এই মুহূর্তে আভার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,
‘ মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম আমি। ‘
আহনাফের ভালোবাসাময় চোখ আভার পানে। আভার চোখে লজ্জা! বাঁধনের চোখে কিছু একটা ভাসছে। কি ভাসছে? নতুন কেউ নাকি পুরনো এক অসহ্য প্রেম?
চিত্রার চোখে জল। তার দৃষ্টি আহনাফের মধ্যে আবদ্ধ। আভা দেখে চিত্রাকে। চিত্রার কষ্ট দেখে তারও কষ্ট হয়। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনা কতটা কঠিন সেটা হয়ত আভা জানে না। কিন্তু চিত্রাকে কাঁদতে দেখে সেটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছে আভা। চিত্রার জীবনেও যেন আহনাফের চেয়েও ভালো এক পুরুষ আসুক! আভা মন থেকে সেই দোয়া করে।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে