বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-০২

0
3894

#বিবাহ_বিভ্রাট(২)
*******************

পরবর্তী দুইদিন বাসায় বিয়ে নিয়ে কোনও কথা হল না। খালাদের সঙ্গে মা’র কথা হয়েছে কি না জানি না, তবে মা আমাকে কিছু বলেননি। মা’র সঙ্গে হঠাৎ করেই আমার কেমন যেন একটা দুরত্ব তৈরি হয়ে গেছে! আমি যেমন মা’র ওপর অভিমান করে আছি, মা-ও কী কোনও অপরাধবোধে ভুগছেন? জানি না। বিষয়টা লক্ষ্য করে পলাশ জিজ্ঞেস করল, “আপু, তোমার কী মা’র সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?”

“না তো। ঝগড়া হবে কেন?”

“দুইদিন ধরে সবকিছু যেন কেমন লাগছে! তোমাদেরকে কোনও কথা বলতে দেখিনি এরমধ্যে। বাইরে থেকে বাসায় আসছি, খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমি কোনও হোটেলে আছি। সবই টাইম মতো হচ্ছে, তবে পাশের মানুষগুলো সব অচেনা। কী হয়েছে আপু, বলো না।”

বুঝলাম, মা পলাশকে এই পাত্রের ব্যাপারে কিছু বলেননি। পলাশের মনোভাব বুঝতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা পলাশ, একটা কথা বল তো?”

“কী কথা, আপু?”

“আমার যদি এখন বিয়ে হয়ে যায়, কেমন হবে?”

“আপু, তোমার বিয়ে হচ্ছে নাকি! আবার কোনও পাত্র পাওয়া গেছে? আমি জানি না কেন?”

“আরে, বিয়ে হচ্ছে না। যদি হয়, সেটার কথা বলেছি।”

“ভালো হবে। মা’র মাথায় তো এখন একটাই টেনশন। তোমার একটা ভালো বিয়ে দেওয়া।”

“আমার বিয়ে হলে তো আমি তোকে আর মা’কে ছেড়ে চলে যাব। আমাদের আর একসঙ্গে থাকা হবে না। আমি তো চাই না তোদের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে।”

“এটা তো আমাদের সমাজের নিয়ম, আপু। সব মেয়ে যেমন যায়, তেমনি বিয়ে হলে তোমাকেও চলে যেতেই হবে। সেদিন রোমানা আন্টি মা’কে জিজ্ঞেস করছিলেন, এখনও কেন তোমার বিয়ে হচ্ছে না? আন্টি তোমার বয়স হিসাব করছিলেন।”

“রোমানা আন্টি? কই মা তো আমাকে কিছু বলেনি!”

“ভুলে গেছে মনে হয়। আন্টি মা’কে ভয় দেখাচ্ছিলেন, এখনই যদি তোমার বিয়ে না হয়, তাহলে কয়দিন পর নাকি আর বিয়েই হবে না। আমার তখন এত রাগ হচ্ছিল ওনার ওপর। আপু, অন্যের বিষয়ে মানুষের এত আগ্রহ থাকে কেন?”

“জানি না রে। মা ওনাকে কী বললেন?”

“মা বলেছেন, পাত্র দেখা হচ্ছে। বিয়ের চেষ্টা চলছে। কথাটা শুনে উনি কেমন যেন ঠোঁট ওলটালেন! রোমানা আন্টিকে আমার ভীষণ কুটনা মনে হয়। যখনই আসেন, তখনই কিছু না কিছু উলটাপালটা বলে যান।”

“আচ্ছা ধর, যদি এমন কারও সঙ্গে আমার বিয়ে হয়, যে মানুষটা আগেও একবার বিয়ে করেছিল?”

“এমন ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে কেন!”

“হবে কে বলল? ধর, যদি হয়ে যায়, সেই কথা বলেছি৷ ভাগ্য বলে একটা ব্যাপার আছে না।”

“আপু, সত্যি করে বলো তো, তুমি কী কোনও ম্যারিড লোকের সঙ্গে রিলেশন করেছ?”

“আরে নাহ। কী সব কথা বলিস তুই!”

“আমি কোথায় বললাম? তুমিই তো ভাগ্য-টাগ্য কী সব বলছ।”

আমাদের কথার মাঝখানে মা রুমে ঢোকায়, আমরা চুপ হয়ে গেলাম। মা, আমার চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়ানোয় আমি মা’র চেহারা দেখতে পাচ্ছি না। মা বললেন, “পলাশ, তোকে বলা হয়নি, আপা, জবার একটা বিয়ের কথা এনেছে।”

পলাশ বলল, “মা তুমি কয়দিন পরপর আপুর বিয়ে দেওয়ার জন্য এত অস্থির হয়ে ওঠো কেন? বিয়ে হলে তো আপু আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে না।”

“মেয়েরা তো সারাজীবন বাপের বাড়িতে থাকে না। বিয়ে হলে তো সব মেয়েকেই চলে যেতে হয়।”

“তা হয়; কিন্তু আপু তো বিয়ে করতে চায় না। তুমি ওকে জোর করে বিয়ে দিতে চাও কেন?”

“তুই ঐসব বুঝবি না। একটা আইবুড়ো মেয়ে ঘরে থাকলে, বাপ-মা’কে কত কথা শুনতে হয়, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।”

“কী বুড়ো?”

“তুই বুঝবি না। ছেলের বাসা থেকে আগামী শুক্রবার আমাদের এখানে আসতে চাচ্ছে। জবা, তুই কী বলিস? ওদের আসতে বলব?”

আমি উত্তর দেওয়ার আগে পলাশ বলল, “আমি তো ছেলেটার কথা কিছু জানলামই না। কে আসবে আপুকে দেখতে?”

আমি বললাম, “পাত্র ইউএস থাকে।”

“তাই নাকি! বাহ, ভালো তো। আপু তুমি তো তাহলে ইউএস চলে যেতে পার। তখন তো বছরের পর বছর তোমার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না।”

“থাম, পলাশ। তুই তো অনেকদূর পর্যন্ত ভেবে ফেলেছিস। বড়ো খালা শুধু প্রপোজাল এনেছেন। আমি ঐ পাত্রের সঙ্গে দেখা করব কিনা, এখনও ঠিক করিনি।”

“কেন আপু?”

উনি আগে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন।”

যেন শরীরে কোনোকিছুর শক লেগেছে, পলাশ এমনভাবে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। “কী বললে তুমি, বিবাহিত লোক? বড়ো খালা একটা বিবাহিত লোকের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা বললেন কোন সাহসে? মা, তুমি বড়ো খালাকে কিছু বলোনি? আপুর কী আগে বিয়ে হয়েছিল, যে আপু ঐরকম একটা মানুষকে বিয়ে করবে?”

পলাশ রীতিমতো কাঁপছিল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “এমন করছিস কেন? এখনও তো কোনও কথাবার্তা হয়নি। বিয়ের কথা বললেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না।”

“আমি এতসব বুঝি না। বড়ো খালা তোমাকে অপমান করল কেন? আমাদের টাকাপয়সা নেই বলে? আমাদের বাবা নেই বলে? বড়ো খালার যখন এতই শখ, তখন তমা আপুর সঙ্গে ঐ লোকের বিয়ে দিক।”

মা বললেন, “আপা ওদেরকে শুক্রবারে আসতে বলে দিয়েছে।”

পলাশ বলল, “তুমি কিছুক্ষণ আগে বললে ছেলের বাসা থেকে আসতে চাচ্ছে আর এখন বলছ বড়ো খালা আসতে বলে দিয়েছে। মানে কী কথাটার? আপুর পারমিশন ছাড়া তুমি কেন এদেরকে আসতে বলেছ?”

“সবকিছু শুনে আমার মনে হয়েছে ছেলেটা ভালো হতেও পারে।”

“আমাদের এত ভালোর দরকার নেই। তুমি এখনই ফোন করে বড়ো খালাকে বলো, খালা যেন ওদেরকে আসতে নিষেধ করে।”

“আপা কথা দিয়ে ফেলেছে।”

“দিক কথা।”

“তোরা এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? কামরুল ভাইয়ের মেয়ে দীপ্তির গতবছর বিয়ে হল, তোদের মনে আছে? যার সঙ্গে দীপ্তির বিয়ে হয়েছে, ঐ ছেলে তো আগে বিয়ে করেনি। সে তো দীপ্তির বাচ্চাসহ বিয়ে করেছে। এখন ওরা অনেক ভালো আছে। আমি শুধু বলছি, আপা যখন ওদেরকে বলেই ফেলেছে, ওরা আসুক। এরপর জবা যা বলবে, তা-ই হবে।”

পলাশ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু তুমি এখনই না বলে দাও। সব ঝামেলা শেষ।”

মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। মা বেশ বিব্রত হয়ে আছেন। পলাশ আজকের আগে এত রাগ হয়ে কখনও মা’র সঙ্গে কথা বলেনি। বিষয়টা সহজ করার জন্য বললাম, “ঠিক আছে, বড়ো খালা যখন কথা দিয়েই ফেলেছে, শুক্রবার ওনারা আসুক; কিন্তু আয়োজন করে তাঁদের খাওয়াতে পারবে না, বলে দিলাম। বিকেলের দিকে আসবে, চা’য়ের সঙ্গে যতটুকু আপ্যায়ন করার, শুধু সেটুকুই আমরা করব৷ এতে যদি তাঁরা রাজি থাকেন, তাহলেই যেন আসেন।”

মা মনে হল এতেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আপাকে বলে দিচ্ছি, ওরা যেন বিকেলেই আসে।” কথা শেষ করে মা রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পলাশ মা’কে কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে থামিয়ে বললাম, “এই বিষয়ে যথেষ্ট কথাবার্তা হয়েছে। আর কিছু বলিস না। গতকাল থেকে মা’র প্রেশার অনেক বেশি হয়ে আছে। আরও বড়ে গেলে, ঝামেলা হয়ে যাবে। তুই পড়তে বস। টেস্ট পরীক্ষার ডেট দিয়েছে?”

“হুম। আটাশ তারিখে পরীক্ষা শুরু হবে।”

“ভালো করে পড়, পলাশ। এইচএসসির রেজাল্ট ভালো হতেই হবে। রেজাল্ট খারাপ হলে, ভালো কোথাও চান্স পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।”

————————

আজ বিকেলে ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতে আসবে। বড়ো খালা সকালেই চলে এসেছেন। সাথে করে নাস্তার জন্য নানারকম খাবার এনেছেন। আমি ঘরবাড়ি গোছগাছ করে মাত্র শেষ করলাম। গোসল করতে যাব, ঠিক তখনই আরোহী এল। আরোহী আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ছোটোবেলার বন্ধু। আরোহীর চঞ্চল স্বভাব আর রাখঢাকহীন কথা বলার কারণে মা ওকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। ছোটোবেলা থেকে সৎমা’র সংসারে বেড়ে ওঠার কারণে ও কিছুটা মুখরা ধরণের। এমন না হয়ে অবশ্য উপায় ছিল না। আরোহীর আব্বা থাকত বিদেশে। সৎমা ওকে সহ্যই করতে পারত না। ওনার বৈষম্যমূলক আচরণ, আরোহীকে দিন দিন একরোখা আর জেদি করে তুলছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় ও আমাদের বাসায় পড়ে থাকত। আমরা দু’জন খাওয়া, ঘুম, লেখাপড়া একসঙ্গেই করতাম। মা বিরক্ত হলেও, বাবা ওকে পছন্দ করতেন বলেই ও নির্দ্ধিধায় আমাদের এখানে চলে আসত, থাকত। আরোহী আমার রুমে ঢুকে বিছানায় বসে বলল, “কী যে গরম বাইরে! ফ্রিজে ঠান্ডা পানি আছে?”

পানি এনে ওর সামনে ধরতেই, ঢকঢক করে পানি শেষ করে বলল, “বড়ো খালা আমাকে দেখে যে লুকটা দিল না! বাপরে বাপ।”

“তুই এই দুপুরবেলায় কোত্থেকে এলি?”

“পার্লারের জিনিস আনতে গিয়েছিলাম। সকালে এককাপ চা আর দু’টো টোস্ট খেয়ে বেরিয়েছিলাম। পেটের ভেতর এখন ছুঁচো ডন দিচ্ছে। পোলাও রান্না হয়েছে নাকি? ঘ্রাণ পাচ্ছি যে?”

“হুম।”

“তোরা খেয়ে ফেলেছিস?”

“নাহ। তুই বস, আমি গোসলটা সেরে আসি। তারপর একসাথে খাব।”

“আচ্ছা শোন, বিকেলে সাদিয়া পার্লারে আসবে। আমি খাওয়ার পর চলে যাব। তুই বিকেলে আসিস।”

“আজকে হবে না। বিকেলে পাত্রপক্ষ আসবে।”

“তোকে দেখতে?”

“না, তোকে দেখতে।”

“আমার কী মা আছে রে, যে আমার জন্য বিয়ের চিন্তা করবে? আমার বিয়ে আমি নিজেই করে নেব একসময়। এখন বল, এবার কে আসছে তোকে দেখতে?”

“আসুক, আসলেই দেখবি। ওহ, তুই তো থাকবি না।”

“আমি কোথায় যাব?”

“এখনই না বললি, বিকেলে সাদিয়া আসবে।”

আরোহী ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “সাদিয়া কালকে আসুক। তোকে দেখতে আসবে, এটা আমার জন্য বেশি জরুরি। অবশ্য আন্টি আর বড়ো খালা মিলে এখনই আমাকে তাড়ানোর চেষ্টা করবে। চেষ্টা করে লাভ হবে না। আমি কোথাও যাচ্ছি না। আরেকটা কথা, এই যে কয়দিন পরপরই একটা করে পাত্র দেখতে আসে; কিন্তু বিয়েটা হয় না। তারচেয়ে তুই একটা প্রেম করলেই তো পারিস। একবারে ঝামেলা শেষ।” কথাগুলো বলেই আরোহী শুয়ে পড়ে কোলবালিশটা কাছে টেনে নিল। তখনই বড়ো খালা রুমে ঢুকে বললেন,”কী ব্যাপার, তুমি এই দুপুরবেলায় কোত্থেকে এলে?”

“মার্কেট থেকে এসেছি খালা।”

“এমন ভরদুপুরে কেউ কারও বাসায় আসে নাকি?”

“আমি আসি৷ এই বাড়ির দরজা আমার জন্য সবসময় খোলা। আংকেল বেঁচে থাকতেই আমাকে পারমিশন দিয়ে গেছেন।”

বড়ো খালা আমার দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললেন, “তোর সব কাজ শেষ? বসে বসে আড্ডা দিলে হবে? একবার পার্লার থেকে ঘুরে আসতে হবে তো।”

“বড়ো খালা, আমি পার্লারে যাব না। এইসব কথা আমাকে বলো না প্লিজ। আমি যেমন আছি, যদি দেখতে হয়, এভাবেই দেখবে।”

আরোহী বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল, “খালা, আপনি একদম চাপ নিবেন না। জবার পার্লারে যেতে হবে না। পার্লার নিজেই তো বাসায় চলে এসেছে। এই জবা তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে আয়। খাওয়া শেষ করে তোকে মেরামত করতে বসব। জলদি যা। পোলাওয়ের সুবাসে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”

বড়ো খালার তীব্র দৃষ্টি উপেক্ষা করে, আরোহী বিছানায় বসে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।…………………………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে