বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-০৩+০৪

0
1252

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৩+০৪

ভোর হতে খুব একটা সময় বাকি নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে ঘন্টাখানেক ধরে৷ রাগের বশে কী করে ফেলেছে বুঝতেই নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তাজের। সে কীভাবে এই মেয়েকে কাছে টেনে নিতে পারলো ? বেডে আধশোয়া হয়ে বসে আছে তাজ। এখন মনে হচ্ছে একটা সিগারেটের খুব দরকার। স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় সকল প্রকার নেশাদ্রব্য থেকে বরাবরই দূরে থাকে তাজ। তাই একটা সিগারেটও নেই তার কাছে। গায়ের ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে টাওয়েল জড়িয়ে নিলো কোমরে। বেডে চোখ পড়তেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।

How is this possible?

বেডের সাদা চাদরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগগুলো যেনো বলে দিচ্ছে মেয়েটা ভার্জিন ছিলো। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব ? মেয়েটা তো প্রেগনেন্ট তাহলে ? মস্তিষ্কে একটু চাপ দিতেই গতরাতের প্রতিটা মুহুর্ত স্পষ্ট হয়ে উঠলো তাজের সামনে। রাগের বশে তখন বুঝতে না পরলেও এখন ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেলো, মেয়েটা ভার্জিন ছিলো। তিতিরকে দু’বছর ধরে চেনে তাজ। তার কোনো কালেই বয়ফ্রেন্ড ছিল না, এটাও জানে।

তাজ মাথা চেপে ধরে বেডে বসে পড়লো, আমি তো ভেবেছিলাম সব মিথ্যে হলেও তিতির প্রেগনেন্ট এটা সত্যি। কিন্তু এখন দেখছি সেটাই সবচেয়ে বড় মিথ্যে। তাহলে রিপোর্টটা কার ? আর তিতির কেনো নিজের নামে এতবড় মিথ্যা বললো। নাহ্ আর ভাবতে পারছি না।

ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে আছে তিতির। শরীরের খুব কম জায়গায় অক্ষত আছে। পানি স্পর্শে প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করছে।

তিতির নিজের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, দেখ বোনু তোকে ভালোবাসার পুরষ্কার পেয়েছি আমি। বাবা-মায়ের দেওয়া দ্বায়িত্ব পালনের কত সুন্দর পুরষ্কার মিলেছে আজ। তোকে ভালোবাসার অপরাধে সবার চোখে আজ আমি চরিত্রহীন ঘৃণ্য একজন মানুষ। না স্যারের উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। তার থেকে আমি যা কেড়ে নিয়েছি সে তুলনায় এসব তো কিছুই না। আমি জানি আরো কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না বোনু তোর জন্য আমাকে যতটা স্বার্থপর হতে হয় হবো, যতটা নিচে নামতে হয় নামবো। পৃথিবীর সব মানুষ আমাকে ঘৃণা করুক শুধু তুই ভালোবেসে আপুনি বলে গলা জড়িয়ে ধরলেই হবে, সব ভুলে যাবো আমি। কিন্তু তোর গায়ে ফুলের টোকাও পড়তে দিবো না আমি। তোকে যেদিন ফিরে পাবো সবকিছু থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাবো আমরা। যেখানে আপন মানুষের মুখোশধারী নরপিশাচরা থাকবে না।

তাজ উঠে ওয়াশরুমের দরজায় আঘাত করে বললো, এই মেয়ে বের হ বলছি। এই মুহুর্তে বের না হলে দরজা ভেঙে ফেলবো।

তাজের আওয়াজে চমকে উঠলো তিতির। কিন্তু বের হবে কী করে ? তার কাছে তো পড়ার মতো কোনো কাপড় নেই। তাজ সমানে দরজা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় দরজা ভেঙে যাবে। তিতির কোনোরকমে টাওয়েল জড়িয়ে দরজা খোলে দিলো। তাজ কোনো দিকে খেয়াল না করে হাত ধরে টেনে বেডের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো।

রাগী গলায় বললো, তুমি যদি প্রেগনেন্ট হও। তাহলে এসবের মানে কী ?

ছোপ ছোপ রক্তের দাগগুলো দেখে আবার চোখ ভড়ে এলো তিতিরের, আনমনে বলে উঠলো, পঁচিশ বছরের আগলে রাখা সতীত্বের প্রমাণ।

কথাটা বারবার কানে বাজতে লাগলো তাজের। এই মেয়ে নিজের মুখে স্বীকার করছে সে প্রেগনেন্ট নয়।

তাজ রেগে ধমক দিয়ে বললো, What ?

তাজের ধমকে হুঁশ ফিরলো তিতিরের। আনমনে কী বলে ফেলেছে ভাবতেই চমকে উঠলো। তার তো কিছু বলার অনুমতি নেই। তাকে তো শুধু কাঠের পুতুলের ন্যায় অন্যের ইশারায় নাচতে বলা হয়েছে। তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি আওড়াতে বলা হয়েছে। সে কোনো ভুল করলে তার মাশুল যে দিতে হবে অবুঝ প্রাণটাকে।

রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তাজের। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। কিছু হিসাব মিলে গিয়েও আবার গড়মিল হয়ে যাচ্ছে। ড্রয়ার থেকে প্রেগনেন্সি রিপোর্ট বের করে তিতিরের দিকে ছুঁড়ে দিলো তাজ।

এসব যদি তোমার সতীত্বের প্রমাণ হয় তাহলে এটা কী ?

তিতির কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। কোনো উত্তর না পেয়ে রাগ বেড়ে গেলো তাজের।

একটু দম নিয়ে বললো, তারমানে এতসব নাটকের মুল উদ্দেশ্য আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া, আমাকে ধ্বংস করে দেওয়া। এই জন্যই বেছে বেছে বিয়ের দিনটা টার্গেট করেছিস। যাতে মিডিয়ার সাহায্যে সারাদেশের মানুষের সামনে আমাকে খারাপ আর চরিত্রহীন প্রমাণিত করতে পারিস।

তিতিরের প্রতি তাজের ঘৃণা বেড়ে গেলো কয়েক গুণ। এগিয়ে এসে তিতিরের গাল চেপে ধরলো, কত টাকার বিনিময়ে এসব করেছিস ? এই নাটকের মুল চরিত্র কে বল ? তোর একার পক্ষে এসব করা সম্ভব নয় আর আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে তো তোর কোনো লাভও নেই। বল কে আছে এসবের পিছনে ? আমার ভাবতেই ঘৃণা লাগছে একটা মেয়ে হয়ে টাকার বিনিময়ে নিজের চরিত্র বিক্রি করে দিয়েছিস তুই।

তিতির তাজের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বললো, টাকা ?

কিছুটা সময় দম নিয়ে আবার বললো, স্যার আমি তো এই খেলার কেবল একটা গুটি মাত্র। পারলে আসল কালপ্রিটটাকে খোঁজে বার করুন আর আমাকেও মুক্তি দিন।

তাজ ছেড়ে দিলো তিতিরকে। হনহনিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তার বুঝা হয়ে গেছে মেয়েটা কারো হাতের পুতুল। এর থেকে কিছুই জানা যাবে না। যা করার তাকেই করতে হবে। তাজ চলে যেতেই তিতির বেডে বসে পড়লো ধপ করে। একটা ফোন করা খুব প্রয়োজন কিন্তু তাজ থাকতে সেটা সম্ভব নয়। নিজের দিকে তাকিয়ে খেয়াল হলো এখনো টাওয়েল পড়ে আছে। চেঞ্জ করা প্রয়োজন কিন্তু পড়বেটা কী ? অনেক ভেবে তাজের কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। একপাশে তাজের পোশাক রাখা আর অন্য পাশে কিছু শাড়ি আর ড্রেস। মনে হয় মৌয়ের জন্য ছিলো এগুলো। মৌয়ের কথা ভাবতেই দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চিঁড়ে।

বিড়বিড় করে বললো, এতো মানুষের অভিশাপে তুই শেষ হয় যাবি তিতির। আপুটার কী দোষ ছিলো তিতির ?

মৌয়ের একটা ড্রেস বের করে ওয়াশরুমের দিকে একবার তাকিয়ে রুমেই চেঞ্জ করে নিলো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে একটু ঘুমানো প্রয়োজন। কাবার্ড থেকে নতুন চাদর নিয়ে বিছানায় বিছিয়ে নিলো আর আগেরটা ঝুঁড়িতে রেখে দিলো। কিছু না ভেবেই শুয়ে পড়লো বেডে। চোখ বন্ধ করতেই মরিচের মতো জ্বলছে চোখ, অসহ্য ব্যাথা হচ্ছে সারা শরীরে। তবু একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো। এখনো অনেক কিছু হওয়া বাকি আছে, অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হবে তাকে। অনেকটা সময় শাওয়ার নেওয়ার পর বের হলো তাজ। বের হয়ে তিতিরকে বেডে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ধপ করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। তার জীবন নরক করে শান্তির ঘুম দেওয়া হয়েছে। তাজ চেঞ্জ করে বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তিতির, যেটা একদমই সহ্য হচ্ছে না তাজের। হাত ধরে টান দিয়ে বসিয়ে ফেললো এক ঝটকায়। কেবল ঘুম লেগেছিলো চোখে, হঠাৎ এমন করায় ধড়ফড়িয়ে উঠে তিতির।

তাজ দাঁত খিঁচিয়ে বললো, তোর সাহস হলো কী করে আমার বেডে ঘুমানোর ?

তিতির কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বললো, কোথায় ঘুমাবো তাহলে ?

যেখানে ইচ্ছে ঘুমা আমার বেডে তোর জায়গা হবে না, নাম বলছি।

তিতির কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো বেড থেকে। আশেপাশে তাকিয়ে সোফা দেখে সেখানে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। তাজ বেডে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

এখন শুধু সকালের অপেক্ষা তার। সকাল হলেই হসপিটালে গিয়ে সব টেস্ট করে সত্যিটা সবার সামনে আনার পালা। বিয়ের আসরে এমন বিশ্রি একটা পরিস্থিতিতে পড়ে চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছিল তার। তখন এটা মাথায় আসলেই এই ঘৃণ্য মেয়েটাকে এতোটা সময় সহ্য করতে হতো না তাকে। কিছুটা সময় এসব চিন্তা করতে লাগলো তাজ। অপর দিকে তিতির ভাবছে শেষ কোথায় এই নাটকের। সে তো অভিনেত্রী নয়, হাঁপিয়ে গেছে এতটুকু সময়েই।

বোনু কোথায় তুই, কীভাবে খোঁজে পাবো তোকে আমি ? এতগুলো বছর সবার থেকে লুকিয়ে রেখেও শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। ঠিক তোর খোঁজ পেয়ে গেলো রাক্ষসগুলো। ছিনিয়ে নিয়ে গেলো আমার থেকে আর আমাকে নামিয়ে দিলো জঘন্য এই খেলায়। খুব কষ্ট হচ্ছে রে বোনু।

৪.
আপুনি।

আশেপাশে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে কান্না করে দিলো ষোল বছরের মেয়েটা। একটা টেডিবিয়ার জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলো, নিজের আপুনিকে স্বপ্নে দেখেই ঘুম ভেঙে গেছে। কোথায় তার আপুনি ? আপুনি তো তাকে একা ফেলে কোথাও যায় না। মানহা মাহমুদ পাখি, বয়স ষোল হলেও বুদ্ধি আট বছরের বাচ্চার সমান। কারণ মেয়েটা মৃদু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। পরণে তার বেবি পিংক কালার টিশার্ট আর প্লাজু। পুতুলের মতো মেয়েটাকে দেখতেও নিতান্তই বাচ্চা মনে হচ্ছে। পাখি বেড থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো।

আপুনি দরজা খোলো না, আমার ভয় লাগে তো।

কেউ দরজা খুলছে না দেখে কান্না করে দিলো পাখি। তবে দরজা ধাক্কানো বন্ধ করলো না। একসময় বিরক্ত হয়ে দরজা খোলে ঘুম ঘুম চোখে সামনে দাঁড়ালো বছর পঁচিশের একটা ছেলে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রচন্ড বিরক্ত সে।

এই পাগল ছাগল ঘুমাতে না ঘুমাতেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিস কেনো ? কেবল একটু ঘুম লেগেছিলো, দিলি নষ্ট করে।

ভয়ে গুটিয়ে গেলো পাখি। কান্নাও বন্ধ করে দিয়েছে কারণ সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে ভয় পায় সে।

ছেলেটা রেগে ধমক দিয়ে বললো, কী হলো এখন চুপ করে আছিস কেনো ? বল কেনো চিৎকার করছিলি ?

পাখি ঠোঁট উল্টে বললো, আপুনি।

ছেলেটা বিরক্ত গলায় বললো, এই পাগল তো দিনরাত আপুনি আপুনি করে আমার মাথা খেয়ে ফেলছে। ভাইয়া কেনো যে এই পাগল আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে বুঝতে পারছি না। এই ন্যান্সি, ন্যান্সি।

ঘুম ঘুম চোখে হন্তদন্ত হয়ে মধ্য বয়সী এক মহিলা এসে হাজির হলো।

আমেরিকান ইংরেজিতে বললো, কী হয়েছে স্যার ?

উত্তরে ছেলেটা বললো, এই মেয়েকে সামলান। আমি এখন ঘুমাবো আবার যদি আমাকে বিরক্ত করেছে এর খবর আছে।

কথাগুলো শেষ করে ছেলেটা পাশের রুমে ঢোকে ঠাস করে দরজা আটকে দিলো। সেই শব্দে কেঁপে উঠলো পাখি। লন্ডনের একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আছে পাখি। তার আপুনির থেকে হাজার মাইল দূরে। ন্যান্সি নানা কথায় ভুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো পাখিকে, নিজেও রুমে না গিয়ে পাখির সাথে ঘুমিয়ে পড়লো।

ছেলেটার আবার ঘুম ভেঙে গেলো ফোনের শব্দে। বিরক্তিতে বাজে গালি দিলো একটা তবে স্কিনে নিজের বড় ভাইয়ের নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো।

কী করছিস আহান ?

হ্যাঁ ছেলেটার নাম আহান চৌধুরী। লন্ডনের নামকরা ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়ছে সে। এখানে সে একাই থাকে। পাখিকে দিয়ে যাওয়ার সময় তার দেখাশোনার জন্য ন্যান্সিকেও রেখে গেছে তার বড় ভাই।

আহান মনে মনে বললো, আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে জিজ্ঞেস করছে কী করছি ?

মুখে বললো, এই তো ঘুমাতে যাচ্ছিলাম।

অপর পাশ থেকে বললো, পাখির কী অবস্থা ?

আহান অসহায় গলায় বললো, ভাইয়া এই পাগলকে কোথায় পেয়েছো তুমি ? প্লিজ এটাকে নিয়ে যাও নাহলে আমিও পাগল হয়ে যাবো। সারা দিনরাত আপুনি আপুনি করে আমার মাথায় খায়।

দেখ আহান তোকে আগেই বলেছি মেয়েটা আমাদের আপন কেউ যদিও ওর পরিচয় এখনই তোকে দিতে পারছি না আমি। আপুনি ওর বড় বোন, যে মারা গেছে কিছুদিন আগে। সেটা পাখি জানে না তাই ওকে সামলে রাখ। সময় হলে আমি ওকে ফিরিয়ে আনবো। তবে মনে রাখিস ওর গায়ে যেনো ফুলের টোকাও না পড়ে। তাহলে আমি ভুলে যাবো তুই আমার ভাই।

ওকে ভাইয়া, আমার উপর তুমি বিশ্বাস রাখতে পারো।

নিজের আর পাখির খেয়াল রাখিস।

ফোন রেখে আহান ঘুমিয়ে পড়লো আর অপর পাশের ব্যাক্তি চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো, পাখি হচ্ছে এই খেলার প্রাণভোমরা। যতক্ষণ পাখি আমার হাতের মুঠোয়, তিতির ততক্ষণ আমার হাতের পুতুল। তাই প্রাণভোমরা তো আগলে রাখতেই হবে।

আবার ফোন বেজে উঠলে স্কিনে তিতির নামটা দেখে পৈশাচিক হাসি ফোটে উঠলো লোকটার ঠোঁটের কোণে।

আবার ফোন বেজে উঠলে স্কিনে তিতির নামটা দেখে পৈশাচিক হাসি ফোটে উঠলো লোকটার ঠোঁটের কোণে।

কেমন আছিস বোন ?

বিতৃষ্ণায় মুখ কুঁচকে গেলো তিতিরের। ঝাঁঝালো গলায় বললো, আপনার মুখে বোন শব্দটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দ মনে হচ্ছে। দয়া করে এমন পবিত্র একটা সম্পর্ক আপনার নোংরা মুখে নিয়ে অপবিত্র করবেন না।

তিতিরের কথায় উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো লোকটি, আচ্ছা নিলাম না এই শব্দ। তো কেমন কাটলো খান ভিলায় প্রথম রাত ?

ঘৃণায় কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এই লোকের সাথে কিন্তু তিতিরের আর কোনো পথ খোলা নেই।

আমার বোনু কোথায় ? আমি তো আপনার কথা অনুযায়ী সবকিছু করেছি। আমাদের দুই বোনের সমস্ত প্রোপার্টি এখন আপনাদের। তাজ স্যারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। এবার আমার বোনুকে ফিরিয়ে দিন।

সেটা তো এখনই সম্ভব নয় তিতিরপাখি।

তিতির এবার রেগে বলল, আর কত নিচে নামাবেন আমাকে ? নিজের বোন না হলেও আপনার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক। নিজের রক্তের সাথে আর কত বেইমানি করবেন।

বোন হয়ে ভাইয়ের এতটুকু কাজ করে দিতে পারছিস না ?

কে ভাই, আপনি ? আমার কোনো ভাই নেই। এই পৃথিবীতে আমার একটা বোন ছাড়া আর কেউ নেই। যেই বোনটাকেও আপনি কেড়ে নিয়েছেন আমার থেকে।

চিন্তা করিস না, পাখি যেখানে আছে ভালো আছে। তুই যতক্ষণ আমার কথা মতো চলবি ততক্ষণ পাখির গায়ে একটা ফুলের টোকাও পড়বে না তার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি তোকে।

আমার বোনুর সাথে কিছু করার কথা স্বপ্নেও ভাববেন না। এই তিতিরের একমাত্র দূর্বল জায়গা তার বোনু। সেখানে আঘাত করলে তার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হবে আমি কল্পনাটও করতে পারবেন না। যে বোনের জন্য তাজের মতো মানুষকে ধ্বংস করতে আমি দু’বার ভাবিনি, মৌ আপুর মতো মানুষের জীবন নষ্ট করেছি। সেখানে আপনাকে ধ্বংস করতে আমি দু সেকেন্ড সময় নিবো না। আহত বাঘিনীর আক্রমন কতটা ভয়ংকর হয় সেটা আপনার জানা আছে নিশ্চয়ই।

তুই যাদের এত মহান মনে করছিস তারা এতটাই মহান তো ? থাক সেসব, তুই আমার কথা মতো চল, আমি আমার কথা রাখবো। কাজ হয়ে গেলে অক্ষত অবস্থায় তোর বোনকে তোর কাছে পৌঁছে দিবো।

ফোন কেটে বেলকনিতে দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো তিতির। ফোনের স্কিনে পাখির হাসোজ্জল মুখটা ভাসছে। তিতির হাত বুলিয়ে দিলো বোনের মুখে। আজ পাঁচদিন হলো পাখিকে দেখে না তিতির। আপুনি বলে গলা জড়িয়ে ধরে না কেউ। বাবা-মা যখন খুন হয় তিতিরের বয়স তখন কেবল দশ বছর আর পাখি এক বছরের বাচ্চা। এক বছরের ছোট পাখিটাকে আগলে বড় করেছে তিতির। আপনজনের মুখোশধারী নরপিশাচদের থেকে লুকিয়ে রেখেছে দীর্ঘ পনেরোটি বছর। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি। যে প্রোপার্টির জন্য তার বাবা-মাকে খুন করা হয়েছে সেসব তো তিতির দিয়েই দিয়েছে। তারপরও কেনো এই নোংরা খেলায় নামিয়েছে তাকে।

তিতির বিড়বিড় করে বললো, তুই চিন্তা করিস না বোনু আমি তোর কিচ্ছু হতে দিবো না। মিস্টার চৌধুরী এবার বুঝবে কার সাথে খেলছে। একবার তোকে পেয়ে যাই। চৌধুরীদের পাপের শাস্তি দিয়ে তবেই তোকে নিয়ে দূরে চলে যাবো। বাবা-মায়ের খুনের প্রমাণ আমার কাছে থাকলেও কখনো সাহস হয়নি শাস্তি দেওয়ার। কিন্তু এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এদের শাস্তি না দিলে বারবার আমাদের জীবনে বিষাক্ত ছোবল দিবে। তবে যাওয়ার আগে স্যার আর মৌ আপুর জীবন গুছিয়ে দিয়ে যেতে হবে। আমি তাদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব এলোমেলো করে দিয়েছি আবার আমিই সব ঠিক করে দিবো। একটু সময়ের প্রয়োজন শুধু।

নানা রকম চিন্তা করতে করতে একসময় বেলকনিতে ঘুমিয়ে পড়লো তিতির।

আজ পাঁচটি রাত ধরে ঘুম নেই তার চোখে। তাজের প্রতি তিতিরের ভালোবাসা অপ্রকাশিত। পাখির পর পৃথিবীতে এই একজনকে সে ভালোবেসেছে। কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি, কখনো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনি। তিতির তাজকে দেখতো তাজের থেকে লুকিয়ে। পাঁচদিন আগেই তাজ আর মৌয়ের বিয়ের কথা জানতে পারে। প্রথম একটু কষ্ট হলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়। তাজ তার নয়, তাজ তার জীবনে একটা না ছোঁয়া স্বপ্ন। মৌকে তার ভালো লেগেছে তাজের স্ত্রী হিসাবে, মেয়েটা খুব ভালোবাসে তাজকে। এ নিয়ে বেশ খুশি হয়েছিলো তিতির। আগামী দশদিন বিয়ের জন্য তাজের অফিশিয়ালি কাজের চাপ কম তিতিরের উপর। বোনুকে অনেকটা সময় দিতে পারবে ভেবে খুশি মনে চকলেট, আইসক্রিম নিয়ে ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখে পুরো ফ্ল্যাট এলোমেলো হয়ে পরে আছে। পাখিকে দেখাশোনা করা মেয়েটাও উধাও। পুরো ফ্ল্যাট খোঁজে পাখির অস্তিত্ব না পেয়ে ভয় পেয়ে যায় তিতির। কী করবে বুঝে উঠার আগেই ফোন বেজে উঠে। বার কয়েক রিং হবার পর তিতিরের হুঁশ ফিরে। ফোনটা ছিলো মিস্টার চৌধুরীর, তখন থেকে তিতির তার হাতের পুতুল।

৫.
মৌ দরজাটা খোল মা।

উঠে গিয়ে দরজা খোলার মতো শক্তি মৌয়ের অবশিষ্ট নেই। গতরাতে কতটা সময় বাথটবে ডুবে ছিলো সে হিসাব নেই তার কাছে। প্রচন্ড শীত অনুভব হতেই উঠে এসে কোনোরকমে চেঞ্জ করে বেডে শুয়েছে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে। অনেকটা সময় ডাকাডাকি করার পরও মৌয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো মৌয়ের মা রেহেনা খন্দকার। স্বামীকে ডেকে এনে চাবি দিয়ে রুমের লক খুললেন। মেয়েকে শুয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও কাছে গিয়ে আঁতকে গেলেন। শীতে কাঁপছে মেয়েটা, কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলেন।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, জ্বরে তো শরীর পুড়ে যাচ্ছে।

মহিবুল রহমান ব্যস্ত গলায় বললো, তুমি ওর কাছে বসো আমি ডাক্তারকে ফোন দিচ্ছি।

মিতা মিতা কোথায় তুই ?

ড্রয়িংরুম থেকে আওয়াজ আসতেই মৌয়ের বাবা-মা একে অপরের দিকে তাকালো। এত সকালে কে এসেছে বুঝতে পারছে না।

রেহেনা মহিবুলের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি গিয়ে দেখো কে এসেছে।

মহিবুল বের হয়ে গেলো রুম থেকে। রেহেনা ওয়াশরুমে গেলেন পানি আনতে, মাথায় পানি দেওয়ার জন্য। ওয়াশরুমের ফ্লোরে ভেজা বেনারসি দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। এক বালতি পানি নিয়ে রুমে এসে মেয়ের মাথায় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন।

আন্টি মিতার জ্বর এলো কীভাবে ?

পেছন থেকে আওয়াজ আসতেই রেহেনা ঘুরে তাকালেন দরজার দিকে। দরজার সামনে রায়হান দাঁড়িয়ে আছে। রেহেনার অনুমতির অপেক্ষা না করে রুমে চলে এলো রায়হান।

রেহেনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, মেয়েটার উপর দিয়ে যা গেলো। বেঁচে আছে এতেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।

রায়হান মৌয়ের ড্রয়ারে ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজতে খুঁজতে রেহেনার কথা শুনে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, যা গেলো বলতে ?

রেহেনা কিছু না বলে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। রায়হান উত্তর না পেয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে মৌয়ের কাছে গেলো। বক্সে প্রয়োজনীয় সব পেয়েও গেলো। থার্মোমিটার মুখে পুরে দিলো জ্বর মাপার জন্য।

রেহেনা শান্ত গলায় বললো, তুই দেশে ফিরলি কবে ?

সকাল ছয়টায় ল্যান্ড করেছি। সেখানে থেকে সোজা মিতার সাথে দেখা করতে এলাম।

থার্মোমিটার বের করে দেখলো ১০৩° জ্বর।

আন্টি জ্বর তো অনেক৷ তুমি এক কাজ করো মাথায় পানি দিয়ে শরীরও মুছিয়ে দাও। আমি কিছু মেডিসিন নিয়ে আসছি, খাবারের পর খাইয়ে দিও।

তুই তোর আঙ্কেলকে দে, সে নিয়ে আসবে। তুইও ফ্রেশ হয়ে আয় ব্রেকফাস্ট করবি। মেয়েটার এই অবস্থা, তুই আজ এখানে থাক।

রায়হান কিছুটা সময় চিন্তা করে বললো, ঠিক আছে।

রেহেনা ওয়াশরুমে চলে গেলো মৌয়ের শরীর মুছে দেওয়ার জন্য পানি আনতে। রায়হান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৌয়ের শুকনো মুখটার দিকে। তাজ, মৌ আর রায়হান তিনজনই ছোটবেলার বন্ধু। মৌ আর রায়হান ডাক্তার হলেও তাজ আলাদা হয়ে গেছে তাদের থেকে। এক মাসের জন্য দেশের বাইরে ছিলো রায়হান। আজই দেশে ফিরেছে তাই গতকালের কিছুই জানা নেই তার। অজানা কারণে মৌ আর তাজ নিজেদের বিয়ের খবর সবচেয়ে কাছের বন্ধুকেই জানায়নি। তাজ জানাতে চাইলেও মৌ বাঁধা দিয়েছে।

রেহেনা এসে রায়হানকে একইভাবে বসে থাকতে দেখে বললো, কী হলো এখনো বসে আছিস কেনো ? গেস্ট রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়। মেডিসিন তোর আঙ্কেলকে আনতে বলে যা।

রায়হান মৌয়ের দিকে একবার তাকিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। রেহেনা মৌয়ের শরীর মুছে দিতে লাগলো।

৬.
ফোনের রিংটোনে ঘুম ভেঙে গেলো তাজের। ফোন রিসিভ করে ওপাশের কথা শুনে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। নতুন যে মুভির জন্য সাইন করেছিলো সেটা ক্যান্সেল করতে চাইছে পরিচালক। তাজের সাথে কাজ করতে চায় না সে। তার সাথে একপ্রকার ঝামেলা করে ফোন রেখে দিলো তাজ। থম মেরে বসে আছে বেডে। এটা তো হওয়ারই ছিলো, কেবল শুরু তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার। সকাল সকাল এমন একটা নিউজে সারা শরীর রাগে ফেটে যাচ্ছে তাজের। রেগে সোফার দিকে তাকিয়ে তিতিরকে দেখতে পেলো না। আশেপাশে খোঁজে না পেয়ে বেড থেকে নেমে বেলকনির দিকে গেলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমানো মলিন মুখটা দেখে মায়া হলো না তাজের। তিতিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গাল চেপে ধরলো।

চমকে উঠলো তিতির, সামনে তাকিয়ে তাজকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।

রাগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, তোকে যদি এখন খুন করতে পারতাম তাহলে হয়তো একটু শান্তি হতো আমার। তোকে যেই শাস্তি দেই না কেনো কম হয়ে যাবে।

তিতির কিছু না বুঝে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। তাজের চোখে তার জন্য তীব্র ঘৃণা হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই গরগর করে সব সত্যি বলে দিয়ে তাজ আর মৌয়ের জীবন থেকে সরে যেতে। তিতিরের মনে হচ্ছে সে তাজ আর মৌয়ের জীবনের সূর্য গ্রহণ।

তাজ ছেড়ে দিলো তিতিরকে,বসে পড়লো মেঝেতে।

তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই যত টাকার বিনিময়ে এসব করছিস তার থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকা আমি তোকে দিবো। তবু এই নোংরা খেলাটা বন্ধ কর।

তিতির এবারও চুপ, যেনো সে কথা বলতে শিখেনি।

একবার আমি সত্যিটা জানতে পারি। তোকে নিজের হাতে খুন করে সবকিছুর বদলা নিবো আমি।

ফ্রেশ হয়ে আসছি তারপর হসপিটালে যাবো। তোর সব মিথ্যে সকলের সামনে আসলে এমনই সব স্বীকার করতে বাধ্য হবি।

তাজ চলে যেতেই দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো তিতির। তার জানা আছে তাজ তাকে যেখানেই নিয়ে যাক রিপোর্ট একই আসবে। শহরের প্রত্যেকটা হসপিটালে শয়তানটার লোক আছে। তারা হসপিটালে যাওয়ার সাথে সাথে তার কাছে খবর পৌঁছে যাবে।

তিতির বললো, না এভাবে বসে থাকলে হবে না। বোনুকে খুঁজতে হবে৷ একমাত্র বোনুকে খোঁজে পেলেই এই খেলা শেষ করা যাবে। আচ্ছা আমি কী মৌ আপুর কাছে যাবো একবার ? মৌ আপুর কাছে গেলেও সে সব জেনে যাবে ? একবার চেষ্টা তো করে দেখি। তুমি চিন্তা করো না আপু, আমি যেমন ভেসে আসা মেঘের মতো তোমাদের জীবনে উড়ে এসেছি, ঠিক সেভাবেই উড়ে চলেও যাবো। একবার শুধু আমার বোনুকে পেয়ে যাই।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে