প্রাপ্তির শহরে পর্ব-০৪ সিজন ০২

0
777

#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব-০৪
#তাহরীমা

তাহু মন খারাপ করে বসে থাকে।আদ্র তাহুকে কল দেয়।তাহু কল রিসিভ করে সালাম দেয়।আদ্র সালাম নিয়ে বলে,
–“অসুস্থ লাগছে আমার বউটার?”

‘বউ’ ব্যস এই একটা শব্দ শুনেছে আর কি লাগে মন ভাল করার জন্য?
তাহু বলে–“উহু,মাথাব্যথা।”

আদ্র তখন ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“ইসস আমি পাশে থাকলে এখন মাথা টিপে দিতে পারতাম!”
–“বলেছেন এতেই মাথাব্যথা চলে গেছে।”
–“কি?বলাতেই মাথাব্যথা চলে গেলো?”

তাহু নিঃশব্দে হাসে।
–“আচ্ছা আপনি কিভাবে জানলেন, আমার অসুস্থ লাগছে সেটা?”
–“আম্মু কল করেছিলো অভিযোগ করার জন্য।”

তাহু তখন বলে,
–“আমি হয়ত ভালবাসায় কমতি করেছি তাইতো অভিযোগ করার সুযোগ পেয়েছেন।আপনি আমাকে বকবেন না?”

আদ্র মুচকি হাসে।এই বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে আদ্র কি করবে?
–“আমার বউকে আমি বিশ্বাস করি।তার মায়াবি মুখের দিকে তাকালেই আমার বেহুশ হয়ে পড়ে যেতে মন চায়।আর বকাঝকা তো অনেক দূর।”
–“আমি কি পচাঁ?তাহলে আম্মু আপনাকে অভিযোগ করলো কেন?”

আদ্র ছোট করে বলে,
–“তাহু।সব মানুষের মন মানসিকতা এক নয়।আমাদেরকে সেটা মানিয়ে নিতে হবে।আম্মু অভিযোগ করেছে করুক গে আমি তো তোমাকে কিছু বলিনি।আমি জানি আমার বউ ভালো।”

তাহু তখন ছোট করে বলে,
–“আপনি আমাকে এত ভালবাসেন?”
–“হ্যা অনেক ভালবাসি।এখন শুয়ে থাকো।আম্মুকে আমি বুঝিয়ে বলেছি।”

তাহু হাসে।
–“আপনার সাথে কথা বলে মাথাব্যথা চলে গেছে।যাই চা করে নিই সবার জন্য।”
–“আর আমার চা?”

তাহু হাসতে হাসতে কল কেটে দেয়,এই একটা মানুষের জন্য সে পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলতে রাজি ।তাহু চা বানিয়ে সকলের জন্য নিয়ে আসে।

সবাই আসলে ও তাহুর শশুড় আসেনা।উনার নাকি পায়ে ব্যাথা করছে।
সবার চা খাওয়া শেষ হলে তাহু শশুড়ের কাছে যায়।
–“আব্বু”
–“আয়।”
–“পা ব্যথা করছে নাকি।আমি টিপে দিতে এসেছি।”
–“না না দরকার নেই।”
–“কেন দরকার নেই।আমি না আপনার মেয়ে?”
–“যে আসল মেয়ে সে খুজ নিতে আসেনা।আর তুই তো?”
–“তার মানে আমি নকল মেয়ে?”

তাহুর গাল অব্ব করতে দেখে আদ্রর বাবা হাসে।
–“তুই আমার আদরের মেয়ে।”

তাহু খুশি হয়।আদ্রর বাবার পা টিপে দেয়।
আদ্রর বাবা না বলে আর পারলেন না।
–“তোর হাতে জাদু আছে রে।পা ব্যথা সেরে গেছে।অনেক সুখী হ রে মা।অনেক সুখী হ।”

আবেগী হয়ে আদ্রর বাবার চোখ ছলছল করে উঠলো।আদ্রর মা তখন বলল,
–“শুধু শশুড়ের সেবা করলে হবে?আমার গুলো কই?”
–“আপনার কোথায় কষ্ট হচ্ছে আম্মু আমায় বলুন না?”
–“মাথা আছড়ে দে?”

তাহু খুশিমনে মাথা আছড়ে দিলো।তাহু চলে গেলে আদ্রর বাবা বলে,
–“বউ কাজ করলে,সেবা করতে যতক্ষন পারবে ততক্ষন ভাল,নইলে খারাপ তাইনা?মেয়েটা সরল বলেই তোমার মত শাশুড়ির সেবা করতে আসে।”

আদ্রর মা রাগি কন্ঠে বলে,
–“বেশি বলে ফেলছো না?”
–“বেশি আর জীবনে কই বললাম।আজ যদি বলতাম।আমার মা ও তোমার সেবা পেয়ে থাকত।যদি ও আমার মা বেশিদিন বেচে ছিলেন না।”

আদ্রর বাবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
_________

তাহুর পরীক্ষা চলছে।নিয়ে যাওয়া আসা সব দেবর ই করবে।পরীক্ষা শুরুর আগে তাহুকে আকাশ দিয়ে আসে।আবার পরীক্ষার শেষে নিয়ে আসে।
.
আজকে ও পরীক্ষা আছে।পরীক্ষার শেষে আকাশ তাহুকে নিতে যায়।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে তাহু একটা ছেলের সাথে হাত মেলাচ্ছে।আকাশের মনে মনে সন্দেহ হতে লাগলো।তারপর আবার তাহু হেসে হেসে কথা বলছে।নেকাবের আড়ালে ও তাহুর হাসিমুখ আকাশের বোধগম্য হলো।
.
আকাশ কাছে যেতেই ছেলেটি আল্লাহ হাফেজ বলে চলে গেলো।তাহুকে আকাশ কিছু না বলে চলে আসলো।

বাসায় এসে আকাশ ভাবলো কথাটা মাকে বলবে,কি বলবে না।তারপর ভাবলো ভাইকে বলা দরকার।আদ্রকে কল করে।

আদ্র কল রিসিভ করলেই আকাশ সব জানায়।
আদ্র প্রথমে এসব বিশ্বাস করেনা।তাহু কেন অযতা ছেলের সাথে কথা বলবে,হাত ধরাধরি করবে?

তারপর আকাশের সন্দেহ যখন এতই,তখন আদ্র বলে,

–“দেখ আকাশ সন্দেহের বশে কাউকে দোষ দেয়া উচিৎ নয়।তারপর ও যদি তোর এতই সন্দেহ কাল আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনিস।তোকে যেন না দেখতে পায়।কিন্তু বলে রাখছি আমার বউ এমন নয়।”

আকাশ হাসে বউয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস চূর্ণবিচুর্ন হবে কাল ই।
______

এর পরেরদিন আকাশ আগে গিয়েই আড়ালে গিয়ে তাহুর পিছনে দাঁড়ায়।তাহু আকাশের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকে।কিন্তু আকাশকে সে দেখতে পায়না।

সেই ছেলেটা আবার তাহুর কাছে আসে।আর বলে,
–“কালকে যে আমাকে পরীক্ষায় কলম দিয়ে হেল্প করেছো, ধন্যবাদ দেয়া হয়নি।”

তাহু বলে,
–“ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই।মানুষ হিসেবে মানুষকে সাহায্য করবে এটাই স্বাভাবিক।”

আকাশ মনে মনে বলে,
“তার মানে হাত ধরেনি কলম দিচ্ছিলো যে,সেটা দূর থেকে হাত ধরেছে মতো লেগেছে।”

তাহু এদিকসেদিক আকাশকে খুঁজতে দেখে ছেলেটি বলে–“তোমার দেবর মানে ভাইয়া টা আসেনি?”

তাহু মন খারাপ করে বলে–“ভাইয়া তো এত লেইট করেনা।আজ কি হলো?ভাইয়া ঠিক আছে তো?”
–“আমি পৌছে দিই?”
–“নাহ ধন্যবাদ আমার ভাইয়া আসবে ঠিক ই,আর না আসলে একা ই যাব।”

তাহুর কথায় আকাশের অপরাধবোধ হতে লাগলো।তারপর আড়াল থেকে সরে গিয়ে আবার তাহুর সামনে এসে তাহুকে নিয়ে বাসায় ফিরলো।এতদিন তাহুকে সে তেমন পছন্দ করতো না কিন্তু আজ থেকে কেমন জানি তাহুর প্রতি সম্মান বেড়ে গেছে।

আকাশ সবকথা আদ্রকে শেয়ার করলো।তখন আদ্র হেসে বলে,
–“তুই যদি আমাকে না বলে কথাটা মাকে বলতি তাহকে কি হতো ভেবে দেখেছিস।সন্দেহের বশে কাউকে দোষী ভাবা উচিৎ নয় এবার বুঝেছিস?কাউকে সন্দেহ লাগলে আগে ভুলঠিক বিচার করে অথবা যাচাই করে দোষ দেয়া উচিৎ।”

আকাশ তখন সরি বলে।
আদ্র বলে–“এ কথাগুলা আর যেন কখনো না শুনি।”

_____

আজ সকালে ও তাহুর পরীক্ষা সাথে আকাশের ও চাকরির ইন্টার্ভিউ আছে।তাহু ভোরে উঠে সবার জন্য নাস্তা রেডি করে।সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আকাশকে নিয়ে বের হয়।

দুজনেই একটা রিকশায় উঠে।হঠাৎ রাস্তায় জ্যামে পড়ায় দুজনেই হাটা ধরে।কারণ বসে থাকলে পরীক্ষায় লেইট হয়ে যেতে পারে।

কিছুক্ষণ তারা হেটে আসলে গাড়ি আবারো চলতে শুরু করে।

তাহুর হঠাৎ চোখ গেলো একটা বাচ্চা মেয়ে গাড়ির নিচে পড়তে যাচ্ছে।তাহু হাতের ফাইল ফেলে দৌড়ে বাচ্চাটাকে ধরে কোলে তোলে নিলো।সাথে সাথে যে গাড়িটার নিচে পড়তে যাচ্ছিল সে গাড়িটা থেমে গেলো।

আকাশ দৌড়ে আসলো।তার চোখেমুখে বিরক্তির চাপ স্পষ্ট।তাহু আকাশের ছোট হওয়ায় ভাবি বলেনা।বরং নাম ধরেই ডাকে।
–“তাহু।তোমার আক্কেল কখন হবে?এভাবে কেউ দৌড় দেয়?তাছাড়া এই নোংরা কাপড়চোপড়ের মেয়েটাকে এভাবে কোলে নিলে তোমার কি খারাপ লাগছেনা।ইসস কি গন্ধ মেয়েটার শরীর থেকে।”

আকাশ এসব বকবক করছিল আর তাহু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল–“ভাইয়া একটা মানুষের জীবনের চেয়ে আমার দৌড়ে আসাটা বেশি অসম্মানের?আর এ শিশুটি তো মানুষ ই।মানুষের সন্তান।কপালগুণে হয়ত এরা ফুটফাতে থাকে কিন্তু মানুষ তো।মানুষ হিসেবে তাদের প্রাপ্য সম্মান দেয়া উচিৎ না?”
–“তাই বলে নোংরা হয়ে আছে মেয়েটা,তাও তুমি জড়িয়ে ধরবে?”

তাহু চুপ করে মেয়েটির দিকে তাকায়।আর বলে–“নোংরা নয়।বরং আপনার দেখার চোখ নেই।সুন্দর চোখ দিয়ে উপলব্ধি করুন দেখবেন সব ই সুন্দর।”

আকাশ চুপ হয়ে থাকে।বাচ্চামেয়েটি তাহুর দিকে তাকিয়ে হাসে।তার হাতে কিছু ফুল ছিল।ফুল বিক্রি করতেই রাস্তার এদিক সেদিক দৌড়ে।হয়ত গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে খেয়াল করেনি।

মেয়েটির থেকে তাহু একটা ফুল কিনে।তারপর মেয়েটি চলে যায়।কয়েকজন লোক এসেছিল ঘটনা কি দেখার জন্য।তারপর তারা যে যার মতো চলে যায়।

কিন্তু যায়না গাড়িতে বসে থাকা এক ভদ্রলোক। তিনি তাহুর ব্যবহারে মুগ্ধ।তবে মধ্যবয়স্ক লোকটি গাড়িতেই বসে থাকেন।
তাহুকে পৌছে দিয়ে আকাশ ইন্টার্ভিউ রুমে ডুকে।
.
.
কাকতালীয়ভাবে সেই মধ্যবয়স্ক লোকটি ইন্টার্ভিউ নিবেন।আকাশকে দেখেই তিনি চিনে ফেলেন।আকাশকে যা প্রশ্ন করা হয় সব জবাব ঠিকঠাকভাবে দেয়।আকাশ যে চাকরির জন্য পারফেক্ট কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু তাও মধ্যবয়স্ক লোকটি জিজ্ঞেস করে–“আচ্ছা মি: আকাশ সকালে আপনার সাথে রাস্তায় আরো একজন মেয়ে দেখেছিলাম।উনি কে?”

আকাশ তাহুর কি পরিচয় দিবে ভাবতে থাকে।এমনিতে তাহু যেভাবে কলেজ যায় আকাশের নিজেরি লজ্জা করে।আজকাল মেয়েরা কত মডার্ন।সুন্দর করে চুল বাধবে তারপর সেজেগুজে কলেজ যাবে।আর তাহু কিনা বোরকা পড়ে নেকাব করে আন্টি আন্টি ভাব নিয়েই কলেজ যায়।যা আকাশের একদম পছন্দ না।তারপর ও তার ভাইয়ের এসব পছন্দ কি আর করার?

তারপর আকাশ যা সত্যি তাই বলে–‘আমার ভাবি।’

লোকটি বলে–“বয়সে আপনার ছোট মনে হলো,কিন্তু মানসিকতা আপনার চেয়ে দারুণ।ভালো পোশাক পড়ার চেয়ে ভাল মানসিকতার মানুষ উত্তম বলে আমি মনে করি।পড়ালেখা করার চেয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়া জরুরি বেশি।যা আজকাল তেমন খুঁজে ই পাওয়া যায়না।
আমি মুগ্ধ!
ভেবেছিলাম আপনার ব্যবহারের জন্য আমি চাকরিটা দিব না,কিন্তু আপনার ভাবির ব্যবহার আমি দেখতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছি।আমি আসলেই আজকে খুব হ্যাপি।
আসলে মানুষের উচিৎ এভাবে মানুষ সম্পর্কে ভাবা তাহলে এত ভেদাভেদ থাকত না।আমি আশা করবো আপনার ভাবির মতো মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করবেন।দায়িত্বের ব্যপারে সচেতন থাকবেন।”

আকাশ মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনে আর মুচকি হাসে–“ইনশাল্লাহ”।
_______________
কয়েকদিন ধরে আলোর শরীর ভাল নেই।মাথা ঘুরায় বমি বমি ভাব।আলোর হাসবেন্ড ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে জানতে পারে আলো মা হতে চলেছে।এমন একটা খুশির খবর পেয়ে সবাই খুশি।আদ্রর মা ও খুশি।আজ থেকে আলোকে একটা কাজ ও করতে দিবেনা।আর গার্মেন্টস ও যেতে দিবেনা।আলোর হাসবেন্ড বলেছে সে আবারো ব্যবসা শুরু করবে।
তবে আদ্র মা বলে,
উনার মেয়ে যেহেতু অসুস্থ সব কাজ সামলাবে তাহু।

আদ্রর বাবা অবাক হয়।প্রতিবাদ করতে গিয়ে ও অশান্তি হবে ভেবে থেমে গেলেন।কিন্তু তিনি এর বিহিত করবেন ই যেভাবে হোক।একটা মেয়ে পুরা সংসারের কাজ করবে।আরেকটা একদম পা তুলে বসে খাবে?

দুইটায় মেয়ে অথচ শব্দ দুইটা (‘ছেলের বউ’ ও ‘নিজের মেয়ে’) চেঞ্জ হওয়ায় একজনের প্রতি দয়ামায়া নেই,আরেকজনের প্রতি অগাধ ভালবাসা।হায়রে জীবন!তিনি আফসোস করলেন কিছুক্ষণ।


পরীক্ষা শেষে আকাশ তাহুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে।তার যে চাকরি কনফার্ম এটা সবাইকে জানায়।আদ্রর বাবা মা খুব খুশি।তখন আকাশ পুরাদিনের ঘটনাটা তাদের সাথে শেয়ার করে।

তখন আদ্রর বাবা হাসিমুখেই বলে,
‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে’

তাহুর প্রশংসা শুনে আদ্রর মা রাগিচোখে তাকালে আদ্রর বাবা আবারো বলে,
‘সংসার রসাতলে যায় ও রমনীর গুণে’

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে