প্রেমকুঞ্জ পর্ব-৫+৬

0
677

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫

আমাকে অবাক করে দিয়ে ফরহাদ পরদিন এসে ঠিক’ই উপস্থিত হলো। কিন্তু আজ মনে হয় অনেক আগেই চলে এসেছে। ভার্সিটিতে যাবার পথে দেখা পেলাম তার। মুখের হাল দেখে বোঝা যাচ্ছে সারা রাত বেচারার ঘুম হয় নি। হবে কি করে, কাল যা বললাম এতে মনে হয় এরপর আর কখনো শান্তিতে ঘুমাতে পারবে বেচারা! ফরহাদ ঠিক আমার সামনে দাঁড়ানো। গতকালের পাঞ্জাবি এখনো তার পরণে! তার থেকে সিগারেটের বিশ্রি গন্ধ ভেসে আসছে। সারারাত কি তবে সিগারেট খেয়ে কাটিয়ে দিল নাকি। কে জানে?

“আপনি এখন যে?

“…

“কথা বলছেন না কেন?

“পত্র টা কি পড়েছিলেন!

“প্রেমপত্র!

ফরহাদ মাথা নিচু করে নিল। নিলুফার মুখ টিপে হাসল। বলে উঠল, “বলছি, তার আগে বাসায় গিয়ে গোসল করে আসুন!

“কেন?

“আপনার গা থেকে সিগারেটের বিশ্রি গন্ধ আসছে। সিগারেট’র গন্ধ আমার একদম সহ্য হয় না। দয়া করে আপনি আমার থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ান। আমার মাথা ঘুরছে!

ফরহাদ দ্রুত সরে দাঁড়াল। ইশ! এতোটা বোকামি কিভাবে করল সে। নিলুফার পাশ দিয়ে চলে যেতে নিল। অতঃপর পিছন ফিরে বলল, ক্লাস শেষ করে এসে কথা বলছি। আপনি বাসায় গিয়ে ততোক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আসুন।

নিলুফার যেতেই ফরহাদ নিজের গা নিজে শুকল! ছিঃ কি বিচ্ছিরি গন্ধ। এতোদিন তো এটা খেয়াল করে নি। নাকি নিলুফার বলায় আজ প্রথম বার তার কাছে এটা বিচ্ছিরি গন্ধ বলে মনে হল!

——-

ফরহাদের আসতে আসতে অনেক সময় লাগল। চুল গুলো শ্যাম্পুও করায় বোধহয় দেরি হয়ে গেল। বাইক নিয়ে কাছে আসতেই দেখল নিলুফার সেই গাছটার নিচে দাঁড়ানো। ক্ষণিকের জন্য তার মনে হলো এটা কল্পনা! নাকি সত্যি নিলুফার অপেক্ষা করছে তার জন্য। সত্যি কি তাই!

ফরহাদ এসে বাইক থামাল। আমি তার দিকে ফিরলাম। হুম এখন অনেকটাই পরিপাটি লাগছে দেখতে!

“বাইক এখানে রেখেই আমার সাথে চলুন!

“কোথায়?

“হাঁটতে, হাঁটতে ইচ্ছে করছে অনেক! যাবেন।

ফরহাদ বাইক সেই গাছের নিচে রেখেই আমার সাথে পা বাড়াল। টিএসসি রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুজন এসে পৌঁছালাম শহিদ মিনারের কাছে। আমি বসে পড়ি সিঁড়ির কাছে। ফরহাদ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় ভাবছে, বসবে কি বসবে না।

“শুনুন!

ফরহাদ কেঁপে উঠে। কেমন এক শিহরণ বয়ে গেল তার শরীর দিয়ে। ঢোক গিলে তাকাল নিলুফারের দিকে!

“হুম!

“পানির তৃষ্ণা পেয়েছে, একটু পানি আনবেন!

“আনছি!

অতঃপর ফরহাদ চলে গেল। খানিকক্ষণ পর ফিরেও এলো। সাথে নিয়ে এলো পানির বোতল আর কাঁটা শসা। রাস্তায় বিক্রি হচ্ছিল বোধহয়। এসেই আমার কাছে বাড়িয়ে দেয়। একটু দূরত্ব রেখে বসে পড়ে আমার পাশে। আমি বসে একা একাই শসা খেতে থাকি। একটিবারের জন্যও তাকে জিজ্ঞাসা করলাম না। করি নি বেশ করেছি! পানি খেয়ে ফরহাদের দিকে ফিরে বলি,

“বুঝলেন আমি কিন্তু খুব স্বার্থপর!

“কেন?

“এই যে আপনাকে একটিবার জিজ্ঞাসা না করে একা একা খেয়ে ফেললাম সব!

“কিন্তু আমি আপনার জন্য’ই এনেছিলাম।

আমি হাসলাম। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বলে উঠি,
“তবুও আমি স্বার্থপর! নিজের স্বার্থের জন্য আরেকটা কাজ করেছি আমি।

ফরহাদ অবাক চোখে তাকাল আমার দিকে। আমি বলি,
“আজ কি বার বলুন তো!

“বুধবার!

“প্রতি সপ্তাহে আমি আর ও এই একটা দিনে দেখা করি। আজও সেইদিন! আমি ভেবেছিলাম আজ ও আসবে কিন্তু এলো না দেখলেন। ভেবেছিলাম যদি আসে তাহলে আপনাকে আর আমাকে একসাথে বসে থাকতে দেখে ও কষ্ট পাবে। তাই আপনাকে এখানে এনে বসিয়ে রেখেছি! বুঝলেন তো!

ফরহাদ হাসল। আমি একটু অবাক হলাম। ফরহাদ নিজ থেকে বলল, আপনি কষ্ট পেতেন না!

“তা না হয় পেতাম। কেন? আমি কষ্ট পেলে বুঝি আপনি কষ্ট পেতেন!

“চা খাবেন!

পাল্টা প্রশ্ন করলাম না। মাথা নাড়িয়ে বললাম, হুম!

ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। আমার দিকে ফিরে বলল, উঠুন। এখানে বসে চা খেয়ে মজা নেই। টং এ বসে চা খেলে চায়ের আসল স্বাদ পাওয়া যায়!

আমি উঠে দাঁড়ালাম‌। আবারো হাঁটতে লাগলাম দুজন। চা খেলাম। ফরহাদ কথা বলল অনেক কথা কিন্তু তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। শুধু মজার কিছু কথা, বন্ধুদের সাথে কাটানো কথা। যা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার মতো। অতঃপর দুজনে আবারো পা বাড়ালাম। এবার ফিরার সময়। আমি সামনের দিকে ফিরে বলি,
“আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় আজ আসবেন না!

ফরহাদের দিকে ফিরে দেখি তিনি হাসছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কেন এলেন?

“জানি না।

চুপ হয়ে গেলাম। দুজনে রাস্তার মোড় পেরিয়ে গলি তে ঢুকলাম। বাইকের কাছাকাছি আসতেই ফরহাদ বলল, আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু আমি জানি এই সাজ টা আমার জন্য না। তবুও কোন ভাবে এর ভাগ টুকু পেলাম আমি!

চাপা শ্বাস ফেললাম। ফরহাদের দিকে ফিরে বলি, দুঃখিত!

“পত্র টা কি ফেলে দিয়েছিলেন!

“বিশ্বাস করুন হারিয়ে ফেলেছি। কিভাবে যে হারিয়ে ফেললাম জানি না।

“থাক কোন ব্যাপার না!

“আপনি দয়া করে আরেকটা পত্র লিখে দেবেন আমায়, আমি কথা দিচ্ছি সেটা আমি পড়ব!

“চেষ্টা করব কথা গুলো মুখে বলার!

আমি তাকে বিদায় দিয়ে চলে এলাম। পেছন ফিরে তাকালাম না আর। কিন্তু আমি জানি ফরহাদ নিশ্চিত অপেক্ষা করছে আমার। তার কোনভাবে মনে হচ্ছে আমি পেছন ফিরে চাইবো!

——-

টেলিফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আচ্ছা সে কি আজও ফোন করবে না। একটিবারের জন্য ফোন করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে তার। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শ্রেয়ার ঘরের দিক পা বাড়িয়েছি। মেয়েটা কাঁদছে! মা আজও বকেছে অনেক। তার টিচার নাকি আজ মা কে ডেকে শ্রেয়ার পড়াশোনার কথা বলেছে। এরপর ঘরে কুরুক্ষেত্র লেগে গেল!

গত তিন দিন হলো ঘর থেকে বের হওয়া ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর ইচ্ছে করে না ঘর থেকে বের থেকে। বাড়ির পরিবেশ অবশ্য তেমন একটা ভালো না। বাবা’র ব্যবসায় লোকসান টা আবারো হয়েছে। আবহাওয়া কেমন গরম গরম লাগছে। মা এবার ঠিক’ই করে ফেলল বাড়ির নিচতলা ভাড়া দিবে। ও হ্যাঁ বলা হয় নি, আমার মা বাড়ি ভাড়া দেবার কারণ খানা। মা’র মনে হয় বাড়ি ভাড়া দিলে কিছু ফূর্তি বাজ ছেলেদের আড্ডা খানা হয়ে যাবে। তার মধ্যে ঘরে দুটো শেয়ানা মেয়ে আর একটা ছেলে‌। এই নিয়ে তার ভয়ের চিন্তা নেই। যদি ভাড়াটিয়া ভালো না হয় তাহলে আরেক সমস্যা! এযুগে তেমন ভালো মানুষ পাওয়ায় যাচ্ছে না।

এই তো সেদিন একটা ভাড়াটিয়া এলো। তার সাথে এলো তার একটা মেয়ে। আমার মা’র তো মেয়ে দেখেই মাথায় হাত! সুন্দরী বলে তা না মেয়ের হাবভাব মোটেও তার কাছে ভালো লাগে নি। তিতির যতবার বসার ঘরে মেয়ে টা ঢ্যাবঢ্যাব করে তার দিকেই তাকিয়ে রইল। এর মাঝেই সবার সামনে তিতির কে জিজ্ঞেস করে বসল, আপনার নাম কি?

ব্যস যা হবার হয়ে গেল। আমার মা তো ভুলেও এই এদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিবে না। বাড়ি ভাড়ার নোটিশ ঝোলানোর পর কয়েকটা ছেলে এসেও খোঁজ নিয়ে গেল। এরপর আর মা’র অবস্থা, মানে করুণ অবস্থা!

রাত ৮ টা বাজে, বাবা নামাজে গেছে অনেকক্ষণ! এখন হয়তো বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। শ্রেয়ার ঘর থেকে পড়ার আওয়াজ আসছে। তিতির পড়াচ্ছে তাকে, খুব জোরে জোরে শব্দ করে পড়ছে। কি একটা বাংলা পড়া মুখস্থ করছে সে। আমি দাঁড়িয়ে আছি ঊষা’র সামনে। মেয়েটা চায়ের কাপ হাতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঊষা’র উচিত পড়াশোনা করা। আমার বাবা চেষ্টা কম করে নি। কিন্তু ঊষা’র নিজের’ই এতে মত নেই। ঊষা’র চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে। তাকিয়ে থাকলে দেখতেই ইচ্ছে করে। ঘন বড় চুল গুলো দুটো বেনী করে ঝুলিয়ে রাখে সে!

“কি হইলো আফা, চা লন!

“নিচ্ছি, তোর খবর কি বলতো?

“আমার আবার কিসের খবর?

ওর কথা শুনলে কেন জানি আমার খুব হাসি পায়! চায়ের কাপটা নিয়ে মুখে দিলাম। চা টা খুব ভালো বানায় ঊষা। একদম পারফেক্ট! হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠলো। ঊষা কে বললাম, যা ফোন টা ধর তো!

ঊষা দৌড়ে এসে ফোন ধরে বলল, হ্যালো কেডা, কারে চান?

আমি মুখ টিপে হাসছি! ওপাশ থেকে কি কথা হলো জানি না। ঊষা শুধু আমার দিকে ঘুরে বলল, আফা আপনার কথা কয়?

আমি কাছে এসে ওর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বলি, যা নিয়ে যা এটা!

কোন কথা না বলে ঊষা চায়ের কাপ নিয়ে গেল। ফোন কানের কাছে ধরে চুপ হয়ে আছি। ওপাশ থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। আমি আবার আবরারের নিশ্বাস খুব ভালো চিনি। নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলাম,

“কেমন আছো?

“ভালো, তোমার খবর বলো!

“আমার আবার খবর?

“রেগে আছো?

“না আমি রাগ করার কে বলোতো!

“দেখা করো না কাল!

“কেন?

“খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমায়!

“আচ্ছা যাও দেখা করবো!

“জানো আমি..

“কোন কথা বলো না দয়া করে একটু চুপ থাকো!

“কেন?

“জানি না, শুধু ফোন কানে গুঁজে চুপ থাকো। আমি তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনবো।

“নিলু আই’ম সরি, প্লিজ কেঁদো না!

“আরেকটা কথা বললে আমি ফোন রেখে দেবো বলে দিলাম।

“কাল নীল রঙের শাড়ি টা পড়ে এসো। আর কোন কথা বলবো না কথা দিলাম! একদম চুপ আমি।

আমি চুপ হয়ে গেলাম। দুই হাত দিয়ে ফোন কানে গুঁজে আছি। নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছি। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু পারছি না। খানিকক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোন কথা না বলে শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি। বোঝাতে পারব না আমি তাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি। আবরার বোঝে না আমার ভালোবাসা। সবসময় সে উদাসীন। সবকিছুতে। কিভাবে পারে এতোটা শান্ত থাকতে। ওপাশ থেকে আবরার বলে উঠল, আর কেঁদো না এবার থামো!

সাথে সাথেই ফোন রেখে দিলাম‌। বললাম তো কথা বলতে না, কেন বললো। রেখে দিলাম ফোন। শান্তি হয়েছে তো এখন। দৌড়ে এসে নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। মনের ক্ষতটা এখন কিছুটা হলেও কম বলে মনে হচ্ছে!

—–

ফরহাদ আজ দাঁড়িয়ে আছে নিলুফারের বাড়ির সামনে। আগে কখনো এই বাড়ির এতোটা ধারে কাছে আসে নি। বাড়িটা অবশ্য চিনতো! কিন্তু কয়েকদিন ধরে নিলুফারের দেখা না পেয়ে চিন্তিত সে। সুস্থ আছো তো নিলু! কিছু হয়নি তো আবার! চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু সাহস হচ্ছে না কিছু করার। কি’ই বা করবে সে। তবে নিলুফারের কাটানো দিন টা আজীবন মনে থাকবে। এই মধুর মুহুর্ত গুলো নিয়ে সারাজীবন থাকতে পারবে সে…

#চলবে….

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৬

কথা মতো নীল রঙের শাড়ি পড়েছি আজ। মাথার চুল গুলো সুন্দর করে আঁচড়ে নিলাম। চোখে গাঢ় কাজল টেনে, শেষে ছোট একটা টিপ দিলাম। কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে বের হলাম। ঘর থেকে বের হতেই রিক্সায় উঠলাম। খুব ইচ্ছে করছে আজ আরবার সাথে রিক্সায় চড়তে। দেখা হলে বলবো, চলো আমাকে নিয়ে রিক্সায় চড়ো। একসাথে খানিকক্ষণ ঘুরি দুজন! আশপাশ তাকিয়ে দেখছি। নিজেকে দেখছি বারবার। এটা প্রথম সাক্ষাৎ নয় তবুও যেন মনে হচ্ছে এটাই তার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ।

ভার্সিটি যাবার পথে ফরহাদ কে দেখতে পাই নি। তবে আজ আর ক্লাস করলাম না। ভার্সিটির কাছে যেতেই পেছন থেকে ডাকল আবরার। তার ডাক শুনে ছুটে এলাম আমি। দৃষ্টিপল্লব স্থির আমার! মনে হচ্ছে আজ কতো বছর আবরার কে দেখছি। আবরার কিঞ্চিত হেসে বলল, চলো!

আমার চোখের কোনে অশ্রু জল জল করছে। আবরার হাঁটছে, তার পাশে পাশে হাঁটছি। হঠাৎ করেই হাত খানা ধরল আবরার। আমাকে নিয়ে বসল শহীদ মিনারের প্রাঙ্গনে!

“কেমন আছো?

“যেমন রেখে গেছিলে!

“রাগ করো না, তিহাশ হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেল। তাকে নিয়েই দৌড়াদৌড়ি করে অবস্থা খারাপ!

“এক মাস বুঝি দৌড়াদৌড়ি করলে!

“না, মোটেও না। কিন্তু আমার কথা এখনো বাকি ছিল। হঠাৎ করেই হুমাশা’র ননদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ছেলে নাকি বিদেশে থাকে। জলদি বিয়ে করে বউ কে সাথে করে নিয়ে যাবে। আর তুমি তো জানোই দুলাভাই এখানে ছিল না। তাই তাকে নিয়ে গেলাম আবার সেখানে। গ্রাম গঞ্জের এলাকা। কিন্তু আমার জানামতে তাদের বাসায় টেলিফোন ছিল। তবে কপাল খারাপ ছিল কারণ..

“টেলিফোন খারাপ ছিল!

“হুম!

“চিঠি লিখলে খুব বেশি কি ক্ষতি হতো তোমার।

“সময় হয় নি!

“তুমি বরাবরই এমন করো। আমার জন্য আদৌও কখনো সময় আছে তোমার।

আবরার হেসে উঠলো।এক দৃষ্টিতে তার হাসির দিকে তাকিয়ে আছি। হাসিটা বরাবরই সুন্দর। আবরার বলল, “একটা খুশির খবর আছে!

“সরকারি চাকরি হয়ে গেছে তোমার।

“না এবার হয়েই যাবে। ইন্টারভিউ দিয়েছি খুব ভালো। দুলাভাই ও এবার সাহায্য করছে।

“বাহ বেশ ভালো তো।

“ভালো বলেই ভালো। শহরে এসেই এই ইন্টারভিউ নিয়ে খুব খাটা খাটুনি করতে হয়েছে।

“বুঝতে পেরেছি।

“নিলু আর রাগ করো না। তুমি জানো রাগ করলে তোমাকে..

“কুৎসিত লাগে কি তাই তো!

“না আরো বেশি সুন্দর লাগে। তোমার নাক খানা যখন লাল টকটকে হয়ে যায় তোমার চেহারার সৌন্দর্য মনে হয় বেড়ে যায়।

“তাই কাঁদিয়ে এই সৌন্দর্য উপভোগ করো তুমি!

আবরার আবারো হাসল। নিলুফারের হাত ধরে বলল, তা যা বলেছে! কিন্তু একটা কথা কি জানো, সুন্দর জিনিস বেশি দেখতে নেই। তাহলে তার সৌন্দর্যের দাম থাকে না।

“…

“কাঁদতে কাঁদতে মনে হচ্ছে সর্দি বসিয়ে ফেলেছ! ( কপালে হাত রেখে ) দেখো আজ তোমার জ্বর আসবে। যাবার আগে তোমাকে এক পাতা প্যারাসিটামল কিনে দেবো কি!

“লাগবে না। আমি চাই আমি একটু অসুস্থ হই তখন যদি আমার কথা তোমার একটু মনে থাকে!

জোরে জোরে হাসল আবরার! “বাহ বেশ ভালো বুদ্ধি তো। তা চিঠি আনো নি!

আমি মাথা নেড়ে না না করি। আবরার কাঁধের ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, আমি জানি ব্যাগ আজ চিঠিতে ভরপুর!

“অভিমানী চিঠি সব!

“তোমার অভিমানী চিঠি পড়তে আমার বেশ লাগে।

“বোকা বোকা কথা লিখা আছে সবকিছুতে!

“থাক না আমি সেগুলোই পড়বো!

মৃদু হেসে কতো গুলো চিঠি বের করল আবরার। গুনে গুনে দেখল ৭ টা চিঠি। আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল, এতো কম কেন?

“এবার কম লিখছি!

“মিথ্যে বলছো!

আমি হাসলাম। ব্যাগ হাতে নিয়ে বলি, ওগুলোর কথা গোছানো না ছিল না তাই আনি নি!

আবরার চিঠি গুলো যত্নে হাতে নিল। এগুলো রেখে দিবে সে। আগের চিঠি গুলোও রেখে দিয়েছে আমি জানি। আমার সব কিছুই যত্নে রেখে দেয়। কিন্তু আমাকে একটু যত্নে করে না!

সারাদিন দুজনে ঘুরলাম। দুপুরের সময় এক কাপ চা আর ফুচকা খেলাম। যদিও আবরার সাধল একটা ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার জন্য তবুও আমার ইচ্ছে হলো না। পড়ন্ত বিকেলে আবরার আর আমি রিক্সায় চড়লাম। রিক্সা এসে থামল পার্কের সামনে। আমি আর আবারার বসে আছি এক বেঞ্চিতে। আশেপাশে আরো অনেক প্রেমিক প্রেমিকা! সবাই করছে গল্প গুজব। আমরাও করছি। আবরার তার ইন্টারভিউ সম্পর্কে বলছে আমাকে। আজ সারাদিন’ই আবরার কথা বলেছে আর আমি শুনেছি। ওর কথা শুনতে সবসময় ভালো লাগে। কিন্তু আজকে কেন জানি ওর কথা শোনার পর কিছুটা মন খারাপ করলাম। কারণ ওর কথার মাঝে ছিল এক মেয়ের প্রসঙ্গ!

হুমাশা’র শশুড় বাড়িতে এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে নাকি তার। হুমাশার বড় ঝা’র বোন সে। আবরার মা’র ও নাকি অনেক পছন্দ। বিয়ের কথাও চলেছিল তবে আবরার নিষেধ করে দিয়েছে। আবরার বলছে গল্প এখানেই শেষ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে না। গল্প এখানেই শুরু, এতো তাড়াতাড়ি সবকিছু শেষ হবে না। কিছু একটা তো হবেই!

“চাকরি টা পেয়ে গেলেই বাড়িতে আমি তোমার কথা বলবো! তুমি কি শুনতে পারছো আমার কথা নিলু!

“উহু!

“কি ভাবছো এতো মন দিয়ে?

“ভাবছি একটা কথা!

“কি?

“তোমার চাকরির কথা!

আবরার অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি সহজ গলায় বললাম, তোমার চাকরি হয়ে গেলে আমার আর তোমার বিয়েটা বোধহয় আর হবে না!

“নিলু!

“বড্ড দেরি হয়ে গেল। চলো এখন বাড়িতে ফেরা যাক!

অতঃপর উঠে দাঁড়ালাম!

——

শ্রেয়া স্কুল শেষে বাড়িতে ফিরছে। চুল গুলো দুটো বেনী করা। মা চুলে তেল দিয়ে বেনী করে দিয়েছে। মাথা নিচু করে হাঁটছে শ্রেয়া। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে পা থেমে গেল তার। মুখ ফিরিয়ে চাইলো বাম পাশের চায়ের দোকানে। ছেলে গুলো আজ আসে নি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল শ্রেয়া। দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতে লাগল। কয়েকদিন ধরেই কিছু ছেলে বিরক্ত করছে তাকে। প্রতিদিন এখান দিয়ে যেতে নিলেই তাকে নিয়ে বিভ্রান্ত কিন্তু উক্তি করে। শ্রেয়া আজ অবদি জবাব দেয় নি এসবের। আজ ছেলে গুলো আসে নি দেখে ভালোই লাগছে।

শ্রেয়ার পছন্দ লম্বা ছিল। এর কারণ সে একটু বাটু! তার বান্ধবী কানিজের ভাই টা কিন্তু অনেক লম্বা। খুব ভালো লাগে তাকে দেখতে। দেখতেও খুব সুন্দর! মাঝে মাঝে কানিজ কে দিতে স্কুলে আসে। আবার নিয়েও যায়! গতকাল যাবার পথে দেখা হয়েছিল। কানিজের ভাই তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছো শ্রেয়া? পড়ালেখার কি খবর!

শ্রেয়া মাথা নেড়ে জবাব দিল ভালো। হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেল। শ্রেয়ার খুব বলতে ইচ্ছে করল, ভাইয়া আপনি এতো লম্বা কেন? আপনি জানেন লম্বা ছেলে আমার খুব পছন্দ! কিন্তু বলা হলো না। তার কথা শুনেই লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেল!

বাড়ির কাছে সরু গলিতে ঢুকতেই মুখ মোচড় দিয়ে উঠল শ্রেয়ার। দুই হাত দিয়ে কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরল। তার সামনে দাঁড়ানো মামুন! মামুন আর ওর বন্ধুরা মিলেই উত্যক্ত করতো শ্রেয়া কে। আজ একেবারে বাড়ির কাছে দেখেই শ্রেয়ার গলা শুকিয়ে যেতে লাগলো। মামুনের হাতে লাল একটা গোলাপ। মা’র কথা মনে পড়ছে। তিনি বলতেন, কোন ছেলে কিছু বললে তাকে জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে এসে পড়বে। যা বলার বাসায় এসে আমাকে বলবে। শ্রেয়াও তাই করল। মাথা নিচু করে গলির পাশ দিয়ে যেতে নিল। তবে শেষ রক্ষা হলো না।
মামুন এসে তার সামনেই দাঁড়াল। ভয়ে তার আত্মা কেঁপে উঠলো। কি হবে এখন যদি তিতির ভাই এখান দিয়ে যায়। এখন’ই তার বাসায় যাবার সময়। যদি এই ছেলের সাথে দেখে নেয় রক্ষা থাকতে না। শ্রেয়া পা বাড়াল পাশ দিয়ে যাবার জন্য। তখনই মামুন দিল এক ধমক। কেঁপে উঠলো শ্রেয়া। মামুন তার চেয়ে বড় তবে তিতিরের চেয়ে ছোট’ই হবে বলে মনে হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে গোলাপ দিল শ্রেয়ার হাতে। শুরুতে ধরছে না বলে ধার গলায় বলল,

“ধরো এটা!

শ্রেয়া কাঁপা কাঁপা হাতে ধরে নিল। মামুন কিছু না বলেই পাশ দিয়ে চলে গেল। মামুনের নামে অনেক কথা শুনেছে সে। এলাকার কেউই তাকে ভালো বলে না। সারাদিন বাজে ছেলেদের সাথে তার আড্ডা! শ্রেয়ার ভয় এ কারণেই বেশি। গোলাপ টা হাতে মুঠ করে নিল। মায়ের কথা সে শুনেছে। কিছু বলে নি ছেলে টাকে। কিন্তু বাসায় এসে ফুল দেবার কথাটা মা কে বলতে সাহস জোগাল না শ্রেয়ার। তার বাংলা বইয়ের ভেতর রেখে দিল ফুলটা!

#চলবে….

[ রি চেক করা হয়নি। ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইল! ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে