বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-১৫+১৬

0
2046

#বিবাহ_বিভ্রাট (১৫)
**********************
মানিকগঞ্জের রিসোর্টে পৌঁছানো পর্যন্ত আমি কারও সঙ্গেই খুব একটা কথা বললাম না। এমনিতেও সবাইকে চিনি না আর তার ওপর কেন যেন মনে হচ্ছিল, ওদের বন্ধুবান্ধবরা আমাকে আর তমাল ভাইয়াকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে।

নীলাঞ্জনা রিসোর্টটা বেশি বড়ো না হলেও বেশ জমজমাট। এর ল্যান্ডস্কেপটা এত চমৎকার, দেখে খুব ভালো লাগল। রাস্তা থেকে মূল বিল্ডিং পর্যন্ত যে রাস্তাটা চলে গেছে, তার দুপাশে গাছ লাগানো হয়েছিল। গাছগুলো এখন বড়ো হয়ে পুরোটা রাস্তায় একটা সেড তৈরি হয়েছে। পথটা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমার হঠাৎ মনে হল, এমন একটা পথ দিয়ে একা হাঁটতে নেই। আমারও একজন মানুষ থাকা দরকার ছিল, যাঁর হাত ধরে আমি এই পথটা হেঁটে যেতে পারতাম।

“এই হাসছিস কেন?”

আরোহীর ধাক্কায় ফিরে তাকালাম। আরোহী তো সবার সঙ্গে ছিল। ও আলাদা হল কখন? আমি বললাম, “জায়গাটা অনেক সুন্দর।”

“হুম। সিয়াম আমাকে ছবি দেখিয়েছিল। তুই তো আসতেই চাচ্ছিলি না। তোর কী হয়েছে রে জবা? তুই সারা রাস্তায় এমন চুপ মেরে বসে ছিলি কেন?”

“কিছু হয়নি৷ কী হবে আবার? চুপ করে ছিলাম, কারণ সবাই তো আমার অপরিচিত।”

“আবারও ঐ এক কথা!”

“আরোহী, তোর কথা বল। কেমন লাগছে সবকিছু?”

“এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।”

“সিয়াম ভাইয়ার বাড়ির সবাই কেমন ব্যবহার করছে?”

“ভালো, খুব ভালো। ওরা তো আমাদের মতো এত হৈ-হল্লা করে না। আর যদি করেও, আমার সঙ্গে হয়ত এখনি করবে না। আমি তো নতুন মানুষ। কিছুদিন যাক, তখন বুঝতে পারব। তবে আমার মনে হচ্ছে, আমি খুব ভালো একটা পরিবার পেয়েছি, জবা। আমার জন্য এমন কিছু অপেক্ষা করে আছে, এটা আমি একমাস আগেও কল্পনা করিনি।”

“কিন্তু আমি জানতাম, তোর জীবনে ভালো কিছু হবেই।”

“তুই জানতিস?”

“হুম। কারণ তুই নিজে খুব ভালো মানুষ। নিজের কথা না ভেবে, সবসময় অন্যের যে কোনও সমস্যায়, যে কোনও বিপদে গিয়ে হাজির হয়েছিস। কখনোই কারোকে হিংসা করিসনি৷ এই গুনটা সবার থাকে না। কাজেই এটা তোর প্রাপ্য ছিল, আরোহী। সিয়াম ভাইয়ার ভাগ্য তো আরও ভালো, কারণ তিনি তোকে পেয়েছেন। কেন জানিস?”

“কেন?”

“ইয়ানার জন্য তোর চেয়ে ভালো মা আর হতেই পারে না।”

“তুই কীভাবে এত নিশ্চিত হচ্ছিস?”

“কারণ তোকে আমি খুব ভালো করে চিনি।”

“আচ্ছা তুই এমন আলাদাভাবে হাঁটছিস কেন? সবাই ডাইনিংয়ে চলে গেছে। চল যাই। ভীষণ খিদে পেয়েছে।”

“যাই। আরোহী, একটা কথা বল তো।”

“কী?”

“তুই কী তমাল ভাইয়া আর আমাকে নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছিস?”

“করলে তোর কোনও আপত্তি আছে?”

“আমি চাই না।”

“কী চাস না তুই?”

“গাড়িতে বসে মনে হচ্ছিল, সবাই শুধু আমাদের দুজনকে নিয়ে কথা বলছে। তুই কী সবাইকেই কিছু বলেছিস, নাকি?”

“শোন কাল রাতে কফি খেতে গিয়ে সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিল। এরা সবাই ছিল। আমি তো সিয়ামকে আগেই বলেছিলাম। ওদেরই এক বন্ধু, পাভেল ভাই হঠাৎ বলল সবার তো বিয়ে হয়েই গেল, এখন শুধু তমাল আর সাদমান বাকি। এদের দুজনার বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিতে হবে। তখন সিয়াম তোর কথা তুলল৷ তোকে তো সবাই বিয়ের দিন দেখেছিল। তখনই ওরা তমাল ভাইকে বলেছে রাজি হয়ে যেতে।”

“এটা ঠিক হল না আরোহী।”

“ভুল কোথায় হল? আমি তো তোকে বলেছি, তোর ব্যবস্থা আমি করবই।”

“আমার বিয়ে নিয়ে তোকে এত ভাবতে হবে না।”

“ভাবতে হবে না বললেই হল! কেন, তমাল ভাইকে কী তোর পছন্দ না? ওকে তো আমার বেশ ভালো লাগল।”

“আমি ওকে কখনও ঐ চোখে দেখিইনি, আরোহী।”

“আগে দেখিসনি তো কী হয়েছে, এখন দেখ।”

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আরোহী বলল, “অন্য কোনও সমস্যা থাকলে বল?”

“বিয়ে-শাদি নিয়ে আপাতত আমি ভাবতেই চাচ্ছি না।”

ফোনে রিং বাজতেই আরোহী বলল, “সিয়াম ফোন করছে। সবাই না খেয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। চল আগে খেয়ে নিই। তারপর কথা বলব।”

———————-

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে, তিনটা পর্বে সবাই ছড়িয়ে পড়ল। একদল সুইমিং করতে নেমে পড়ল, আরেকদল রিসোর্টের পেছনদিকের সবজি বাগানে গেল। আমি আর আরোহী ডাইনিং হলের সামনের খোলা জায়গায় দোলনায় বসেছিলাম। তমাল ভাইয়া আর সিয়াম এসে সামনে দাঁড়াল। আরোহী বলল, “কী ব্যাপার, তোমরা না সুইমিং করতে গেলে?”

সিয়াম বলল, “এমন ভরপেটে সুইমিং করা যায় নাকি? ওদের আর তর সইছে না, তাই পানিতে নেমে পড়েছে। আমরা একটু পরেই না হয় যাই।”

দোলনার সামনে চেয়ার পাতা ছিল। ওরা দুজন চেয়ারে বসল। সিয়াম এখন আমার সঙ্গে কিছুটা সহজ হয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তারপর, আপনার কী খবর বলেন? আপনার সঙ্গে তো এই কয়দিন কথা বলার সময়-সুযোগ হয়নি। আপনি কিন্তু আরোহীর লাইফের অনেকটুকু জুড়ে আছেন।”

“আরোহীও আমার লাইফের বড়ো একটা জায়গাজুড়ে আছে।”

আমার কাজের কথা, ফ্যামিলির কথা জানার ফাঁকে সিয়াম হুট করে বলল, আমার এই বন্ধুটার একটা ব্যবস্থা করে দেন এবার। বেচারা তো দলছুট হয়ে যাচ্ছে। ভালো কোনও পাত্রীর খোঁজ আছে নাকি আপনাদের কাছে?”

আরোহী বলল, “তমাল ভাই, আপনি কেমন পাত্রী খুঁজছেন? একজন পাত্রী কিন্তু আপনার সামনেই আছে।”

আরোহী আর সিয়ামের কথার পর আমি বুঝলাম, এরা দুজন ইচ্ছা করে এই দৃশ্যটার অবতারণ করেছে। আরোহীর ওপর আমার এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে তমাল ভাইয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েই দম নেবে। তমাল ভাইয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, সিয়াম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “জবা, আপনি আর তমাল দু’জনেই এডাল্ট। কিছু কথা মনে হয় আমরা সরাসরিই বলতে পারি। আপনি যদি পারমিশন দেন, তবেই বলব।”

আরোহী বলল, “ওর পারমিশন লাগবে না। তুমি বলো। তমাল ভাই, আপনার কী বিশেষ কোনও পছন্দ বা চাওয়া আছে? আপনি খোলাখুলিভাবে বলেন প্লিজ।”

তমাল ভাইয়া বলল, “আমি আসোলে সেভাবে ভাবিনি কখনও।”

“আপনারও একই কথা! আগে ভাবেননি তাতে কী? এখন ভাবেন।”

“আমি বিয়ের বিষয়টা আম্মার ওপর ছেড়ে দিয়েছি।”

আন্টির চেহারাটা আমার মনে পড়ল।

সিয়াম বলল, “সমস্যা নাই। তোর যদি এত লজ্জা লাগে, তাহলে আমি আন্টির সঙ্গে কথা বলব।”

“কক্ষণো না।” আচমকাই আমার মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল।

সিয়াম জিজ্ঞেস করল, “জবা, আপনার কী কোনও সমস্যা আছে? আপনি কী কিছু বললেন?”

আরোহী বলল, “তোরা দুইজন নিজেরা কথা বললেই তো পারিস। এই চলো তো, সবজি বাগান থেকে ঘুরে আসি।” কথা শেষ করে আরোহী, সিয়ামের হাত ধরে নিয়ে আমাদের সামনে থেকে সরে গেল।

আমি চুপচাপ বসে আছি। কী বলা উচিত, বুঝতে পারছি না। তমাল ভাইয়াই পরিস্থিতি সামাল দিল। “ওরা দুইজন বোধহয় একটু বেশিই করে ফেলছে। স্যরি, জবা।”

“তুমি স্যরি হচ্ছ কেন?”

“তুমি বোধহয় রাগ করেছ। বিশ্বাস করো জবা, আমি কিন্তু একবারও এই কথা বলিনি। ওরা দুইজনই এটাকে বাড়াচ্ছে।”

“কেন, তুমি কখনও বিয়ে করবে না?”

“ঐ যে বললাম, আম্মার ওপর ছেড়ে দিয়েছি।”

“তোমার আম্মা যেমন মেয়ে পছন্দ করবেন, তুমি তাকেই বিয়ে করবে? তোমার নিজস্ব পছন্দ বলতে কিছু নেই?”

“একসময় হয়ত ছিল; কিন্তু এখন আর নেই। তাছাড়া আম্মা যা করবেন, আমার ভালোর জন্যেই করবেন। আম্মার ওপর আমার এই ভরসাটুকু আছে।”

“সিয়াম ভাইয়া যে বলল, আমাদের বিষয়টা নিয়ে আন্টির সঙ্গে কথা বলবে। এটাতে তোমার সায় আছে?”

“হুম।”

“কেন?”

“কারণ…. উম, সত্যি কথা যদি বলি, তুমি কী বিশ্বাস করবে?”

“অবিশ্বাস করার মতো কিছু আছে? তাছাড়া, তুমি মিথ্যা বলবেই বা কেন?”

“জবা, ছোটোবেলায় যখন চাচার বাসায় গিয়ে তোমাকে দেখতাম, তখন তোমাকে আমার খুব ভালো লাগত। তোমার সঙ্গে খেলতে ভালো লাগত। আমরা তো একসঙ্গে অনেক রকম খেলা খেলেছি। ক্যারম, দাবা, লুডু… মনে আছে তোমার?”

“হুম।”

এরপর তো একটা সময় আব্বার কাজের কারণে আমরা ঢাকা থেকে চলে গেলাম। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। তোমাদেরকে ধীরে ধীরে ভুলে গেলাম। আমরা যে যার মতো বড়ো হতে থাকলাম। আমি কলেজ, ভার্সিটি শেষ করলাম। এর মাঝে আমার জীবনে শুভ্রা এল। তুমি তো শুভ্রার কথা জানো না।”

আমার বলতে ইচ্ছা করল, আমি তো তমার মুখে তোমাদের উথালপাথাল প্রেমের কত গল্পই শুনেছি; কিন্তু বললাম না। এখন শুধু আমি তার কথাই শুনব।

শুভ্রার সঙ্গে আমার চার বছরের রিলেশন ছিল। একদিন হঠাৎ সে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। সত্যিই কী ওর বাবা-মা ওকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিল, নাকি সে আমাকে বোকা বানিয়ে চলে গেল, আমি বুঝিনি। সেই সময়টা আমার ভীষণ খারাপ কেটেছে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেকে একদম গৃহবন্দি করে ফেলেছিলাম। কারও সঙ্গে কথা বলি না, ঠিকমতো খাই না, সারাক্ষণ রুমে পায়চারি করি আর একা একাই ভুল-ভাল কথা বলি। সিয়াম তখন আমার জন্য দেশে এসেছিল। ওর সাপোর্টটা তখন আমার কী যে দরকার ছিল! ওর মতো বন্ধু পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। যাই হোক, একসময় বাজে অবস্থা কাটিয়ে উঠলাম। এখন ঐসব মনে পড়লে খুব হাসি পায়। কী যে ছেলেমানুষী কাজ করেছিলাম তখন! জবা, তুমি কী বিরক্ত হচ্ছ এসব শুনে?”

“না তো। বিরক্ত কেন হব?”

“এবার তোমাকে সত্যি কথাটা বলি, এতবছর পর যখন তোমার সঙ্গে আবার দেখা হল, আমি বেশ চমকে গেছি। সেই কিশোরী জবা আর আজকের এই পরিণত জবার মধ্যে কত পার্থক্য!”

“কেমন পার্থক্য?”

“সবকিছুর। তুমি তো আগে থেকেই খুব সুন্দর করে কথা বলতে। এখন তোমার কথাগুলো শুনতে যেন আরও বেশি ভালো লাগে!”

“ভাইয়া, তুমি সেদিন রাতের ফোনের কথাগুলো এখনও মনে রেখেছ, তাই না? আমি সত্যিই স্যরি ঐ কথাগুলো বলার জন্য।”

“এই দেখো, তুমি আগেরচেয়ে অনেক বুদ্ধিমতিও হয়েছ। কী সুন্দর বুঝে ফেললে।”

“আমি ওর দিকে তাকাতেই সে বলল, “এভাবে তাকাচ্ছ কেন? দুষ্টামি করছি তোমার সঙ্গে। আমি ওগুলো মনে রাখিনি। জবা, তুমি কিন্তু আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছ।”

“আগে কী খারাপ ছিলাম?”

“না, না। তা বলিনি।”

আমার মনে হল তমাল ভাইয়া কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। সত্যি বলতে, আমারও একটু লজ্জা লাগছে। ওর কাছ থেকে এমন কথা শুনব, এটা তো আমি ভাবিনি।

“জবা, আমি কিন্তু বিয়ে নিয়ে ভাবনা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার কেবলই মনে হতো, মেয়েরা বোধহয় এভাবেই বিশ্বাসঘাতকতা করে। এভাবে দু-তিন বছর কাটিয়ে দিলাম। এরপর থেকে আম্মা এমন জোরাজোরি শুরু করে দিল! যাকে পায়, তাকেই আমার বিয়ের কথা বলে। আমার জন্য পাত্রী খুঁজতে বলে। আম্মার কারণেই অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি বিয়ে করব।”

“তমাল ভাইয়া, তুমি যখন খোলাখুলি কথা বলছই, আমি তাহলে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?”

“হুম, বলো না।”

“তুমি কী সিয়াম ভাইয়াকে আমার কথা বলেছ, নাকি ওরা দুজন মিলে এটা করছে?”

“সত্যি যদি বলি, তোমার কথা আমার মাথায় ছিলই না। আরোহী ভাবী সিয়ামকে বলেছে। সিয়াম আবার আমাকে বলেছে। আমার তখন মনে হল, বিয়ের কথা যেহেতু ভাবছি, জবা নয় কেন? একদম অপরিচিত কেউ আসার চেয়ে, পরিচিত কেউ হলে, রিস্ক কম থাকে।”

“রিস্ক! বিয়েটা কী লাভ-ক্ষতি জাতীয় কোনও প্রজেক্ট?”

“তুমি এভাবে কেন দেখছ? আচ্ছা, আচ্ছা, আমার তো একটা জায়গায় ভুল হয়ে গেছে। এই বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলার আগে, আমার উচিত ছিল তোমার সঙ্গে কথা বলে নেওয়া। স্যরি জবা। জবা, তুমি কী বলবে, বিয়ে নিয়ে তুমি কী ভাবছ?”

“বিয়ে নিয়ে?”

“মানে, তুমি তো বুঝতেই পারছ। আমি আমাদের দুজনের কথা বলছি। আমি তোমার মতামতটা জানতে চাচ্ছিলাম।”

“আমি হুট করেই কিছু বলতে পারছি না। কারণ এই বিষয়টা নিয়ে, মানে তোমাকে নিয়ে আমি কখনোই কিছু ভাবিনি। আমি একটু সময় নিতে চাই।”

“নিশ্চয়ই। আমার কোনও তাড়াহুড়ো নেই। আমি আজকেও তোমাকে বলতাম না। সিয়ামরা দুজন এমন জোরাজুরি করল দেখেই বলে ফেললাম।”

“ওদের জোরাজুরির কারণেই তুমি বললে?”

“জবা, প্লিজ। তুমি আমাকে আরও কনফিউজড করে দিয়ো না। এমনিতেই এখন গুছিয়ে কথা বলতে পারছি না। তার ওপর তুমি যদি এভাবে কথা বলো, তাহলে….”

“ঠিক আছে বলব না। চলো সবজি বাগান দেখে আসি।”

“আমিও সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম। পেছনে কিন্তু বিশাল জায়গা। বড়ো একটা পুকুরও আছে। চলো তোমাকে নিয়ে যাই। তোমার অনেক ভালো লাগবে।”

———————–

তমাল ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলার পর সবকিছু সহজ মনে হল। এখন আর মনে হচ্ছে না, কেউ আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। আমি, তমাল ভাইয়ার সঙ্গে সবজি বাগানে গিয়ে ওদের বন্ধুদের কয়েকজনকে পেলাম। বাকিরা সুইমিং পুলে নেমে পড়েছে। আমরা বাগান ঘুরে ইচ্ছামতো লাউ, পটল, শশা, করল্লা, পেয়ারা ছিঁড়ে ঝুড়িতে ভরে নিলাম। নিজ হাতে গাছ থেকে এসব সবজি তুলে নেওয়ার যে এত আনন্দ, এটা তো আমি আগে কখনোই বুঝিনি।

সবজি তোলা শেষ করে বাকিরাও সুইমিং পুলে চলে যাচ্ছে। সিয়াম, আরোহীকে যেতে বললে, আরোহী আমাকে বলল, “জবা চল।”

“না রে। তোরা যা৷ আমি এখানেই একটু বেড়াই।”

তমাল ভাইয়া বলল, “জবা, তুমি যাবে না কেন? আমরা সবাই তো যাচ্ছি।”

“আমার কখনও সুইমিং পুলে নামতে ইচ্ছা করে না। তোমরা যাও। আমি এখানেই ভালো আছি।”

আরোহী বলল, “জবা না গেলে, আমিও যাব না।”

“তুই যাবি না কেন? তুই যা প্লিজ। আমার সত্যি ভালো লাগছে না।”

শেষ পর্যন্ত আরোহী গেল না। অন্যেরা চলে গেল। আমরা দুজন হেঁটে গিয়ে আম গাছের ছায়ায় বসলাম। আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে, সেটা জানার জন্য আরোহীর যেন সহ্য হচ্ছিল না। বসেই সে জিজ্ঞেস করল, “এবার বল, তোদের কী কথা হল?”

“তেমন কিছু না।”

“তমাল ভাই তোকে কিছু বলেনি? সিয়াম ওকে এত করে বলে দিল।”

“বলেছে। আমার জন্য তো জিনিসটা আচমকা, তাই আমি বলেছি একটু সময় নিয়ে ওকে জানাব।”

“এত সময় নেওয়ার কী আছে? তমাল ভাই ভালো ছেলে। এতকিছু ভাবিস না তো। ঝট করে রাজি হয়ে যা। আমার মনে হচ্ছে তোর সঙ্গেই ওর ভাগ্য লেখা আছে।”

“যত সহজে বলছিস, বিষয়টা ততটাও সহজ না রে আরোহী।”

“এত জটিলও না। তুই একটু বেশিই ভাবছিস।”

“আমি ভেবেই আগাতে চাই। পরে যেন আমাকে কাঁদতে না হয়।”

“কাঁদতে হবে কেন?”

প্লিজ তুই আমাকে জোর করিস না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কিছু করতে চাই না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তুই চিন্তা করে আমাকে জানাস। আমি কিন্তু পজিটিভ কিছু শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।”

————————–

রিসোর্ট থেকে ঘুরে আসার দুইদিন পর বড়ো খালার ফোন এল। আমি কাজে থাকলে, বাসার কেউ সাধারণত ফোন করে না। বড়ো খালা আমাকে তেমন একটা ফোনও করেন না। সবসময়ই তো বাসায় আসছেন, দেখা হচ্ছে। “হ্যালো, বড়ো খালা….”

“জবা, তুই কোথায়?”

“হসপিটালে।”

“তোর ছুটি কখন?”

“ছুটি তো পাঁচটায়। কেন বড়ো খালা?”

“তুই অফিস থেকে আমার বাসায় চলে আয়।”

“কোনও দরকার ছিল?”

“তুই আয়, তারপর বলছি।”

“বড়ো খালা, আমি কালকে আসি?”

“না, না। আমার আজকেই দরকার। তুই কিন্তু কোনোভাবেই মিস করিস না সোনা।”

বড়ো খালা এমন সোনা, ময়না বলে তখনই ডাকেন, যখন তাঁর কোনও কাজ করানোর দরকার পড়ে। আমার সঙ্গে এমন কী জরুরি দরকার, আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।

“হ্যালো জবা, আমি রাখছি। তুই অফিস থেকে সোজা চলে আসিস, মা।”

“ঠিক আছে।”

কাজের ফাঁকে সারাদিন মাথার ভেতর বড়ো খালার ব্যাপারটা ঘুরতে থাকল। তমাকে ফোন করে জিজ্ঞেসও করলাম, বাসায় কিছু হয়েছে কি না। সে-ও কিছুই বলতে পারল না।

বড়ো খালার বাসায় পৌঁছাতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। বাসায় ঢুকে অন্যরকম কোনোকিছু চোখে পড়ল না। সবই ঠিকঠাক আছে। বড়ো খালা আমাকে দেখেই জোর করে খেতে বসিয়ে দিলেন। বারবার নিষেধ সত্ত্বেও তাঁকে বোঝানো গেল না। অবশ্য টেবিলে দোপেঁয়াজা করে রাখা বিশাল সাইজের ইলিশ পেটি দেখে আমার সত্যি খুব খেতে ইচ্ছা করছিল।

আমি খাচ্ছি। খালা আমার সামনে বসে গল্প করছেন। খালাতো ভাইবোনেরা যে যার রুমে আছে। সবার রুমের দরজা বন্ধ থাকায়, আমি কারও রুমে নক করিনি। একটু পরে ওদের সঙ্গে দেখা করব। বড়ো খালা গুড়ের সন্দেশে কামড় বসিয়ে বললেন, “আমি জানতাম, তুই আসার সময় এটা নিয়ে আসবি।”

“এই সন্দেশ তো তোমার অনেক পছন্দের। তাই নিয়ে আসি।”

“তোর অফিসে সব ঠিকঠাক চলছে তো?”

“হুম।”

“জবা, তমাল কী তোকে কিছু বলেছে?”

“তমাল ভাইয়া? কিসের কথা বলছ বড়ো খালা?”

“তমাল কী তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?”

আমি ইলিশের কাঁটা বাছা বন্ধ করে খালার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বুঝতে চেষ্টা করছি, এই কথাটা বড়ো খালার কানে এল কীভাবে?

“জবা শোন, বড়ো ভাবী আমাকে ফোন করেছিল। ভাবীই বলল তমালের কথাটা। ভাবী এখন আসছে আমার এখানে। ভাবী, তোর সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে চায়।”

তমাল ভাইয়ার মা আসছেন! উনি আাসার পর কী হতে পারে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে একটু আন্দাজ করতে পারছি, ভালো কিছু তো অবশ্যই হবে না।………………………..

#বিবাহ_বিভ্রাট (১৬)
*********************
“কী হল, খাওয়া বন্ধ করলি কেন?”

“বড়ো খালা, আন্টি আসছেন, এটা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?”

“আমি নিজেই কী আগে জানতাম নাকি? আমি তো কখনও তমালের সঙ্গে তোর বিয়ের কথা কল্পনাই করিনি। ভাবীর যা দেমাগ আর টাকার গরম, উনি যে তমালের কথায় এখানে আসছেন, এটা আমার কাছে খুব অবাক লাগল।”

“উনি কেন আসছেন? আমার সঙ্গে ওনার কী কথা?”

“তুই আগে আমাকে বল, তমালের সঙ্গে তোর কখন কী হল? তোরা যে কী শুরু করেছিস, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তোকে দেখতে আসলো, অথচ আরোহী বিয়ে করে বসে থাকল। তমাল, বন্ধুকে নিয়ে এল আর এখন নিজেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেল! ওর মা তো এতদিন ধরে ওকে রাজিই করাতে পারছিল না। তমালের সঙ্গে তোর কী কথা হয়েছে?”

“তমাল ভাইয়ার সঙ্গে আমার কোনও কথাই হয়নি। আরোহী আর সিয়াম ভাইয়াই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। সেদিন রিসোর্টে হালকা-পাতলা কিছু কথা হয়েছে; কিন্তু সেটার জন্য তো আন্টির এখানে চলে আসার কথা না। তমাল ভাইয়া তো আমাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবও দেয়নি। সে বলল, বিয়ের চিন্তা যখন করতেই হচ্ছে, তাহলে আমার কথা ভাবতে দোষ কোথায়?”

“তোদের মধ্যে কী কোনও ভালোলাগা তৈরি হয়েছে?”

“ভালোলাগার বিষয়টা কী এতই সহজ, বড়ো খালা? এত অল্প সময়ের মধ্যে কাউকে ভালো লেগে আবার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়?”

“তমাল হঠাৎ করে তোর কথা বলল তো, তাই ভাবলাম, তোরা বুঝি নিজেরা কিছু একটা ঠিক করে ফেলেছিস।”

বড়ো খালার সঙ্গে কথা বলছি ঠিকই; কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। আরোহীর বিয়ের দিনে বলা ওনার কথাগুলো আমার একদম ভালো লাগেনি। ওনাকে তো আমি আজকে থেকে চিনি না। ছোটোবেলা থেকেই তাঁকে দেখছি। উনি শুধু অহংকারীই নন, মানুষকে আঘাত করে কথা বলতেও তিনি সিদ্ধহস্ত।

তমাল ভাইয়ার আম্মার আসার কথা শুনে আমার খাওয়ার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবুও জোর করে প্লেটের খাবারটুকু শেষ করলাম। হাত ধুয়ে এসে চেয়ারে বসতেই কলিং বেল বাজল। একটু পরে টুনি এসে বলল, আন্টি এসে ড্রইংরুমে বসেছেন। উনি বড়ো খালাকে ডাকছেন। বড়ো খালা বললেন, “জবা, তুই তমার রুমে বস। আমি ডাকলে তখন আসবি। আর শোন, সারাদিন অফিস করে চেহারার কী হাল হয়েছে! মুখটা ভালো করে ধুয়ে তমার মেকআপ-টেকআপ কী যে সব আছে, ওগুলো একটু লাগিয়ে নে। চুলটাও বেঁধে নিস।”

“বড়ো খালা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, উনি পাত্রী দেখতে আসেননি।”

“কী সব বলিস তুই! যেটা বললাম, সেটা কর, যা।”

“সমস্যা নেই। উনি আমাকে চেনেন। আমার চেহারা দেখতে হলে, এভাবেই দেখবেন।”

“মাঝেমধ্যে তুই এমন ত্যাড়ামি করিস, তখন ভীষণ বিরক্ত লাগে, বুঝলি।”

“খালা তুমি গিয়ে ওনার সঙ্গে কথা বলো। আমি আসছি।”

বড়ো খালা চলে গেলে, আমি বেসিনের কাছে এসে মুখটা ধুয়ে নিলাম। আয়নায় তাকিয়ে দেখি, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। তমার রুমে ঢুকে মুখটা মুছে নিয়ে চুলগুলো আঁচড়ে নিলাম। তমা এখনও ঘুমাচ্ছে। ওকে ডাকতে ইচ্ছা করল না। ওকে ডেকে তুললে অবশ্য বড়ো খালা আর আন্টির মধ্যে কী কথা হয়েছে, তার কিছু না কিছু জানতে পারতাম। টুনি রুমে উঁকি দিয়ে বলল, “জবা আপু, খালাম্মা আপনারে ডাকতাছে।”

আমি ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি আন্টি আর বড়ো খালা পাশাপাশি সোফায় বসে আছেন। আন্টিকে সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর দিয়ে সামনের সোফাটা দেখিয়ে বললেন, “এখানে বসো।”

আমি বসার পর আন্টি বললেন, “দেখো মেয়ে, আমি সবসময় সরাসরি কথা বলা পছন্দ করি। যা বলার আমি সরাসরিই বলব এবং তুমিও ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবে না।”

আন্টির কথা শুনে আমার হাসি পেল। মনে হল, উনি শুরুতেই আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছেন। আমি কিছু না বলে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, “তমালের সঙ্গে তোমার কতদূর কথা হয়েছে?”

“কোন বিষয়ে, কতদূর কথা, আমি বুঝিনি আন্টি, আপনি কী বলছেন?”

আন্টি, বড়ো খালাকে বললেন, “শেফালী, তুমি ওকে কিছু বলোনি?”

বড়ো খালা বললেন, “আমি কী বলব ভাবী? আমি তো নিজেই ঠিকমতো কিছু জানি না। আমি শুধু বলেছি, আপনি আসছেন তমাল আর জবার বিয়ের ব্যাপারে….” কথাটা শেষ না করে বড়ো খালা আমার দিকে তাকালেন।

আন্টি বললেন, “আমার ছেলেকে গত কয়বছরে বিয়ের জন্য রাজিই করাতে পারছিলাম না। কিছুদিন হল সে নিমরাজি হয়েছে। আমি তো মেয়ে দেখাও শুরু করেছি। এই তো সেদিন সুরমা গ্রুপের মালিকের মেয়েকে দেখলাম। সুরমা গ্রুপ চিনেছ তো শেফালী? দিনক্ষণ ঠিক করে ছেলেমেয়ের দেখার ব্যবস্থা করব ভাবছিলাম, তখনই আমার ছেলে বলে বসল, সে জবাকে বিয়ে করতে চায়।”

আমি সুরমা গ্রুপকে চিনতে চেষ্টা করলাম। আন্টি সুরমা গ্রুপের পরিচয় এমনভাবে দিলেন, এটা যেন যমুনা গ্রুপের মতো কিছু একটা, যাকে এক নামেই সবাই চিনবে! বড়ো খালাও সুরমা গ্রুপ চিনেছেন বলে মনে হল না।

আন্টি বললেন, “তমালের সঙ্গে কী তোমার কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে?”

“কিসের সম্পর্ক, আন্টি?”

“জবা, তুমি কী আমাকে বিরক্ত করতে চাচ্ছ নাকি ইচ্ছা করে ন্যাকামি করছ?”

কেন জানি আন্টিকে রাগাতে ভালো লাগছে। বললাম, “আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি ন্যাকামি করছি? কথা নেই বার্তা নেই, আপনি হুট করে আমাকে ডেকে পাঠালেন। এখন আবার বলছেন তমাল ভাইয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? সে আমার দূর সম্পর্কের কাজিন। এছাড়া তার সঙ্গে আমার আর কী সম্পর্ক থাকবে?”

“যত সমস্যা শুরু হয়েছে সিয়ামের বিয়ের সময় থেকে৷ সিয়াম যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছে, এই মেয়েই হচ্ছে নাটের গুরু। মেয়েটা ভীষণ চালাক। চালাক না হলে, এমন একটা মেয়ে এত ভালো ফ্যামিলিতে ঢুকতে পারে? সে আগে নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তারপর আমার ছেলেটার মাথা নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।”

“আন্টি আপনি আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন, প্লিজ সেই কথা বলেন৷”

“ঠিক আছে, আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করছি। আমার ছেলে কী তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে?”

“না।”

“তমাল যে বলল, তোমার সঙ্গে ওর কথা হয়েছে।”

“কথা হওয়া আর বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া, দুটো ভিন্ন জিনিস। আমরা যেদিন রিসোর্টে গেলাম, তমাল ভাইয়া সেদিন কথা বলেছে। বিয়ের কথা বলেছে, আমার মতামত জানতে চেয়েছে। বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি।”

“তুমি কী বলেছ?”

“আমি বলেছি, একটু ভেবে তারপর জানাব।”

“কিন্তু সে তো আমাকে বলল, সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়।”

বড়ো খালা বললেন, “বাহ, ভালো তো। ঘরেই মেয়ে পাওয়া গেল। আমাদেরও আর কষ্ট করে ছেলে খুঁজতে হল না। তাই না ভাবী?”

আন্টি বললেন, “তমাল তার মনের ইচ্ছা জানিয়েছে; কিন্তু আমি তো মত দিইনি। আমার সংসারে আমার কথাই শেষ কথা।”

বড়ো খালা বললেন, “ছেলেটা যখন এতদিন পর রাজি হলই, তখন ওর মনের দিকটা খেয়াল করা উচিত, ভাবী।”

“করব, খেয়াল করব। অবশ্যই খেয়াল করব। আমার একটাই ছেলে। আমি তার কথার অবশ্যই দাম দেবো। সে কারণেই আজকে তোমাকে ডেকেছি।”

“বলেন আন্টি, কী বলবেন।”

“আমি এত সহজে কাউকে পছন্দ করি না। আমার পছন্দের তালিকায় থাকতে হলে, তার কিছু যোগ্যতা থাকতে হয়।”

আমি ধৈর্য ধরে তাঁর কথা শুনছি। আজ অবশ্যই আমি তাঁকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে যাব; কিন্তু তার আগে তিনি কী বলেন, সেগুলো শুনতে চাই।

বড়ো খালা বললেন, “আমাদের জবা তো রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, হাতের কাজ, সবটাতেই এক্সপার্ট। ও যাঁর ঘরে যাবে, তাঁদের তো ভাগ্য ভালো, বলতে হবে।”

বড়ো খালা হলেন আরেকজন! এত বেশি অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে পারেন! আমি বললাম, “খালা তুমি থামো। আন্টি বলুক।”

আন্টি বললেন, “তুমি যেন কী কর?”

“আমি বাড্ডা জেনারেল হসপিটালের অ্যাডমিন সেকশনে কাজ করি, আন্টি।”

“ধরো, আমি যদি তমালের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হই, তখন তোমাকে কয়েকটা শর্ত মেনে নিতে হবে। প্রথমেই তোমাকে চাকরি ছাড়তে হবে। এই চাকরিজীবী মেয়েগুলোকে আমার দুই চোখে দেখতে ইচ্ছা করে না। এরা চাকরির নাম করে সংসারের সব দায়িত্ব থেকে সরে যায়। এখনকার মেয়েদের মানসিকতাই এমন, যেন তিনি চাকরি করে এসে দুনিয়া উদ্ধার করে ফেলেছেন। ঘরে ফিরে টেবিলে সাজিয়ে রাখা খাবার খেয়ে, এসি রুমে ঢুকে, চোখের ওপর মোবাইলটা ধরে রাখবে। এরা স্বামীকে দিয়ে, শ্বশুর বাড়ির লোকদের দিয়ে সব কাজ করায়। আর সুযোগ পেলেই বাপের বাড়ির জন্য জান কোরবান করে দেয়।”

“আপনি কী বলতে চান, আন্টি? মেয়েরা চাকরি করবে না?”

“করতে পারে। যাদের টাকার প্রয়োজন, তারা করবে। আমার ছেলের বউ চাকরি করতে পারবে না। কারণ আমদের ফ্যামিলির একটা সম্মান আছে। আমি তো চাকরিজীবী মেয়ে ঘরেই আনব না। আমি বাবা সোজা কথার মানুষ। আমি তমালকেও আমার মনের কথা বলে দিয়েছি। তারপরও যদি সে তোমাকে বিয়ের ব্যাপারে এগোতে চায়, তখন কিন্তু তোমার চাকরি করা চলবে না।”

“আন্টি, আপনি আর কিছু বলবেন?”

“বলার তো অনেক কথা আছে। যতক্ষণ সবকিছু আমার মনের মতো না হবে, ততক্ষণ আমি তমালের কথায় রাজি হব না। সত্যি কথা যদি বলি, আমি তো কোনোদিনও তমালের বউ হিসেবে তোমাকে কল্পনা করিনি। এতদিন পর তমাল যখন বিয়েতে রাজি হয়েছে, তার ওপর এই প্রথম সে নিজ থেকে কোনও মেয়ের কথা বলেছে, তাই আজকে আমি এখানে আসলাম। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলে দেখতে চাই, তুমি আসলেই আমাদের ফ্যামিলিতে যাওয়ার যোগ্য কি না।”

বড়ো খালা বললেন, “জবার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন ভাবী। আমি এই নিশ্চয়তা দিচ্ছি।”

“বড়ো খালা, প্লিজ তুমি কথা বলো না। আন্টি, আমি কী এখন কথা বলতে পারি?”

“কী বলতে চাও, বলো।”

“আন্টি, আমি কিছু কথা বলব, আপনি কিছু মনে করবেন না, প্লিজ। প্রথম কথা হল, আমি মা’কে জানিয়ে দিয়েছি, আমি এখন বিয়ে করব না। আর কোনও পাত্রপক্ষের সামনে আমি সাজগোজ করে দাঁড়াতে পারব না। তমাল ভাইয়ার বিষয়টা যদি বলি, আরোহী আর সিয়াম ভাইয়ের জোরাজুরিতেই হয়ত তমাল ভাইয়া আমার কথা ভেবেছেন। শুধু উনি আমাকে বিয়ে করতে চাইলেই তো হবে না। আমারও তো তাকে পছন্দ হতে হবে। পাত্র হিসেবে তমাল ভাইয়া খুব ভালো, যে কোনও মেয়ে ওকে পছন্দ করবে। আমাদের ফ্যামিলির তুলনায় আপনাদের অবস্থান অনেকখানি উঁচুতে। আপনারা সবকিছুতে এগিয়ে থাকার কারণে আপনি হয়ত ধরেই নিয়েছেন, তমাল ভাইয়াকে বিয়ে করার জন্য আমি অস্থির হয়ে গেছি। এমন একটা প্রস্তাব আমি চোখ বন্ধ করে লুফে নেব। আপনার এই ধারণাটা একেবারেই ভুল। সত্যি যদি বলি, আরোহীরা বলার পর এবং তমাল ভাইয়ার সঙ্গে কথা হওয়ার পর আমি মনে মনে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আপনি বিয়ের দিন যেসব কথা বলেছিলেন, আমি আরোহীকে সেগুলোও বলিনি। বললে সে নিজেই আমাকে বলত, জবা, খবরদার এই ছেলেকে বিয়ে করিস না।”

“মানে! কী বলতে চাও তুমি? তুমি কী আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ?”

“না আন্টি। আমি বাবা-মা’র কাছে কাউকে অকারণে অপমান করার শিক্ষাটা পাইনি। আমি শুধু বলছি, আমার মধ্যে যে দুর্বলতা কাজ করছিল, আপনার সঙ্গে এখন কথা হওয়ার পর, আমার দুর্বলতা কেটে গেছে। আমার মধ্যে এখন আর কোনও দ্বিধা কাজ করছে না। আন্টি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি আপনার বাড়িতে যাচ্ছি না।”

“মানে?”

“আপনি এখনই বললেন না, আপনার পছন্দের তালিকায় থাকতে হলে কিছু যোগ্যতা লাগবে। তাই আপনি আজকে আমার যোগ্যতা মাপতে এসেছেন৷ অথবা আমাকে বুঝিয়ে দিতে এসেছেন, আমি কোনোভাবেই আপনাদের ফ্যামিলির যোগ্য না। আন্টি, সত্যি বলছি, আমি আপনাদের ফ্যামিলির যোগ্য হতেই চাই না। আপনার সেদিনের কথাগুলোও আমার মনে আছে। আন্টি, আমার বাবা সবসময় একটা কথা বলতেন, বিনয়ী মানুষ চেনা যায় তাঁর আচরণে আর মুখের ভাষায়, আবার অহংকারী আর দাম্ভিক মানুষও চেনার উপায় হচ্ছে, তাঁদের আচরণ আর মুখের ভাষা। বাবা সবসময় বলতেন, অহংকারীদের এড়িয়ে চলতে। নিজের আত্মসম্মান বজায় রেখে চলতে। আমিও খুব চেষ্টা করি, সেভাবেই চলতে। আপনার হয়ত আমাকে ভীষণ বেয়াদব মনে হচ্ছে; কিন্তু আপনার মনে হলেও আমার কিছু করার নেই। আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন এভাবে কথা বলতে৷”

আন্টি বড়ো খালাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই শেফালী, শিউলির মেয়ের এত অহংকার হল কী করে? এত বড়ো বড়ো কথা বলে কিসের ভিত্তিতে? কত বড়ো চাকরি করে সে? সে কী বুঝতে পারছে, সে কার সঙ্গে কথা বলছে?…………………………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে