প্রেমকুঞ্জ পর্ব-১১+১২

0
633

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| একাদশ পর্ব |

“ফরহাদ সাহেব! আপনার হাতের কৃষ্ণচূড়া ফুলটা কি আমি নিতে পারি!

বাড়ির সামনে দেওয়ালের সাথে ঘেসে দাঁড়িয়ে ফরহাদ! তার সামনে আসমানি রঙের শাড়ি পড়ে দাঁড়ানো নীলুফার হাস্যোজ্জ্বল মুখ! নীলু কে বোধহয় আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। চোখের পাতা ফেলে ফেলে তাকিয়ে আছে ফরহাদ নিলুফারের দিকে। অতঃপর নড়েচড়ে উঠল সে। হেসে ফুলটা নিলুফারের হাতে দিল সে। নিলুফার মুচকি হেসে ফুলটা হাতে নিয়ে চলে গেল। আজ বুধবার, সেই খেয়াল আছে ফরহাদের। নিলুফার আজ অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই সাজগোজ করবে। এটাও জানা ছিল! কপালের টিপ টা একটু সরে ছিল। ফরহাদের বলার ইচ্ছে ছিল টিপ টা একটু সরে গেছে। ঠিকমতো কপালে বসে নি। কিন্তু বলা হলো না। আরো একটা কথা বলা হয়নি, কৃষ্ণচূড়া ফুলটা নিলুফারের জন্য’ই এনেছিল সে। এতো সাজগোজের পর এই ফুলের একটা কমতি থেকে যাবে বলে মনে করে ফরহাদ। যদিও জানে নিলুফার নিজেই একটা ফুটন্ত ফুল, ঠিক তার নামের মতোই! নদীতে ভাসমান একটা ফুটন্ত পদ্ম! তবুও ফরহাদের ইচ্ছে নিলুফারের খোঁপায় গাঁধা কৃষ্ণচূড়া ফুলটা সে দেখবে। নিলুফার তাই করছে। হাতের কলমটা দিয়ে চুল গুলো খোঁপা করছে। আন্দাজে সে চুলে ফুলটা গাধছে। ফরহাদ সেখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে। এটাই তার জন্য প্রাপ্তি! সে জানে আজকের সাজটা তার জন্য না, তবুও নিলুফার কে এই সাজে দেখতে পেরে তৃপ্ত সে। নিলুফারের পিছু পিছু আজ যাবে না। এভাবে প্রতিদিনই নিলুফারের অগোচরে তার পিছন পিছন যেত কিন্তু আজ যাবে না। তাহলে একটু বেশিই কষ্ট পাবে সে! ফরহাদ হাঁটা ধরল ছাদের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে নিলুফারের ফিরে আসা অবদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাবে সে। সাথে এক প্যাকেট সিগারেট আছে।‌

—–

“খুব সুন্দর লাগছে আজ তোমায়!

“খোঁপায় ফুল দেখে বললে!

আবরার হেসে বলল, আমার এই ফুল দেখতে বরাবর সুন্দর! কিন্তু আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে।

নিলুফার হেসে ফেলল। শহিদ মিনারের প্রাঙ্গনে বসল দুজন।

“চাকরিটা তাহলে পেয়েই গেলে!

“হুম অবশেষে..

“তাহলে এখন থেকে তো আর বুধবার দেখা হবে না আমাদের

“হুম, তা ঠিক!

নিলুফার চাঁপা শ্বাস ফেলল। দুজনের আজ এতো কাছকাছি থাকার পরও কোথায় জানি মনে হচ্ছে দুজনে খুব দূরত্বে আছে। নিলুফার আবরারের দিকে ফিরে বলল, “কিছু কি হয়েছে?

“না কি হবে?

“তাহলে তোমাকে এমন লাগছে কেন?

“কেমন লাগছে!

“একটু অস্বাভাবিক!

আবরার হেসে বলল, চাকরি নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় আছি তো তাই।

“চিন্তা করো না। কবে থেকে যাচ্ছো।

“এই শনিবার।

“ওহ আচ্ছা। প্রথম দিন যাবার আগে আমাকে একবার টেলিফোন করো তো।

“কেন?

“এইভাবেই কথা বলব। তোমায় অল দ্যা বেস্ট বলবো!

“আচ্ছা করবো!

নিলুফার হেসে দাঁড়িয়ে বলল, চলো এক কাপ চা খেয়ে আসি!

“চলো!

দু’জনে চায়ের টং এ এসে দাঁড়াল। এক কাপ বলে তিন কাপ চা খেলো নিলুফার। আবরার এক কাপ চা খেয়ে শুধু নিলুফার কে দেখতে লাগল‌। নিলুফার চা খাবার মাঝে মাঝে মৃদু মৃদু হাসল।
আজ নিলুফারের চাহিদা অন্য দিনের তুলনায় অন্যরকম ছিল। আবরার কে টেনে মিষ্টির ভান্ডারে গেল। সেখান থেকে দই, মিষ্টি খেল। বিকালে খেল ফুচকা। পার্কে দুজন মিলে অনেকক্ষণ গল্প করল‌। বাদাম খেল। আবারার বাদামের খোসা ছাড়িয়ে নিলুফার কে দিতে লাগল আর নিলুফার একটা একটা করে বাদাম মুখে দিচ্ছে। সন্ধ্যা অবদি আবরারের হাত হাত রেখে হাঁটতে লাগল নিলুফার!

“সন্ধ্যে নেমে যাচ্ছে, বাসায় ফিরবে না।

নিলুফার আবরারের হাত শক্ত করে ধরে বলল, যেতে ইচ্ছে করছে না।

“এটা কি ধরনের কথা নিলু!

“জানি না!

“বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে।

“করতে দাও, আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো তোমার সাথে!

আবরার হেসে ফেলল। নিলুফার হেসে আবরারের কাঁধে মাথা রাখল। দু’জনেই নিঃশ্বাস ফেলছে ধীরে ধীরে! রাত্রি নেমে যাচ্ছে। টিএসসি রোড দিয়ে হাঁটছে দুজন। মাথার উপরে ল্যাম্পপোস্টের আলো। রাস্তায় মানুষজন তেমন একটা নেই। আজান একটু আগেই দিয়েছে, তাই হয়তো খালি খালি। আরেকটা গলি পেরিয়ে এখন মেইন রোড! হঠাৎ মাঝ গলিতে থেমে গেল নিলুফার। আবরার অবাক হয়ে তাকিয়ে গেল।

“থেমে গেলে যে!

“তোমার আর যেতে হবে না।

“কেন?

“আমি একাই যেতে পারবো। তুমি বরং এখান থেকেই চলে যাও।

“এই না বললে তোমাকে এগিয়ে দিতে।

“হুম বলেছিলাম, কিন্তু এখন বলছি তুমি চলে যাও। এখান থেকেই চলে যাও!

“নিলু!

নিলুফার চলে যেতে দিল। আবরার তার হাতটা ধরে নিজের দিকে ফিরাল। নিলুফারের দুচোখে অশ্রু জমে আছে। আবরার বলে উঠল, কি হয়েছে নিলু!

“তুমি চলে যাও!

“হ্যাঁ চলে তো যাবোই, কিন্তু তুমি কাঁদছো কেন?

“কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি! বড্ড ভালোবাসি তোমায়। একটা আবদার করবো, একটু জড়িয়ে ধরবে আমায়!

“নিলু!

“ধরো না!

আবরার বুকে টেনে নিল নিলুফার কে। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল নিলুফারের। খানিকক্ষণ এভাবে থাকার পর আবরার তাকে ছেড়ে দিল। হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“আজ চিঠি দিলে না আমায়!

নিলুফার হুট করেই হেসে উঠলো। বলল,

“আজ চিঠি আনে নি গো। রাগ করো না লক্ষ্মী টি। আচ্ছা তুমি কি মনে করেছিল আমি সত্যি সত্যি কাদঁছিলাম। না কাঁদি নি, একটু ভান করেছি। যাতে তুমি আমায় জড়িয়ে ধরো! দেখলে কি চালাক আমি!

আবরার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নিলুফার এবার খিলখিলিয়ে হাসল। আবরারের গালে হাত রেখে বলল, তুমি এভাবে তাকিয়ো না গো, তাহলে আমি তোমার প্রেমে মা*রা যাবো।

“সাবধানে যেও!

“হুম তুমিও যাও!

বলেই হাঁটা ধরল নিলুফার। কাঁধের ব্যাগ টা কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। পেছন ফিরে তাকাল আবরারের দিকে। আবরার দাঁড়িয়ে আছে এখনো। নিলুফার মৃদু হেসে আবারো সামনে ফিরল। কি করে বুঝাবে নিজের মন কে, আজ যে তার শেষ দেখা। এরপর আর কখনো দেখা হবে না আবরারের সাথে। এরপর আর কখনো কোন অধিকার থাকবে না আবরারের উপর। সব জানে সে সব! আবরারের মুখ দেখেই বুঝে গেছিল সব। দুটোনায় ভুগছে সে। নিলুফার নিজ থেকেই মুক্তি দিয়ে দিল তাকে। আজ আবরার সাহস করে নি। সারাটা দিন ইচ্ছে করেই ছিল আবরারের সাথে। যদি আবরার একবার মুখ ফুটে বলতো, চলো নিলুফার আজ’ই আমরা বিয়ে করে ফেলি!

নিলুফার হয়তো তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যেতো। কিন্তু আবরার তা বলেনি। খুব বড় ভুল করলো আবরার খুব বড়!

—–

মিটি মিটি পায়ে হেঁটে চলছি আমি। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। হাঁটার ক্ষমতা অবদি পাচ্ছি না। হঠাৎ সামনে তাকাতেই দূর থেকে ফরহাদ কে দেখতে পেলাম। পরণে এখনো সকালের পোশাক। খয়েরি রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। কার জন্য দাঁড়িয়ে, আমার! ভাগ্যের পরিহাস দেখে হাসি পাচ্ছে।

ফরহাদ এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি হেঁটে তার কাছে এলাম। হেসে বলে উঠি,

“কি ব্যাপার ফরহাদ সাহেব,‌এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে। আমার অপেক্ষা করছিলেন নাকি।

ফরহাদ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নিলুফারের মুখের দিকে। কেন জানি নিলুফারের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু ঠিক নেই।

“কি হয়েছে, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? দেখুন আপনার দেওয়া ফুলটা খোঁপায় গেধেছি। খুব সুন্দর লাগছে না আমায়।

ফরহাদ হেসে বলল, হুম!

নিলুফার হাসল। হেসেই বলল,‌ “জানেন ফরহাদ সাহেব,‌ আবরারের চাকরিটা হয়ে গেছে। সত্যি সত্যি হয়ে গেছে। এই খুশিতে আমি আজ হাফ কেজি মিষ্টি খেয়েছি !

ফরহাদ মৃদু হাসার চেষ্টা করল। নিলুফারের হাসি থেমে গেল। গলাও ভার ভার হয়ে যাচ্ছে। ফরহাদের থেকে চোখ সরিয়ে নিল সে। শুধু বলে উঠল,

“আপনি কষ্ট পাবেন, বুঝলেন তো ফরহাদ সাহেব। কষ্ট পাবেন!

বলেই নিলুফার হাঁটা ধরল। ফরহাদ স্থির চোখে তাকিয়ে আছে নিলুফারের চলে যাবার দিকে। নিলুফার বলল কষ্ট সে পাবে। কিন্তু মনে হলো নিলুফারের বলার মাঝে কষ্ট আছে। আচ্ছা কষ্ট কি সে পেয়েছে!

——

শনিবার ভোর বেলা! নিলুফার সারারাত ঘুমায় নি। জেগে ছিল আবরারের জন্য। আবরার ফোন করবে এটা সে জানতো। নিলুফার বেশ স্বাভাবিক ছিল এ কদিন। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া ঘুম সব’ই করেছে। কিন্তু কে বলবে তার মাঝে কতো কষ্ট লুকিয়ে আছে। টেলিফোন বেজে উঠলো। দেরি না করে তাড়াতাড়ি করে ফোন তুলল নিলুফার। কানে দিতেই ওপাশ থেকে আবরার বলল,

“নিলু!

নিলুফার হাসল। হাসির শব্দ পাচ্ছে আবরার। আবরার বলল,

“কি করছিল?

“তোমার টেলিফোনের অপেক্ষা! তৈরি হয়েছো তুমি।

“হুম, আধ ঘন্টা পর বের হবো।

“নাস্তা করেছ?

“মা বানাচ্ছে!

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিলু। আবরার বলে উঠল,

“কি হয়েছে নিলু!

“কিছু না, তোমার গলার আওয়াজ শুনতে বেশ ইচ্ছে করছে। তুমি কথা বলতে থাকো।

“বলছি তো, কিন্তু তুমি বলো তোমার কি হয়েছে? আমি জানি তোমার কিছু হয়েছে?

নিলুফার হেসে বলল, সত্যি!

“হাসির মাঝে কি আড়াল করছো?

নিলুফার থমকে গেল। চোখের কোনে অশ্রু জমছে তার। গলাও জমে যাচ্ছে তার। নিলুফার বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলল, যা আমার থেকে তুমি লুকাতে চাইছো!

আবরার চুপ হয়ে গেল। নিলুফার কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদছে। আবরারের গলা ধরে যাচ্ছে। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলল,

“নিলু!

“তোমার পরিবার মেনে নেয় নি আমায়!

“নিলু!

নিলুফার হেসে বলল, দেখলে আমি বলেছিলাম না। তোমার চাকরি টা হয়ে গেলে তুমি আর আমায় পাবে না। দেখলে কথাটা ফলে গেল।

আবরারের দম বোধহয় আটকে যাচ্ছিল। নিলুফার হাসছে। কেন হাসছে এই মেয়েটা এটাই বুঝতে পারছে না আবরার। আবরার বলে উঠল,

“নিলু আমরা বিয়েটা করে নিই। আজ আসবে তুমি আমরা বিয়ে করবো।

“এখন বলছো! তুমি জানো সেদিন আমি সারাটা দিন এই কথাটা শোনার জন্য তোমার সাথে ছিলাম।

“আমি..

“তোমার মা তার মরা মুখের কসম দিয়েছে।

ওপাশ থেকে আর কোন কথার আওয়াজ আসছে না। নিলুফার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“তোমার সাহস হয় নি আবরার। বরাবরের মতোই আমাকে নিয়ে তুমি উদাসীন। কিন্তু আমি উদাসীন ছিলাম না। বড্ড ভালোবাসি আমি তোমায়। বড্ড!

কাঁদছে নিলুফার খুব কাঁদছে। ওপাশে টেলিফোন হাতে কানে নিয়ে আবরার নিশ্চুপ। নিলুফারের কান্নার টের সে পাচ্ছে। নিজেকে এখন খুব অসহায় মনে হচ্ছে তার। নিলুফার বলতে শুরু করল,

“জানো, আমিও খুব ভিতু। কথা গুলো সামনাসামনি বলতে পারি নি তোমায়! তাই তোমাকে আজ সকালে টেলিফোন করতে বলেছি। এইই আমাদের শেষ কথা। খবরদার বলছি আর কখনো ফোন করবে না আমায়, কখনো না!

“কি বলছো তুমি এসব! তুমি না বলেছিলে অল দ্যা বেস্ট জানাবে আমায়।

“জানাচ্ছি তো, তোমার জীবনের নতুন অধ্যায়ে। দেখো খুব সুখী হবে তুমি। অনেক ভালোবাসবে সে তোমায়!

“নিলু থামো তুমি

“দুটোনায় ভুগো না আবরার! আমি নিজ থেকে মুক্তি দিয়ে দিলাম তোমায়। তুমি চাও নি তবুও দিলাম। কি করবে বলো, মা বাবা ছেড়ে আমার কাছে চলে আসলে তো আর হবে না। জীবনে এদেরও অনেক দরকার আছে।

আবরার চুপ হয়ে নিলুর কথা শুনছে। নিলু কান্না থামিয়ে এবার বড় শ্বাস নিল। হেসে বলল, তা কি পড়েছ আজ। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট! বড় বাবু লাগছে বুঝি তোমায় আজ।

“নিলু এমন করো না।

“করতে হয় আবরার। করতে হয়। আচ্ছা নাম কি তার, কখনো বললে না তো। সে কি দেখতে খুব সুন্দরী।

“আমার নিলু সবচেয়ে সুন্দরী!

নিলুফার হাসছে, খিলখিলিয়ে হাসছে। হঠাৎ করেই সেই হাসি থেমে গেল। নিলুফার বলে উঠল, অল দ্যা বেস্ট তোমায়।

“টেলিফোন রেখো না।

“না আজ তোমার কথা হবে না। শোন আমার শেষ আবদার টা রেখো। আমার দেওয়া সব চিঠি খুব যত্ন করে রাখবে তুমি। আমার সাথে কাটানো সব মুহুর্তে খুব করে মনে রাখবে, পারবে না!

“….

“আবরার, আমি ভালোবাসি তোমায়। বড্ড ভালোবাসি! ভালো থেকো। খরবদার বলছি আর কখনো ফোন করবে না এখানে। খুব খারাপ হবে তখন। খুব!

আবরার কিছুই বলতে পারছে না। কথা বলার শক্তিটা বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে সে। এই মনে হচ্ছে নিলুফার এখন’ই হেসে বলবে, আহ! এসব কিছু সত্যি ভাবলে নাকি তুমি। আমি তো সব মজা করেছি। খুব বোকা তুমি আবরার। খুব! লক্ষ্মী টি রাগ করো না! হি হি হি! আবারো সেই হাসির শব্দ।
নিলুফার হাসছে। হেসেই বলছে,
“শেষবারের মতো বলবে না আমায় ভালোবাসো তুমি, কি হলো বলো!

আবরারের গলা কাঁপছে। নিলুফার খুব আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে। আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে নিল তখন’ই লাইন কেটে গেল। নিলুফার ফোন কেটে দিয়েছে। থমকে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল আবরার। নিলুফার ফোন রেখে দৌড়ে ঘরে ঢুকল। আজ কাঁদবে সে, খুব কাঁদবে। এই কয়েকদিনের জমিয়ে থাকা চাপা কষ্ট, অভিমান আর ঝড়বে তার অশ্রুর সাথে। ঘরের কোনে মুখে হাত দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে নিলুফার। অনেক জোরে জোরে কাঁদার চেষ্টা করছে কিন্তু মুখে হাত দেবার কারণে সেই কান্নার শব্দ দরজা ভেদ করে বাইরে যাচ্ছে না। ঘরের কোনের মাঝেই সেই চাপা কষ্ট বন্দি হয়ে গেল!

#চলবে….

[ রি চেক করা হয়নি, ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইল ]

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| দ্বাদশ পর্ব |

পূর্ণা গ্রামে চলে এলো আজ দুদিন। তিহাশ কে দেখার অজুহাতেই হুমাশা’র বাড়িতে যাওয়া। সেখান থেকে আবরারের বাড়িতে। আবরারের সাথে তার বিয়ের কথাটা সে জানত। আবরার না বলে দিয়েছে সেটাও জানত। তবুও তার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছিল তার। এই মায়ার টানেই আবারো তার কাছে ফেরা!

আবরার কে বরাবরই ভালো লাগতো কিন্তু কখনো বলা হয়ে উঠেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল পূর্ণা! আচারের বাটি হাতে বাগানের কাছে গেল। সেখানে বড় গাছটার সাথে একটা বিশাল দোলনা ঝুলানো। সেখানে বসেই দোল খেতে লাগল সে। মনে পড়ছে আবরার কে! কেন তার প্রতি এতো মায়া আজ অবদি সেটা বুঝতে পারল না! আবরারের বাড়িতে আবরার তাকে অবহেলা করেছে প্রতি নিয়ত তবুও তার কাছে তার ছুটে যাওয়া বেহায়াপনা মনে হয় নি! কিন্তু কেন? আবরার আর তার মায়ের কথা আড়াল থেকে শুনেছিল সে। আড়িপাতা ভালো না, তবুও কিছু কথা শোনার জন্য তার মন ব্যাকুল ছিল। কথা গুলো এমন ছিল, আবরারের মা বলছিলেন —

“তুই পূর্ণা কে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যা‌। মেয়েটা বড্ড, ভালো, লক্ষ্মীমন্তর মেয়ে! বিয়ে করে সুখে থাকবি। দেখলি না বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই রাখতেই তোর চাকরি টা কেমন হয়ে গেল।

“মা বন্ধ করো তো তোমার এসব কথা, এটা শুধুমাত্র কুসংস্কার আর কিছু না!

“সে যাই হোক, পূর্ণা মেয়েটা খারাপ কোথায় বল তুই।

“বলছি না সে খারাপ। খুব ভালো মেয়ে!

“এমন একটা ভালো মেয়ে আমার ছেলের বউ হবার যোগ্য।

“এটা যোগ্যতার কথা না মা, আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই!

তখন’ই রোহানা বেগমের গলায় কেমন তিক্ততা এসে জড়ো হলো বলে মনে হলো। তিনি বোধহয় রেগে গেছেন। হুট করেই বলে উঠেন,

“বিয়ে করতে চাইলেই কি হবে নাকি। দেখি মেয়ের নাম বল, কি করে তার বাপ। বংশপরিচয় কি দেখতে হবে না। এভাবে তো আর বিয়ে হয়ে যাবে না। পূর্ণার বাবা’র দুটো মেয়ে। একটার বিয়ে হয়ে গেছে আর রইল এই পূর্ণা! কোন অভাব আছে তাঁদের শুনেছিস। গ্রামের বাড়িতে কতো বড় বাড়ি। সেটার ভাগিদার পূর্ণা আর তার বোন ছাড়া কে হবে বলতে পারিস ‌

“মা! আমার দরকার নেই এসব বাড়ি ঘরের। যাকে আমি বিয়ে করতে চাই তার হয়তো এতো কিছু নেই , যা আছে সামান্য। তবুও তাকেই বিয়ে করতে চাই।

“এই দিনটার জন্য আমি বেঁচে ছিলাম। শেষমেষ ছেলের মুখে এই কথা শুনবো বলে ‌

“মা দয়া করো। তুমি এখন শুরু করে দিয়ো না!

“কেন শুরু করবো না। আমার ছেলের বিয়ে,
শখ আহ্লাদ কি থাকবে না আমার। তার উপর আমাদের কমতি কোথায়? শোন আবরার ওই মেয়েকে বিয়ে করলে আনলে আমি কিন্তু ঘরে উঠাবো না।

“উঠানো লাগবে না তোমার, আমিই চলে যাবো!

বলেই আবরার বের হতে নিল। তখন ভেতর থেকে রোহানা বেগমের গলা শোনা গেল!

“তাহলে সেটাই কর তুই। কিন্তু মনে রাখিস এরপর আমি বিষ খেয়ে ম*রে যাবো। আমার ম*রা মুখে মাটি দিতে আসিস না!

আবরার কিছু বলে না। রেগে হন হন করে বের হয়ে যায়। তখন’ই বাইরে পূর্ণা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু কিছু বলে না সে। পূর্ণার পাশ দিয়ে চলে যায় সে। পূর্ণার তখন ইচ্ছে করছিল গলায় দ*ড়ি দিতে। ছিঃ! শেষমেষ নিজে নিজেই এলো সে অপমান হতে! না আর না, সেদিন বিকেল বেলায় চলে এলো সেই বাড়ি থেকে। আর কখনো ফিরবে না সেই বাড়িতে!

ঠিক দু’দিন পর তার বাড়িতে হইচই লেগে গেল। তার বোন, আবরারের বোন হুমাশা সবাই হুট করেই এসে হাজির। তখনো সে কিছুই বুঝতে পারে নি। অতঃপর যখন তাকে সাজানো হচ্ছিল তখন বুঝল তাকে দেখতে আসছে। কিন্তু কারা? আবরার! নাম নিতেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম! এরকম আরো কয়েকবার হয়েছে কিন্তু কেন এমন হয় আজ অবদি বুঝল না সে!

তাকে আজ হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি পড়ানো হয়েছে। হাত অবদি কাঁচের চুড়ি, কানে দুল! সবকিছুই হুমাশা পড়িয়ে দিচ্ছে‌। আয়নায় নিজেকে দেখছে পূর্ণা! হুমাশা তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করছে কারা এসেছে!

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পূর্ণা কে এনে হাজির করা হলো পাত্র পক্ষের সামনে। চোখ তুলে তাকাল পূর্ণা! আবরার মুখটাই দেখতে পেল সে। সাথে সাথেই তার চোখ স্থির হয়ে থাকল তার দিকে। রোহানা বেগম পূর্ণাকে বসালেন তার পাশে। কথা বলাবলি শুরু হলো। এতো লোকের মাঝেও পূর্ণার চঞ্চল চোখজোড়া বার বার আবরার কে দেখছে। এদিকে আবরার নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।‌ তার চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে ঘরের কোনের দিকে। কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই তার।‌ শুধু বার বার মনে পড়ছে নিলুফারের কথা। ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে চলে যেতে। কিন্তু পারছে না। হঠাৎ করেই তার ঘাড়ে হাত রাখল কেউ। আবরারের বোধ হলো। পাত্র আর পাত্রিকে আলাদা ভাবে কথা বলা দরকার বলছে সবাই!

পূর্ণার ঘরে বেতের চেয়ারে বসা আবরার! পূর্ণা বিছানার কোনে বসা। প্রায় অনেকক্ষণ হয়ে গেল কেউই কিছু বলছে না। আবরার হালকা কাশল। পূর্ণা বলে উঠল,

“আপনার কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করতে পারেন?

“কিছু জিজ্ঞেস করার নেই আমার!

“তবে আমার আছে!

আবরার মুখ তুলে তাকাল পূর্ণার দিকে। পূর্ণা সহজ সরল গলায় বলল,
“আপনি না অন্য একজন কে বিয়ে করতে চেয়ে ছিলেন নাহলে আমাকে কেন দেখতে এলেন!

“আমার মায়ের কারণে!

“পরিবারের জন্য ভালোবাসাকে বিসর্জন দিলেন। সে জানে আপনি এসেছেন এখানে!

“হুম!

পূর্ণা হাসল। দাঁড়িয়ে বলল, আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই আমার। আপনি চাইলে আসতে পারেন।

আবরার উঠে দাঁড়াল। পূর্ণার দিকে ফিরে বলল, “বিয়ে টা কি তুমি ভেঙে দিতে চাইছো!

পূর্ণা হাসল। পূর্ণার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলবে না। আবরার দাঁড়াল না। হেঁটে চলে এলো। আপাতত সেদিন সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে বলে তাদের বিদায় করা হলো। আবরারের মনে হচ্ছিল পূর্ণা হয়তো বিয়েতে রাজি না। কারণ পূর্ণা জানে আবরার অন্য কাউকে ভালোবাসে। টেলিফোন হাতে নিয়ে কয়েক বার নাম্বার ডায়াল করে রেখে দিয়েছে আবরার। ফোন করেনি, কোথায় যেনো আটকে যাচ্ছিল সবকিছু। মনে হচ্ছে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে!

আবরার কে চমকে দিয়ে পূর্ণা রাজি হলো বিয়েতে। আবরার শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। কিছুই বলল না সে! কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছিল তখন। কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আজ পর্যন্ত নিজেকে এরকম নিরুপায় কখনো মনে হয় নি তার। এদিকে বিয়ের খুশিতে রোহানা বেগম তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে!

——

চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিল তিতির! আজ এক সপ্তাহ হতে চলল ইরার দেখা পায় নি সে। সেদিনের পর দেখা হয় নি বললে চলে। আয়াত তার কাঁধে হাত রেখে বলল,

“কার কথা ভাবছিস? ইরার!

“ওর কথা কেন ভাবতে যাবো।

“মিথ্যে কেন বলছিস? তোর মুখ দেখেই সবকিছু বোঝা যাচ্ছে।

তিতির ফিরে তাকাল আয়াতের দিকে‌। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপ শেষ করল সে। আয়াত বলে উঠল,

“বাঁধা টা কোথায়?

“পার্থক্যের! আমাদের অবস্থা ওদের মতো নয়। বাড়ি ভাড়ার টাকা আর দোকানের ভাড়া টাকায় কোনমতে দিন চলে যাচ্ছ আর ওরা..

বলেই হাসল তিতির। আয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই বোধহয় একটু বেশিই ভাবছিস!

“বাস্তব’ই ভাবছি!

“দেখ! এখনো অনেকদিন পরে আছে। সবকিছু বদলে যেতে পারে।

তিতির হেসে উঠে দাঁড়াল। আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে বদলাক। তখন বোধহয় ভাববো এসব নিয়ে!

অতঃপর তার পথের দিকে হাঁটা ধরল সে!

#চলবে….

[ ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইল ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে