প্রাপ্তির শহরে পর্ব-০৩ সিজন ০২

0
1174

#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব-০৩
#তাহরীমা

আদ্র কলেজে গিয়ে তাহুকে ভর্তি করিয়ে দেয়।যদি ও আদ্রর মা এতে নারাজ।আদ্রর মা সাফসাফ বলে দেয়-“এই পড়াশোনার জন্য সংসারের অবহেলা করা চলবে না।”

তাহু তাই মেনে নেয়।জীবন মানে ই যুদ্ধক্ষেত্র।যুদ্ধ করলে জিততে পারবে,নইলে হেরে যাবে।
.
আলো গার্মেন্টেস এ সকালে যায়।সারাদিন ওখানে কাজ করে।বাসায় এসে একদম হাপিয়ে যায়।

আলো কাজ থেকে ফিরে এসেই দেখে,তার হাসবেন্ড বসে বসে বই পড়ছে।নতুন উপন্যাস ধরেছে।বই পড়তে বসলে বাইরের কোনো হুশ থাকেনা।ঘরের কাজে ও নেই বাইরের কাজে ও নেই।

আলোর মাথায় রাগ চেপে বসে–“আমি বাইরে খেটে মরছি আর তুমি বসে বসে খাও!”

আলোর হাসবেন্ড মুচকি হাসে।
–“এর জন্য দায়ী তুমি।তুমি সেদিন যদি না বলতে টাকা আয় করা সহজ।তোমার কাজ ই একমাত্র কঠিন তাহলে আমি ব্যবসা টা ছাড়তাম না।”

আলো চুপ করে থাকে।আলোর হাসবেন্ড আবারো বলে,
–“কথা অনু্যায়ী আমি ঘরের কাজ করতাম।কিন্তু এখানে নতুন ভাবি এসেছে আর শাশুড়ি মা আছেন এখানে আমি এসব কাজ করলে, এদের সাথে মানাবে বলো?থাকছো তাও বাপের বাড়ি।কত বললাম চলো আলাদা বাসা নিই।”

আলো তখন তেড়ে এসে বলল–“ওখানে ও তুমি ঘরের কাজ আমাকে দিয়ে করাতে।কাজ করতে অনেক কষ্ট বুঝলে?”

–“আমি তো বুঝি কিন্তু তুমি বুঝো না যে।ঘরে বাইরে সব কাজ ই কষ্টকর।তাই কারোর কাজকে অসম্মান করা উচিৎ না?”

আলো নিজের ভুল অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলো কিন্তু অই যে মুখের একটা কথা ছুড়ে দিলে সেটা যে গুলির মতো ফিরিয়ে নেয়া যায়না।আলোর বেলায় ও তেমন হয়েছে।

আলোর হাসবেন্ড হাসে।আর মনে মনে ভাবে আর কয়েকদিন বুঝোক আয় করার মর্ম তারপর সে আবারো ব্যবসা শুরু করবে।
_________

রাতে সবাই খাওয়াদাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে যায়।তাহু সব গুছিয়ে আসে।আদ্র আজ জেগে বসে থাকে।তাহু আসতে দেখেই নড়েচড়ে বসে।আদ্র বলে–“তাহু!”

তাহু তাকালে বলে–“তোমার চাচি কল করেছিলো।তোমার সাথে কথা বলতে চায়।কথা বলবে?”
তাহু হেসে বলে-‘হ্যা।”

আদ্র কল ব্যাক করে তাহুকে দেয়।মেজাম্মু বলে,
–“কেমন আছিস রে?”

তাহু সালাম দেয়।
–“ভালো মেজাম্মু।রিয়াদ রিপা কই?তোমাদের খুবি দেখতে মন চাইছে।”
–“ওরা আছেই ঘুমিয়ে গেছে।আসবো তোর শশুড়বাড়িতে একদিন সময় করে।”

তাহু খুব খুশি হয়।তারপর মেজাম্মু কল কেটে দিলে তাহু ফোন এগিয়ে দিতেই দেখে আদ্র হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
তাহু চোখ সরিয়ে বলে–“ফোনটা?”

আদ্রর ধ্যান ভাঙ্গে।
–“তাহু?”
-“বলুন না?”
–“তুমি যেমন তোমার মেজাম্মুকে ভালবাসো সম্মান করো আমার আম্মুকে ও ভালবাসবে সম্মান করবে ঠিক আছে?”
–“ইনশাল্লাহ অবশ্যই।আমি তো আমার নিজের মা কে কখনো কাছে পাইনি,আপনার মা মানে আমার ও মা।”

আদ্র খুব খুশি হয়।আর বলে–“কাছে আসো তো একটু জড়িয়ে ধরি।”

এই একটা বাক্য তাহুকে অসস্থি ফেলতে যতেষ্ট।তাহু চোখ স্থির নেই।খালি এদিকসেদিক তাকাচ্ছে।আদ্র হেসে উঠে তাহুর কান্ড দেখে।

________

আজকে তাহুর কলেজের প্রথম দিন।আদ্র তাহুকে নিয়ে যাবে।সকাল থেকেই তাহু সব কাজ করেছে।কাজ করে একদম হাপিয়ে উঠেছে।এত কাজ করে আবার কলেজে যেতে তার এত কষ্ট লাগছে।তারপর ও পড়ালেখা করা টাও মেয়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।যারা বিবাহিত শুধু তারা ই জানে বিয়ের পর পড়তে কত কষ্ট হয়।সংসারের সব কাজ সামলে তাদেরকে পড়তে হয়।

আদ্র সব বুঝে।ঘরে চাইলে আলো আর তার মা ও তাহুকে একটু হেল্প করতে পারতো কিন্তু তারা ইচ্ছে করে এমন করছে।আদ্র ভাবে বিদেশ চলে গেলে তাহুর কি হবে?মেয়েটা যে সহজ সরল।আদ্র ঠিক করলো একটা কাজ করার লোক ঠিক করবে।

কলেজের প্রথম দিন তাহু বোরকা পড়ে তার উপর এপ্রোন গায়ে দেয়।সবাইকে সালাম করে।কেউ দোয়া না করলেও তাহুর শশুড় মন ভরে দোয়া করে।

তাহুর শাশুড়ি চুপ ছিল কিছুই বলছেনা।তারপর তাহুকে নিয়ে আদ্র বের হয়ে যায়।
___

ভালই ভালই তাহু ক্লাস শেষ করে।আদ্র আবার গিয়ে নিয়ে আসে।কয়েকদিন গেলে নিজে নিজে যাওয়া আসা করতে পারবে।কলেজ টা তাদের বাসা থেকে একদম ই কাছে ই।
.
.
রাতে সবাই খাওয়াদাওয়া শেষ করে চলে যায়।আদ্রকে তার মা বলে ঘরে যেন আসতে তার সাথে কথা আছে।

আদ্র মায়ের পিছন পিছন যায়,
–“শুন তুই বউকে যা খুশি পড়ালেখা করা।কিন্তু আমাকে নাতি অথবা নাত্নি এনে দিবি ব্যাস।”

আদ্র অবাক হয়–“এত তাড়াহুড়া কিসের আম্মু?তাছাড়া তাহুর এখনো অল্প বয়স।অন্তত কলেজ পাশ করুক।১৮ বছর হোক তারপর না হয়..!”

–“তোকে এসব মা হয়েও আমার বলতে হচ্ছে লজ্জা লাগছে।তাও আমার নাতি নাত্নি চাই।”
–“আমরা ভেবে দেখবো।তবে এখন নয় অন্তত ওর সতেরো বছর পার হোক।আমি আমাদের জন্য একটা মেয়ের সাস্থ্যের রিস্ক নিতে পারিনা।”

আদ্রর মা চুপ করে থাকেন।না এই ছেলেকে বুঝানো সম্ভব নয়।

___

তাহু রুমে বসে বইগুলো উলটে পালটে দেখছিলো আদ্র এসে পাশে দাঁড়ায়।

তাহু হেসে বলে–“আপনি খুব ভালো।”
–“তারপর?”
–“আপনি যখন চলে যাবেন আমার খুব কষ্ট লাগবে।আপনাকে খুব মিস করবো।”
–“আচ্ছা তাই?আমি বিদেশে বেশিদিন থাকি না।দুই তিনমাস পর পর চলে আসি।ওখানে আমাদের দোকান আছে এসব দেখতে যায়।আর কিছুই নাহ।”

–“দুই তিন মাস কি কম?”

তাহুর কথা শুনে আদ্র হাসে।
–“তাহলে এখানে থেকে যাই কি বলো?”
–“নাহ আমার জন্য আপনার কাজের ক্ষতি হোক আমি চাইনা।তাছাড়া আম্মু ও অসন্তুষ্ট হবেন।এমনিতে আমার পড়ালেখাতে উনি অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন।”

আদ্র তাহুকে জড়িয়ে ধরে।এমন বউ পাওয়া সত্যি ই ভাগ্যের ব্যপার।
–“তুমি পড়ালেখা করে যখন ডাক্তার হবে।মানুষের সেবা করবে আম্মু সেদিন নিজেই বলবে ‘বউকে পড়িয়ে আমি কোনো ভুল করিনি’।”

তাহু হেসে উঠে।
–“আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।ভালবেসেই আগলে রাখবো বউকে।”

_________

এভাবে চলছে জীবন।তাহুর চাচি এসে তাহুকে দেখে গিয়েছে।মাঝেমাঝে তাহু ও ভাইবোন দের দেখতে যায়।
.
.
কালকে ই আদ্র বিদেশ চলে যাবে।পুরা রুম টা তাহুর একা একা লাগবে।এ কষ্ট কাকে বুঝাবে?

কিছুক্ষণ পর পর চোখ ভিজে আসছে তাহুর।জায়নামাজে বসে আল্লাহকে বলে–“তার স্বামী যেখানেই থাকুক যেন ভাল আর সুস্থ থাকে।আল্লাহ যেন সব বিপদ থেকে রক্ষা করেন।”

________

সকালেই তাহু আদ্রকে সব গুছিয়ে দেয়।আদ্র যাওয়ার আগে তাহুর কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে।আবারো আল্লাহ চাইলে দেখা হবে তাদের।

মা বাবাকে সালাম করে আদ্র বের হয়ে যায়।আকাশ ইয়ারফোর্ট পর্যন্ত যায়।
.
আদ্র যাওয়ার পর কেমন শূন্যতা ভর করে তাহুর।আদ্র তাহুকে একটা ফোন কিনে দিয়ে যায়।যাতে কল করতে পারে।তাহু কাজ শেষে ফোনের দিকে চেয়ে থাকে কখন তার প্রিয় মানুষ টা কল করবে।আর সারাদিনের জমানো গল্পগুলো বলবে।

আদ্র পৌছেঁ তাহুকে কল করে।
–“তাহু!”

তাহুর মন খারাপ করে।আদ্রর জন্য চোখের জল টপটপ করে পড়ে।
–“কি হলো কাঁদছ বুঝি?আমি তো কয়েকদিন পর আবারো আসতেছি।”

তাহু এবার বলে–“খেয়েছেন?”
–“খেয়েছি।তুমি ও খেয়ে নাও।শুনো আম্মু কিছু বললে মনে কষ্ট নিয়ো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”
–“আচ্ছা।এসবে আমি অভ্যস্থ।”
–“ভাল থেকো বউ আমার।”

আদ্র কল কেটে দেয়।আদ্র মা কে ও একটা ফোন কিনে দেয়।যাতে একে অপরের সাথে মানে শাশুড়ি বউয়ের সাথে ঝগড়া না হয়।মাকে কল দিয়ে সে টুকটাক কথা বলে।

এভাবেই তাহুর দিন কাটে।কলেজ, সংসার আর রাত হলে আদ্রর ফোনের অপেক্ষা।দিন ভালই যাচ্ছে মোটামুটি।

_____

আজ সকালে তাহুর জ্বর জ্বর লাগছে।আজকে ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।এদিকে সংসারের সব কাজ সামলে যেতে হবে।
আদ্র যে কাজের লোক ঠিক করেছিলো আদ্রর মা তাকে বিদায় করে দিয়েছে।অথচ আদ্রকে বলেছে কাজের লোক ইচ্ছে করে চলে গেছে।যেটা ও তাহু ও জানেনা।তাই সব কাজ তাহুকেই করতে হয় উপায় নেই।

তাহু খুশি মনে সব কাজ সামলে কলেজে গেলো।


আলো কাজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কারো সাথে কথা বলেনি।লম্বা ঘুম দিয়েছে।আলোর হাসবেন্ড বাসায় থাকলে বই পড়ে।নয়তো বাইরে ঘুরতে যায়।এখন বাসায় নেই তাই ঝগড়া ও হয়নি।

আলোর হাসবেন্ডের বাবা মা কেউ নেই।প্রেম করেই তারা বিয়ে করেছিলো।কয়েকদিন আলো একা একা সংসার করেছিলো কিন্তু বাসায় বিয়ের আগে সে কাজ করত না।কাজের কোনো ধারণায় তার মধ্যে ছিল না।বিয়ের পর যখন একটুয়াধটু কাজ করতে হচ্ছে সে একদম বিরক্ত হয়ে বাপের বাড়ি উঠে বসলো।আদ্র আকাশ এরা ও কিছু বলল না।কারণ বাবা মার অতি আদরের মেয়ে আলো।আর আদ্র আকাশের ও একমাত্র বোন হওয়ায় আদরের ছিলো।
___

কলেজ থেকে ফিরে এসে তাহুর মাথাব্যথা টা আরো বেড়ে গেলো।

তাহু ফ্রেশ হয়ে নিলো।ভীষণ ক্লান্ত লাগছে কিন্তু কলেজে নামাজ পড়ার সুযোগ সে পায়নি।তাই তাড়াতাড়ি ওযু করে নামায আদায় করে নিলো।শুদ্ধতম নিঃশ্বাস নিতে পারার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে শুকরিয়া জানালো।

তারপর উঠে ক্লান্ত লাগায় একটু শুয়ে থাকবে ভাবলো আর শুয়ে পড়লো।

বিকেলের দিকে সবাই চা খাবে। রান্নাঘরে তাহুকে না দেখে শাশুড়ি তাহুর রুমে গেলো।গিয়ে দেখলো তাহু শুয়ে আছে।
.
আদ্রর মা সাথে সাথে আদ্রকে কল দিলো।আদ্র মাকে সালাম দিলো।

কেমন আছো ভাল আছি পর্ব শেষ করে আদ্রর মা বলে–“তোর বউ সকালে বের হয়ে বিকেলে এসেছে কলেজ থেকে।তাও এসে শুয়ে থাকছে।এমন কথা কি ছিলো?সংসারে যে অবহেলা করছে তা কি তুই বুঝছিস?”

আদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে–“হয়ত ওর অসুস্থ লাগছে।তাহু ত এমন মেয়ে নয়?”
–“জানতাম বউয়ের হয়েই কথা বলবি।মা তো আর এখন আপন না।”
–“আপন পরের কথা না আম্মু।আমার যেটা মনে হলো বললাম আরকি।”

আদ্রর মা কল কেটে দিয়ে তাহুর কাছে যায়।মাথাব্যথায় এমনিতে তাহুর ঘুম আসছিলো না।তাও সে চোখ বুজে রইলো।
–“তাহু।কি ব্যপার শুয়ে আছিস যে?”

তাহু শাশুড়ি কে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করে বলে,
–“আম্মু মাথাব্যথা করছে একটু।”
–“একটু মাথাব্যথায় তুই শুয়ে থাকলে কাজগুলো কে করবে?ভুলে যাস না তুই এ বাড়ির বউ।”

এটা বলেই তিনি গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

তাহু আহত হয়ে ছোট করে বলে–“শাশুড়িকে মায়ের মতো ভালবাসলে ও কি মা হয়? মায়ের মত ভাবলেও আদৌ কি শাশুড়ি মা হয়?আমার নিজের মা বেচে থাকলে কখনো এভাবে বলতো?কই আলো আপুকে তো এমন বলেনা।আমি বউ বলে?বউরা কি মানুষ না?”

অতঃপর দীর্ঘশ্বাস..

চলবে………………

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে