মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-০৯+১০

0
1160

#মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম পর্ব-০৯+১০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_____________________________
সুন্দর এক ফুরফুরে সকাল। গা ছুঁয়ে বইছে ঠান্ডা বাতাস। মেঘেরা বন্ধুত্ত্ব করেছে সাজেকে আগত সকল পর্যটকের সাথে। সকালটা সুন্দর হলেও আভার কাছে তা মোটেও সুন্দর মনে হচ্ছে না। বরং ভয়াবহ অসুন্দর লাগছে। সদ্য জন্মানো অনুভূতিরা দল ছুটে পালাতে চাইছে। আভা তাদের ছুঁতে চাইলেও ছোঁয়া হচ্ছে না। মন খারাপেরা আজ ভীষন ছোঁয়াচে হয়েছে। আভাকে তার গরম-সবুজ নিঃশ্বাসে ছুঁয়ে হত্যা করতে চাইছে। সে কি দমবন্ধকর অনুভূতি। আভার প্রাণ লুটিয়ে পড়ছে।
–’ ব্যাগ প্যাক করেছ সবাই? আমাদের বেরুতে হবে। ‘

আভা চলে যাবে। চলে যাবে আহনাফরা সবাই। সাজেক ট্রিপ শেষ হয়েছে তাদের। আর দেখা হবে না আহনাফের সাথে। আহনাফের এই ভালো ভালো বন্ধুদের সাথে। যাদের সঙ্গে থেকে আভার সাজেক ট্রিপ মহা সুন্দর হয়েছিল। আভাকে সাজেকের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করতে যারা সাহায্য করেছিল, আভা আর কখনোই তাদের দেখবে না। আভার কান্না আসছে। চোখের কোল ছাপিয়ে কান্নার দলা উপচে পড়তে চাইছে। আভা আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চোখ মুছে লাগেজ হাতে নিয়ে হোটেল ছেড়ে বের হল।
আহনাফরা বাসে উঠছে। আহনাফ সবাইকে গাড়িতে তুলে দিয়েছে। আভা এগিয়ে আসল। আহনাফ নজর সরিয়ে আভার দিকে তাকাল। আভার শির নত করা। বারবার চোখ মুছে কি প্রমাণ করতে চাইছে এই মেয়ে? আহনাফ তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–’ ব্যাগ দাও। ‘

আভা কানের পেছনে চুল গুঁজল। মিনমিন করে বলল,
–’ বাকিটা পথ আমি একাই পাড়ি দিতে পারব। ‘

আহনাফ ভ্রু কুঁচকে আভার দিকে চাইল। আভার চোখে জল মুক্তোর ন্যায় ঝিলমিলিয়ে উঠছে। মেয়েটা এত আবেগপ্রবণ কেন? একটুতেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। আহনাফ কি করবে এই বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে?
আভা ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠে। আহনাফও আভার পেছন পেছনে বাসে উঠে। আভা বসার জায়গা খুঁজছে। দুটো সিট একসঙ্গে খালি নেই। একজন বৃদ্ধ মহিলার পাশে একটা সিট খালি আছে। আরো একটা চিত্রার পাশে। আভা চিত্রার পাশে বসতে চাইছে না। মেয়েটা একটু কেমন যেন! সবসময় কেমন কেমন করে আভাকে দেখে। যেন আভার কিছু খুঁত খুঁজে যাচ্ছে। আভা চুপ করে বৃদ্ধ মহিলার পাশে বসে যায়।

আহনাফ বসে চিত্রার পাশে। চিত্রা খুশিতে নেচে উঠে যেন। আহনাফের সাথে সাজেক থেকে ঢাকা যাবে। চিত্রার খুশি দেখে কে? চিত্রার হলদেটে সুন্দর মুখশ্রী উজ্জ্বলতায় ঝিলমিলায়।
বাস ছেড়েছে। আভা জানালার দিকে মুখ করে চেয়ে আছে। জানালা ধেয়ে আসা ধু ধু বাতাসে আভার রেশমি কেশ উড়ছে। বারবার ঝাপটে পড়ছে আভার মুখে। গতবার আহনাফের পাশে বসেছিল আভা। তখন এমন করেই আভার চুল উড়েছিল। আহনাফ আড়চোখে আভাকে দেখছিল। অনুভূতিটা খুব সুন্দর ছিল তখন। অথচ এখন? আভা সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যাচ্ছে আহনাফের থেকে বহুদূর।
আহনাফ আভার পেছনের সিটে বসেছে। আভার বুজে থাকা চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়া আহনাফের দৃষ্টি এড়ায় নি। আহনাফ স্থির দৃষ্টিতে আভার দিকে চেয়ে আছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে এই অতীব আশ্চর্যজনক নারীকে।

–’ আহনাফ, পানি নিবি? ‘
চিত্রা মিনারেল ওয়াটারের বোতল আহনাফের দিকে এগিয়ে দেয়। আহনাফের ধ্যান ভেঙে যায়। চিত্রার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,
–’ লাগবে না। ‘
–’ চিপস? ‘
–’ লাগবে না। ‘
–’ কোক নে? তুই তো কোক খাস। ‘
আহনাফ এবার বিরক্ত হয়। চিত্রার দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে সুধায়,
–’ আমি এখন ঘুমাব চিত্রা। অযথা কথা বলিস না। হু? ‘
চিত্রার মন খারাপ হয়। মাথা দুদিকে হেলিয়ে বলে,
–’ ঠিক আছে। ‘
আহনাফ সিটে হেলান দেয়। মাথাটা সিটের এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে। আহনাফের ইচ্ছে ছিল, সারা রাস্তা আভার দিকে চেয়ে থাকবে। অথচ শেগুরে বালি। আহনাফ সজাগ থাকলে চিত্রা এটাসেটা বলে আহনাফের মাথা খেতে থাকবে। তাই ঘুমিয়ে পড়াই শ্রেয়।
আহনাফ ঘুমিয়ে পড়েছে। দু দিনের লাগাতার দৌঁড় ঝাপে আহনাফ বড্ড ক্লান্ত। ক্লান্তিতে দু চোখ খুলে রাখাই দায়। আহনাফ ঘুমিয়ে গেলে চিত্রা আহনাফের চুলে হাত রাখে। আরাম করে চুলে টেনে দিতে থাকে। আরামে আহনাফের ঘুম আরো শক্ত হয়। ঢলে পড়ে চিত্রার কাধে। চিত্রা হকচকিয়ে যায়। সারা অঙ্গ ভূমিকম্পের মত কাপতে থাকে। আহনাফের প্রথম স্পর্শে চিত্রার শরীরের সমস্ত পশম দাড়িয়ে গেছে। চিত্রার হাত থেমে যায়। চিত্রা ঘাড় কাত করে আহনাফের দিকে চায়। ঘুমের অবস্থায় আহনাফের রাগী রাগী চেহারা এই মুহূর্তে এক নিষ্পাপ বাচ্চার ন্যায় লাগছে। সবসময় কুচকে রাখা ভ্রুযুগল সোজা হয়ে আছে। উচু নাকের ডগা লাল। ইশ, আহনাফ এত সুন্দর কেন? চিত্রার বুক ধুকপুক-ধুকপুক করছে।
চিত্রা মুচকি হাসে। আবারো আহনাফের চুল টেনে দিতে থাকে।
আভা ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম না, মূলত ঘুমানোর ভান করছে। ভালো লাগছে না এই সফরটা। কবে শেষ হবে এই অসহ্য সফর? আভার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কিচ্ছু না।

–’ আভা? ঘুমিয়ে পড়েছ? ‘
পেছন থেকে চিত্রার কণ্ঠ শুনে আভা চোখ খুলে। উঠে বসে সিট থেকে। পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে,
–’ ঘুমাই নি। বলো কি বলবে? ‘
আভা থমকে যায়। চিত্রার কাধে আহনাফের মাথা। আভার দুনিয়া ঘুরে যায়। আভা স্পষ্ট শুনতে পায়, তার অনুভূতিরা ঝরঝর করে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে।
আভা বহু কষ্টে ঢোক গলাধঃকরণ করে। অতঃপর ঠোঁট চিপে বলে,
–’ কোনো দরকার চিত্রা। দ্রুত বলো। আমার না ভীষন ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাব। ‘
চিত্রা মুচকি হাসে। চোখের ইশারায় নিজের ব্যাগ দেখিয়ে বলে,
–’ ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে দিবে? আহনাফ এমনভাবে ঘুমিয়েছে যে একবিন্দু নড়তে পারছি না। প্লিজ! ‘
চিত্রা ভীষন কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করে। আভা হাসার চেষ্টা করে। হাসতে পারে না। বরং কাদতে পারছে। আভা ঠোঁট টিপে চিত্রার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দেয়। বোতল চিত্রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাড়াহুড়া করে বলে,
–’ আমি ঘুমাব চিত্রা। আমায় আর ডেকো না। এনজয়। ‘

আভা চিত্রাকে আর কথা বলতে না দিয়ে দ্রুত সিটে কথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নেয়।
চিত্রার ঠোঁটে হাসি। কোনো কিছু অর্জন করতে পারার জয়ী হাসি। চিত্রা হাতের বাধন শক্ত করে। আরো আদর করে আহনাফের চুল টেনে দিতে থাকে।

আভা দু চোখে বুজে আছে। বারবার ঢোক গলাধঃকরণ করছে। কান্না চেপে রাখার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। পাশে থাকা বৃদ্ধ পান খাচ্ছিলেন। আভাকে এম অস্থির হতে দেখে তিনি পেছন ফিরে আহনাফদের দিকে চাইলেন। মুচকি হাসলেন তিনি। আভার দিকে চেয়ে দেখলেন। আভার কোমড়ে আঙ্গুল দিয়ে খুঁচা দিয়ে বললেন,
–’ কিরে মেয়ে? কাঁদস ক্যান? ‘
আভা উঠে বসে। দুহাতে চোখ মুছে বলে,
–’ কই কাদি, দাদী? ‘
–’ আমি দেখেছি রে মেয়ে। তুই কানতাসস। ক্যান? মরদে ভালোবাসে না? ‘
আভা বৃদ্ধ মহিলার দিকে একপল চায়। যৌবন কালে দাদী যে ভীষন রকমের ভালোবাসা পেয়েছিল, তা তার উজ্জ্বল, ভাজ পড়া মুখে স্পষ্ট। আভার মন খারাপ হল। সবাই ভালোবাসা পায়। শুধু আভার জন্যে ভালোবাসার বড্ড অভাব। আভা কেন ভালোবাসা পায় না? আভা মলিন কণ্ঠে বলল,
–’ জানিনা। হয়তো বাসে। নাও বাসতে পারে। সে আমায় কিছু বলে নি এখনো। ‘

বৃদ্ধ মহিলা আভার গাল টেনে দেয়। ফোকলা দাতে হেসে বলে,
–’ তুই খুব মিষ্টি মেয়ে রে। আমার নাতির মত দেখতে একদম। শুন, তোকে একটা পদ্ধতি বাৎলে দেই। কাজে আসবে। ‘
আভা ভীষন উৎসুক দৃষ্টিতে বৃদ্ধ মহিলার দিকে চায়। তার দিকে এগিয়ে এসে সুধায়,
–’ কি পদ্ধতি, দাদী? ‘

#চলবে

#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
অতঃপর দাদীর পদ্ধতি বেশ মনে ধরল আভার। আভার ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে পড়েছে অমায়িক হাস। আভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। দাদীর নরম তুলতুলে গাল টেনে বলল,
–’ কি চালাক গো তুমি দাদী। ‘

দাদী ফোকলা দাঁতে হাসল। সুন্দর দেখাল বেশ। চেহারায় কিশোরীদের ন্যায় উচ্ছলতা। চোখ জোড়ায় আকাশসম আদর। মনে হচ্ছে আভার সামনে কোনো বৃদ্ধ নয় বরং এক কিশোরী বসে আছে। কিশোরীর হাসির ঝঙ্কারে চারপাশ ঝিলমিলিয়ে উঠছে। আভা হেসে ফেলল। দাদীর শরীরের সাথে ঘা ঘেঁষে বসল। টিপ্পনী কেটে বলল,
–’ কি গো দাদী। দাদু এখনো অনেক আদর করে, তাই না? ‘

দাদী হাসতে হাসতে ব্যাকুল হচ্ছেন। আভার গায়ে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে সুধালেন,
–’ হর ত মাইয়া। খালি দুষ্টু দুষ্টু কথা। ‘

আভার ঠোঁটে হাস। হাসতে হাসতে দাদীর গায়ের উপর লেপ্টে যাচ্ছে সে। দাদী পান খাচ্ছেন। আভাকে সাধলেন,
–’ এই মেয়ে, পান খাবি? ‘
দাদীর কথা শুনে আভা মৃদু নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
–’ জর্দা বেশি করে দিবে। ‘
–’ হ। পরে মাথা ঘুরাইব। ‘
–’ ঘুরাক। একটু মাথা ঘুরালে কিছু হয় না। ‘
–’ হ। বিয়ের পর যখন ছেরি ছেমরা হইব, তখন বুঝবি। একটু মাথা ঘুরাইলে কেমনটা লাগে। ‘
আভা লজ্জা পেল। গাল দুটো কেমন যেন লাল টকটকে রং ধারণ করল। দাদীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল। দাদী হেসে উঠলেন। আভা মুচকি হেসে বলল,
–’ তুমি খুব ভালো, দাদী। পান দিবে না? ‘
দাদী পান সাজালেন। আভাকে পান এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–’ জর্দা বেশি খাইস না। খাওয়া বালা না। মাথা ঘুরায়। বমি করবি শেষে। ‘
–’ আচ্ছা। কম করেই দাও।’
–’ নে। ধর। ‘

দাদী আভাকে পান মুখে তুলে দিলেন। আভা পান চিবিয়ে মুখ বাঁকিয়ে নিল। চোখ মুখ খিচে বলল,
–’ পানের কি তেজ গো দাদী। ‘
–’ পানের তো তেজ হই রে বোকা মেয়ে। ‘
–’ মজা আছে কিন্তু। ‘
আভা পান চিবিয়ে দাদীর সাথে গল্প করতে মন দিল। আহনাফের চিন্তা মস্তিষ্কের কোথাও উকিঝুঁকি দিতে চাইলে আভা ধূর ধূর করে তাড়িয়ে দিল। মানুষটাকে আর মনে করবে না আভা। এবার অন্য চাল চালবে সে। যে চালে বাঘ নিজে এসে ফাঁদে ধরা দিবে। প্রেম স্বীকার করবে।

বাস ঢাকার কাছাকাছি এসে গেছে। আহনাফের ঘুম ভেঙে যায় বেশ খানিক আগে। চিত্রার কাধে নিজেকে উপলদ্ধি করতে পেরে হকচকিয়ে উঠে সে।
–’ তুই? ‘
চিত্রা নিজের কাধ ঘষে। ব্যাথাতুর গলায় বলে,
–’ পুরো তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছিস। কাধ ব্যথা করে দিয়েছিস একদম। ‘
আহনাফ বোকা বনে যায়। সে তো সিটে ঘুমিয়েছিল। চিত্রার কাধে আসল কখন? উফ! মাথা ধরছে। আভা? আভা কোথায়?
আহনাফ সিট থেকে উঠে সামনে তাকায়। হাস্যরত আভাকে দেখে তার বুকে পানি আসে। আহনাফ ভ্রূ কুচকে আভার দিকে চায়। আভা আড়চোখে আহনাফের দিকে চায়। অতঃপর একটি সুন্দর হাসি। আহনাফের বুক ধড়াস করে উঠে। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে কেন? আহনাফের মত গম্ভীরমুখো মানুষেরও এই হাসির তরে কুরবান হতে ইচ্ছে হয়। অদ্ভুত!
গাড়ি এক জায়গায় থামে। দিহান সামনে থেকে চিৎকার করে বলে,
–’ এই আহনাফ, তোরা কিছু নিবি? বাস কিন্তু আর থামবে না। ‘
আহনাফ মাথা নাড়ায়। বলে,
–’ লাগবে না। তোদের কিছু দরকার হলে আন। ‘
–’ আভা? তোমার কিছু লাগবে? ‘
–’ না। আমার কাছে খাবার আছে। ‘
–’ চিত্রা তুই? ‘
–’ বিস্কুট আনিস একটা। ক্ষুধা লেগেছে। ‘
–’ আচ্ছা। গেলাম আমি। ‘
দিহান নেমে পড়ে বাস থেকে। বাঁধন পেছনে ফেরে। আভার দিকে চেয়ে বলে,
–’ কোনো অসুবিধা হচ্ছে, আভা? ‘
আভা মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
–’ না। ঠিক আছি আমি। ‘
বাঁধন আবার সিটে বসে পড়ে। আভা দাদীর কাছে ঘেঁষে বসে। কানেকানে বলে,
–’ দেখেছ? তার বন্ধুরা ঠিকই আমার খোঁজ নিচ্ছে। অথচ সে? গুতুম পেঁচার ন্যায় হুব করে বসে আছে। খারাপ লোক।’

দাদী হাসল। আভার মত ফিসফিসিয়ে বলল,
–’ আরে বোকা মেয়ে। সে তোর খুঁজ না নিলেও ঘুরেফিরে তোরেই দেখে যাচ্ছে। পেছনে ফিরে দেখ একবার। তোর দিকেই কেমন করে চাইয়া আছে। সেও ভালোবাসে রে পাগল। ‘
আভা সোজা হয়ে বসে। মুখ গোমড়া করে বলে,
–’ হ্যাঁ। তুমি তো খুব জানো। ভালো টালো বাসে না গো। খারাপ লোক একটা। ‘
–’ বোকা মেয়ে। ‘
দাদী মৃদু হাসে। আভা সারাপথ গাল ফুলিয়ে পাড়ি দিল। দাদীর সাথেও একটা কথা বলল না। ভীষন মন খারাপ ঝেঁকে ধরেছে তাকে। কি করতে যে এই নিরামিষ লোকের প্রেমে পড়েছিল আভা। যার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা বের করতে এত কসরত করতে হচ্ছে। ভালোবাসি, শব্দটা বলা এত কি কঠিন? চট করে বলে ফেলা যায়। ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি ‘, এই ছোট্ট বাক্য বলতে কি কষ্ট হয় কারো? শুধু অনুভূতি থাকলেই বলা যায়। অথচ সে বলবে না। খারাপ, জঘন্য লোক। আভা আর তার পেছনে যাবে না। এখন এই গম্ভীরমুখোকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। ভালোবাসি না বলে কোথাও যাবে? ফিরে তো তার কাছেই আসতে হবে।
অথচ আভা বুঝতে পারল না। হায় অবুঝ মন। ভালোবাসি, কথাটা কি তজবিহ পাঠের ন্যায় বলে কয়ে বেড়ানোর বিষয়? ভালোবাসা, অনুভবের বিষয়। যে মন থেকে প্রিয় মানুষকে যত অনুভব করতে পারে, সে তত ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসা বলার মধ্যে নয়, প্রকাশেই স্বার্থক। এই যে শাড়ীর কুচি সামলে দেওয়া, কপালে আদর করে ছোট্ট এক টিপ পড়িয়ে দেওয়া, রাস্তার পাশে অবহেলায় গজে উঠা বেলি ফুলের চারা থেকে বেলি ফুল ছিঁড়ে প্রেমিকার কানে গুঁজে দেওয়া, অবেলায় অভিমান করা প্রেমিকের অভিমান ভাঙ্গানো, অসুস্থ হলে দু একটা মিথ্যা রাগ দেখানো, একটু ছুঁয়ে দেখার জন্যে মিছামিছি বাহানা দেওয়া! এসব কি ভালোবাসা নয়?
প্রেমে পড়ার ন্যায় সুন্দর কিছু এই ধরনীতে আর কিছু নেই। প্রেম সুন্দর, প্রেমে পড়ার অনুভুতি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর সুন্দর। আভা প্রেমে পড়েছে। তার সম্পূর্ন পৃথিবী একজনাতে আটকে আছে। সেই একজন ব্যতীত আভা আর কিছু দেখতে পারছে না। তাকে একনজর দেখতে না পেলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এ কি প্রেম নয়? প্রেমের অনলে ক্রমাগত দগ্ধ হওয়া অবুঝ সেই প্রেমিকা জানতে পারল না, ওপরপাশের মানুষটা তাকে নিয়ে নিজের সমগ্র ধরনী সাজিয়েছে। কলাপাতায় ঘেরা সুন্দর এক সংসারের স্বপ্ন দেখছে। আভা জানল না, তার প্রেমিক পুরুষও তাকে ভালোবাসে। বড্ড অধৈর্য্য সে।

বাস থেমেছে। ঢাকা পৌঁছে গেছে সবাই। আভা লাগেজ নিয়ে বাস থেকে নেমে দাড়াল। পেছনে রেখে গেল আহনাফের অবাক দৃষ্টি।
–’ তোমাদের ভীষন মনে পড়বে! ‘
আভা আহনাফের বন্ধুদের দিকে চেয়ে আছে। মন খারাপের গলা শুনে দিহান বলল,
–’ আবার দেখা হবে আমাদের। মন খারাপ করো না। ‘
–’ বারবার দেখা হোক। ‘
আভা আহনাফের বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। আহনাফ পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে আভার এই নতুন নাটক।
–’ আচ্ছা এখন যাই। বাবা বাইরে দাড়িয়ে আছেন। ‘
–’ গুড বাই। ‘
–’ শুভ বিদায়। ‘
আভা চলে যাচ্ছে। আহনাফের সাথে এখন অব্দি একটা কথা বলে নি আভা। আহনাফ বিস্মিত। আভার এই পরিবর্তন সে ভালো চোখে দেখল না। বন্ধুদের কাজের বাহানা দিয়ে সে ছুটে গেল আভার দিকে।

আহনাফ আভার হাত ধরল। আভা থেমে গেল। আহনাফের কড়া দৃষ্টি আভাকে যেন ছারখার করে দিবে। গভীর ওই দু চোখে আভা তার সর্বনাশ দেখতে পারছে। আভা নিজেকে সামলাল। বলল,
–’ হাত ছাড়ুন। দেরি হচ্ছে আমার। ‘
আহনাফ ছাড়ল না। বরং বলিষ্ট পেশীবহুল হাত ছুঁয়ে রাখল আভার হাতের কব্জিতে। যেন আভার হাত আজ মুচড়ে ভেঙে ফেলবে। আভা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। আহনাফ হিড়হিড় কণ্ঠে বলল,
–’ কি হয়েছে? এমন অদ্ভুত বিহেভ কেন করছ? হোয়াটস রং? ‘
আভা অবাক হওয়ার ভান করল। মুখের আকৃতি সামান্য হা করে বলল,
–’অদ্ভুত? কখন অদ্ভুত ব্যবহার করলাম? ‘

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে