বিবাহ বিভ্রাট পর্ব-০১

0
5196

#বিবাহ_বিভ্রাট(১)
******************
ঘরে ঢুকেই শুনি, আমার বিয়ে নিয়ে আলোচনা চলছে। কাজ থেকে মাত্রই বাড়িতে ফিরেছি৷ ফিরেই দুই খালা আর মা’র কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল। মেজাজ বিগড়ালেও তাঁদেরকে বুঝতে দিলাম না। আমার মা-খালারা তিন বোন, বড়ো খালা শেফালী, আমার মা শিউলি আর ছোটো খালা, শাপলা। ছোটো খালা বলল, “শোন জবা, তোর ভাগ্য বলতে হবে। এমন ছেলে সবার ভাগ্যে জোটে না। যেমন দেখতে, তেমন অমায়িক আর টাকাপয়সার কোনও ভাবনা নেই। একদম ফার্স্ট ক্লাস।”

বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা শুনতে বা বলতে একদম ভাল লাগে না। গত দুই বছরে আমার বেশ কয়েকটা বিয়ের কথা হয়েছিল। এরমধ্যে পাঁচবার আমাকে পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বসতে হয়েছে। সবগুলোই কোনও না কোনও কারণে বিয়ে পর্যন্ত গড়ানোর আগেই, ফুলস্টপ পড়ে গেছে। কোনোটায় আমাদের সমস্যা ছিল, কোনোটায় ঐ তরফের। এখন বিয়ের কথা উঠলেই আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। সাজগোজ করে কতগুলো মানুষের সামনে গিয়ে পুতুলের মতো বসে থাকা। এরপর তাঁরা জহুরির চোখে আমাকে পরখ করতে থাকবে। এটা আমার ভীষণ অপছন্দের কাজ। তার ওপর থাকবে তাঁদের জন্য ভুঁড়ি ভোজনের ব্যবস্থা। প্রতিবার এত্ত এত্ত টাকা খরচ! কই একবারও তো ছেলেদের বাড়িতে এমন আয়োজন করে পাত্রীপক্ষকে, মানে আমাদেরকে ডাকা হল না! এসব খরচ সবসময় কেন মেয়ের বাড়ির ওপরই চাপানো হয়? এই নিয়ম কে, কবে তৈরি করেছিল? সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো থেকে পাত্রী দেখানোর এমন চল আর কতদিন চলবে, কে জানে?

যা-ই হোক, ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। সবকিছু যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে। আমার কথায় তো আর দুনিয়া চলবে না। দুনিয়া কেন, নিজের বাড়ির লোকজনও তো আমার কথা শোনে না। এই যে আমি কঠিনভাবে বলেছিলাম, আর যেন আমার বিয়ের কথা না তোলা হয়। কেউ শুনল আমার কথা?

ছোটো খালা বলল, “কী রে জবা, তুই কোনও কথা বলছিস না কেন?”

“কী বলব, বলো?”

“কিছু তো বল।”

“তোমরা কী শুনতে চাচ্ছ?”

ছোটো খালা আমার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলল, “শোন, পাত্র খুবই ভালো। আহা শোন না, তুই আগেই ভ্রু কুঁচকাচ্ছিস কেন? ছেলে হল বড়ো আপার ভাসুরের ছেলে, তমালের বন্ধু। খুব ভালো ছেলে। ঐদিন বড়ো আপার বাসায় এসেছিল। আমি নিজে ছেলেকে দেখেছি। কথাও বলেছি।”

মা ইতস্তত করে বললেন, “কিন্তু ছেলেটার তো বিয়ে হয়েছিল।”

আমি কৌতুহলী হয়ে উঠলাম, “বিয়ে হয়েছিল, মানে? তোমরা বিবাহিত লোকের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ভাবছ?” হায় অদৃষ্ট! আমার বিয়ে হচ্ছে না দেখে, এঁরা যাকে পাবে, তার সঙ্গেই…..

বড়ো খালা বললেন, “বিবাহিত না। বিপত্নীক। ছেলেটার বউ মারা গেছে বছরখানেক আগে। এই ছেলেকে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। অসম্ভব।”

আমি মা’র দিকে তাকিয়ে বললাম, “অসম্ভব কেন?”

উত্তরটা বড়ো খালা-ই দিলেন, “অসম্ভব, কারণ ছেলে আমেরিয়ায় থাকে।”

“ছেলে আমেরিকা থাকে, এটাই তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয়! এটাই যোগ্যতার মাপকাঠি?”

“আমেরিকায় থাকার মানে বুঝিস? রাজরানীর জীবন পাবি তুই। আমাদের চৌদ্দ গুষ্ঠির কেউ কখনও আমেরিকায় গিয়েছে? তুই গেলে, তোর বদৌলতে যদি আমাদের বাচ্চারা যেতে পারে। তুই না করিস না, জবা।”

“ইউএসএ যাঁরা থাকেন, তাঁরা সবাই কী রাজা-রানীর জীবন পায়, বড়ো খালা? দাসী, খানসামা, পাইক-পেয়াদা কেউ হয় না? তাহলে রাজা-রানীর সেবা করবে কে?”

“চুপ কর হতচ্ছাড়ি। ফাজলামো করছিস আমার সঙ্গে?”

“আমি কোথায় ফাজলামো করলাম! শুরু তো করলে তুমি। কী সব রাজরানী-ফাজরানী বলে তুমিই তো…..”

কথা শেষ করার আগেই মা’র ধমক কানে এল, “জবা, বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। সবসময়, সব বিষয়ে কথা বলতে হয় না।”

বড়ো খালা বললেন, “একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর, মা। এত সহজে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ সবাই পায় না। ভাগ্য যদি তোকে সেই সুযোগ দেয়, তুই নিবি না কেন, বল?”

আমার হাসি পেল। শুধুমাত্র অন্যদের আমেরিকায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে দেখে, ঐ লোককে আমার বিয়ে করতে হবে! আমার কোনও সিদ্ধান্ত নেই? আমার কোনও স্বপ্ন নেই? বড়ো খালা বললেন, “দিন দিন এদেশটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। তুই চলে যা। গিয়ে ভাইবোনদের নেওয়ার ব্যবস্থা কর।”

“আমি চাইলেই কী সবাইকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে পারব, বড়ো খালা? আমেরিকা কী মুড়ির মোয়া?”

“আহা, চেষ্টা করতে দোষ কোথায়? একটা সুযোগ যখন এসেছে, সুযোগটা কাজে লাগা।”

আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আমার বিয়ে হচ্ছে না দেখে শেষ পর্যন্ত এঁরা আমাকে দোজবেরে লোকের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছে! তা-ও যদি আমার কথা চিন্তা করে বিয়েটা ঠিক করা হত? সেখানে অন্যদের স্বার্থই বেশি দেখতে পাচ্ছি আমি। আমার ভাইবোন আর কাজিনরা ইউএসএ যেতে পারবে দেখে, আমাকে এখন এই মানুষটাকে বিয়ে করতে হবে!

আমি জানি, আমাদের একদম সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। দাদার বাড়ির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তেমন ভালো না। বাবা মারা যাওয়ার পরই চাচারা আমাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। আমরা যাতে জমির ভাগ আনতে না যাই, সেই কারণে আগে থেকেই তাঁরা ভিলেজ পলিটিক্স খাটিয়েছে৷ আমরা ঐ জমির আশাও করি না। কারণ, দাদাজানের জমির কোনো ভাগবাটোয়ারা হয়নি। আমার তিন চাচা ঐসব জমির ভোগদখল করছে। চাষের জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। কাজেই আমরা ঢাকা শহরে বসে, ঐ জমির জন্য হাপিত্যেশ করে কিছুই করতে পারব না। মা বলেছেন, মামলা-মোকদ্দমা করলে, শুধু শুধু টাকা নষ্ট আর হয়রানি হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না। নষ্ট করার মতো টাকা যেহেতু আমাদের নেই, তাই দাদার বাড়ির জমির আশা আপাতত ছাড়তে হয়েছে। পলাশ অবশ্য আশা ছাড়েনি। সে আরেকটু বড়ো হয়েই, নিজে গিয়ে হাজির হবে, বাবার সম্পত্তি বুঝে নিতে। এখন দাদাবাড়ি বলতে, একমাত্র ফুপুর সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক আছে।

আমার মা’র তিন বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে আমাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত খারাপ। বাকিরা সবাই মোটামুটি স্বচ্ছল। একটা কথা মনে হয়ে আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, আমরা তাঁদের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছি বলেই, তাঁরা আমাকে নিয়ে এমনটা ভাবতে পারছেন। কই, বড়ো খালার ছোটো মেয়ে তমারও তো বিয়ের কথা চলছে। এই লোকের সঙ্গে তমার বিয়ের কথা তো কেউ বলল না। আমার এখন ভীষণ অভিমান হচ্ছে; কিন্তু এই অভিমান দেখানোর মতো একটা মানুষও আমার জীবনে নেই।

আড়াইবছর আগে আমার বাবা মারা গেছেন। আমাদের নিজস্ব সহায়সম্পদ বলতে, নানার বাড়ি থেকে ভাগে পাওয়া এই ফ্ল্যাট আর বাবা কিছু সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছিলেন৷ তিনমাস পর পর সেটার কিছু লভ্যাংশ পাওয়া যায় বলে আমাদের খুব বেশি বিপদে পড়তে হয়নি। আমি বাড্ডা জেনারেল হাসপাতালের এডমিনিস্ট্রেশনে কাজ করছি একবছর হল। এর আগে একটা বুটিক শপে কিছুদিন কাজ করেছিলাম।

মা বললেন, “জবা কিছু বল।”

আমি বলতে চাচ্ছিলাম, “মা, আমাদের অবস্থা খারাপ বলেই সবাই আমাদের সঙ্গে খবরদারি করার সাহস পায়। আমার বাবা বেঁচে থাকলে খালারা এমন প্রস্তাব আনার কথা ভাবতেই পারত না৷” কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ আমাদের খালা-মামারা আমাদের দুই ভাইবোনকে খুব আদর করেন৷ তাঁরা হয়ত আমাদের ভালোই চান; কিন্তু তবুও আমি বিষয়টা সহজভাবে নিতে পারছি না৷ মা’কে বললাম, “মা আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও। আমি হুট করে কিছু বলতে চাই না।”

বড়ো খালা বললেন, “পাগল হয়েছিস? এমন ছেলে কেউ হাতছাড়া করে? একদম সময় দেওয়া যাবে না। ছেলেকে নিয়ে তো লোফালুফি চলছে। আমি তমালকে বলেছি, আগে আমরা জবাকে দেখাব। ছেলে যদি জবাকে পছন্দ করে, তবে তো মিটেই গেল। আমার বিশ্বাস, ছেলেটা জবাকে পছন্দ করবে।”

“বড়ো খালা, পাবনার ঐ ছেলেটার বেলায়ও কিন্তু তোমার এমন বিশ্বাস ছিল। যাদের পনেরো জনকে খাওয়ানোর জন্য বাবুর্চি দিয়ে রাঁধতে হয়েছিল।”

“ধুর ধুর, ঐ বিয়েটা না হয়ে ভালোই হয়েছে। ওখানে বিয়ে হলে কী আজকে সিয়ামকে পাওয়া যেত?”

“সিয়াম কে?”

“ঐ যে আমেরিকান।”

“বড়ো খালা, লোকটা মোটেও আমেরিকান না। উনি প্রবাসী।”

“আরে বাবা, ওর তো কাগজপত্র সব আছে। এদেরকে আমেরিকানই বলে। তুই জানিস না। তুই একদম চিন্তা করিস না। আমি তমালকে বলছি দেখাদেখির ব্যবস্থা করতে।”

এখানে এখন কথা বলে কোনও লাভ হবে না। বরং আমার মেজাজ আরও খারাপ হবে। আমি ব্যাগটা তুলে নিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।

রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে দুই খালা চলে গেল। যাওয়ার আগে আবারও একগাদা আদেশ-উপদেশ দিয়ে গেলেন। আমি চুপচাপ সব কথা শুনলাম। এনাদের সবার মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ, আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। খালাদের ওপর আমার এতটুকুও রাগ হচ্ছে না। যত রাগ আর অভিমান, সবই মা’র ওপর জমেছে। মা খুব সহজেই এই প্রস্তাব নাকচ করে দিতে পারতেন; কিন্তু মা সেটা করেননি। কাজেই এখানে মা’রও সম্মতি আছে।

সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে আমি গল্পের বই নিয়ে বিছানায় এলাম। বইয়ের কয়েক পাতা পড়েছি, এমন সময় রুমে মা’র উপস্থিতি টের পেলাম। আমি বইয়ের দিকেই তাকিয়ে আছি। যদিও এখন আর একটা লাইনও পড়তে পারছি না। অপেক্ষায় আছি মা’র কথা শুরু করার। মা কথা শুরু করলেই, আমি আজ কঠিন কিছু কথা মা’কে শুনিয়ে দেবো।

মা আমার পায়ের কাছে বসেছেন। আমি মনে মনে কথা গোছানো শুরু করেছি। হঠাৎ মা আমার পায়ে হাত রেখে বললেন, “কী রে বাবু, পা কাটলি কখন? আঙুলে ব্যান্ডেজ কেন?”

মা যখন খুব আদর নিয়ে কথা বলেন, তখন সবসময় আমাকে বাবু ডাকেন। মা’র আওয়াজে অদ্ভুত এক মিষ্টতা ছিল, তার ওপর মা’র ছোঁয়া পেয়ে আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম! সাথে সাথে আমার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। আড়ালে চোখের জলটুকু মুছে উঠে বসলাম। মা বললেন, “ব্যথা পেলি কী করে?”

“চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছিলাম।”

“বেশি কেটেছে?”

“না। তেমন কিছু না। এইসব কাটাকাটি সবসময়ই তো হচ্ছে।”

“তুই আমার ওপর রাগ করেছিস?”

“তোমার ওপর রাগ করব কেন?”

“তুই বিশ্বাস কর বাবু, আমি শুরুতেই না করেছিলাম। আপা আর শাপলা মিলে এত জোর করল, যে….”

“যে তুমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলে!”

“ছেলেটা মনেহয় ভালো হবে।”

“তুমি কী করে বুঝলে?”

“মানুষের চোখ দেখে বোঝা যায়। ছেলেটার চেহারায় একটা মায়া আছে।”

“তুমিও দেখে ফেলেছ! তুমি কোথায় দেখলে!”

“না না। আমি আবার কোথায় দেখব? বড়ো আপা ছবি দেখাল। তুই শুধু একবার ছেলেটাকে দেখ। দেখলেই তো বিয়ে করতে হবে না। তোর যদি ভালো না লাগে, তাহলে আর একটা কথাও হবে না।”

“কিন্তু মা….”

“আমি বললাম তো, তোর যদি ভালো না লাগলে….

আমার গোছানো কথাগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মা’র বিষয়ে আমার সবসময় একটা দুর্বলতা কাজ করে। আমি কখনোই মা’র সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারি না। মা’র মুখের ওপর কঠিন কথাও বলতে পারি না।…………………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে