প্রেমকুঞ্জ পর্ব-৭+৮

0
717

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| সপ্তম পর্ব |

ইরা ঘন্টা খানিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার এপারে। পরনে শাড়ি টা কে ঠিক করছে বার বার। আকাশের কাঠফাটা রোদ কমে গিয়ে এখন একটু ছায়ার দেখা পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। ইরা’র হচ্ছে করছে নদীর ঘাটে গিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকতে। তিতির কে আজ বলবে, আমাকে নিয়ে একটু নদীর ঘাটে চলো না। দু’জনে মিলে নদীর জলে পা চুবাবো। যদি নৌকা থাকে তাহলে বেশ হবে। দু’জনে মিলে একটু নৌকাতেও চড়া যাবে! কিন্তু এসব তার শুধুই কল্পনা। তিতির কখনোই তার সাথে যেতে রাজি হবে না। কেন জানি সবসময় এড়িয়ে যেতে চায় সে! চাঁপা শ্বাস ফেলে সামনে তাকাল ইরা! তিতির আসছে! ইরা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। তিতির আজ পাঞ্জাবি পড়েছে। বাদামী রঙের একটা পাঞ্জাবি যদিও তিতির কে কখনো পাঞ্জাবি পড়া দেখে নি সে। খানিকটা অবাক হলো। পাঞ্জাবি পড়ার বিশেষ কোন কারণ কি ছিল আজ? কি হতে পারে সেটা? কোন মেয়ে! যদি মেয়ে হয় তাহলে সেটা ইরা না এটাতে সে শতভাগ নিশ্চিত। কারণ তিতির জানে না ইরা আজ এখানে আসবে কিন্তু ইরা জানত তিতির এখানে আসবে। তার মন বলছিল তিতির আসবে। তাই তাড়াহুড়ো করে শাড়ি পড়ে ছুটে এসেছে সে!
ইরা কে দেখে মুচকি হাসল তিতির। ইরার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল‌। তিতির কাছে এসে বলল,

“তুই এখানে?

“এভাবেই এলাম কিন্তু তুই?

“একটা কাজে এসেছি!

“পাঞ্জাবি পড়েছিস, বিশেষ কোন দিন আজ!

“না বিশেষ কোন দিন না। মা আমার সব শার্ট গুলো একসাথে ধুয়ে দিয়েছে তাই বাধ্য হয়ে পাঞ্জাবি পড়েছি। কেন খারাপ লাগছে খুব!

“না বেশ মানিয়েছে!

“তোকেও সুন্দর লাগছে!

ইরা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মনে হলো তার এখানে আসা সার্থক হয়েছে। তিতির বলে উঠল, আচ্ছা আমি যাই কেমন?

“কোথায় যাবি?

“এই একটু নদীর ধারে, কেন?

“আমিও যাবো!

“তুই যাবি কেন?

“এমনেই!

“এমনেই কেউ যায়?

“তাহলে তুই কেন যাচ্ছিস, কোন কাজ আছে নাকি তার!

“না কোন কাজ নেই, ইচ্ছে করছে শুধু একটু গিয়ে নদীর ধারে বসে থাকতে।

“আমারও ইচ্ছে করছে চল!

তিতিরের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে ইরা। মনটা হঠাৎ করেই বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল মনে হলো। তার প্রতিটি ইচ্ছা পূরণ করছে। ইশ! যদি আজ অন্য কিছু চাইতো তাহলে বোধহয় সেটাই পেতো! আফসোস হচ্ছে এখন..

——–

প্রতিদিন একবার করে গোলাপ ফুলটা দেখে শ্রেয়া। ফুলটা সে কেন এখানে রেখেছে জানে না কিন্তু তার কাছে ফুলটা খুব ভালো লেগেছে। বিশেষ ভাবে ভালো লাগার কারণ ছিল এই প্রথম তাকে কেউ ফুল দিলো এটা ভেবেই। কখনো ভাবতে পারে নি কোন ছেলে তাকে ফুল দিবে। ফুলটার প্রতি খুব সাবধানতা অবলম্বন করছে শ্রেয়া। কেউ যাতে ফুল দেখে না ফেলে সেই ব্যাপারে বিশেষ সর্তক সে। সেদিন তো তিতির ভাই দেখেই ফেলেছিল। ভারি ভারি গলায় জিজ্ঞেস করল, ফুলটা কোথায় পেলি শ্রেয়া!

শ্রেয়ার তো মনে হলো শ্বাস বুঝি এবার বন্ধ হয়ে যাবে। কথা বলতে গিয়েও তোতলাতে লাগলো। তবুও ভয়ে ভয়ে বলল, রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি ভাইয়া!

“যা রাস্তায় পাবি তাই’কি আনতে হবে নাকি। আর এনে রাখলি তো কোথায় বইয়ের ভেতর। বলি তোর কি কান্ডজ্ঞান জীবনে হবে না।

“ফুলটা সুন্দর ছিল বলে..

“কোন ফুল অসুন্দর বল তো! এসব ঢং রেখে এবার পড়তে বস। পরিক্ষায় এবার খারাপ করলে পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রাখবো ‌

শ্রেয়া মাথা নেড়ে পড়তে বসল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো সে ভুলেই গেছে কিভাবে পড়তে হয়!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইয়ের পাতা বন্ধ করে দিল শ্রেয়া। মাথা রাখল টেবিলের উপর। তার মনে হচ্ছে তার দ্বারা আর পড়ালেখা হবে। কোন কিছুতেই মন নেই তার! পড়ালেখায় তার মন না বসলে এখানে তার দোষ কি? স্কুলের স্যার ম্যামরা খুব কথা শোনায় যখন পড়া না পারে। অতঃপর কিছুক্ষণ পর বলে, হ্যাঁ তাই তো পড়ালেখা শিখে কি হবে। শেষ তো রান্না ঘরে গিয়ে বাসন’ই মাজতে হবে। তা সেটা কি এখন থেকেই শিখে রেখেছ নাকি!

সবাই তখন জোরে হাসাহাসি করে তাকে নিয়ে। শ্রেয়ার খুব লজ্জা করতো। মাথা নিচু করে কলম আঁকড়ে ধরতো সে। খুব কান্না পেতে। ইচ্ছে করতো জোরে জোরে কাঁদতে। কিন্তু তাও করতে পারতো না সে। মাথা নিচু করেই বসে থাকতো পুরো ক্লাসে!

মামুন কে আজও দেখতে পেয়েছে সে। কি কুৎসিত ভাবে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল সে। সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না শ্রেয়ার। তবুও দূর থেকে দাঁড়িয়ে মামুন কে দেখে যাচ্ছিল সে। মামুন তার দিকে ফিরতেই তড়িখড়ি করে হেঁটে চলে এলো সে। গলির ভেতর ঢুকে গিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার বুক ধক ধক করছে। কিন্তু কেন ভয়ে নাকি খুব জোরে হেঁটে এসেছে তাই। শ্রেয়া উঁকি মারলো সেই রাস্তা দিয়ে। মামুন তার পিছনে পিছনে আসছে কি না সেটাই দেখছে সে। না আসে নি। কারণ কি? এখন আর আগের মতো ছেলেরা তাকে বাজে কথা বলে না। তাকে দেখলেই মাথা নিচু করে নেয়। কারণটা এখনো অজানা শ্রেয়ার কাছে। তবে তারা সবাই ভালো হয়ে গেছে!

——-

আমার মা এবার অসাধ্য সাধন করেছে এটা বলা যেতেই পারে। হুম সে এবার আমাদের নিচ তলা ভাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। তাও কোন পরিবার কে না একটা ব্যাচেলর ছেলেকে। এটা শুনেই যেন আমার চক্ষু চড়কগাছ! কিভাবে করল মা এ কাজ! শুধু আমি অবাক না, বাবা, তিতির,শ্রেয়া এমনকি ঊষা অবদি অবাক। রান্না ঘর থেকে উঁকি মেরে তাকিয়ে কথা শুনছিল সে। মা এক ধমক দিতেই দৌড়ে গেল রান্না ঘরে। বাবা শান্ত গলায় বলল, কাজটা কি ঠিক হলো?

“ভালো খারাপের তুমি কি বুঝ!

“না তা বলছি না, বাইরের লোকে কি বলবে!

“লোকে আবার কি বলবে? একদিন না খেয়ে থাকলে কি ওরা এসে ভাত দিয়ে যাবে।কই তা তো দেবে না। এখন যদি ভাতের বদলে দু একটা কথা শোনায় তাহলে তা শুনে হজম করে নিয়ে।

“ব্যাচেলর ছেলে, ভাড়া ঠিক মতো পাবে।

“সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তিন মাসের ভাড়া এডভান্স নিয়ে রেখেছি!

“ওহ আচ্ছা ভালো করেছ!

মা চোখ রাঙিয়ে তাকালেন।

তিতির হেসে বলল, একদম ঠিক বলেছ মা। ভালোই করেছো এখন আমিও একটা মানুষ পাবো যার কাছে কথা বলে খানিকটা সময় পার করা যাবে!

মা শ্রেয়ার মুখের দিকে তাকালেন। শ্রেয়া মাথা নিচু করে নিল। মা কর্কশ গলায় বললেন, পড়তে বসেছিলি!

শ্রেয়া মাথা নাড়ল! মা বললেন, উদ্ধার করেছিস।

শ্রেয়া হাত পা গুটিয়ে নিল। বাবা বলে উঠেন, কি করছো তুমি? ওর উপর রাগ দেখাচ্ছ কেন?

“রাগ দেখাচ্ছি না। আমার রাগের দাম তোমরা কে দাও বলো তো। এতো করে বললাম ব্যবসা করো না। এটা তোমাকে দিয়ে হয় না। কই তবুও তো এটাই করো তুমি। আর দুদিন পর পর লোকসান হলে ঘরে বসে থাকো। তিনটে ছেলে মেয়ে আছে আমাদের। তাদের কথা কখনো ভেবেছ? খাওয়াতে পড়াতে হবে সেই চিন্তা আছে। মেয়ে বড় হচ্ছে এখন অবদি কি বিয়ের কথা বলেছে! আমার ভাই একটা সম্বন্ধ আনলো, নাকোচ করে দিলে তুমি। কি মেয়েকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেবে বলে ভেবে রেখেছ নাকি। মেয়েকে রেখে দিলে তখন কি বাইরের মানুষ কিছু বলবে না তোমায়?

“আহ চুপ করো তো!

“কেন? গায়ে ফোস্কা পড়লো নাকি।‌ সত্যি কথা হলো বলছি না এখন তো ফোস্কা পড়বেই!

মা তর্ক শুরু করে দিলেন বাবা’র সাথে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। রান্না ঘরে এসে হাত বাড়াতে থাকি ঊষা’র সাথে। ঊষা ফিসফিস করে বলে, খালার কি মাথাটা গেছে নাকি আফা!

“কেন, কি করল আবার তোর খাল!

“কি করে নাই কও? চিনে না জানে না একটা পোলারে ঘরে আইসা চা খাওয়ালো!

“তো কি হয়েছে?

“তুমি জানো ওই পোলায় তোমাগো বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিছে।

“ওহ এতো ভালো।

“ভালো না ভালো না। আফা হুনো, পোলায় অনেক বড় একটা গাড়ি লইয়া আইছিলো। হের মানে পোলা অনেক টাকা পয়সা। এই পোলা তোমাগো এই হানে বাড়ি ভাড়া কেন নিবো। নিশ্চিত কোন ধান্দা আছে ‌, বুঝলা!

“বুঝলাম! তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস। অনেক কিছু ভাবতে লিখেছিস। কিন্তু তোর এতো কিছু নিয়ে চিন্তা করা লাগবো না।

“আরেকটা কথা তুমি জানো।

“বল শুনি!

“পোলা এক কাপ চা খাওয়ার পর আরেককাপ চাও খেতে চাইছে। বলতাছে তোমার হাতের চা অনেক ভালো।

“ভালো তো, তোর চায়ের প্রশংসা করল। সত্যিই তো তুই চা টা ভালো করিস!

“না গো আফা মতলব আছে আমি কইলাম। পোলা ধান্দা বাজ!

ঊষার কথা শুনে হেসে দিলাম। ঊষা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি হাসো!

“কই না তো! বলার পরও আবারো হেসে দিলাম। ঊষা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল!

আজ মাসের ১ তারিখ! নতুন ভাড়াটিয়া আসার কথা। সকাল বেলা গোসল করার পর ছাদে এসে কাপড় শুকাতে দিলাম। নিচ থেকে গাড়ির আওয়াজ পেলাম তখন। ছাদের গ্রিলে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখি নতুন ভাড়াটিয়া’র জিনিসপত্র! মা বলল ব্যাচেলর কিন্তু জিনিসপত্র দেখে মনে হচ্ছে একটা গোটা ফ্যামিলি থাকবে এখানে। হঠাৎ রিক্সা করে দুজন ছেলে নামল। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। একে খানিকটা ফরহাদের মতো লাগছে! লাগছে না এটা সত্যি ফরহাদ!

নিলুফারের বাড়ির সামনে এসে রিক্সা থামল। ফরহাদ বের হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সিদ্ধান্তটা ঠিক কি না জানে না তবুও মনে হচ্ছে এটাই ঠিক। মনের কোনে এক ধরণের শান্তি অনুভব করছে সে! জানে নিলুফার তাকে ভালোবাসে না তার প্রেমিক আছে তবুও তাকে এক দন্ড দেখার যে তৃষ্ণা, তা মেটাতে এখানে আসতে হলো তাকে। আজকের সকালের আকাশ টা অনেক সুন্দর! নীলুফার কি বের হয়ে গেছে নাকি! কি জানি? শরীর টাকে তরতাজা করতে বুক করে শ্বাস নিল ফরহাদ। আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্বাস নিতেই চোখ দুটো আটকে গেল আর। ছাদের উপর থেকে নিলুর মুখখানা দেখে তৃপ্তি পেল সে!

#চলবে….

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| অষ্টম পর্ব |

“আমি তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই তিতির!

তিতির মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে বসে আছে ইরা আর তিতির! নদীর পানি বয়ে যাচ্ছে বাতাসের সাথে সাথে! এই নিয়ে পর পর তিন দিন দুজনে একসাথে এলো এখানে। বাতাসের শো শো শোনা যাচ্ছে। ইরা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে। তিতির আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরাও তিতিরের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। পরিষ্কার নীল আকাশ, না আছে রোদ্দুর আর না মেঘ। নীল এই আকাশ দেখলে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে। আজ দু’জনেই কলেজে না গিয়ে এখানে এসেছে। আগে থেকে কোন চিন্তা ভাবনা ছিল না‌। তিতির যেই রাস্তা দিয়ে কলেজ যাবার কথা ইরা আগে থেকেই সেখানে বসা ছিল। অতঃপর ইরা একবার জিজ্ঞেস করতেই তিতির চলে এলো। না করল না, ঘন্টার পর ঘন্টার এখানে বসে থাকতেও বিরক্ত লাগে না তার!

অনেকক্ষণ পরেও ইরার কোন কথা শুনতে না পেয়ে তিতির ফিরল ইরার দিকে। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে আছে ইরা। তিতির হালকা কেশে বলল, “কি জানি বলবি বলছিলি!

“হুহ!

“তো বল?

ইরা হাসল! তিতিরের দিকে মুখ ফিরে বলল, নিউ মার্কেট যাবি আমার সাথে!

“কেন?

“মার্কেটে কেন যায় মানুষ!

“তোরা মেয়ে মানুষ এতো সব কি কিনিস বল তো।

“তোরা ছেলে মানুষ, শুধু কিনিস তো নিজের জন্য। মাঝে মধ্যে সেটাও কিনিস না। সব কিছুতেই তোদের আলসেমি আর আমরা মেয়েরা! আমরা সবার কথা ভাবি! সবার জন্য আমাদের কিনতে হয়। মা, বাবা, ভাই আর..

“আর!

“প্রিয় মানুষ!

তিতির শব্দ করল হাসল। হাত দুটো মাটিতে রেখে ইরার দিকে ফিরে বলল, ভালোই বললি। সবকিছু তোরা কিনিস, সবার জন্য ভাবিস কিন্তু কেনার জন্য যেই টাকার দরকার তা জোগাড় করিস কোথা থেকে!

ইরা হাসল। জবাব দিল না। তিতির উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল! দুপুর গড়িয়ে গেছে। তোর আবার তো মার্কেটে যেতে হবে। এরপর না হলে দেরি হয়ে যাবে।

ইরা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নে উঠা আমাকে!

“নিজে উঠ!

“তিতির মানুষ আমি, মেয়ে মানুষ। আমাকে ধরলে পুড়ে যাবি না বরং.. ( বলেই মিটিমিটি হাসতে লাগলো )

তিতির ভ্রু কুঁচকালো। “হাসছিস কেন?

“আমার হাসি অনেক সুন্দর তাই তোকে দেখাচ্ছি, দেখ আমার হাসি!

অতঃপর খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। তিতির সত্যি ইরার হাসির দিকে তাকিয়ে রইল। হাসির শব্দটা কানে বাজছে। ভালো লাগছে তিতিরের। কিন্তু এই ভালো লাগা ক্ষণিকের জন্য। মুহুর্তে ইরার হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলল, নে উঠিয়ে দিলাম!

“আহ আস্তে, মেরে ফেলবি নাকি।

“যা বাবা, হাত ধরলেও দোষ না ধরলেও দোষ।

“ঠিক বলেছিস, মেয়েদের হাত এমন একটা জিনিস যা ধরলে সারাজীবন ছেলেদের পস্তাতে হবে আর না ধরলেও পস্তাতে হবে, হি হি!

“রাখ তো বচন!

“আরে বচন না সত্যি!

“আচ্ছা তখন আর্ধেক কথা বলে থেমে গেলি কেন?

“কখন?

“ওই যে কথা বলে মিটি মিটি হাসতে লাগলি!

“মেয়ে মানুষের হাত ধরলে পুড়ি যাবি না বরং, এইটা!

“হুম , এই বরং এর পর কি?

ইরা আবারো মুখ টিপে হাসলো। তিতিরের কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, বরং প্রেমে পড়ে যাবি!

তিতির চোখ বাকিয়ে তাকাল। ইরা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, এর মানে হলো আর বেশি সময় নেই। তুইও আমার প্রেমে পড়বি বুঝলি তিতির!

তিতির ইরার কথার পাত্তা দিল না। হন হন করে হেঁটে চলে গেল। ইরা কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে তিতিরের পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, থাম তিতির, আর থাম না!

তিতির থামে না, নিজের মতো করে হেঁটে চলে যেতে থাকে। হঠাৎ করেই ইরা এসে তিতিরের হাত শক্ত করে ধরে। তিতির চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিতে চায়। ইরা তখন শক্ত করে ধরে বলে, আরে ভয় পাস না। আমি তখন তোর সাথে মজা করেছিলাম। হাত ধরলেই বুঝি প্রেম হয়ে যায়। এসব কথা বিশ্বাস করিস নাকি তুই। তিতির তুই কিন্তু খুব ভিতু! এই ভয়ে আমার হাত ধরতে চাইছিস না।

“তোর পাগলামি বন্ধ করবি!

“আচ্ছা যা বন্ধ করলাম। কিন্তু তুই বল প্রেমে পড়া কি এতো সহজ নাকি। এই যে আমি তোর হাত ধরলাম তোর মনে কি অস্থিরতা চলছে বল!

“মানে..

“আমি জানতাম তুই বুঝবি না, এসব প্রেম ভালোবাসা তোকে নিয়ে হবে না। প্রেমে পড়া এতো সহজ না বুঝলি। যার প্রেমে পড়বি সারাক্ষণ শুধু তাকে নিয়েই ভাববি। সে থাকবে তোর স্বপ্নে। তোর পুরো মস্তিষ্ক ভর করে থাকবে পুরো পেত্নির মতো! তবুও তোর বার বার মন চাইবে এই পেত্নির সাথে থাকতে।

অতঃপর শব্দ করে হেসে হাত সরিয়ে ফেলে ইরা। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে, চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। কেনাকাটা করতে হবে আমাদের।

পা বাড়িয়ে এগিয়ে যায় ইরা। তিতির সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের দিকে তাকায়। এখনো ইরার হাতের অনুভূতি হচ্ছে তার। ইরা তার পাশাপাশি থাকলেই অস্থিরতা অনুভব করে সে। একা থাকলেই ইরার কথা মনে পড়ে। কিন্তু এসব কথা ইরা কে বলবে না সে কখনো না!

ইরার মন খারাপ, আজও সেই কথাটা বলতে পারল না তিতির কে। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হবার আগে ভেবে আসে আজ বলবে আজ বলবে কিন্তু এই আজ আজ করতে করতেই দিন পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কথাটা বলা হচ্ছে না। আদৌও কি বলতে পারবে কি না জানে না। আচ্ছা তিতির’র কি তার মনের কথা কখনো বুঝবে না। বোধহয় না কারণ মনের কথা বুঝতে হলে মনের মাঝে তাকে রাখতে হয়। আর তিতিরের মনের মাঝে হাজারো চিন্তা, এসবের এক কোনে তার ঠাঁই হবে বলে মনে হচ্ছে না!

——

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। এতোক্ষণে বোধহয় ঘর গোছানো শেষ। শেষ হবার’ই কথা, সাথে এতোজন বন্ধু আনলো সবাই মিলে হাতে হাতে কাজ করলে তো কাজ শেষ হয়েই যাবে! মা আমার দরজায় কড়া নেড়ে বলল, নিলু আছিস!

“হুম বলো!

“ভার্সিটিতে গেলি না যে শরীর খারাপ নাকি।

“যেতে ইচ্ছে করছে না তাই যায় নি, তুমি কিছু বলবে।

“হুম, জানিস নিচে গিয়েছিলাম।

“ওহ ভালো তো।

“ছেলেটাকে দেখে ভালোই মনে হচ্ছে। বন্ধুগুলো হাতে হাত লাগিয়ে কাজ সব শেষ করে ফেলেছে।

“মা, তোমার মনে হয় না এই ছেলেটাকে বাড়ি ভাড়া দিয়ে তুমি ভুল করেছ। দেখেছ আজ কতো বন্ধু নিয়ে এসেছে। রোজ আসবে না তার গ্যারান্টি কি?

মা হেসে বলেন, না না। আমি আগে থেকেই বলে দিয়েছি বেশি ছেলেদের যেন আমার বাড়ির মধ্যে দেখতে না পাই। আর আজ তো কাজের জন্য’ই এসেছে। অকাজের কিছু নেই!

“আচ্ছা!

“যাই আমি গিয়ে রান্না ঘরে ঢুকি, ঊষা কে বলেছিলাম কাটাকুটনি গুলো করে রাখতে। মেয়েটা করেছে কি না কে জানে!

অতঃপর মা রান্না ঘরে চলে গেলেন। আমি বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে সামনে বইটা রাখলাম। মা কে মিথ্যে বলেছি, শরীর খারাপ বলে ভার্সিটিতে যায় নি। ভার্সিটিতে যায় নি ফরহাদের জন্য। উনি হঠাৎ করে আমার বাসায় ভাড়া নিতে এলেন কেন আমার জানা খুব দরকার! এই চিন্তার কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছি না। অদ্ভুত একটা লোক বটে, আসতে না আসতেই আমাকে ঘরবন্দি করে দিল!

বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছি, পড়তে ইচ্ছে করছে না কিছুই! হঠাৎ একটা কাগজের টুকরো চোখে পড়লো আমার। কিসের কাগজ এটা? কাগজের ভাজ খুলতেই মনে পড়ল এটা আবরার জন্য লেখা! সেদিন আমি আর ফরহাদ হাঁটতে বের হয়েছিলাম। সেটাই লিখেছিলাম এই কাগজে। কিন্তু আবরার কে আর দেওয়া হয় নি। না, আমি ইচ্ছে করেই দিই নি। বেচারা কষ্ট পাবে এটা ভেবে আর দিই নি!

কি মনে করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম! জানাল দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলাম আজকের আকাশটা অনেক সুন্দর! ভালো লাগছে এই সুন্দর আকাশ দেখতে। খোলা জানালায় বসে আকাশ দেখতে ভালো লাগে কিন্তু মাঝে মধ্যে মনে হয় খাঁচায় বন্দী পাখির মতো। তাই আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাদে উঠলাম। পরণে শাড়ি, ভার্সিটিতে যাবো ভেবে পড়েছিলাম কিন্তু আর যাওয়া হয় নি।

গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি। নিচে তাকাতেই দেখি শ্রেয়া আসছে। আমি ডাক দিলাম,

“শ্রেয়া!

শ্রেয়া মাথা তুলে উপরের দিকে তাকাতেই হাত দিয়ে ইশারা করলাম। শ্রেয়া হয়তো একটু অবাক হলো, অতঃপর দৌড়ে ছাদে উঠে এলো।

“আপা, তুমি আজ ভার্সিটি যাও নি!

“না যেতে ইচ্ছে করে নি।

“কেন শরীর খারাপ নাকি!

“হুম,একটু। তোর পড়াশোনা কেমন চলছে বল।

“ভালো আপা।

“মা খুব বকে না তোকে।

“শুধু মা না ভাইয়া ও বকে।

“আমি তিতির কে বলে দিবো যেন তোকে না বকে!

শ্রেয়া নিলুর দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। নীলু হাসছে! নিলুফার কে দেখলে হিংসে হয় তার। আপা তার থেকে সুন্দর, কিন্তু কেন? সেও তো চাইলে আপার থেকে সুন্দর হতে পারত তাই নয় কি! খুব খারাপ লাগে যখন নিলু আর নিজেকে একসাথে দেখে।

শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, কি ভাবছিস?

“তুমি এতো সুন্দর কেন আপা!

“সুন্দর হওয়ায় শখ এতো বেশি তোর।

“যে যত বেশি সুন্দর সবাই তাকে তত বেশি ভালোবাসে।

“না রে এই কথা ভুল! যে যত বেশি সুন্দর তার কপালে দুঃখ বেশি। অভাগী সে! এটা তুই এখন বুঝবি না, যখন বড় হবি তখন বুঝবি!

“আমি এবার মেট্রিক দেবো।

“মেট্রিক দিলেই কেউ বড় হয়ে যায় না। আচ্ছা শ্রেয়া আচার খাবি।

“এখন, এই ভর দুপুরে।

“আচার যখন ইচ্ছে তখন খাওয়া যায়। তুই ঘরে গিয়ে কাপড় ছেড়ে বাটিতে করে আচার নিয়ে আয়। গত বছর না মা আমের আচার দিয়েছিল।

“ঝাল আচার খাবে।

“হুম নিয়ে আসিস যা!

শ্রেয়া দৌড়ে চলে গেল। আবার খুব তাড়াতাড়ি ফিরেও এলো। তার হাতে দুটো আচারের বাটি। একটাতে আমের মোরব্বা আর একটাতে ঝাল আচার। আমি ঝাল আচারের বাটি টা হাতে নিলাম। গ্রিলে হাত রেখে চা খাচ্ছি আর নিচে মানুষের যাওয়া আসা দেখছি!
বাড়ির নিচ থেকে খুব জোরে জোরে কথাবার্তা আসছে। ফরহাদ আর তার বন্ধুরা বের হচ্ছে। সবাই কি খেতে বার হচ্ছে নাকি। একজনের কাছে বিরিয়ানি’র কথা শুনলাম বলে মনে হলো!

হঠাৎ করেই একজন তাকাল উপরের দিকে। আমাকে দেখতে পেয়ে ফরহাদের ঘাড়ে হাত রেখে ইশারা করল। ফরহাদ উপরের দিক আমাকে দেখে অবাক হলো। বাকি সবাই শুকনো ঢোক গিলল। মুখ শুকিয়ে গেছে তাদের। মুখের হাল দেখে হাসি পাচ্ছে। এদের কে পুলিশি হাজতে পাঠিয়েছিলাম। তারা মেহমানদারি পায় নি, কিন্তু না পেয়েই এই হাল! ফরহাদ কে রেখে একে একে সবাই চলে গেল‌। ফরহাদের বোধ অনেকক্ষণ পর হলো। শ্রেয়া কে আমার পাশে দেখতে পেয়ে সোজা হেঁটে চলে গেছে। মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছে বেচারা। শ্রেয়া উঁকি ঝুঁকি মেরে বলল, কারা এরা আপা!

“আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া!

“মা তো বলল একজন কে ভাড়া দিয়েছে। কিন্তু এখানে তো এক দল!

“আরে বোকা, এরা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে।

“ওহ আচ্ছা কুলি!

“বেশ বলেছিস!

শ্রেয়া আর আমি জোরে হেসে দিলাম!

—–

কেনাকাটা শেষে রাস্তায় ফুটপাতে হাঁটছে দুজন! ইরার হাতে দুটো প্যাকেট! একটাতে তুতে রঙের ছাপার শাড়ি আরেকটাতে কালো রঙের পাঞ্জাবি! তিতির প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কি আজ তাহলে তোর প্রিয় মানুষটার জন্য কেনাকাটা করলি!

ইরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তিতির হেসে সামনের দিকে তাকাল। এর মানে তার ভাবনা ভুল ছিল। প্রিয় মানুষটি সে না অন্য কেউ। যাই হোক ভালোই হয়েছে! তিতির মেইন রাস্তায় এসে ইরার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে ইরা কে বাসে উঠিয়ে দিয়ে যাবে সে। প্রত্যেক বার’ই এই কাজটা করে সে!

ইরা তাকিয়ে দেখল দূর থেকে বাস আসছে। তিতিরকে ডেকে তার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বাসের কাছে দৌড়ে গেল সে। তিতির অবাক হাতে দাঁড়িয়ে রইল। বাসে চড়ে তিতিরের দিকে ফিরল সে। তিতির প্যাকেট হাতে এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই প্যাকটি ছিল প্রিয় মানুষটার জন্য! তবে এটা তাকে দিয়ে গেল কেন? ইরার প্রিয় মানুষটি তাহলে কে!

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে