প্রেমকুঞ্জ পর্ব-৯+১০

0
634

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| নবম পর্ব |

সকাল সকাল আবরারের বাসায় এসে হাজির হুমাশা! শুধু হুমাশা না এর সাদে তিহাশ তো আছেই তবে আরো একজন আছে, সে হচ্ছে পূর্ণা! পূর্ণা হুমাশার বড় ঝা’র বোন! যার সাথে আবরারের বিয়ের কথা চলছিল। যদিও আবরার বিয়েতে না করে দিয়েছে। রোহানা বেগম পূর্ণা’র জন্য খুব হাই হুতাশ শুরু করে দিয়েছে! এই পূর্ণার জন্য এটা করছো তো এই ওটা করছে! এদিকে পূর্ণা আসার কিছুক্ষণ আগেই আবরার বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। সকাল সকাল হাঁটতে বের হওয়া আবরার’র পুরনো অভ্যাস। বাড়ি থেকে ঢুকতে যাবে তখন’ই দরজার সামনে পূর্ণা কে দেখে অবাক হলো আবরার। পূর্ণা কিঞ্চিত হেসে তাকিয়ে আছে আবরার দিকে।

“চিনতে পারছেন আমায়!

“পূর্ণা!

“বাহ! নামটাও দেখছি মনে রেখেছেন।

“তুমি এখানে?

“কেন আসতে পারি না।

“না, এই সকাল সকাল যে!

“গতকাল এসেছি। আপা জোর করে নিয়ে এলো এখানে। আমি বললাম বিকেলে যাই কিন্তু না। তিহাশ কে নাকি চেকাপ করাতে নিয়ে যাবে এজন্য সকাল সকাল এসেছে।

“হ্যাঁ তিহাশের আজ চেকাপের কথা আছে। কিন্তু আমিই তো যেতাম আপুর বাসায়।

“মনে হচ্ছে আমি এখানে আসায় আপনি এতোটা খুশি নন।

“না, বললে যে তাড়াহুড়ো করে এসেছ তাই বলছি। পরে না হয় আস্তে ধীরে আসতে।

পূর্ণা মুচকি হাসল। আবরার কথাটা তার মন কে ক্ষত বি*ক্ষত করল। আবরার হেসে বাড়ির ভিতরে গেল। পূর্ণা এলো তার পিছু পিছু। রোহানা বেগম আর হুমাশা দুজনেই রান্না ঘরে কাছ করছে।‌ আলতাফ হোসেন ( আবরারের বাবা ) তিহাশের সাথে খেলছে। আবরার এসে বসার ঘরে বেতের চেয়ারে বসে পড়ল। এছাড়া তাদের বসার ঘরে দুটো ছোট সাইজের সোফা আছে। মেঝেতে একটা কার্পেটও আছে। কয়েকটা ছবি টাঙানো দেওয়ালে আর এছাড়া ঘরের এক কোনে একটা ল্যাম্পশেড আছে। আলতাফ হোসেন তার এই বাড়ির উপর অনেক টাকা খরচ করেছেন। খুব শখের বাড়ি তার।‌বাড়ির পিছনে দুটো বড় বড় আম গাছ আছে। দুতলার এই বাড়িটার নিচতলা ভাড়ায় দেওয়া। আলতাফ সাহেবের চালের আরদ ছিল। ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথেই সবকিছুই শেষ হয়ে গেল। ছেলে এসব ব্যবসা বোঝে না বলে ব্যবসাটা আর টিকল না!

আবরারের আসার খবর পেয়ে রোহানা বেগম ছুটে এলেন। পূর্ণার সাথে দেখা হয়েছি কি না, কথা বলেছে কি না এসব জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। আবরার হ্যাঁ বলে নিজের ঘরে চলে গেল। দু একটা কথা বলার ইচ্ছে ছিল তার কিন্তু পেছনে পূর্ণা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু বলল না।

সকালে চিঠি এসেছে। কিন্তু সেই চিঠি এখন অবদি খুলে দেখে নি আবরার। ঘরে এসে বিছানায় বসে সেই চিঠি দেখতে লাগল। একটা চিঠি তার ইন্টারভিউ দেওয়া অফিস থেকে এসেছে। অনেকটা আগ্রহ নিয়েই সেটা খুলল আবরার। চিঠি টা পড়ে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। চাকরি টা হয়ে গেছে। অবশেষে তার চাকরি হয়ে গেছে!

আবরার খুব খুশি হলো। চিঠি টা ঘরে রেখে এসে দাঁড়াল বেলকনির কাছে। এবার মনে হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সময় হয়ে গেছে তার পরিবার কে নিলুর কথা টা বলার!

দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। বেলকনি থেকে ঘরে উঁকি দিল আবরার। সে জানে এটা পূর্ণা কারণ এই বাড়িতে এখন সে ছাড়া আর কেউ নেই তার ঘরে নক না করে ঢুকবে না। তবুও উঁকি দিয়ে বলে, এসো!

“আপা আপনাকে ডাকছে খেতে আসার জন্য!

“আসছি!

বলেও বেলকনির কাছে দাঁড়িয়ে রইল আবরর। বিছানায় থাকা চিঠি টা দেখতে পেল পূর্ণা। কৌতুহল বসত সেটাই তুলে নিল। আবরার চাকরি হয়ে গেছে এটা শুনে খুশি হলো সে। কিন্তু অবাক হলো এটা ভেবে এই নিয়ে আবরারের কোন মাতামাতি না দেখে। নিজেই মুখ ফুটে বলল,

“আপনার চাকরি হয়ে গেছে!

“হুম!

“তবুও আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

“তো কি করবো?

“কি করবেন জিজ্ঞেস করছেন?

“হুম, কি করার আছে। চাকরি হয়ে গেছে। এখন থেকে শুধু সকাল সকাল অফিসে যাবো সারাদিন কলম ধরে বসে কাগজ দেখবো। বাসের সেই ঠ্যালাঠ্যালি পেরিয়ে সন্ধ্যা হতেই বাসায় ফিরব। প্রতিদিনের এক রুটিন।

“আপনি মানুষটা তো দেখি বড্ড উদাসীন!

আবরার হাসল কিছু বলল না। পূর্ণা চিঠি নিয়ে ছুটল রান্না ঘরে!

আবরার তৈরি হচ্ছে। তিহাশ কে নিয়ে এক্ষুনি বের হবে। তিহাশ তৈরি হয়ে আবরারের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, মামা!

“তৈরি হয়েছিস!

“হুম, নানু ডাকছে তোমাকে।

“কেন?

“জানি না।

“সেটাও ঠিক, তুই জানবি কিভাবে। তা তোর পেটে কি এখন ব্যাথা হয় আর।

তিহাশ মাথা নেড়ে না বলল। আবরার তিহাশ কে কোলে উঠিয়ে বলল, তাহলে তোকে আজ একটা আইসক্রিম কিনে দেবো ঠিক আছে। কিন্তু এটা তোর পেটে ব্যাথা না হবার খুশিতে না, আমার চাকরি হবার খুশিতে জানিস।

তিহাশ মাথা নাড়ল। আবরার হেসে বলল, তুই কিভাবে জানবি।

“নানু বলেছে।

“তোর নানু কিভাবে জানল? পূর্ণা বলেছে।

তিহাশ মাথা নাড়ল। আবরার তিহাশ কে নামিয়ে রোহানা বেগমের ঘরে দরজা কড়া নাড়ল,‌

“মা!

“আয় ভেতরে আয়।

“বলো

“চাকরি হয়ে গেল আর এখনি ভুলে গেলি।

“কি বলছো এসব।

“আর না হলে কি বলবো। নাহলে একবার এসে বলে যেতিস না, মা আমার চাকরি হয়ে গেছে।

“আমি কি তোমাদের না বলে থাকতাম।

“জানি না এতো কিছু। বাদ দে!

বলেই আবরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, তবে আমি এতো টুকুতেই খুশি যে তোর চাকরি টা হয়ে গেছে। আল্লাহ আমার কথা শুনেছে। আসার সময় ভালো দেখে মিষ্টি আনিস তো। ভালো দেখে আনবি আর একটু রসমালাই আনিস। পূর্ণার খুব পছন্দ।

আবরার মুখ নিমিয়ে গেল। রোহানা বেগম আবার বলতে শুরু করলেন, দেখলি পূর্ণা মেয়েটা কতোটা লক্ষ্মী মেয়ে। বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই এতো বড় একটা সু খবর পেলাম।

আবরার কথার জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। তার মায়ের কথা সে বুঝতে পারছে কিন্তু এমনটা হয় না! সে নিলু কে ভালোবাসে শুধু নিলু কে!

—–

“আর এক কাপ চা কি দিতে বলবো, আপনার নাকি ঊষা’র হাতের চা অনেক পছন্দ!

ফরহাদ মাথা নিচু করে বসে রইল। নিলুফার হেসে বলল, “মা চাচিদের বাসায় গেছে শ্রেয়ার সাথে। এই তো দশ মিনিটের পথ হবে। কিন্তু সেখানে বসে আড্ডা দেবে অনেকক্ষণ।

“আমি তাহলে এখন চলে যাই!

“উঁহু, না তা হবে না। চা খান, এই বিস্কিট দিয়ে ভিজিয়ে খান। আমার খুব পছন্দের বিস্কিট এগুলো।

“আমার তৃষ্ণা পেয়েছে!

নিলুফার শব্দ করে হাসল। উঠে পানির গ্লাস নিয়ে এসে বাইরে দিলো ফরহাদের কাছে। ফরহাদ ঠক ঠক করে পুরো গ্লাস শেষ করল। নিলুফার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল,

“খুব ভয় পাচ্ছেন দেখছি।

“ভয় পাচ্ছি না। নার্ভাস হচ্ছি।

“এ দুটোর মাঝে পার্থক্য আছে বুঝি।

“হুম!

“কিন্তু ফরহাদ সাহেব একটা কথা কিন্তু বলতে হবে, আপনার সাহস কিন্তু দারুন। নাহলে কি ভালোবাসার জন্য এসে শেষ অবদি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন।

ফরহাদ চুপ হয়ে বসে রইল। নিলুফার বিস্কিটে কামড় দিয়ে বলল, “ভুল করছেন ফরহাদ সাহেব! আপনি ভুল করছেন।

ফরহাদ চোখ তুলে তাকাল নিলুর দিকে। নিলু অন্যত্রে চোখ সরিয়ে বলল, আবরার চাকরিটা এবার হয়ে যাবে। তখন বাড়িতে আমার কথা বলবে সে। অতঃপর বিয়ে তখন মাঝখান দিয়ে আপনি কষ্ট পাবেন। কেন পেতে চান এই কষ্ট। এখনো সময় আছে চলে যান।

ফরহাদ মৃদু হেসে বলল, তাহলে না হয় আপনার বিয়ে খেয়ে যাবে।

নিলুফার ফরহাদের দিকে তাকাল।‌ খিলখিলিয়ে হেসে বলল, ফরহাদ সাহেব আপনি একটা পাগল বুঝলেন তো। শুধু পাগল না অনেক বড় পাগল!

ফরহাদের ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিত হাসির কিনারা দেখা গেল!

——

ইরার দেওয়া প্যাকেট হাতে নিয়ে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে তিতির। এই প্যাকেট নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলেই হাজারো কথা জুটবে। নিলু আপা দেখলে তো পিছেই থাকবে। কে দিলো, কেন দিলো এটা না জানা অবদি পেটের ভাত হজম হতে দেবে না আপা!

হঠাৎ করেই বাবার গলার আওয়াজ পেল তিতির। তাকিয়ে দেখল সাদা পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। তার মাথায় একটা সাদা টুপি। বাবা হেসে বললেন, কিরে তিতির এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

“কিছু না বাবা এভাবেই।

“চল ভেতরে চল!

অতঃপর বাবার সাথে করে বাড়ির ভেতরে ঢুকল তিতির। নিলুফার এসে দরজা খুলে দিল। প্যাকেট তার চোখের আড়াল হলো না। বলে না যেখানে বাঘের হয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। তিতির ঘরে ঢুকতেই নিলুফার দৌড়ে এসে বলল, এই কি আছে রে প্যাকেটে

“পাঞ্জাবি!

নিলুফার প্যাকেট খুলে পাঞ্জাবি বের করল। হাত দিয়ে ছুঁইয়ে বলল, বাহ বেশ তো দেখতে। কে দিল? সাদা চামড়ার মেয়েটা!

“হুম আপা!

“কেন দিল?

“আমি কিভাবে জানবো, যে দিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করো আপা!

“আহ রেগে যাচ্ছিস কেনো? কেনো দিয়েছে এটাই তো জিজ্ঞেস করলাম।

“যদি আমি জানতাম তাহলে তো বলতাম।

“ওহ আচ্ছা!
বলেই হাসতে লাগলো। তাও মুখ টিপে। তিতিরের এবার রাগ হচ্ছে, অসহ্য লাগছে। গামছা হাতে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল সে! নিলুফার এখনো মুখ টিপে হাসছে!

——–

তিন দিনের জ্বরে ভুগল শ্রেয়া। ঘর থেকে বের হতে পারি নি জ্বরের চোটে। আজ তার মনটা ভালো তার সাথে শরীরও। মা সুন্দর করে চুলে তেল দিয়ে দুটো বেনুনী পাকিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই না, এমনকি তাকে সাথে নিয়ে এসেছে স্কুলে দিয়ে যেতে। রাস্তায় কিনারে মায়ের হাত ধরে হাঁটছে শ্রেয়া। দূরে কতো গুলো ছেলে দৌড়াদৌড়ি করছে। কি হলো এখন? মা হাত আরো শক্ত করে ধরল। শ্রেয়া উঁকি দিয়ে দেখল একটা ছেলেকে মা*রছে কয়েকজন মিলে। ছেলেটা হুমড়ে পড়ল নিচে। সেই ছেলেটাকে একজন উঠিয়ে কলার ধরে ঘুষি মারতে লাগল। যে মারছে সে হলো মামুন! মামুনের এমন বিমর্ষ রূপ দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে গেল শ্রেয়া। মা’র সাথে খুব সাবধানে সেখান থেকে চলে গেল স্কুলে।

মা তাকে স্কুলের গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে বলেন, ভালো মতো মন দিয়ে ক্লাস করবে। শরীর কি এখন খারাপ লাগছে।

“না!

“ঠিক আছে। একদম স্কুলের বাইরে যাবে না। ছুটি দিলে এইখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে আমি নিতে আসবে। দেশটা অধঃপতনে গেছে। যেখানে সেখানে এখন মারামা*রি, কাটাকা*টি। কিভাবে বেধোরে মা*রল ছেলেটাকে। তোমাকে বলছি, একা একা একদম বের হবে না।এখন বলো কিছু খাবে কিনে দেবো।

শ্রেয়া মাথা নেড়ে না করল কিন্তু তার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। ইচ্ছে করছে বলতে একটা কোক কিনে দাও খাবো। কিন্তু তখনকার ওই কান্ড দেখে ভয়ে এখনো ঘাবড়ে আছে সে। তবুও মা তাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে একটা কোক কিনে দিল। মা কি তাহলে তার মনের কথা টের পেয়েছে।

স্কুল ছুটির পর মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরছে শ্রেয়া। চায়ের দোকানের দিকে একটিবার তাকাল সে। মামুন ছুটে বের হলো দোকান থেকে। তার হাতের সিগারেট’র ধোঁয়া উড়ছে। মামুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রেয়ার দিকে। শ্রেয়া তাকিয়ে দেখল মামুনের হাত বেয়ে র*ক্ত পড়ছে। এতেই সে ভয় পেয়ে গেল। মায়ের হাতটা আরো শক্ত করে ধরে মুখ ঘুরে নিল সে।

মামুন সিগারেট টেনে শ্রেয়ার দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখতে লাগল! জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, এই কয়েকদিন কেন আসে নি ও। সে কি জানে, তার জন্য’ই প্রতিদিন এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে মামুন। বোধহয় জানে না!

#চলবে….

[ ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইল ]

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| দশম পর্ব |

৩ দিন পর আজ দেখা মিলল তিতিরের। তিতির কে দেখতে পেয়েই রাস্তার এপার থেকে জোরে ডেকে উঠলো ইরা। তিতির থমকে দাঁড়িয়ে খুঁজতে লাগল। ইরা হাত নাড়িয়ে দেখাল। চাঁপা শ্বাস ফেলল তিতির। ইরা হাত নাড়িয়ে এদিকে আসতে চাইলে তিতির তাকে না করে দিয়ে নিজেই পা বাড়াল। হাতে খুব জোরে একটা বারি মেরে বলল,

“কোথায় ডুব দিয়েছিল এতোদিন? তোর দেখা নেই কেন? কলেজেও যাচ্ছিস না শুনলাম!

“তোকে কে বলল?

“আয়াত বলল। গতকাল গিয়েছিলাম দেখা হলো ওর সাথে। গত তিন দিন ধরে নাকি কলেজে যাচ্ছিস না।

“হাম!

“এতো ক্লান্ত কেন লাগছে তোকে। কি হয়েছে?

“কিছুই হয় নি!

“তাহলে, আচ্ছা চল কোথাও বসি খানিকক্ষণ কথা বলি!

অতঃপর বড় বটগাছের নিচে বসল দুজন। ইরা ব্যাগ থেকে বাদাম বের করে তিতিরের দিকে বাড়াল। তিতির বাদাম হাতে নিয়ে মুখে দিল। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তার তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। ইরা বাদাম খেতে খেতে বলল,

“শুনলাম তুই নাকি টিউশনি করছিস?

“হুম!

“কাকে পড়াচ্ছিস!

“আমার এক বন্ধুর বোন কে। এবার মেট্রিক দেবে।

“ওহ কবে থেকে?

“হবে এই কয়েকদিন!

“মেয়েটা কি খুব সুন্দরী!

তিতির ইরার দিকে ফিরল। এতোক্ষণে দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকাল। ইরার চোখ দুটো স্থির। ইরার স্থির চোখ গুলোই অসাধারণ লাগে। তিতির পারলে ইরার এমন একটা স্থির মাখা মুখের ছবি এঁকে ঘরে টাঙিয়ে রাখতো। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতো। ইরার বুক ধক ধক করছে তিতিরের উওর শোনার জন্য।

“মেয়েটা তোর থেকেও সুন্দরী!

ঢোক গিলল ইরা। হাসার চেষ্টা করে তিতিরের দিকে ফিরে বলল, আমি কি জিজ্ঞেস করেছি আমার থেকে সুন্দরী কি না।

তিতির হেসে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে বলে, “আমার ধারণা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা তুই কিন্তু তাহিরা কে দেখার পর সেই ধারণা পাল্টে গেছে।

“ওহ আচ্ছা!

বলেই চুপ হয়ে গেলে ইরা। তিতিরের কেন জানি বেশ মজা লাগছে। সত্যি বলতে এমন কিছু না। তাহিরার মুখটা এখন অবদি ভালো করে দেখে নি তিতির। পড়ানোর সময় মাথা টা নিচু করেই রাখে সে। দরকার না পড়লে চোখ তুলে না। তবে তাহিরা যেমন’ই হোক না ইরা কে’ই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে বলে মনে হয় তিতিরের। নিলু আপা এভাবে এভাবেই ওকে সাদা চামড়ার মেয়ে বলে ডাকে না।

হুট করেই দাঁড়িয়ে গেল ইরা। সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে গেল তিতির।‌
“কিরে চলে যাচ্ছিস নাকি?

“হুম,‌বাসায় যেতে হবে।

“এই তো এলি।

“কিন্তু এখন যেতে হবে।

“আচ্ছা আমিও যাবো চল একসাথে যাই!

অতঃপর দুজনে একসাথে বের হলো গেল। ইরার অস্বস্তি লাগছে, তিতিরের মুখ থেকে অন্য মেয়ের কথা শোনাটা ঠিক হয় নি। কিন্তু কথা টা তো সে নিজেই তুলেছিল। না ভুল হয়ে গেছে, বড্ড খারাপ হলো বিষয়টা। হঠাৎ তিতির বলে উঠল,

“আচ্ছা সেদিন তুই পাঞ্জাবির প্যাকেট টা আমায় দিলি কেন?

“রাখতে দিয়েছিলাম

“কার জন্য?

“কার আবার, আমার প্রিয় মানুষটার জন্য।

“আমার কাছে রাখার কি হলো?

“সে এখন এখানে নেই, যেদিন এখানে আসবে সেদিন এসে তোর থেকে প্যাকেটটা তোর থেকে নিয়ে যাবো। সাবধানে রাখিস ওটা।

“তোর কাছে রাখ না, শুধু শুধু আমায় কেন জড়াচ্ছিস।

“জড়াচ্ছি না। বাসায় রাখা সম্ভব না হলেই তোর কাছে রাখছি। কেন রাখতে পারবি না তুই, আমার বন্ধু হয়ে এতোটুকু উপকারী কি করবি না?

তিতির হেসে বলল, কেন করবো না অবশ্যই করবো। কিন্তু সেই প্রিয় মানুষটা এখন কোথায়?

ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানি না! ওই তো বাস চলে এসেছে। গেলাম আমি!

বলেই দৌড়ে বাসের দিকে চলে গেল। তিতির খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। অতঃপর নিজের পথের দিকে পা বাড়াল সে!

——–

“তুমি এই কয়েকদিন আসো নি কেন?

থরথর করে কেঁপে উঠলো শ্রেয়া। পেছন থেকে এই গলা ভেসে আসছে। সাহস হচ্ছে না পেছন ফিরে তাকানোর। আজ মায়ের শরীরটা ভালো না। তাই আসতে পারে নি। তাই বলে একা আসে নি। তিতির ভাইয়া এসে স্কুল গেটের কাছে দিয়ে গেছে। তাকে এক প্যাকেট বিস্কুট ও কিনে দিয়েছে। বলে দিয়েছে, তোর ছুটির সময় আমি আসতে পারব না। তুই একদম এখানে একা দাঁড়িয়ে থাকবি না। লোকজন থাকতে থাকতে তাদের সাথে হাঁটা ধরবি। বুঝলি!

“আচ্ছা!

“কারো সাথে কোন কথা বলার দরকার নেই। শুনলাম সেদিন নাকি এখানে ঝামেলা হয়েছিল। এমন ঝামেলা আজ হলে কিন্তু ধারে কাছে যাবি না খবরদার!

শ্রেয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল! অতঃপর ভাইয়ের কথা মেনে লোকজন থাকতে থাকতে তাঁদের সাথে করে চলে এলো। চায়ের দোকানের দিকে অবশ্য একবার তাকিয়েছিল কিন্তু মামুন কে দেখতে পায় নি। তার হাতের অবস্থা সম্পর্কেও একবার ভেবেছিল! কিন্তু বাড়ির গলির কাছে আসতেই একা হয়ে গেল সে। আর তখন’ই এই গলার স্বর পেল সে। ভয়ে তার আত্না শুকিয়ে যাচ্ছে। তার পুরো শরীর কাঁপছে। পেছন থেকে আবারো সেই কন্ঠ। নিম্নস্বরে বলে উঠল, “শ্রেয়া”!

ভয়ে তটস্থ শ্রেয়া। তবুও কেন জানি পেছন ফিরল সে। মামুন কে দেখে তার শরীর জমে গেল। সেদিনের ঘটনা মনে করতেই ভয়ে তার শরীর শিউরে উঠল। কিন্তু হঠাৎ এর মাঝেও মামুনের ঠোঁটের কোনে হাসি দেখল শ্রেয়া। খানিকটা অবাক ও হলো! মামুন কিছু বলার চেষ্টা করতে গিয়েও বলল না। হঠাৎ করেই দ্রুত সরে গেল সে। শ্রেয়া নির্বাক হয়ে গেল। এক পা এগিয়ে সামনে আসতেই তার মনে হলো পেছন থেকে কেউ আসছে। সাথে সাথেই পেছনে ফিরল শ্রেয়া। ফরহাদ কে দেখে থমতম খেয়ে বলল,

“ভাইয়া আপনি!

ফরহাদ হেসে বলল, তুমি এখানে যে। আমি তো তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম।

“আমার কাছে?

‘হুম, তিতির বলল যদি সময় হয় তাহলে যেন তোমাকে নিয়ে আসতে যাই, তাই এলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার দেরি হয়ে গেল।

“না ভাইয়া, দেরি হয় নি চলুন।

“চলো। ক্লাস কেমন হলো?

“খুব ভালো।

“গরম পড়েছে অনেক, কোক খাবে একটা।

শ্রেয়া মাথা নাড়ল। ফরহাদ হেসে সামনের দিকে তাকাল। শ্রেয়া এই ফাঁকে পিছনে ফিরে তাকাল। মামুন কে দেখতে পেল সে। দূর থেকে তাকেই দেখতে পেল সে। মামুন কি তবে এই কারণেই দৌড়ে চলে গেল। এই কথা ভেবে কেন জানি মনটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেল।

—–

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি শ্রেয়া আর ফরহাদ একসাথে আসছে। শ্রেয়া খুব কথা বলছে ফরহাদের সাথে। বলতে হবে লোকটা বেশ চালাক। এই কয়েকদিনের মাঝেই তিতির আর শ্রেয়ার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। শ্রেয়া এখন তার কাছেও পড়তে যায়। মা ভাবছে, শ্রেয়ার টিউটর হিসেবে ফরহাদ কেই রাখতে।

তিতিরের সাথে প্রায়’ই ছাদে বসে গল্প করতে দেখা তাকে উনাকে। মাঝে মাঝে আমিও দেখি ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে। আমাকে দেখলেই আর্ধেক খাওয়া সিগারেট টা ছুড়ে ফেলে দেন। তবুও আমি সামনে যাই না। ফিরে আসি! আমার মনে হচ্ছে লোকটা কষ্ট পাবে। ভীষণ কষ্ট পাবে! শুধু শুধু এতো কিছু করছে হয়তো বুঝতে পারছে না এর পরিণাম কি হতে পারে!

আগামীকাল যাবো আবরারের সাথে দেখা করতে। আজ অনেকদিন হলো তার সাথে কথা হয় না। একবার টেলিফোনও করে নি ও। আমি টেবিলে বসলাম। সাদা কাগজে লিখতে শুরু করলাম,

প্রিয়তম,

আজ তোমাকে ভিন্ন কিছু লেখতে যাচ্ছি। রাগ করো না, আমার মনে হয় না এই চিঠি পড়ে তুমি রাগ করবে। তবুও ব্যতীক্রম অনেককিছুই ঘটে। তাই আমিও আজ সেরকমই কিছু লিখছি। তোমাকে বার বার বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছি, বলা হয় নি একটি ছেলের কথা। ছেলেটির সম্পর্কে তোমাকে বললে তুমি বলবে আমি তার সম্পর্কে একটু বেশিই বলছি বা একটু বেশিই জানি। তবুও আমি বলবো,বলতে ইচ্ছে করছে আমার। ছেলেটার নাম ফরহাদ! তাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম টিএসসি রোড থেকে খানিকটা পথ হাঁটার পথ মেইন রোড পেরিয়ে একটা গলির ভেতর। রোজ তাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হতে লাগল ছেলেটা বোধহয় আমার জন্য’ই এখানে আসে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি কখনো তার সাথে একটিবার দাঁড়িয়ে কথা বলি নি। একদিন হলো কি, ছেলেটা তার কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে এলো। সেদিন এসেই ছেলেটা ফেসে গেল। ধরিয়ে দিলাম তাকে আমি পুলিশের হাতে। বন্ধুদের বাঁচাতে গিয়ে সে মার খেলো। কিন্তু পরদিন হলো কি জানো? আমি ভেবেছিলাম হয়তো সে আর আসবে না, কিন্তু সে এলো। সাথে করে তিতিরের দেওয়া কলমটা নিয়ে এলো। লক্ষ্মীটি, জানো সেদিন প্রথমবার ফরহাদের সাথে আমি কথা বলেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস অবদি করেছিলাম এখানে কেন আসে সে। কিন্তু ফরহাদ খুব ভিতু ধরনের লোক। কিছু বলতে পারে নি আমায়। একটা কথা বলি, রাগ করো না। কেন জানি আমি ফরহাদের সাথে তোমাকে খানিকটা গুলিয়ে ফেলি। তুমি যেমন উদাসীন সেও উদাসীন। তবে এটার কারণ ভিন্ন। তুমি আমাকে নিয়ে উদাসীন আর সে নিজেকে নিয়ে। ফরহাদ আমাকে বার বার তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় তোমার সাথে কাটানো আমার প্রথম দিনের কথা। আমি কিন্তু তাকে তোমার কথাও বলেছিলাম কিন্তু এরপরও সে এসে একটা কান্ড ঘটালো। আমাদের বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিল। কেন জানো? না থাক তোমাকে বলবো না। আমার মনে হয় এতো টুকু পড়ার পর তোমার হিংসে হচ্ছে। আজ আমার উদাসীন প্রেমিক খানিকটা হলেও আমার জন্য চিন্তা হচ্ছে। আমি চাই চিন্তা হোক, হওয়া দরকার! তাই নয় কি?

#চলবে….

[ ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইল ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে