মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-২৫+২৬

0
1250

#মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-২৫+২৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
______________________________
ট্যুরে যাবার কথা আহনাফের ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। সচেতন মনে নানা জল্পনা কল্পনা এঁকে ফেলল। আভা নিশ্চয়ই একা দট্যুরে যেতে চাইবে না। আহনাফের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যেতে বলবে। এ কদিন আভার সাথে আহনাফের বন্ধু বান্ধবের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। আহনাফের বন্ধুরা ছাড়া ট্যুরে মজা করতে পারবে না আভা। আহনাফ দ্বিধান্বিত হল। কি
উত্তর দিবে ঠাহর করতে পারল না। বলল,
‘ এখন না। আরো কদিন পর যাব, হু? ‘
আভা নাছোড়বান্দার ন্যায় আচরণ করল। গাল দুখানা ফুলে ফেঁপে ঢোল করে বলল,
‘ এখন কেন নয়? গেলে কি হয়! সবসময় আপনার এই করো না, সেই করো না সারাক্ষণ শুধু না আর না। আপনি বলেছেন, এক্সাম পরে আমরা ট্যুরে যাব। এখন নিজে কথা পাল্টাচ্ছেন। এটা ঠিক না।’
আহনাফ খানিক কঠিন চোখে আভার দিকে চাইল। আভা আহনাফের লাল চোখ দেখে আদুরে বিড়াল ছানার ন্যায় মিইয়ে গেল। আভাকে এমন গুটিয়ে যেতে দেখে আহনাফের বড্ড মায়া লাগল। না চাইতেও আভার মায়াময় মুখে হারিয়ে গেল। না করতে একদম ইচ্ছে করল না। বরং মুচকি হেসে দ্বিধা জড়ানো কন্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা যাব। শুধু তুমি আর আমি! হবে? ‘
আভা হকচকিয়ে গেল। দুহাতে মানা করে বলল,
‘ না, না। বিয়ের আগে একা দুজন কোথাও যাওয়া যাবে না। ভুল হয়ে যাবে। আপনার বন্ধুদের বলুন। ওরাও আমাদের সঙ্গে যাবে। তারা গেলে অনেক মজা হবে। ওরা খুব দারুন মানুষ। ‘
আহনাফের চোয়াল শক্ত হতে লাগল। আভা যা একবার মুখ দিয়ে বের করেছে, এখন তা ফিরিয়ে নেবে না। কাজে করে দেখাবে। মেয়েটার জেদ সম্পর্কে আহনাফ খুব ভালো জানে। আহনাফ বলল,
‘ না, হয় দুজন একা যাব। নাহলে যাওয়ার দরকার নেই। ‘
‘ আপনার কি ওদের সাথে ঝগড়া হয়েছে? ‘
আভা চোখ পিটপিট করে বলল। আহনাফ দ্রুত উত্তর দিল,
‘ না, তেমন কিছু না। ‘
‘ তাহলে! ওদের নিতে চাচ্ছেন না কেন? ‘
আহনাফ আকাশের দিকে চেয়ে চোখ উল্টে মৃদু নিঃশ্বাস ছাড়ল। হার মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে কণ্ঠনালি গম্ভীর করে বলল,
‘ আচ্ছা, আচ্ছা। যাব। সবাই যাব। হয়েছে? শান্তি? ‘
আহনাফের হ্যাঁ-বোধক উত্তর শুনে আভা খুশিতে নেচে উঠল যেন। আহনাফের বাহু দুহাতে জড়িয়ে ধরে চোখ চোখ রেখে বলল,
‘ থ্যাংকস। ‘
‘ সবসময় জেদ করো। তোমার সব জেদ আমাকে পূরন করতে হয়। কি মুশকিল! ‘
‘ করবেন। সারা জীবন করবেন। কোনো ছাড় পাবেন না। ‘
আহনাফ মৃদু হাসল। মেয়েটার এমন চঞ্চল রূপেই আহনাফ কুপোকাত! এত আদুরে একটা মেয়ের আবদার না রেখে পারা যায়? উহু! বরং ইচ্ছে করে মেয়েটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে। তারপর তার ছোট-বড়, সম্ভব-অসম্ভব সকল আবদার একসঙ্গে পূরণ করে ফেলতে। এত ভালো লাগে কেন এই ছোট্ট মেয়েকে?
আভা আহনাফের হাত টেনে ধরল। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে চাইল। আভা হাতের উপর কিছু একটা আঁকিবুকি করতে লাগল। আহনাফ মনযোগ দিয়ে দেখতে লাগল আভার কাজ। কি লিখছে সে?
আভা একটা আঁকল। বলল,
‘ বলেন তো কি এঁকেছি? ‘
আহনাফ অবলীলায় বলল,’ একটা কুড়েঘর। ‘.
‘ এই কুড়েঘরটা আমাদের। আমরা এখানে সোনার এক সংসার পাতব! ঠিকাছে? ‘
‘ আচ্ছা! পাতব। এবার? ‘
আভা এবার আরো একটা চিত্র আঁকল। আভা প্রশ্ন করার আগে আহনাফ বলল,’ একটা মেয়ে। ‘
‘ এটা আমি। আপনার বউফ্রেন্ড। ‘
আহনাফ মুচকি হাসতে লাগল। আভা এবার আরেকটা চিত্র আঁকল। আহনাফের খুব মজা লাগছে আভার বাচ্চামো। মেয়েটা আহনাফকে দেখলে কেমন যেন বাচ্চা হয়ে যায়। সে হেসে বলল, ‘ এটা নিশ্চয়ই আমি? ‘
‘ হ্যাঁ। হাসছেন কেন? হাসবেন না। আমার লজ্জা করবে। ‘
আহনাফ হাসতে লাগল। আভা আহনাফের হাসির দিকে চেয়ে রইল অবলীলায়। সে এমন করে হাসে কেন? এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসি কি তার? হ্যাঁ, তার, শুধু আভার ব্যক্তিগত মানুষটার! আভা আনমনে বলল,
‘ আপনি এত সুন্দর করে হাসবেন না। আমার বুকে ব্যথা করে। চোখ অসাড় হয়ে আসে। মাথা ঝিমঝিম করে। এমন করে হাসলে আমি সুখের যন্ত্রণায় মরে যাব একদিন। ‘
আহনাফ হাসি থামায়। চোখ পলকহীন চেয়ে রয় আভার দিকে। আভা কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে চেয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। বুকের ভেতর আভার যেন কেউ ঢোল পেটাচ্ছে। চেয়ে থাকতে করছে না আর একটুও। চোখে ছানি পড়ে যাচ্ছে যেন। আহনাফ আভার নাক টেনে ঘোরময় কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার কথাগুলো এত সুইট কেন? এত প্রেম কোথা থেকে আসে, হু? প্রেমে পড়ে দেবদাসী হয়ে যাচ্ছ। হা হা হা! ‘
আভা লজ্জায় যেন পাথর হয়ে গেল। ইশ, ইশ, ইশ! সে এমন কেন? সদা আভাকে লজ্জা দেয়। লজ্জায় যেন খু’ন করে ফেলতে চায়! খুব খারাপ সে!
আহনাফ বুঝতে পারল আভা লজ্জা পাচ্ছে। মেয়েটা লজ্জায় আর চোখ মেলতে পারছে না। চোখ বুজে হাসফাঁস করতে থাকে। এত লজ্জা? আহনাফ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গলা কেশে উঠল। বলল, ‘ কি যেন আঁকছিলে? আর আঁকবে না? ‘
আভা স্বাভাবিক হল। আড়চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। আহনাফের বলিষ্ট হাত দুহাতে টেনে নিজের কোলে নিয়ে আবার আঁকিবুকি করতে লাগল। আভা লিখল এবার কিছু। আহনাফ অনুভব করে পড়ার চেষ্টা করল। আভা প্রশ্ন করল,
‘ কি লিখেছি বলতে পারবেন? ‘
আহনাফ আভার চোখে চোখে রেখে বলল,
‘ বললে লজ্জা পাবে না তো? ‘
আভা রেগে গেল। আহনাফের হাতে কিল ঘুষি দিয়ে বলল,
‘ ইশ, আপনি খুব খারাপ। সারাক্ষণ এমন করেন। ‘
আহনাফ হাসতে থাকল। কেমন যেন প্রাণখোলা, প্রাণোচ্ছল হাস। প্রিয়তমার কাছে থাকলে সে সদা এমন করে হাসে। নিজের গুরুগম্ভীর বৈশিষ্ট্য কোথাও যেন ছুটে পালিয়ে যায়! আহনাফ হাসি থামাল। আভা আহনাফকে মারা থামিয়ে ক্লান্ত হয়ে আহনাফের বাহুতে মাথা রাখল। হাত টেনে ধরল আহনাফের। শাসিয়ে বলল,
‘ এবার কিন্তু আর মজা করবেন না। যা লিখছি তাই বলবেন। ‘.
‘ আচ্ছা, বলব। ‘
আহনাফের ঠোঁটে সকৌতুক হাস! আভা আবারও কিছু একটা লিখল।
আহনাফ পড়ল, ‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি! ‘
আহনাফের ঠোঁটে হাসি ফুটল। এমন করেও বুঝি মেয়েরা ভালোবাসা প্রকাশ করতে জানে? সে পুরুষ হয়েও এত নিঃসংকোচে ভালোবাসি বলতে পারে না। কেন পারে না?
আভার নরম তুলতুলে গাল লাল হয়ে আছে। লজ্জায় তরতর করে কাঁপছে। সামান্য ভালোবাসিটুকু বলতে লজ্জায় যেন মরনকে বরণ করে নিচ্ছে। আহনাফ আর লজ্জা দিল না তাকে। বরং আভার হাত টেনে ধরে বলল,’ অনেক লিখেছ। এবার আমি লিখি। ‘
আহনাফের হাতে আভার হাত মুষ্টিবদ্ধ করা। আভার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে আহনাফ লিখল কিছু। আভা চমকে উঠল। হাত সরিয়ে বলল,
‘ না, আমি পারব না। ‘
আহনাফ মিহি হেসে বলল,
‘ চেষ্টা করো, পারবে। ‘.
‘ না, আপনি আমার বড়।
‘ বড় মানুষের সাথে প্রেম করছ। অথচ তুমি বলতে পারবে না। এটা কেমন ধরনের অবিচার? ‘
‘ না, না। কেমন যেন লাগবে বলতে। আমি পারব না। ‘
‘ পারবে। বলো, তুমি? ‘
‘ আ-পনি.. ‘
আহনাফ আরো ঝুঁকে এল আভার মুখের দিকে। হুইস্কি কণ্ঠে বলল,
‘ তুমি?
‘ আ-পনি..’
‘ তুমি? ‘
‘ আপনি। ‘
‘ আপনি?
‘ তু-মি। ‘
আহনাফ হেসে ফেলল। সরে এল আভার থেকে। আভা ঠোঁট কা
কাঁপছে। কি করে ফেলল? তাকে তুমি করে বলে ফেলল? ইশ!
আহনাফ আভার রক্তিম হয়ে যাওয়া নাক টেনে বলল,
‘ এবার থেকে তুমি করেই বলবে। ঠিকাছে? ‘
আভা হাতের উপর হাত রেখে ঘষে যাচ্ছে। কি বলবে? তুমি করেই কি বলবে? হু, বলবে। কেন বলবে না? সে প্রেমিক হয় আভার। প্রেমিককে তুমি করে বলাই যায়। সে আবদার করেছে। আভা অবশ্যই তার আবদার রাখবে। মৃদু হাসল আভা।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সময়ের কথা বেমালুম ভুলে গেছে আহনাফ। আহনাফ তাড়া নিয়ে ঘড়িতে তাকাল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাসায় যেতে হবে। আভাকে বলল,
‘ বাসায় যাবে না? সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ‘
যাওয়ার কথা শুনে আভার মন খারাপ হল। বলল,
‘ যেতেই হবে? ‘
‘ হু, যেতে হবে। বিয়ের পর আর যেতে দেব না। এখন একটু কষ্ট করে নাও। হু? ‘
আভা সোজা হয়ে বসল। আহনাফ বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল। কাধে ব্যাগ তুলে এপ্রোন হাতে ঝুলাল। আভার হাত টেনে জোর করে উঠাল। বলল,
‘ চলো। ‘ আভা হেলেদুলে আহনাফের সাথে পা মেলাল।

#চলবে

#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

২৬.
আহনাফের বাবা আরহাম শেখ পালঙে ঠেস দিয়ে বসে আছেন মেঝেতে। ধবধবে সাদা রঙের লুঙ্গি আর ফতুয়া পড়ে লেবুর শরবত খাচ্ছেন। আহনাফ স্থবির পায়ে এসে বসে বাবার পাশে। গায়ের এপ্রোন খুলে পালঙ্গের উপর আলগোছে রেখে দেয়। আরহাম শেখের দিকে ক্ষণিককাল চেয়ে থেকে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ে। হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে নত মুখে বলে,
‘ মা জমি চাইছেন। ‘
আহনাফের বাবা তাচ্ছিল্যভরা হাসেন। পুনরায় লেবুর শরবতে চুমুক দিয়ে বলেন,’ কেন? ‘
‘ মায়ের ইচ্ছা তার কবর পরিবারিক কবরস্থানে হবে। ‘
‘ আমাকে কবরে দিকে ছুঁড়ে ফেলে তোর মায়ের এখন কবরে যেতে ইচ্ছে করছে। হাও রাবিশ! ‘
আহনাফ চোখ তুলে বাবার দিকে চায়। বাবার চোখে বাঁধভাঙা কষ্ট দেখতে পারছে সে। বাবা সেই কষ্টে ক্রমাগত নীল হয়ে যাচ্ছেন। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বাবার জীবন! বাবা মায়ের সম্পর্কের এই করুন অবনতি আহনাফ চুপ করে দেখে যাচ্ছে। কিছু করতে পারছে না। আহনাফ আবার হাঁটুতে মুখ গুজে। মৃদু স্বরে বলে,
‘ সেদিন মাকে কেন আটকালে না, বাবা? তাহলে আজ আমাদের জীবন অন্যরকম হতে পারত। ‘
আহনাফের কন্ঠনালী কাঁপছে। শব্দগুচ্ছ কম্পিত হচ্ছে। ঠোঁটের আগা তরতর করে নড়ছে। আহনাফের বাবা ছেলের বাহুতে হাত রাখেন। আহনাফ এখনো হাঁটুতে মুখ গুঁজে। মৃদু স্বরে বলে,
‘ তুমি ছাড়া আমরা ভালো নেই, বাবা। মাকে নিয়ে আসো। একসঙ্গে থাকব আমরা। আমাদের সুখী সংসার হবে। ‘
‘ কতবার গেলাম তোর মায়ের কাছে। কি লাভ হল? বারবার ফিরিয়ে দিল। আর যেতে ইচ্ছে করে না। বারবার হারতে ইচ্ছে করে না। ‘
‘ দোষটা তোমার বলে মায়ের অনেক কষ্ট। ‘
‘ আমি জানি দোষ আমার। সেদিন নিজের মায়ের কথা না শুনে তোর মায়ের কথা শুনলে আজ বোধহয় দৃশ্যটা অন্যরকম হত। ‘
‘ দাদিমা কেমন আছে?
‘ জানিনা। আমি যাই না তার কাছে। মাসশেষে টাকা পাঠিয়ে দেই। তোর ছোট চাচা খেয়াল রাখেন। ‘
‘ দাদিমা বুঝতে পারেনি, উনার জন্যে তোমার সংসারটা এমন এলোমেলো হয়ে যাবে। ‘
‘ জানি। তবুও মনকে বাঁধা দিতে পারিনা। রাগ চলে আসে। আমি চাইনা আমার রাগের জন্যে আম্মা অসম্মানিত হোন। ‘
‘ মাকে আরো একবার অনুরোধ করবে, বাবা? মা ভালো নেই। ডায়াবেটিস বেড়েছে, হার্টে সমস্যা দেখা গেছে, আজকাল মনে কিছু রাখতে পারছে না, সব ভুলে যাচ্ছে,আমি নিজ হাতে না খাওয়ালে ঔষধ ঠিকমত খান না। আমি একা একা হাঁপিয়ে উঠেছি বাবা। এবার একটা কাঁধের খুব প্রয়োজন। ‘
আহনাফের বাবা ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়েন। বিড়বিড় করে আওড়ান,
‘ নিজে ভালো থাকবে না আর আমাকেও ভালো রাখবে না। ‘
আহনাফের বাবা শরবতের গ্লাসটা টি-টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ান। ফতুয়া টেনেটুনে ঠিক করে আহনাফের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,,
‘ উঠ। ‘
আহনাফ মাথা তুলে তাকায়। বলে,
‘ কেন?
‘ খাবি না কিছু? তুই আসবি বলে আজ ইলিশ মাছ রান্না করিয়েছি। চিংড়ি মাছ ভাজানো হয়েছে। চল, আজ বাপ-ব্যাটা মিলে কব্জি ডুবিয়ে খাব। ‘
আহনাফ বাবার হাতে হাত রাখে। আহনাফের বাবা চট করে ছেলেকে টান দিয়ে উঠান। আহনাফের বুক বাবার বুকে ধাক্কা খায়। আহনাফের বাবা ছেলের কাধে চাপড় দিয়ে শব্দ করে হেসে বুক ফুলিয়ে বলেন,
‘ আমার ছেলে, আমার রাজা ছেলে। ‘
আহনাফ মৃদু হাসে। বাবার হাতে হাত রেখে খাবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
খাবার টেবিলে চেয়ার পেতে বসে আহনাফ ও তার বাবা। আহনাফের বাবা এ কথা-সে কথা বলছেন। আহনাফ খাবার খেতে খেতে মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনছে। বাড়ির দুজন কর্মচারী মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাবা ছেলের মধ্যকার সম্পর্ক দেখছে। আহনাফ বাবার প্লেটে ইলিশ মাছের মাথা তুলে দিল। আহনাফের বাবা মানা করলেন। নিজের পাতের ইলিশের মাথা জোড়পূর্বক ছেলের পাতে তুলে দিলেন। আহনাফ ফিরিয়ে দিতে চাইলে তিনি নিলেন না। বরং বললেন, ‘ কামড়ে কামড়ে মাছের মাথা খাবি। ডাক্তার হচ্ছিস। আমার মত মেধাওয়ালা ডাক্তার হতে হবে তোকে। আমার ছেলেকে পুরো বাংলাদেশ চিনবে। কার ছেলে দেখতে হবে না? ‘
আহনাফ হেসে উঠে। আহনাফ সপ্তাহে একবার বাবার বাসায় আসে। আহনাফ বাসায় এলে আরহাম শেখ বোধ করেন, তিনি আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছেন। সেই চাঁদ তার হাতে লুটোপুটি খাচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে ছেলেকে দেখেন। যতবার ছেলেকে চোখ ভরে দেখেন, আনন্দে তার গা কেঁপে উঠে। চোখ উজ্জ্বল রঙে ছেয়ে যায়। চোখের পাতা আন্দোলিত হয়ে উঠে। আহনাফের চেহারায় মায়ের গঠন স্পষ্ট। সেই খাড়া নাক, পুরু ঠোঁট, বাঁকানো ভ্রু। সবই মায়ের পেয়েছে। স্ত্রীকে দেখতে পারছেন না আজ প্রায় দু বছর। তাই ছেলেকে দেখেই নিজের আঁশ মেটান আহনাফের বাবা। আহনাফ তার কাছে এলে তার খুশির অন্ত থাকে না। কি করবেন, কি করবেন না ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েন। আহনাফ যখন চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়, তার বুক মোচড় দিয়ে উঠে। আবার এক সপ্তাহের অপেক্ষা! ভেবে মন খারাপ হয় উনার। ছেলেকে বিদায় দেওয়ার বেলায়, মনেমনে হাজারবার স্ত্রীকে কি’ডন্যাপ করার কথা ভেবে ফেলেন। আহনাফের মায়ের জেদ অসামান্য। হতে পারে কিডন্যাপ করলে নিজেই নিজের নার্ভ কে’টে বসে। স্ত্রীকে হাড়ে হাড়ে চেনেন আহনাফের বাবা। নার্ভ কা’টা তার জন্যে মামুলি ব্যাপার। বয়স যত বাড়ছে, দিনদিন জেদের মাত্রা যেন তরতর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

খাবার পর্ব শেষ করে আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে বাবার দিকে চেয়ে বলে, ‘ যেতে হচ্ছে বাবা। মা অপেক্ষা করছে।’
আরহাম শেখের আবার মন খারাপ করে। চুপ করে কিছুক্ষণ তরকারি ভাতে মাখাতে থাকেন। আহনাফ বুঝতে পারে বাবার মনের কথা। সে বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘ আবার আসব। মন খারাপ করো না। ‘
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আহনাফের বাবা গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করেন,
‘ তুই আমার এখানে আসলে তোর মা খুব চেঁচামেচি করে। তাইনা, আহনাফ? ‘
আহনাফের কণ্ঠনালি কেঁপে উঠে। বাবাকে কি উত্তর দিবে সে? মা চেঁচামেচি করেন আবার টানা দুইদিন কথা বলা বন্ধ করে দেন। অতঃপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মায়ের রাগ ভাঙাতে হয়। আহনাফ মৃদু হেসে বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘ মা এ বাড়িতে একেবারে চলে এলে আর চেঁচামেচি করবে না। ‘
আহনাফের বাবা তাচ্ছিল্যভরা হাসেন। কর্মচারী শহীবকে ডাকেন। শহীব কাছে এলে বলেন,
‘ ইলিশ মাছের ঝোল আর ছোট মাছের তরকারিটা টিফিনে ভরে দিয়ে দাও তো। আহনাফ বাড়িতে নিয়ে যাবে। ‘
আহনাফ চমকে উঠে। দ্রুত হাত দিয়ে মানা করে বলে,
‘ না, না,দিও না। মা অনেক রাগ করবে। ‘
‘ আরে নিয়ে যা, নিয়ে যা। তোর মায়ের তোর মতোই ইলিশ আর ছোটমাছের তরকারি খুব পছন্দের। যদি জিজ্ঞেস করে বলবি তুই কি যেন নাম, ওহ…নুর দাদুর হোটেল থেকে আনিয়েছিস। ‘
আহনাফ তীক্ষ্ম চোখে বাবার দিকে চায়। অতঃপর ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
‘ তুমি খুব চালাক হয়ে যাচ্ছ দিনদিন। ‘
‘ তোর মায়ের জেদের কাছে আমার চালাক হওয়া অতি সামান্য। ‘
আহনাফ হেসে উঠে। বাবার কাঁধে হাত রেখে পুনরায় সুধায়,
‘ আসছি। ভালো থেকো। দরকার পড়লে ফোন করবে। ‘
‘ তুই আবার আসবি তো? ‘
‘ সামনের শনিবার আসব। ‘
‘ পুরো এক সপ্তাহ? ‘
‘ মাকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করো। তাহলে সারাজীবন তোমার সাথে মা-ছেলে একসঙ্গে থাকব। ‘
আহনাফের বাবা আর কথা বাড়ান না। তিনি তো কম চেষ্টা করেন নি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্ত্রীর জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে বারবার। আহনাফের মায়ের আর কি দোষ! নিজের দোষেই স্ত্রী-সন্তান হারিয়েছেন। এখন ভুগো সাজা!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে